স্যানাটোরিয়াম-১
বন্ধুকে বলতে পারো, অনায়াসে বলতে পারো বন্ধুর মাকেও। আমি পরেছিলাম তুঁতরঙের জামা-তা এমন আহামরি ছিল না, কিন্তু ছিল তোমাদের কবরের মতো মাঠভরতি অন্ধকার। আমি ছিটিয়েছিলাম কিছু বিষাদবীজ আর অদ্ভুত গাছসকল জন্মেছিল ধূসররঙ মেয়েদের চোখের ভেতর-তা আবার কান্নাও নয়, ঠিক যেমন প্রত্যাখ্যাত হয়ে আমরা উষ্ণ ব্রোথেলে যাই কিংবা ফিরে আসি মধুর মাতৃগৃহে।
(স্যানাটোরিয়াম, ২০০৮)
দুধগাছ
দুধগাছ আমার মা
না-হলে বাবা কী করে আমাদের
এই বনের ভেতর পেলে-পুষে মানুষ করলেন
নাঙ্গা সময়ের নিচে শিশুদের ভাতের জোগাড় ছিল না
জন্মেছি রোগা-পটকা আমরা ন’ ভাই-বোন
মা ছিল হাড়-জিরজিরে কিন্তু বুকভরা দুধ
আমরা ন’ ভাই-বোন স্তন চুষে স্তন্য খেয়ে
দুধের ফেনায় পুড়ে পুড়ে মা আমার ধনুক আর
শস্যের দেবী হয়ে গমখেতে সূর্যালোক হয়ে জ্বলে
ফলবতী মাটিতে বিষণ্ন লাল ফুল হয়ে ঝরে
মা আমার চিরহরিৎ, অন্নপূর্ণা; বাবা বিষগাছ-করুণ ওষধি!
(তাঁবুর নিচে দূতাবাস, ২০১১)
সিন্ধুদ্রাবিড়ের ঘোটকী-৬৭
এইখানে, আমার মাচানের পাশে আবারও লাফিয়ে উঠেছ তুমি
ভাদ্রের ফুলে-ওটা মরা-নদীটির তীরে যখন এরণ্ডা পাতায় ছেয়ে
গেছে মাঠ আর আমি চোখ মেলে তোমার দিকে তাকিয়ে রয়েছি!
মাটিতে বৃষ্টির ফোঁটা বর্শার মতো গেঁথে যাচ্ছে আর আল ভেঙে
ক্ষেতে ঢুকে যাওয়া পানির শব্দে একটি কেউটের মুগ্ধ জাগরণ
আমাকে যখন গভীর পুলক দিয়েছে আর তমাল গাছটি রাধিকার
আর্তি হয়ে ফুটেছে চরাচরে-ভেজামুখে আবারও লাফিয়ে উঠেছ!
সিন্ধুদ্রাবিড়ের ঘোটকী-৬৮
আমাকেও গৃহত্যাগী জেনো, যদিও ভরা পূর্ণিমায় তোমার কপালে
করেছি চুম্বন! তুমিও ডোরাকাটা সাপের মতো ফুঁসে উঠেছিলে
ভূমিধসের রাতে, জড়িয়ে ধরেছিলে আমার কোমর! গঙ্গাঋদ্ধির
মানুষেরা এইভাবে বেদনার নদী পেরিয়ে এসেছে দূরের পারে!
একদা গৌতম নামে এক বিষণ্ন যুবক গৃহত্যাগ করেছিল কপিলাবস্তু
থেকে ঊনতিরিশে এসে! আনন্দ পায়নি সে পুত্রের জন্মের কালেও
তারপর বৃহৎ জীবন তাকে ডেকে নিয়ে গেছে গেরুয়া পোশাকে!
আমাকে কী ভাবো তুমি? আমার পাশে সৎস্ত্রী শুয়ে আছেন তাই বলে
আমি কি সুখী? বুদ্ধের চোখ দিয়ে এই পৃথিবীটাকে দেখেছি আমি
কিন্তু কে প্রথম শুনবে আমার বার্তা? তুমিও কি চেয়েছিলে? যখন
একা পথে হাঁটি আমার পেছনে একটি কণ্ঠস্বর শুনি গৌতম, গৌতম!
(সিন্ধুদ্রাবিড়ের ঘোটকী, ২০১২)
আদিপাপ
ভগ্নী তুমি সরে দাঁড়াও! চিৎকার করে একজন
আকলিমা কাঁদে আর ভাবে এই দুই পুরুষের ক্রোধের উৎস কী?
হাবিল ও কাবিল মল্লযুদ্ধে মেতে উঠেছে পৃথিবীর প্রথম প্রান্তরে
আকলিমা দেখে দুজনের শরীরের মাঝখানে দুটি করে অণ্ডকোষ আছে
আর তার একটিও নেই
হাবিলের রক্ত মাটিতে গড়িয়ে পড়ে আর কাবিল উল্লাস করে
আকলিমা ভীত হয়
কিন্তু তার উষ্ণ জরায়ুতে
হাবিলের ভেড়ার বলি-দেওয়া মাথা তখন ছটফট করছে।
(জাতক ও দণ্ডকারণ্য, ২০১৩)
ময়ূর উজানে ভাসো: ২৩
আমাদের বাক্যালাপের মাঝখানে একটা অস্পষ্ট আগামীকাল ছিল। তোমার শরীরের সৌন্দর্যের নুন তোমারই ক্ষয় হয়ে আসা পোট্রেট। আমি অবাক হয়ে দেখি তোমার কথাবলার মুহূর্তের গ্রীষ্মগুলো কিভাবে তোমার জোড়া বুকে ওঠানামা করে। বাক্যালাপ শেষ হয়ে গেলে দীর্ঘ মৌনতার ভেতর আমাদের আগামীকালের বেঁচে থাকাটাও নিশ্চিত হয়ে ওঠে। যদিও এ-সবকে তুমি নিতান্তই আয়ুক্ষয় ভেবেছ।
(ময়ূর উজানে ভাসো, ২০১৪)
প্রস্তরলিখিত
সিয়েরা স্টেটন, তোমার নামের রঙ লাল। আমারও।
তুমি সমাধির এপিটাফ, আমি তাতে একের পর এক খোদাই
করে যাচ্ছি আমার অনুভূতিগুলো।
তুমি এসব কোনোদিন জানতেও পারবে না, কারণ আমি মৃত।
আজকের দুপুরটা খুব বিষণ্ন ছিল,
আর আমি হারিয়ে ফেলেছি আমার স্বপ্ন।
আমি এখন মধু আর লেবু সমেত পান করছি সবুজ চা
তুমি ক্যালিফোর্নিয়ায় বসে পান করছ বিশ্রী রকমের কালো কফি
চিনি ছাড়াই। তাতে কিছু যায় আসে না।
আমরা দুজনই মৃত্যুর সমবয়েসী। আমরা বসে আছি মুখোমুখি
আমাদের কোনোকালেই দেখা হবে না, সিয়েরা স্টেটন।
(প্রস্তরলিখিত, ২০১৫)
প্রথম বৃক্ষরোপণ
এই লিঙ্গমুণ্ড, আদিম দেবতা
গ্রহণ করো গ্রহণ করো বলে
পুরুষ কাঁপাচ্ছিল রক্তিম প্রদোষ!
এই যোনিচক্র, মন্দির-তোরণ
ব্রহ্মাস্ত্র নিয়ে প্রবিষ্ট হও বলে
নারীও উৎসুক হলো কম্পিতা!
তখন থেকে ভূমি ভেদ করে
জেগে ওঠে ফুলশস্যের গাছ।
(এখন মৃগয়া, ২০১৬)
চন্দ্রাবতী
আমি কি লিখেছি তোমারে পত্র আড়াই অক্ষরে?
বলেছি হইও সাক্ষী ওরে নদী, কূলের হিজলগাছ!
তা হলে বিষ্টিতে গাছের মূলে আর ঘাসে ঘাসে
ঘুরে বেড়ায় এই সমাচার? রে কন্যা চম্পকবরণী!
আমি কি তোমারে শুধায়েছি তাবৎ দুস্কের কাহিনি?
তবু দেখো তোমারেই ভাবিয়াছি কন্যা চন্দ্রাবতী
আর তিলে তিলে দগ্ধ নাগর আমি জয়ানন্দ রায়?
ঢেউয়ের ওপরে ভাসে দ্যাখো সাড়ে তিন হাত জমি
নদীও উজানি কন্যা মুখে নাই বাণী
আমারে অভিশাপ দিলা কেমন অনাদি শঙ্করে?
না-হইলা সম্মত কন্যা না-করিলা ক্ষমা
পাগল হইয়া নাগর কত উচ্চৈঃস্বরে ডাকিলা
যোগাসনে আছিলা কন্যা সমাধিশয়ানে
আমিও লিখ্যা রাখি বিদায়পত্র কপাট ওপরে
জলের ওপরে ভাসে দেখো আমারও তনুদেহ
তুমি কন্যা চন্দ্রাবতী মাটিতে চম্পক হয়ে ঝরো।
(আবারও শবর, ২০১৬)
তিনভাগ রক্ত
কুরুক্ষেত্রের বিস্তার এখানেও।
কুরু আর পাণ্ডবকুলের রক্তে এককালে
ভিজেছিল পৃথিবীর মুথাঘাস
আবারও মেদিনীযুদ্ধে পুড়ছে আকাশ
আর অতি কাছ-থেকে-ছুড়া গুলিতে বিদ্ধ
হচ্ছে বৃদ্ধ-নারী-শিশু ও পুরুষ
জাফরানের খেত ভিজে যাচ্ছে মানুষের রক্তে।
…
যুদ্ধ শেষ না আসন্ন?
কুরুক্ষেত্রে এই সংলাপ ছিল রাজা ধৃতরাষ্ট্রের
তিনি অন্ধ ছিলেন
এখন জগতসুদ্ধ সকলেই অন্ধ।
রক্তে ভেসে যাচ্ছে উপত্যকার মাটি
অক্ষৌহিণী সেনাদল চারদিক থেকে চিৎকার করছে
জিতেছি জিতেছি
আর অন্ধেরা প্রশ্নও করছে,
যুদ্ধ শেষ না আসন্ন!
(তিনভাগ রক্ত, ২০১৯)