[পর্ব: সাত]
মাথার ভিতরে
স্বপ্ন নয়—প্রেম নয়—কোনো এক বোধ কাজ করে ।
আমি সব দেবতারে ছেড়ে
আমার প্রাণের কাছে চ’লে আসি ,
বলি আমি এই হৃদয়েরে:
সে কেন জলের মতো ঘুরে ঘুরে একা কথা কয় !
[জীবনানন্দ দাশ]
‘‘আমি নিরাপদে দিল্লিতে পৌঁছলাম। এখন মহীপালপুর ‘সপ্তগিরি’ হোটেলে আছি।’’ ম্যাসেঞ্জারে এইটুকু লিখে মৌমিতা ও পীযূষ দু’জনকেই জানিয়ে রাখলাম। ক্লান্তিজনিত কারণে তখন চোখজুড়ে রাজ্যের ঘুম নেমে এলো। দুপুর সোয়া ১টায় আচমকা ঘুম ভাঙে। তাও ইন্টারকমে কামরুল ভাইয়ের ফোনে। হুড়মুড় করে উঠে পড়লাম। প্রস্তুত হয়ে দড়িদড়া ছিঁড়ে নিচে নামলাম। ‘সপ্তগিরি’র ডাইনিং রুমে বসে আছেন কামরুল ভাই এবং সেঁজুতি। তাদের পাশেই বসেছেন নেপাল থেকে আসা কবি ও লেখক গোবিন্দ গিরি প্রেরণা। পরিচিত হলাম। তিনি বেশ দিলখোলা ও বিনয়ী। জন্মসূত্রে নেপালি হলেও বছরের বেশি সময় চাকরির কারণে থাকেন আমেরিকায়। হলে কী হবে, শিল্পের টানে, কবিতার প্রেমে তিনি সদা সমর্পিত থাকেন। পকেট থেকে ওয়ালেট বের করে আমাদের প্রত্যেকের হাতে ভিজিটিং কার্ড দিলেন। একটা ছোট্ট নোটবুক আমাদের দিকে এগিয়ে দিয়ে সেখানে আমাদের নাম ও ইমেইল আইডি, ফেইসবুক আইডির লিংক চাইলেন। আমরাও সোৎসাহে লিখে দিলাম। কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ এবং ভ্রমণ বিষয়ক বই মিলে তার সর্বমোট গ্রন্থসংখ্যা ২৪টি। তিনি ‘America Nepal Literature Academy’-এর প্রেসিডেন্ট।
হোটেল ‘সপ্তগিরি’র কাচঘেরা ঘরে বাসমতি চাল, ঝালঝাল চিকেন, ডাল, সবজি, সালাদ ইত্যাদি আয়োজন। এছাড়া রুটিও আছে। যার যা পছন্দ খেতে পারেন। আমি বরাবরই ভেতোবাঙাল। ভাত ছাড়া আমার চলেই না। বাসমতি চালের বড় বড় ভাত। দেখতে কিছুটা রান্নাকরা নুডূলসের মতো। আমার মা বলেন, ‘পেটে ক্ষুধা থাকলে ঘাস রান্না করে পাতে দিলেও নাকি পোলাওয়ের চেয়ে দ্বিগুণ মজা লাগে।’ আমার পেটেও বাঘের মতো ক্ষুধা। পেন্টের বেল্ট ঢিলে করতে হলো না। এমনিতে ঢিলে হয়ে আছে।
সবার চোখে কৌতূহল এবং কপালে বিস্ময়রেখা। কেউ মোবাইল ফোনের ক্যামেরায় ধারণ করছেন নানামাত্রিক ছবি। কারো হাতে বেশি রেজুলেশনের অত্যাধুনিক ক্যামেরা
স্নান, বিশ্রাম ও দুপুরের আহার সেরে বেশ সতেজ লাগছে। এবার ঘুরে বেড়াবো রাত অবধি। সাহিত্য সম্মেলন শুরু ১৮ তারিখ। মানে আগামীকাল সকাল আটটায়। এই সুযোগটি আমরা কাজে লাগাতে চাই। কামরুল ভাইয়ের স্নেহছায়া ও নির্দেশনায় বের হলাম। গাড়ি ভাড়া করার ব্যাপারে হোটেলের ম্যানেজার সহযোগিতা করলেন। শুরুতেই ‘দিল্লির কুতুব মিনার’ দেখবো বলে মনস্থির করলাম। গাড়িতে বসে আছি। মিউজিক প্লেয়ারে মৃদু আওয়াজে বাজছে হিন্দি গান। ক্রমশ দিল্লি শহরের প্রকৃত রূপ দৃশ্যমান হচ্ছে। একসময় দিল্লির পরিবেশ এবং প্রকৃতির প্রতি অবহেলার যে অভিযোগ উঠেছিল। এখন চারিদিকের সবুজায়ন এবং সমান উচ্চতার দালান দেখে আশা জাগে। দিল্লির মন্ত্রী কিংবা জনগণের সচেতন মনোভাবের তারিফ করতে হয়। সকাল বেলায় এয়ারপোর্ট থেকে মহীপালপুর যাওয়ার পর যা দেখেছি। তা মূলত দিল্লির প্রান্তীয় একটি এলাকার চিত্র। ফলে খুবই সাদামাটা মহীপালপুর দেখে নয়া দিল্লিকে মূল্যায়ন করা ঠিক হবে না।
চলতি গাড়িতে বসে ডানে-বামে, সামনে-পিছনে দেখতে দেখতে আমরা কুতুবমিনারের গেটে পৌঁছে যাই। ড্রাইভারকে নির্দিষ্ট জায়গায় অপেক্ষায় থাকতে বলি। কামরুল ভাই টিকিট কিনতে গেলেন। এখানে টিকিট দেয়োর ক্ষেত্রে রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন নিয়ম। যারা ভারতীয় নাগরিক তারা সর্বনিম্ন ৪০ রুপি দামে টিকেট পেয়ে থাকেন। এছাড়া সাউথ এশিয়ান পর্যটকদের জন্য টিকেটের দাম ভারতীয়দের চেয়ে কিছুটা বেশি। তবে এর বাইরে পৃথিবীর অন্য যেকোনো দেশ থেকে আগত পর্যটকদের জন্য ভারতীয়দের চেয়ে কমপক্ষে ১০গুণ বেশি মূল্যে টিকিট কিনতে হয়। এটা আমার কাছে অতিমাত্রায় বৈষম্য মনে হয়েছে। কামরুল ভাই হিন্দিতে কথা বলায় স্বতঃস্ফূর্ত। তিনি টিকিট কাউন্টারে গিয়ে ৪০ রুপি দামে তিনটি টিকেট নিলেন। আমরা অনতিদূরে দাঁড়িয়ে দেখছি। তার চোখেমুখে রাজ্যজয়ের হাসি।
এবার বহুকাঙ্ক্ষিত কুতুবমিনার দর্শনে এগিয়ে গেলাম। মূল গেট পেরিয়ে পা ফেলতেই আমি কিছুটা আনমনা হয়ে পড়ি। স্কুল-কলেজের ইতিহাস বইয়ে শৈশব-কৈশোরে যে ঐতিহাসিক স্থাপনার কথা পড়েছি। সেটা এখন চোখের সামনে। ওই তো দেখা যাচ্ছে আকাশস্পর্শী কুতুবমিনার। কেবল কুতুবমিনারের কথাই বা বলছি কেন। মিনার-চত্বরের নিকটবর্তী দুরত্বে ছড়িয়েছিটিয়ে আছে বেশকিছু ঐতিহাসিক চরিত্রের গল্পকথা। এই তবে পাথর নির্মিত বিশ্বের সর্বোচ্চ মিনার!
মধ্যদুপুরের সূর্য কেবল হেলে পড়েছে পশ্চিমে। রৌদ্রোকরোজ্জ্বল মধ্যাহ্নের সূর্যতাপ ক্রমশ স্তিমিত হতে শুরু করেছে। আমাদের সেদিকে খেয়াল নেই। দেখছি মানুষের ঢল। যারা পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে ছুটে এসেছে। সবার চোখে কৌতূহল এবং কপালে বিস্ময়রেখা। কেউ মোবাইল ফোনের ক্যামেরায় ধারণ করছেন নানামাত্রিক ছবি। কারো হাতে বেশি রেজুলেশনের অত্যাধুনিক ক্যামেরা। ধারণ করছেন অপূর্ব সুন্দর দৃশ্যের ভিডিও। কামরুল ভাই যথারীতি নোটবুক হাতে টুকে নিচ্ছেন বিভিন্ন বৃত্তান্ত। এভাবে তিনি দলছুট হয়ে হারিয়ে গেলেন। বলাযায়, আমরা নিজেরাই হারিয়ে গেলাম। ওই সময় আমরা যেন পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছি। কুতুবমিনার আমাদের তিন জনকেই বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে।
পরে অবশ্য আবার সংস্কার করা হয়। স্থাপত্যশৈলীর অনন্য নিদর্শন স্বরূপ ইউনেস্কো এই স্থাপনাকে বিশ্বের ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে ঘোষণা করেছে।
আমিও প্রায় হারিয়ে গিয়েছিলাম। তবে ছবি তোলার প্রয়োজনে সেঁজুতিকে খুঁজে বের করি। এই ভ্রমণে সেঁজুতির প্রতি বিশেষ কৃতজ্ঞতা আমার জানাতেই হয়। কারণ আমার ফোনের ছবি ততোটা ভালো হয় না বলে সেঁজুতিকে অনেক বিরক্ত করেছি বৈকি। কুতুবমিনার চত্বর বেশ পরিচ্ছন্ন। সবুজ ঘাসের গালিচা এবং পাতাবাহারের সারি। এখানে ওখানে মাঝারি আকারের গাছও আছে। সবুজ ঘাসের ওপর খেলা করছে কাঠবিড়ালি। এগুলো বেশ আদুরে এবং লাজুক। সেঁজুতি বড়ুয়া কিছুক্ষণ কাঠবিড়ালির পেছন পেছন হেঁটেছে। তার চোখেমুখে কাঠবিড়ালিকে হাতে ছুঁয়ে দেখার প্রবল আকুতি। এই দৃশ্য দেখে শৈশবে পড়া কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতাটি মনে পড়ে গেল:
কাঠবিড়ালি! কাঠবিড়ালি! পেয়ারা তুমি খাও?
গুড়-মুড়ি খাও? দুধ-ভাত খাও? বাতাবি-নেবু? লাউ?
বিড়াল-বাচ্চা? কুকুর-ছানা? তাও—
ডাইনি তুমি হোঁৎকা পেটুক,
খাও একা পাও যেথায় যেটুক!
বাতাবি-নেবু সকলগুলো
একলা খেলে ডুবিয়ে নুলো!
তবে যে ভারি ল্যাজ উঁচিয়ে পুটুস পাটুস চাও?
ছোঁচা তুমি! তোমার সঙ্গে আড়ি আমার! যাও!
কাঠবিড়ালি! বাঁদরীমুখী! মারবো ছুঁড়ে কিল?
দেখবি তবে? রাঙাদাকে ডাকবো? দেবে ঢিল!
পেয়ারা দেবে? যা তুই ওঁচা!
তাই তোর নাকটি বোঁচা!হুতমো-চোখী! গাপুস গুপুস
একলাই খাও হাপুস হুপুস!
পেটে তোমার পিলে হবে! কুড়ি-কুষ্টি মুখে!
হেই ভগবান! একটা পোকা যাস পেটে ওর ঢুকে!
ইস! খেয়ো না মস্তপানা ঐ সে পাকাটাও!
আমিও খুবই পেয়ারা খাই যে! একটি আমায় দাও!
কাঠবিড়ালি! তুমি আমার ছোড়দি’ হবে? বৌদি হবে? হুঁ!
রাঙা দিদি? তবে একটা পেয়ারা দাও না! উঃ!
এ রাম! তুমি ন্যাংটা পুঁটো?
ফ্রকটা নেবে? জামা দুটো?
আর খেয়ো না পেয়ারা তবে,
বাতাবি-নেবুও ছাড়তে হবে!
দাঁত দেখিয়ে দিচ্ছ ছুট? অ’মা দেখে যাও!
কাঠবেড়ালি! তুমি মর! তুমি কচু খাও!!’
[খুকি ও কাঠবিড়ালি]
কামরুল ভাই নোটবুক হাতে নিখোঁজ। আমি আর সেঁজুতি ঘুরে ঘুরে চত্বরের বিভিন্ন স্থাপনা দেখি। আমার কাছে নোটবুক নেই। ফলে বিভিন্ন স্থাপনার তথ্য সংবলিত নামফলকের ছবি তুলে রাখি। কুতুবমিনার চত্বরের দক্ষিণাংশে টিকিট কেটে ঢুকতেই বড় একটি গেট চোখে পড়ে। এ গেটের নাম ‘আলাই দরজা’। সুলতান আলাউদ্দিন খিলজি ১৩১১ সালে এটি নির্মাণ করেন। লাল বেলেপাথরে নির্মিত বর্গাকৃতির এই স্থাপনার ওপরে আছে একটি গম্বুজ। আছে অসমাপ্ত ‘আলাই মিনার’।
প্রাপ্ত তথ্যমতে, কুতুবমিনার দিল্লি শহরের দক্ষিণাঞ্চলে ‘মেহরুলি’ নামক স্থানে অবস্থিত। এটি লাল বেলেপাথরে নিৰ্মিত। উচ্চতা ৭২.৫ মিটার (২৩৮ ফুট)। মিনারটির পাদদেশের ব্যাস ৪৭ ফুট এবং শীৰ্ষ অংশের ব্যাস ৯ ফুট। ১১৯২ সালে কুতুবউদ্দিন আইবেক এই মিনারের নিৰ্মাণ কাজ আরম্ভ করলেও ইলতুৎমিশের রাজত্বকালে (১২১১-৩৮) মিনারের কাজ শেষ হয়। এছাড়া আলাউদ্দিন খিলজীর রাজত্বকালে (১২৯৬-১৩১৬) এটার প্রাঙ্গণ এবং নিৰ্মাণকাৰ্য সম্পাদন হয়। একসময় বজ্ৰপাতে মিনার ক্ষতিগ্ৰস্ত হয়। পরে অবশ্য আবার সংস্কার করা হয়। স্থাপত্যশৈলীর অনন্য নিদর্শন স্বরূপ ইউনেস্কো এই স্থাপনাকে বিশ্বের ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে ঘোষণা করেছে।
চলবে..
কবিতার পথে পথে-৬॥ ফারুক সুমন