[পর্ব-৩]
‘আমরা শূন্য থেকে ঘুরতে ঘুরতে এসেছি, যেমনটা তারারা আকাশে ছড়িয়ে থাকে। তারারা মিলে একটি বৃত্তের সৃষ্টি করে এবং তার মাঝে আমরা নাচতে থাকি।’(কবি জালাল উদ্দিন রুমি)
রাত নয়টা ত্রিশ মিনিটে বিমান ছেড়েছে। বিমান ছাড়ার আগমুহূর্তে সাউন্ডবক্সে হিন্দি ভাষায় বিভিন্ন বিধিনিষেধ এবং নির্দেশনা বাজতে লাগলো। একজন বিমানবালা ইশারায় যাত্রীদের সেসব বুঝিয়ে দিচ্ছেন। এই জীবনে এয়ার হোস্টেস বা বিমানবালাদের নিয়ে অনেক গল্প শুনেছি। লোকমুখে কিংবা গল্প-উপন্যাসের পাতায় পাতায়। তাদের নিয়ে সে কী অপরূপ রূপের বর্ণনা। উপমার পর উপমার খোপ বসিয়ে বিমানবালাদের আকর্ষণীয় করে তোলা হয়েছে। আমি আজই প্রথম বাস্তবে তাদের প্রত্যক্ষ করছি। অবয়বে তারা সুন্দর, সন্দেহ নেই। কিন্তু আমার কাছে বাহ্যিক সুন্দরের চেয়ে তাদের আন্তরিক অভিব্যক্তিই বেশি আকর্ষণীয় মনে হয়েছে। তারা যাত্রীদের চোখে চোখ রেখে কথা বলেন। তাদের চোখের দৃষ্টিতে থাকে যত্নের আভাস। ফলে মানসিকভাবে মুহূর্তেই তারা যাত্রীদের নিকটজন হয়ে ওঠেন। তারা এতই প্রফেশনাল যে, নিজের মনে শত দুঃখকষ্ট থাকলেও গোপন করে রাখেন। যাত্রীদের সামনে সুখী মুখ নিয়ে দাঁড়াতে হয়।
আমাদের বিমানটি কিছুক্ষণ হামাগুড়ি দিয়ে যাত্রী নিয়ে শূন্যে ভেসেছে। প্রথম উড্ডয়ন বলে এটা আমার কাছে অন্যরকম একটা ব্যাপার। ওই মুহূর্তে মনে এলো অনেক কিছু। সৃষ্টিকর্তা। মানুষের আবিষ্কার। জন্ম-মৃত্যু। আলো-অন্ধকার। এরকম দার্শনিক প্রশ্ন আমার ভাবনাবলয়ে পাখাঝাপ্টাতে লাগলো। সামান্য উঁচু থেকে পাখির চোখে দেখছি রাতের ঢাকা। শহরজুড়ে জ্বলে থাকা কোটি কোটি বাতি জোনাকির মতোই মিটমিট করে জ্বলছে কেবল। বিমান যত ঊর্ধাকাশে উঠছে ততই ঢাকার বাতিগুলো ক্রমশ নির্বাপিত হয়ে গেলো।
কবিতার পথে পথে-১॥ ফারুক সুমন
মিনিট দশেক পরেই ট্রলিতে করে নাস্তা এলো। জুস, কাজুবাদাম, পায়েস ও পানি। নাস্তা শেষ হতে না হতেই বিমান অবতরণের ঘোষণা এলো। আমাদের বিমান ‘নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু বিমানবন্দর’-এ অবতরণ করছে। এই বন্দরের পূর্ব নাম ‘দমদম এয়ারপোর্ট’। আমরা এখন ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের বিখ্যাত শহর কলকাতায়। জনসংখ্যার বিবেচনায় বৃহত্তর কলকাতা ভারতের ৩য় সর্বাধিক জনবহুল মহানগর। দৃষ্টিনন্দন পরিচ্ছন্ন বিমানবন্দর দেখে আমরা তিনজন মুগ্ধ হয়ে ইতিউতি তাকাচ্ছিলাম। ঢাকা-কলকাতা সময়ের ব্যবধান মাত্র আধাঘণ্টা। বাংলাদেশ সময় রাত ১০টায় আমরা নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু বিমানবন্দরে হাঁটছি। একেই বলে পাখির জীবন। পাখায় ভর দিয়ে মুহূর্তে উড়ে যায় হাওয়ায়। ঢাকা শাহজালাল বিমানবন্দরের ‘স্কাই লাউঞ্জে’ বাদাম খেয়েছি। দাঁতের ফাঁকে আটকে থাকা বাদাম এখনো আছে। অথচ আমরা এখন কলকাতায়। ভোর পৌনে পাঁচটা পর্যন্ত থাকতে হবে। কারণ এখানে ট্রানজিট। এয়ার ইন্ডিয়ার দিল্লিগামী বিমানটি এখান থেকে ছেড়ে যাবে।
আমার কাছে ইন্ডিয়ান সিম আছে। এখানে আসার আগে শ্বশুর দিয়েছেন। দীর্ঘদিন ব্যবহার না করায় সিমটির মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়েছে। সিমে টাকা তুলতে হবে। অনেকক্ষণ ধরে চেষ্টা করেও কোথাও রিচার্জের দোকান পেলাম না। সিকিউরিটিকে জিজ্ঞেস করলাম। বললেন বিমানবন্দরে বাইরে মেইনগেটের সাথে থাকতে পারে। শুনে সেঁজুতিও যেতে চাইলো। সে একটা ইন্ডিয়ান সিম কিনতে চায়। কামরুল ভাই বললেন, ‘ঠিক আছে তোমরা যাও। আমি এখানে থেকে ব্যাগ পাহারা দিই।’ দ্বিগুণ আনন্দ নিয়ে গেইট পেরিয়ে বাইরে এসেছি। কিন্তু এখানেও সিম কেনা কিংবা রিচার্জ করার মতো কোনো দোকান পেলাম না। ব্যর্থ হয়ে ফিরতে হচ্ছে। কিন্তু এবার আমরা বড় ধরনের সমস্যায় পড়ে যাই। সিকিউরিটি এখন আমাদের কিছুতেই ঢুকতে দিচ্ছে না। সম্ভাব্য সবকটি গেইটে বিস্তারিত বুঝিয়ে বললাম। কিছুতেই তাদের মন গলে না। বলেছি ভেতরে আমাদের লোক আছে। আমাদের লাগেজ, ট্রাভেল ব্যাগ সব রাখা আছে। কিন্তু তারা কিছুতেই গুরুত্ব দিচ্ছেন না। এভাবে প্রায় ঘণ্টা দেড়েক গেইটে গেইটে দৌড়ালাম। আমি হতাশ হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। যৎপরনাস্তি দিশেহারা লাগছে। আমরা যতই জোর দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করি। সিকিউরিটি যেন ততোধিক নির্লিপ্তির সঙ্গে আমাদের সংক্ষিপ্ত উত্তর দেন-‘এভাবে প্রবেশের অনুমতি নেই।’ আমরা কি তবে যেতে পারবো না? এর কোনো সমাধান নেই? কার সঙ্গে কথা বলবো বলুন? নাহ, আমাদের এসব জিজ্ঞাসার দিকে তাদের মোটেও গুরুত্ব নেই।
হায়রে কপাল। এ তো দেখি মহাযন্ত্রণা। তবে কি কলকাতায় থেকে যেতে হবে! সার্ক সাহিত্য সম্মেলনে যোগ দিতে পারবো না! দিল্লি যাওয়ার স্বপ্ন এখানেই ধূলিসাৎ হয়ে যাবে! সেঁজুতি একজন সিকিউরিটির কাছে গিয়ে মিনিট পাঁচেক কী কী বিষয়ে যেন কথা বললো। মনে হলো তার মন গলেছে। কিভাবে গলেছে? জানি না। হয়তো সেঁজুতির কথায় দয়া হয়েছে। আমরা একটি রেজিস্টার খাতায় স্বাক্ষর করে প্রথম গেইট পার হলাম। পরের গেইটে গিয়ে আবার বাধা। এখানে একজন অফিসার দায়িত্বে আছেন। তাকে এতক্ষণ যা যা হয়েছে বিস্তারিত বুঝিয়ে বললাম। তিনি মেঘেঢাকা গম্ভীর মুখে উত্তর দিলেন। ‘আপনাদের যেতে হলে ‘ইন্ডিয়া এয়ারলাইন্স’-এর কারও সুপারিশ লাগবে। একজন এখানে থাকেন। একজন গিয়ে এয়ারলাইন্সের কাউকে নিয়ে আসেন।’ সেঁজুতিকে এখানে রেখে আমি ‘ইন্ডিয়া এয়ারলাইন্স’-এর ট্রানজিট লাউঞ্জে গেলাম। সেখানে কাউকে পেলাম না। খোঁজ নিয়ে জানলাম তারা ৩টায় আসবেন।
আবারও অপেক্ষা। দাঁড়িয়ে আছি। এমন সময় ইন্ডিয়া এয়ারলাইন্সের একজন বিমানবালাকে হেঁটে যেতে দেখলাম। কিছুটা মুখচেনা। ঢাকা থেকে কলকাতা আসার সময় তিনি আমাদের বিমানে ছিলেন। সুন্দরী বিমানবালার দিকে অন্য অনেকের মতো তখন আমিও ঘনঘন তাকিয়েছিলাম। তিনিও আমার সেই আগ্রহ উপচেপড়া দৃষ্টির কথা ভুলে যাননি বোধ হয়। দৌড়ে গিয়ে বিস্তারিত সমস্যার কথা বললাম। ‘হ্যাঁ, আপনাকে আমি দেখেছি। মনে আছে আমার।’ তার এই কথায় আমার শুকিয়ে যাওয়া কলিজায় কিছুটা হলেও রহমতের বারিবর্ষণ হয়েছে। ওহ শান্তি। কিন্তু হায়, মুহূর্তে আশার বাসা ভেঙে গেলো। তিনিও আমাকে তিনটা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বললেন। আমিও নাছোড়বান্দা। আবার অনুরোধ করি। এবার আমার দিকে তাকিয়ে বললেন ‘আসুন’। সঙ্গে নিয়ে সেই অফিসারের কাছে গেলেন। নিজ হাতে মুসলেকা দিয়ে আমাদের উদ্ধার করলেন। হায়রে বিড়ম্বনা! পরিশেষে তাকে অজস্র ধন্যবাদ জানাতে ভুলিনি। বললেন, ‘এভাবে বাইরে যাওয়ার নিয়ম নেই।’ আমরা শুকনো হাসি দিয়ে মাথা নাড়লাম। তিনি চলে গেলেন।
ত্যক্তবিরক্ত হয়ে সোজা কামরুল ভাইয়ের কাছে যাই। গিয়ে দেখি তিনি দিব্যি নাকডেকে ঘুমাচ্ছেন। ডেকে তুলে এইসব বিপদের কথা বললাম। কি আর করা। তিনি ঘটনা শুনে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আফসোস করলেন। এদিকে দৌড়াতে দৌড়াতে ভীষণ ক্ষুধাও লেগেছে। কিছু খেতে হবে। সেঁজুতি বললো মম খাওয়া যেতে পারে। আমি যেহেতু আগে কখনো মম খাইনি। সেহেতু আগ্রহ নিয়ে ছুটলাম মম’র খোঁজে। অবশেষে মম পেয়েছি সত্য। কিন্তু দাম এতোই বেশি যে খাওয়ার সাহস পাইনি। আমাদের কৃপণ মনে করার কোনো কারণ নেই। অভিজ্ঞজনের পরামর্শ হলো, ‘দেশের বাইরে একটু হিসেব করে চলাটাই বুদ্ধিমানের কাজ।’ না খেয়ে আবার ফিরছি কামরুল ভাইয়ের কাছে।
কবিতার পথে পথে-২॥ ফারুক সুমন
পথিমধ্যে হঠাৎ এই মধ্যরাতে আমার চোখ যায় এক তরুণীর দিকে। তিনি একটি রাউন্ড টেবিলে বসে আছেন। একপাশে লেখা আছে ‘অনুসন্ধান ডেস্ক’। তিনি আগত যাত্রীদের নানান তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেন নিশ্চয়। তার সামনে এক তরুণ অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে কথা বলছে। তাদের কথা যেন ফুরোয় না। আমি এগিয়ে গেলাম। আমার পেছন পেছন সেঁজুতিও। গিয়ে বললাম, এক্সকিউজ মি।
-‘জি বলুন। কিভাবে সহযোগিতা করতে পারি?
-আমরা ঢাকা থেকে এসেছি। দিল্লি যাবো সার্ক সাহিত্য সম্মেলনে যোগ দিতে। ইনি কবি সেঁজুতি বড়ুয়া। আমি ফারুক সুমন। আমাদের বিমান ছাড়বে ভোর পাঁচটায়। এখন বাজে দেড়টা। অনেক সময় বাকি। যদি এখানকার ওয়াইফাই পাসওয়ার্ড পেতাম। সময়টা ভালো কাটতো। একনাগাড়ে কথাগুলো বলে এবার দম নিলাম।
-দেখুন, ওয়াইফাই আছে। কিন্তু এটা একান্তই বিমানবন্দরের স্টাফদের জন্য।
-প্লিজ, অনুরোধ করছি। আপনি আমাদের পাসওয়ার্ড দিয়ে সহযোগিতা করলে কোনোদিন ভুলবো না। আপনি যখন ঢাকায় আসবেন। কথা দিচ্ছি আমি পুরো ঢাকা শহর আপনাকে রিকাশায় ঘুরে দেখাবো। আপনি তবু এই কবিদের খালি হাতে বিদায় দেবেন না।
-দেখি আপনার মোবাইলটি দিন।
মোবাইল দেওয়ার পর কিছুক্ষণ চেষ্টা করেও তিনি নেটের কানেকশন দিতে পারলেন না। পরে সেঁজুতির মোবাইলটি চেয়ে নিয়ে ওয়াইফাই কানেকশন দিলেন। আর আমার মোবাইলটি সেঁজুতির মোবাইলের সাথে হটস্পটে যুক্ত করলেন। আমি তাকে দুর্বার গতিতে কমপক্ষে দশবার ধন্যবাদ দিলাম। তিনি মিষ্টি করে হাসলেন। আমিও হাসতে হাসতে বললাম, ‘দিদি কিছু মনে করবেন না। আপনি খুব ভালো। আপনার হাতের আঙুল ও নখগুলো খুব সুন্দর।’
সেঁজুতি আমার এই আপাত উল্টাপাল্টা আচরণে কিছুটা অবাক হয়েছে বৈকি। আসলে ওই মুহূর্তে আমার মধ্যে এক ধরনের পাগলামি তৈরি হয়েছিল। যে করেই হোক ইন্টারনেট কানেকশন নিতেই হবে। ফলে নিজেকে তখন এতো গুটিয়ে রাখতে মন চাইছিল না।
প্রমাণিত হলো, গুটিয়ে থাকলে সবসময় দাবি আদায় করা যায় না। আমরা দুজন এত বাধাবিপত্তির পরেও নেটের কানেকশন পেয়ে বেজায় খুশি। গিয়ে দেখি কামরুল ভাই আগের মতোই আছেন। তারপাশে অন্য যাত্রীদের কেউ সোফায় গা এলিয়ে শুয়ে আছেন। কেউবা ফ্লোরে হালকা চাদর পেতে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে নিচ্ছেন। এদের অধিকাংশ যাত্রী ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে যাবেন। কামরুল ভাই ব্যাগে থাকা বিস্কিট এবং জুস বের করে দিলেন। আমার ব্যাগেও বিস্কিট ছিল। আমরা ভাগাভাগি করে খেলাম। কিছুক্ষণ পর আমি গলা ছেড়ে গান গাইতে শুরু করলাম। তাও বাউল আব্দুল করিমের লোকগান। গানের উচ্চনাদে অনেকের ঘুমে ব্যাঘাত সৃষ্টি হয়েছে। তারা ঘুমভেঙে নড়েচড়ে উঠলো। দুয়েকজন আবার বিরক্তির শ্যেনদৃষ্টি দিয়ে আমাকে নিরীক্ষণ করলো। পরপর দুটি গান গেয়ে আমিও থেমে গেলাম। পৌনে পাঁচটা পর্যন্ত আমাদের সময় এরকম আনন্দবেদনা ও উৎকণ্ঠার ভেতর দিয়ে অতিবাহিত হয়েছে। আমরা ঘুরে ঘুরে দেখেছি নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু বিমানবন্দরের অভ্যন্তর। এখানে প্রাসাদোপম বিল্ডিংয়ের গাত্রজুড়ে নানা কারুকাজ। ভারতীয় নানা ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির শৈল্পিক চিত্রকর্ম শোভা পাচ্ছে। আমাদের হাতে যেহেতু ভোর অব্দি সময় আছে। সেহেতু আমরা সেসব আগ্রহ নিয়ে দেখেছি।
চলবে…