যুক্তি ও বুদ্ধির নিগড়ে বাঁধা, কল্পনার সংমিশ্রণে কোনো বিষয় সম্পর্কে লেখকের ‘আত্ম-সচেতন’ সাহিত্য রূপই প্রবন্ধ। গদ্যের অন্যান্য শাখা—গল্প, উপন্যাসের জয়জয়কারের তুলনায় প্রবন্ধের পালে হাওয়া যেন সবসময় স্তিমিত, কিছুটা কম। আর সাধারণত যে সব প্রবন্ধ প্রতি বছর লেখা হয়, প্রকাশিত হয়, তার অধিকাংশ কেঁজো কথায় ভরপুর। প্রবন্ধে কেঁজো কথা থাকবে সেটাই স্বাভাবিক। তবে এগুলো যেন বড্ড বেশি দরকারি। প্রয়োজনের। টীকা-টিপ্পনীতে ভরপুর, চর্বিতচর্বণের স্তূপ। পদে পদে তাই বাধা। অনেক সময় তাতে সাহিত্যের রস থাকে না, পাত্রটুকুই থাকে। তবে মননশীল প্রবন্ধের চর্চা যে হচ্ছে না, তা নয়। যেখানে বুদ্ধির সঙ্গে আছে হৃদয়ের সংযোগও। আছে নতুন দিগন্ত আবিষ্কারের আনন্দ। সে ধরনের প্রবন্ধও লেখা হচ্ছে। অল্প পরিসরে হলেও হচ্ছে।
এ ধরনের প্রবন্ধে তত্ত্ব, যুক্তি, বিশ্লেষণের ভিড়ে শিল্প শূন্য হয়ে যায় না। সাহিত্যের রস অন্তঃসলীলার মতো প্রবাহিত হয় এখানে। পাণ্ডিত্যের সঙ্গে মনপবনের পাল তুলে দিতে এখানে বাধা থাকে না। যারা এ ধরনের প্রবন্ধের চর্চা করে যাচ্ছেন, তাদের একজন মোহাম্মদ নূরুল হক। তিনি একইসঙ্গে কবিও। কবি বলেই হয়তো নতুন ও বিচিত্র বিষয়ে তার বিচরণ। আগ্রহ। শব্দকে বুঝতে পারেন। ধরতে পারেন শব্দের স্পন্দন। ইঙ্গিতের ধোঁয়াশায় পথ হারান না। কবি বা লেখকের প্রচ্ছন্ন করে রাখা সুতো ঠিকই খুঁজে নেন, পৌঁছে যান, কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে, পাঠককেও সঙ্গে নিয়ে যান।
তিনি লিখেছেন, ‘তবে বিস্ময়ের ব্যাপার এই যে, কর্মীরা পারিশ্রমিকেই তুষ্ট; শিল্পী চান সম্মানী-সম্মান-দুটোই। এজন্য শিল্পীকে অপেক্ষা করতে হয়। পরিচয় দিতে হয় পরম ধৈর্যের। কর্মী ও শিল্পীর পার্থক্য এখানেই সুস্পষ্ট।’
মোহাম্মদ নূরুল হকের ‘আহমদ ছফার বাঙালিদর্শন ও অন্যান্য’ (২০২০) প্রবন্ধগ্রন্থ পাঠ করলেই উপর্যুক্ত কথার সত্যতা মিলবে। বইয়ে রয়েয়ে বারোটি প্রবন্ধ। এগুলোর বিষয় প্রবন্ধ, কবি, কবিতার প্রকরণ, গল্প ও ছোটকাগজ। প্রথম প্রবন্ধ ‘আহমদ ছফার বাঙালিদর্শন।’ আহমদ ছফা সাহিত্যের প্রতিটি শাখাতেই কমবেশি বিচরণ করেছেন। তবু প্রাবন্ধিক হিসেবেই তার খ্যাতি। যেকোনো বিষয় নিয়ে দ্রুত, যুক্তিনির্ভর, আবেগী প্রবন্ধ রচনা করতে পারতেন তিনি। তার ভাষা ছিল তীক্ষ্ম, ধারালো, জেদি। বিষয়ের এফোঁড়-ওফোঁড় করে বেরিয়ে যেতেন তিনি।
আহমদ ছফা বাঙালিকে কিভাবে দেখেছেন, বাঙালির চরিত্র, বৈশিষ্ট্য, স্বভাব কিভাবে অবলোকন করেছেন, এই প্রবন্ধে মোহাম্মদ নূরুল হক তা-ই তুলে ধরেছেন। আহমদ ছফার ‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’ ও ‘বাঙালি মুসলমানের মন’ শীর্ষক বই দুটি মোহাম্মদ নূরুল হকের প্রবন্ধের মূলভিত্তি ভূমি। এ বই দুটো ছাড়াও আলোচনার প্রয়োজনে তিনি আহমদ ছফার অন্যান্য প্রবন্ধগ্রন্থের প্রসঙ্গও টেনেছেন।
প্রবন্ধের শুরুতেই আহমদ ছফার প্রাবন্ধিক পরিচয় দিতে গিয়ে আলোচ্য লেখক বলেছেন, ‘আহমদ ছফা সম্পর্কে একবাক্যে বলতে গেলে তাকে এই আপাতত বেদরকারি গদ্যলেখকের দলেই বিবেচনা করতে হয়।’ ছফার ভক্তরা হয়তো তাকে ‘বেদরকারি গদ্যলেখক’ বলেছেন বলে রাগ করতে পারেন্ তবে এক্ষেত্রে রাগ করার কিছু নেই। কারণ প্রাবন্ধিক এই বাক্যের কয়েকবাক্য আগেই ‘বেদরকারি গদ্যলেখকের’ রূপরেখা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘দরকারি প্রবন্ধের রচয়িতারা কর্মী হলে আপাতত বেদরকারি গদ্যের লেখকেরা শব্দ-শ্রমিকের পাশাপাশি শিল্পীও।’ এই বাক্যের পরবর্তী কয়েকটি বাক্য পড়লে আমরা ‘বেদরকারি গদ্যলেখক’ সম্পর্কে আরও একটু পরিষ্কার ধারণা পাবো। তিনি লিখেছেন, ‘তবে বিস্ময়ের ব্যাপার এই যে, কর্মীরা পারিশ্রমিকেই তুষ্ট; শিল্পী চান সম্মানী-সম্মান-দুটোই। এজন্য শিল্পীকে অপেক্ষা করতে হয়। পরিচয় দিতে হয় পরম ধৈর্যের। কর্মী ও শিল্পীর পার্থক্য এখানেই সুস্পষ্ট।’
আহমদ ছফা যে চূড়ান্তভাবে বাঙালি সম্পর্কে হতাশ, বাঙালিকে সুবিধাবাদী, মেরুদণ্ডহীন বলেছেন, তা নয়। তিনি বাঙালি সম্পর্কে ইতিবাচক দৃষ্টিও পোষণ করেন। বাঙালির শক্তির মূল জায়গাটা তিনি আবিষ্কার করেছেন। মোহাম্মদ নূরুল হকের ভাষায়, ‘সবচেয়ে বিস্ময়ের ব্যাপার হলো—আহমদ ছফা মেরুদণ্ডসম্পন্ন বাঙালি বলতে মূলত বুঝেছেন, চাষাভূষাকেই।’
প্রশ্ন হতে পারে, শিল্পীকে কেন অপেক্ষা করতে হয়—পরম ধৈর্যের পরিচয় দিতে হয়? উত্তর এমন হতে পারে—এজন্যই শিল্পীকে ধৈর্যের পরিচয় দিতে হয়, কারণ শিল্পী ভুইফোঁড় কেউ নন। তাকে আগুনে পুড়ে পুড়ে খাঁটি হতে হয়। দেখার চোখ তৈরি করতে হয়। সাধারণ আট-দশ জন যা দেখে না, তাকে সেটা দেখতে হয়। এই অবলোকনশক্তি তাকে অর্জন করে নিতে হয়। শুধু অবলোকনের শক্তি অর্জন করলেই চলে না—তাকে শৈল্পিকভাবে প্রকাশের পদ্ধতিও আয়ত্ত করতে হয়। এজন্যেই এই অপেক্ষা—ধৈর্য।
আহমদ ছফা এভাবে নিজেকে তিলে তিলে মুক্তোয় পরিণত করেছিলেন বলেই, বলতে পেরেছিলেন, ‘বুদ্ধিজীবীরা যা বলতেন, শুনলে বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না। এখন যা বলছেন, শুনলে বাংলাদেশের সমাজ-কাঠামো আমূল পরিবর্তন হবে না।’ এখনো দেশের অধিকাংশ বুদ্ধিজীবী সম্পর্কে এরচেয়ে যুৎসই বাণী আর নেই। ‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’ বইতে আহমদ ছফা বাঙালি বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদদের এক হাত দেখে নিয়েছেন। মোহাম্মদ নূরুল হক লিখেছেন, ‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’ বইয়ে আহমদ ছফা বাঙালিচিন্তকদের সম্পর্কে রূঢ় সব মন্তব্য করেছেন। অবশ্যই এসব মন্তব্যের শক্ত ভিতও রয়েছে।’
মোহাম্মদ নূরুল হক সেই রূঢ় কিন্তু সত্য মন্তব্যগুলোকে বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন। তবে প্রাবন্ধিক ছফাকে শুধু অন্ধভাবে সমর্থনই করেননি, ক্ষেত্র বিশেষে সমালোচনাও করেছেন। আহমদ ছফার পাঠকরা নিশ্চয় জানেন, ছফা কোনো বিষয় নিয়ে তাড়িত হলে, খুব দ্রুতই তিনি তা লিখে ফেলতেন। এজন্যে কখনো কখনো নিজের পছন্দের সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করতো পারতেনে না।
আহমদ ছফা তার ‘শতবর্ষের ফেরারী: বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়’ প্রবন্ধে বঙ্কিমকে যেভাবে বিশ্লেষণ করেছেন, মোহাম্মদ নূরুল হক তার সমালোচনা করে বলেছেন, ‘‘তিনি (আহমদ ছফা) গড়পরতা বাঙালির কাতারে ফেলেই বঙ্কিমকেও বিচার করেছেন। ফলে বঙ্কিমের সামাজিক অবস্থান, মুসলমানদের প্রতি তার বিরূপ মনোভাবের কারণ অনুসন্ধান করেননি ‘বাঙালি মুসলমান মন’ যে মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে, যে দৃষ্টিভঙ্গিতে লিখেছেন, একই মনোভাব নিয়ে বঙ্কিম মূল্যায়নও করেছেন। ফলে বিচারটা হয়ে পড়েছে একপেশে।’’
তবে, আহমদ ছফা যে চূড়ান্তভাবে বাঙালি সম্পর্কে হতাশ, বাঙালিকে সুবিধাবাদী, মেরুদণ্ডহীন বলেছেন, তা নয়। তিনি বাঙালি সম্পর্কে ইতিবাচক দৃষ্টিও পোষণ করেন। বাঙালির শক্তির মূল জায়গাটা তিনি আবিষ্কার করেছেন। মোহাম্মদ নূরুল হকের ভাষায়, ‘সবচেয়ে বিস্ময়ের ব্যাপার হলো—আহমদ ছফা মেরুদণ্ডসম্পন্ন বাঙালি বলতে মূলত বুঝেছেন, চাষাভূষাকেই।’
দুই.
‘আহমদ ছফার বাঙালিদর্শন’ প্রবন্ধের পরের ছয়টি প্রবন্ধ ছয় জন কবির কবিতা নিয়ে। প্রবন্ধগুলোর শিরোনাম: ‘আত্মবিদ্রূপ ও সমর সেনের কবিতা’, ‘মাসুদ খানের কবিতা: আবেগে-প্রজ্ঞায়’, ‘সাযযাদ কাদিরের কবিতা: শিল্পিত উচ্চারণ’, ‘আহমেদ স্বপন মাহমুদের কবিতা: অন্তহীন রহস্যের কথা’, ‘শিহাব শাহরিয়ারের কবিতা: হৃদয়-মননের যুগলগ্রন্থী’ ও ‘জাকির জাফরানের কবিতা: বিষয়ে প্রকরণে’।
মোহাম্মদ নূরুল হক উল্লিখিত কবিদের কবিতা বিশ্লেষণের মাধ্যমে সেই ভালোটাই তুলে ধরতে চেয়েছেন। ডুবুরির মতো সিন্ধু সেঁচে তাদের মুক্তোসম কবিতা তুলে ধরেছেন, যেন পাঠক কবির গোত্র চিনতে ভুল না করেন।
আলোচিত কবিদের নামের তালিকায় দৃষ্টি দিলেই প্রথমে যা নজরে পড়ে, তাহলো, সমর সেন থেকে জাকির জাফরান বাংলা কবিতার ভূমণ্ডলে দীর্ঘ আশি বছরের বিভিন্ন চিহ্নকে তুলে ধরেছেন প্রাবন্ধিক। আরেকটি বিষয়, সমর সেন ও সাযযাদ কাদির ছাড়া সব কবিই জীবিত ও সচল। বাংলা কবিতার ভাঁড়ার তাদের ‘সোনার ধানে’ ভরে তুলছেন প্রতিনিয়ত। তাদের অনেকেই প্রতিশ্রুতিশীল, তবে পাড়ি দিতে হবে অনেকটা পথ, যেতে হবে অনেক দূর। তাদের কবিতার নিয়ে আলোচনা নিঃসন্দেহে ইতিবাচক। উপর্যুক্ত কবিদের কবিতা নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে বিষয়, প্রকরণ, শৈলী নিয়ে ধরে ধরে আলোচনা করেছেন মোহাম্মদ নূরুল হক। দেখিয়েছেন, তাদের স্বাতন্ত্র্য ও শক্তিমত্তা। চিহ্নিত করেছেন কবিতার মূল বৈশিষ্ট্যগুলো। তাদের উজ্জ্বল পঙ্ক্তিমালা উদ্ধৃত করে পাঠকের সঙ্গে কবির নৈকট্য আরেকটু দৃঢ় করেছেন।
আমরা প্রশ্ন তুলতে পারি, একজন সমালোচকের কাজ কী? মোটা দাগে এর উত্তর আসতে পারে—যেকোনো রচনার ভালো-মন্দ চিহ্নিত করা। এখন যদি পুনরায় প্রশ্ন করা হয়, ‘কোনটি বেশি প্রয়োজন? ভালো লেখা নিরূপণ করা, নাকি মন্দ লেখা চিহ্নিত করা? তাহলে বোধহয়, উত্তর হওয়া উচিত, একজন সমালোচকের প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত—ভালো কাজ প্রকাশ করা। লেখার শক্তিশালী দিকগুলো তুলে ধরা। কেননা, দুর্বল কাজ সেটা কালের গতিতে নিজেই নিজেই হারিয়ে যাবে। তাই ভালো কাজের পাশে দাঁড়াতে হবে। তাকে প্রাণিত করতে হবে। জীবনানন্দ দাশের কথাই ধরি, তাকে যদি বুদ্ধদেব বসু এভাবে তুলে না ধরতেন, তাহলে তিনি আরও কতটা হতাশ হয়ে পড়তেন, তা সহজেই অনুমেয়। তাই যিনি ভালো করছেন, তার পাশে দাড়ানো উচিত—যেন যথাযথ আলোর অভাবে তার কাজ ঢাকা পড়ে না যায়। এই দায় সমালোচককেই নিতে হবে। মোহাম্মদ নূরুল হক উল্লিখিত কবিদের কবিতা বিশ্লেষণের মাধ্যমে সেই ভালোটাই তুলে ধরতে চেয়েছেন। ডুবুরির মতো সিন্ধু সেঁচে তাদের মুক্তোসম কবিতা তুলে ধরেছেন, যেন পাঠক কবির গোত্র চিনতে ভুল না করেন।
তিন.
কবিতার পাঠক চিরদিনই কম ছিল। এর পেছনে ছিল নানা কার্য-কারণ। তারপরও রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে পঞ্চপাণ্ডব হয়ে আমরা আরও অনেক কবি পেয়েছি, যাদের কবিতায় পাঠক খুঁজে পেয়েছেন নিজেদের অনুবিশ্ব। যাদের কবিতা পাঠকের কাছে হয়েছে আদরণীয়-গ্রহণীয়। কিন্তু বর্তমানে বিপুল সংখ্যক কবিদের ভিড়ে কেন কবিতা ‘সহৃদয়-হৃদয়সংবেদী’ পাঠকের হৃদয়ে জায়গা করে নিতে পারছে না? এত এত কবিতা কেন শুধু শব্দের জঞ্জাল হয়ে আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হচ্ছে? কবিতা কি আস্তে আস্তে একেবারেই জনবিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে? এ দায় কি শুধু পাঠকের, না কবিদের? লেখক এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজেছেন, ‘বাংলা কবিতার ভবিষ্যৎ, ভবিষ্যতের কবিতা’ প্রবন্ধে।
ছন্দ কেন কবিতায় দরকারি, তা বোঝাতে গিয়ে প্রাবন্ধিক চমৎকার একটি কথা প্রবন্ধের শেষে সেঁটে দিয়েছেন। বলেছেন, ‘শেষপর্যন্ত কবিতা ও অকবিতার পার্থক্য নির্ণয়ের জন্যও ছন্দ জরুরি।’ আসলেই তাই।
পাঠক বর্তমানের কবিতার প্রতি মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার কারণে হিসেবে মোহাম্মদ নূরুল হক বলেছেন, ‘এ সময়ে যারা কবিতা লেখার কসরৎ করতে চেয়েছেন, তাদের সিংহভাগেরই রচনা হয় তীব্র ভাবাবেগের স্ফূরণ মাত্র, নয় কোনো মতবাদ বা ইচ্ছা-অনিচ্ছার ভাষিক রূপ। যা তারা প্রেমিকা বা কোনো নারীর উদ্দেশে কিংবা মনোবিকলনের বিশেষ মুহূর্তে অবচেতন মনে লিখেছেন। কিন্তু মনের স্বাভাবিক অবস্থায় ওই রচনার শিল্পমান নিয়ে কখনো ভাবেননি। প্রয়োজনও মনে করেননি ভাবার। […] আজকের যে তরুণরা কবিতা লিখতে এসেছেন, তাদের অভিরুচিই গড়ে ওঠেনি।’
এই যে সময় বিচ্ছিন্ন, জনবিচ্ছিন্ন, নান্দনিকতাশূন্য অভিরুচিহীন তরুণেরা আপন খেয়াল নিয়েই পড়ে রয়েছে তার কিছু কারণ বর্তমানে কবিতা প্রকাশের সহজলভ্যতা, নানা উপায়ে পুরস্কার প্রাপ্তি, গোষ্ঠীবন্ধ হয়ে নর্সিসিজমের চর্চা—এ সবই। তাই ভবিষ্যতের কবিতা এমন অন্ধকারেই নিমজ্জিত থাকবে, না সমহিমায় অতীতের ঔজ্জ্বল্য ফিরে পাবে, তা নির্ভর করছে, ‘বর্তমানের সৎ-পরিশ্রমী কবিদের নিষ্ঠা-প্রস্তুতির ওপর।’ বলা যায়, প্রাবন্ধিক এই প্রবন্ধে কবিতার বর্তমান ও ভবিষ্যতের সংকট-সম্ভাবনার বিষয়গুলো ঠিক ঠিকই আবিষ্কার করেছেন।
‘কেন ছন্দ অনিবার্য’ প্রবন্ধ লেখা হয়েছে কবিতার অনুষঙ্গ হিসেবে ছন্দের গুরুত্ব নিয়ে। অনেকেই মনে করেন কবিতায় ছন্দের প্রয়োজনীয়তা নেই। ‘ছন্দ মানেই কবিতা নয়’—এ বাক্যটি স্বীকার করে যারা ছন্দকে অস্বীকার করেন, তাদের মনস্তাত্ত্বিক কারণগুলো উদ্ঘাটন করেছেন লেখক। দেখিয়েছেন, ছন্দ কিভাবে কবিতাকে আরও মনোগ্রাহী করে তোলে। আবার, অনেকেই মনে করেন, ছন্দ মানে অন্ত্যমিল। এটি একটি চরম ভ্রান্ত ধারণা। আলঙ্কারিকদের সংজ্ঞা, বিভিন্ন কবির কবিতার উদ্ধৃতি দিয়ে বিষয়টি পরিষ্কার করেছেন লেখক। বলেছেন, অন্ত্যমিলের সঙ্গে ছন্দের কোনো সম্পর্কই নেই। এটা আলাদা অলঙ্কার মাত্র।
ছন্দ কেন কবিতায় দরকারি, তা বোঝাতে গিয়ে প্রাবন্ধিক চমৎকার একটি কথা প্রবন্ধের শেষে সেঁটে দিয়েছেন। বলেছেন, ‘শেষপর্যন্ত কবিতা ও অকবিতার পার্থক্য নির্ণয়ের জন্যও ছন্দ জরুরি।’ আসলেই তাই।
চার.
জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত ও ইমদাদুল হক মিলনের ছোটগল্প নিয়ে দুটি প্রবন্ধ আছে এ বইয়ে। বিভিন্ন গল্প আলোচনা করে, বিশ্লেষণ করে তাদের স্বরূপ চিহ্নিত করেছেন। ১৯৬০ সালের পর যখন বাংলা সাহিত্য এক নতুন দিকে মোড় নিচ্ছিল, তখন সাহিত্যমঞ্চে এক দল তরুণ তুর্কির আবির্ভাব ঘটে—জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত তাদেরই একজন। বাংলা সাহিত্যে তিনি দীর্ঘপথ নির্মাণ করেছেন। এই লেখকের গল্প সম্পর্কে মোহাম্মদ নূরুল হক লিখেছেন, ‘তার ভাষা, পটভূমি, সৃজনীকৌশল, চরিত্রসৃষ্টি, কাহিনির প্রবাহমানতায় তিনি অনন্য।’ (জ্যোতিপ্রকাশ দত্তের কয়েকটি গল্প: সামাজিক বাস্তবতা)।
অনেকেই যেখানে ছোটকাগজ বলতে সাত খুন মাপের কথা বলেন, পত্রিকার সাহিত্যপাতাকে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দেন, প্রাবন্ধিক তাদের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করেছেন। বলেছেন, সব ছোটকাগজই সাহিত্য বিকাশের ক্ষেত্রে, নতুন লেখক গড়ার ক্ষেত্রে সমানভাবে গুরুত্ব রাখে না। কিছু ছোটকাগজ আছে হীনস্বার্থ রক্ষার জন্যই তাদের জন্ম। কিছু কিছু পত্রিকার সাহিত্যপাতা অনেক ছোটকাগজের চেয়ে বড় ভূমিকা পালন করেছে। প্রবন্ধের শেষে তিনি বেশ কিছু ছোট কাগজের তালিকা দিয়েছেন, যা কালের দলিল হয়ে থাকবে।
ইমদাদুল হক মিলন বাংলাদেশের খুবই জনপ্রিয় একজন কথা সাহিত্যিক। জনপ্রিয়—এজন্য তিনি হালকা, বিদগ্ধ সমাজে অচ্ছুৎ। সিরিয়াস নয়। মোহাম্মদ নূরুল হক বলেছেন, ‘ওই অভিযোগ তার (ইমদাদুল হক মিলন) ছোটগল্পের ক্ষেত্রে খাটে না। তিনি যখন ছোটগল্প লিখেছেন, লিখতে চেয়েছেন, তখন স্বপ্ন, বাস্তবতা, শিল্পরস—এই তিনের সমন্বয়ের চেষ্টা করেছেন।’
মিলনের গল্পের শ্রেণিবিভাগ করে, বিস্তৃত আলোচনা করে তার যুক্তির যথার্থতা দেখিয়েছেন প্রাবন্ধিক। এরপর এই সিদ্ধান্ত নিয়ে সমাপ্তি টেনেছেন—‘‘মিলনের গল্পে স্বপ্ন ও যাপিত জীবন অনেক সময়-ই হাত ধরাধরি করে চলে না। কিন্তু যাপিত জীবনে পরিবর্তন আনার স্বপ্ন দেখানোও অনেক বড় কাজ। যা একজন কথাশিল্পীর কলমকে রূপকথার ‘সোনার কাঠি, রূপার কাঠির’ মতোই বিস্ময়কর করে তোলে। ইমদাদুল হক মিলনের ছোটগল্পে কলমকে সেই রূপকথার ‘ সোনার কাঠি, রূপার কাঠি’ বললে অত্যুক্তি হয় না।’’
‘বাংলাদেশের ছোটকাগজ: দায় ও অর্জন’ বইয়ের শেষ প্রবন্ধ। আমরা সবাই জানি, ছোট কাগজ একজন নতুন লেখক তৈরি হবার আঁতুড়ঘর। বাংলা সাহিত্যে ও বাংলাদেশে সাহিত্য বিকাশে ছোট কাগজ কিভাবে ভূমিকা রেখেছে, সেটিই প্রাবন্ধিক আলোচনা করে দেখিয়েছেন। তবে অনেকেই যেখানে ছোটকাগজ বলতে সাত খুন মাপের কথা বলেন, পত্রিকার সাহিত্যপাতাকে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দেন, প্রাবন্ধিক তাদের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করেছেন। বলেছেন, সব ছোটকাগজই সাহিত্য বিকাশের ক্ষেত্রে, নতুন লেখক গড়ার ক্ষেত্রে সমানভাবে গুরুত্ব রাখে না। কিছু ছোটকাগজ আছে হীনস্বার্থ রক্ষার জন্যই তাদের জন্ম। কিছু কিছু পত্রিকার সাহিত্যপাতা অনেক ছোটকাগজের চেয়ে বড় ভূমিকা পালন করেছে। প্রবন্ধের শেষে তিনি বেশ কিছু ছোট কাগজের তালিকা দিয়েছেন, যা কালের দলিল হয়ে থাকবে।
মোহাম্মদ নূরুল হকের গদ্যভাষা বেশ ঝরঝরে। অনেক কঠিক বিষয়কেও তিনি সহজভাবে, আকর্ষণীয়ভাবে উপস্থাপন করতে পারেন। তবে দুয়েকটি শব্দের প্রতি তার পক্ষপাত দেখা যায়। যেমন একটি শব্দ ‘প্রপঞ্চ’। ঘুরেফিরেই তিনি শব্দটি নানা অর্থে ব্যবহার করেছেন। এসব দোষ-গুণ উজিয়েও বলা যায়, ‘আহমদ ছফার বাঙালিদর্শন ও অন্যান্য’ বই সাহিত্যপ্রেমী, সাহিত্যের ছাত্রছাত্রীদের কাছে আদরণীয় হওয়ার গুণাবলি ধারণ করেছে।
আহমদ ছফার বাঙালিদর্শন ও অন্যান্য
লেখক: মোহাম্মদ নূরুল হক
প্রচ্ছদ: শতাব্দী জাহিদ
প্রকাশক: বাংলানামা
প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি-২০২০
মূল্য: ২০০টাকা