স্বাগতিক মেঘের সাঁকো-১
অপরাহ্ণে আমি প্রমিতার কাছে যাই―যেতে চাই, সমুখে সোনার সাঁকো…
প্রমিতা নদীর মতো মেয়ে; বুকে তার মেঘ জমে থাকে গ্রীষ্মবর্ষাশীতে; আমি তাকে নীল বলে ডাকি।
সে বিরহ ভালোবাসে, বেদনা রচনা করে হেমন্তের মত; তটিনীর হাত ধরে মোহনার কাছে যায়; নেপথ্যে নিয়ত উপাসনা করে নক্ষত্রের মায়াভরা রাত।
দুয়ারে দরাজ খিল আড়াআড়ি নিরিবিলি, ঝুলে আছে বধিরের মতো ইস্পাতের তালা;
নিরুদ্ধ সূর্যের আলো ফিরে এলে ওই ঘরে বেড়ে ওঠে বেদনার বোন, বিভ্রান্ত অনুজ!
সারা রাত যেতে যেতে তারা ডুবে যায়―পথ যায় সরে―ছায়া ও মায়ায় খেলে দিকচক্রবাল;
দুলে ওঠে সাঁকো ও শালিক; প্রেমে ও অপ্রেমে দোলে দরিয়াদেয়াল।
স্বাগতিক মেঘের সাঁকো ২
ভেবে ভেবে খুন হই―দাঁড়িয়ে থেকেছি রোজ নিষাদ বালক―অযুত আলোকবর্ষ শেষে
একাকী তোমার কাছে গেলে সহসা সকালে খুলে যাবে দখিনা দরজা; খুলে গেলে জন্মান্ধ জানালা ব্যাকুল বিহ্বল আমি ঠিক বেদনার পাশে বসে মোনাজাত করে যাবো, করপুটে খেলে যাবে সাত সমুদ্দুর ঢেউ।
না, আমার মোনাজাত কখনো সমাপ্ত হবে না, পৃথিবী বিদীর্ণ হবে বিরহের ভাপে, আকাশে মেঘের ছায়া খুঁজে নেবে নতুন নীহারিকা!
আমাকে বেদনা দাও, দিতে পারো সমুদ্রের সমূহ ক্রন্দন আর মধ্যাহ্নের ঘুঘুর বিলাপ;
অবেলায় পোড়া ধূসর জোছনা বারান্দায় নেমে এলে তোমাকে একান্তে চাই, কবিতা ফুটতে থাকে দূরভাষী কামারশালায়…
প্রমিতার চোখ সমুদ্রের মতো ডাকে; নাক তার জামরুলের মতন―মাছরাঙা পাখি একা বসে থাকে রোজ প্রভাতের প্রতীক্ষায় আর আমি সোনালি সাঁকোর গল্প শুনি, ছবি দেখি; শরীরী ঘুমের ঘোরে দুলতে দুলতে উড়ে যায় স্বাগতিক ময়ূখ সাঁকো।
স্বাগতিক মেঘের সাঁকো-৩
যে ঠোঁটে বাজাও তুমি রোদের সানাই―সে ঠোঁট ছুঁয়েছে হিরে―কবির চুমোয় আঁকা গোলাপের রঙ নিযুত বিরহবর্ষ জুড়ে পৃথিবীর কক্ষপথে জোছনা ছড়ায়।
শরীরে সতত মেখে মরণ মরণ খেলা পাখি কি গাইতে পারে অমৃতের গান?
সাহারার কোল ঘেঁষে বয়ে যেতে পারে নদী নিরবধি?
প্রমিতা নামাজ পড়ে―তসবির মালা দোলে শাপলাগ্রীবায়; সেজদায় যায়―বিগলিত হৃৎপিণ্ড চুয়ে চুয়ে নেমে আসে হিরণ্ময় ঝর্ণাধারা।
বেহেশতে সে কি একা যেতে চায়?
শিমুল যাবে না সাথে?
রোজ রোজ যত কথা জমা রাখে বকুলের প্রাতে―ডুব দেয় সন্ধ্যায়―গভীর রাতে নীল পানকৌড়ি হয়ে যায়।
মানুষ বোঝে না হায়―কাঁধের ফেরেস্তা তার মরে গেছে; বিগ্রহ প্রণয়ে মাতে―কবি হতে চায়।
অশরীরী সঙ্গমের পর প্রতিরাতে জেগে ওঠে মেঘের বদ্বীপ;
শরীর শিউরে ওঠে―তার চোখে ঘুম নেই, চুল আলুথালু―আমি আর পারি না ভুলিতে!
কবিতার রাষ্ট্র নেই, ধর্ম নেই, মানে না সে সীমানা শ্মশান;
তবু তাকে তালা দিতে গিয়ে পদতলে পিষ্ট হয় বেতাল মাহুত।
স্বাগতিক মেঘের সাঁকো-৪
প্রমিতা, নিশুতি রাত―জোনাকির গানে তবু জাগে সোনাদিয়া; কোলাহল থেমে গেলে পাথুরে শূন্যতা নামে; কোহালিয়া শুয়ে থাকে হেমন্তের বাটে; আমি তার পিছু পিছু খুঁজি শবনম।
এ কোন আজাব এলো বলো মধুপুর ধামে―ধূমায়িত চিমনির তলে ছোটে অজগর―বহুগামী লরি; চারদিকে ভেঙে পড়ে আবাদি ধানের গোলা প্রিয় নুনঘর।
দুজনের ঘুম নেই, দিনে রাত বাড়ে; প্রলাপে বিলাপে কাঁপে পবিত্র মৈনাক;
অগ্রজ প্রলুব্ধ আজ অনুজ উদ্বাস্তু―কোথায় দাঁড়াবে বলো শিবের সন্তান?
প্রমিতা নিকটে এসো―অন্ধকারে এত দূরে! বড় ভয় হয়…
তোমার পানের মত মুখ সায়াহ্নে স্বপন আঁকে, ডাকে অহর্নিশ সবুজ আপেল ক্রমে হলদে তামাটে হয়―শেষ হলে পাললিক আয়ু―ডানা মেলে দোঁহে মঙ্গলে ময়ূখ জ্বেলে শাপলা ফোটাবো।
স্বাগতিক মেঘের সাঁকো-৫
হেমন্তে খেয়ালি চাঁদ বারান্দায় নেমে এসে দুহাত বাড়ায়;
তোমার কপোল তলে
জোছনারা যায় খেলে
ঠোঁট ও চিবুকপাড়ে কুয়াশা ঘুমায়।
আকাশ অচেনা হলে নন্দনের পাখিসব গান ভুলে যাবে, দাবদাহে পুড়ে যাবে অঙ্গনউদ্যান পত্রপুষ্পছায়া;
মরে গেলে ক্ষীণ করতোয়া কোথায় মিলবে বলো শুশ্রূষার জল?
প্রমিতা, তোমাকে চাই―সকাল বিকেল দুপুরে ও রাতে―অবসরে ব্যস্ততায়;
অহর্নিশ কানে বাজে কল্পপত্রে আঁকা কবিতার কথা, ব্যাকুলরোদন;
বিমর্ষ সন্ধ্যার মতো মুখে যখন সে হাসে হৃৎপিণ্ড দোল খায়, বুকের বিরহপাতা ছিঁড়ে ছিঁড়ে যায়…
মুখোশের মুখ পাঠ শেষ হলে নক্ষত্রে আগুন ঝরে―রোদের ডানায় কাঁদে বিবিক্তকুসুম।
স্বাগতিক মেঘের সাঁকো-৬
নক্ষত্রপুঞ্জের মতো জেগে থাকে হৃদয়ের যত বুদবুদ―নিসর্গ নীরবে গোনে উদ্যত চাপাতির ফণা।
উপকূলে চারপাশে কাম আর ক্ষুধা, বাস্তুহীন মুখ শৈবালের প্রাণে ভাসে;
অসুন্দরের গ্লানি হতে দূরে সরে যাই; বিবমিষা ভুলে ক্লোদাক্ত শরীর ঘিরে স্বপ্ন আর সুর অপরাহ্ণে অকস্মাৎ দোলা দিয়েছিল…
প্রমিতা, মোমের মতো মেয়ে নির্লিপ্ত নির্বাক; যেদিন কাঁদতে কাঁদতে অতীব কাছে এসেছিল; অমল পায়রা ভেবে আমি তারে চুমু খাই হেসে―কোলে তুলে নেই―ভুলে যাই নারীর ডানায় মিশে আছে প্লাবনের মতো লোভ, বিনয়ের অভিনয় আর ছলনা ও ছায়া।
ঝড়ের গভীর রাতে নেমে এলে অন্য অন্ধকার―শাঁখা আর পাতারা অস্থির―সন্দেহ-সংশয়ে দোলে সবুজ পেয়ারা…
তুমি শুধু বলেছিলে, মেঘ নয় মিহিরকে দেখো, জয় করে নাও তুমি আপন আঁধার দিবসের মতো।
নিটোল শরীর নয়, রূপগত কোনো উত্তরাধিকারও নয়―শরীরের চেয়ে অতিরিক্ত এক পরমার্থ চেয়ে আমরা সেদিন পরস্পর দুইহাত বাড়িয়েছিলাম হেমন্তের রাতে ধানবতী দেশে।
স্বাগতিক মেঘের সাঁকো-৭
ধানফুলরোদ দোলে কপোলে কার্নিশে; বিলেড়িত অভিমান ছুঁয়েছে কি হেমন্তের মন!
সদর্পে সামনে আসে হলুদ কলেজবাস―অনাঘ্রাতা চন্দ্রপ্রভা হাসে;
প্রমিতা, কোথায় যাবে?
মুঠোভরা নীলমেঘ নিয়ে―বিমর্ষ দাঁড়িয়ে নিকটে―মফিজ পাগলার মোড়;
গোধূলির শেষলগ্ন এলে ম্যাক্স মোটেলে জোছনা নামে…
সাঁতারনদীতে ঢেউ নেই, মুকুলিত দশটি আঙুল;
সদ্যস্নাত জোছনার আলো―টলমলে দুচোখ―নুরুন আলা নুর।
চিনিপাতা দইয়ের মতো স্নিগ্ধ তোমার শহর;
যোগ আর বিয়োগের নাম সাতমাথা―বীরশ্রেষ্ঠ স্মৃতিস্তম্ভ হয়ে হৃদয়ে নিয়েছে ঠাঁই;
মুখ ও মুখোশের আড়ালে যে ডাকে নিরলে প্রণতি জানায় তারে―ভোরের দোয়েল আর―ধবধবে যমুনার জল।
নক্ষত্র কোথায় যায়―কখন হারায়―যামিনী জানে না।
খেলাঘর
পাখা ও পেখম জমা রাখে নীলিমার কাছে মাটির ময়ূর; স্বপ্নস্বপ্ন খেলাঘর খুঁজে নদীও তটের কাছে ইশারা পাঠায়।
তটিনী জানে না―উজালা স্বপ্নের তারাদের কোনও হাটে বিকিকিনি নেই, নেয়েও চেনে না―ছাইরঙা দীর্ঘশ্বাস জমা রাখার কোনও ব্যাংক বা লকার নেই।
প্রতিদিন রাতে মেঘের আঙিনা জুড়ে নধর কবিতা নাচে―যমুনায় যায়; নেয়ে ও তটিনী রোজ নয়নে নোঙর ফেলে শরীর রাঙায়।
মাতাল করাত
যাবে যদি নদীপথে পাহাড়ের দেশে―যমজ পাহাড়ে ঠেলে চিলতে আকাশ হাসে―হাত নেড়ে মেঘনীল স্বাগত জানাবে।
সর্বদর্শী দুই চোখ দূরের প্রাচীর কেটে আমাজন পাড়ি দিতে পারে―অথচ নিজের ছায়া নিজেই চেনো না; কীভাবে মুছবে বলো মাস্তুলের রোদ―দাঁড়ের জখম?
মায়াপথে নদীগুলো আরশির মতো অবিকল ছবি আঁকে―হাওয়ায় নাওয়ায়; বাঁকে বাঁকে দুঃখ ক্ষুধা কাঁদে অবিরত। যমজ ব্যাকুল পায়ে মধ্যরাতে নেমে আসে শহরের ক্লেদ―অবসাদ। তুমি সেই নদী এতদিন যে নিজেকে সর্বগামী বলে অযথা অহং দেখিয়েছ!
খুলে রেখে প্রাতের হাসুলি রাতের মুহুরি দোলে জলহীন ঘরে; নদী এক মাতাল করাত চাঁদ কাটে জ্বলে নেভে―কখনো ফেরে না ঘর, চেনে না সে সন্ধ্যাবেলা সারেঙের বাড়ি।
তটিনী-৩
মেঘের কোমল তট―সবুজে হলুদ রঙে ঢেউ খেলে রোজ;
দোয়েলের গান শুনে কখন যে আনমনা হয়ে পড়ি নিজেই জানি না।
নদীর পেখম খুলে গেলে তটের কিনারে নাচে সমুদ্রের ছায়া, তোমাকে খুঁজতে গিয়ে দেখি লাল কাঁকড়ার খোল, মৃত কাসিমের চোখ; দূরগামী ইগলের নখ। নিমগ্ন নদীর তীরে হেঁটে যতদূর একা যেতে পারি; চার দিকে ভেঁপু বাজে; জাহাজ নোঙর খুলে দূরদেশে ধোঁয়া ছেড়ে যায়।
আমার যাত্রার কালে কেউ যদি নদী পাড়ে অজান্তে দাঁড়ায়, হাতের তালুতে সে দুচোখ মোছে আমি তাকে দিয়ে যাব দোয়েলের শিস আর শীতার্ত রোদের ভোরে ওমের আমেজ।