নারী জন্ম
নারী জন্মের কালেই
এক আঁজলা ব্যথার মিশ্রণ
যেভাবে মিশিয়ে দেওয়া হয়
আমার মস্তিষ্কে, বোবা রক্তকণিকার
কোনো নির্জন হাড়ের ভেতর গভীর তাজা ক্ষতে
আমি নিষিক্ত কোকুণ হয়ে জমে থাকি
ওভামের অন্ধকার জলে,
যেসব ঝর্ণার নিচে
কুড়িয়ে রেখেছি মৃত বালি সেখানেই পাথরের
সাথে নোনাজলের মিশেলে তারা হয়ে ওঠে দামি
এক একটা আলোর জুয়েলারি
এই ডানাহীন প্রেম,
নৈঃশব্দ্য ছড়ানো প্রার্থনার আকুতি যখন নিভে
যায়, আবডালে ঝরে
আর্দ্র বাউল বাতাস
রেটিনার ওপর পিঙ্গল জলে ছাতিমের
কোন দুর্দান্ত ভাস্কর্য!
আমি দূর থেকে পতন শুনতে পাই
আর হারানো সৌরভে মিশে যাই
ভিজে যাই অবিরাম
ডুবে যাই দীর্ঘ অভিমানে ।
নারীর মুদ্রা
নারীর মুদ্রায় নেচেছে যে জীবন প্রগাঢ় আনন্দের
কোনো গল্পের নায়িকার মতো
ধূসর শূন্যতায় চাকার মতো ঘোরে স্বপ্নঘুড়ি
উড়ে উড়ে পাড়ি জমায় মেঘমল্লারের দেশে
শুভ্রতার মলিনতা আত্মস্থ হয়ে ধূলিজমে সেখানে
যেভাবে পরিত্যক্ত কোনো রেস্তোরাঁয়
শূন্য নৌকার দেহলিতে নিথর হয়ে ভেসে থাকতে হয়,
জল ভেঙে ভেঙে জেগে ওঠার বাসনায়
নিখাদ ইন্দ্রধনুর বেশে
নেপথ্যে রয়ে যায় দেবদারুর ঘন অন্ধকার ও নির্মমতা
কখনোবা ফিকে হয়ে আসে নিভে যায় সব আলো দূর-নীলিমায়
অথচ এমন কোনো ব্যর্থ গল্প না হলেও হয়তো হতো ।
ম্যালানকোলিক গল্প
বিকেলের গল্পগুলো খুব ম্যালানকোলিক হয়
পেন্ডুলামে ঝুলে থাকে স্মৃতিরা
যাযাবর হয়ে ইতস্তত ঘোরাঘুরির পর
গোলকধাঁধায় আটকে থাকে অভিমানগুলো
আর কিছুটা দুশ্চিন্তা ঝুলে আছে জংধরা বিষণ্ন রেলিংয়ের গায়
ডানাহীন আলোয় অতীত ছলকে ছলকে পড়ে
কাঁচপোকাদের রি-রি সালিশের ভিড়ে
ঘুমহীন ছিপিতে আটকানো শিশি
সোপ অপেরা ম্যাপল পাতার ওপর লেখা হয়
এদিকে সংবাদ পত্রে এসেছে নিখোঁজ সংবাদ
ট্রামে চড়ে বসা ক্রমশ ছোট হয়ে যাওয়া উপন্যাসের
শেষ চরিত্রটিকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না কোথাও।
ওর হাতে ছিল নিভে যাওয়া একটি রুমাল।
স্বপ্নচারী
জলরাশি ছাড়ালেই সামনে আফ্রিকার বিষণ্ন উপকূল
আন্দালুসিয়ার সোনালি বালুকাবেলা
নীল জামদানি আকাশের ক্যানভাসে নাক্ষত্রিক উপাচার
লাবণ্য ছড়ায়, ধু-ধু প্রান্তর
রূপসী পানির ধারা শব্দস্রোতের মতো উজ্জ্বল,
বড় চেনা মনে হয়
যুগ যুগ ধরে পাথর ভেঙে চলে
নেশাতুর এক ধূসর শ্রমিক
নিরুত্তাপ নদীর বুক চিরে নিবিড় বিচ্ছেদ তুলেছে যে পাহাড়
তারই গা থেকে খুলে নেয় একটি একটি করে পাথর
অ্যামারাল্ড, অ্যামারাল্ড পেতে হবে তাকে!
ক্যালেন্ডারের শেষের তারিখের মতো নৈঃশব্দ্যে ঢেকে আছে
শেষ পাথরটি, পৃথিবীর সুন্দরতম অ্যামারাল্ড
কিন্তু বহুবছরের রাগ-ক্ষোভ-ক্ষুধা,
মেঘকালো আঁধার জমেছে
শ্রমিকের নিস্তরঙ্গ মনে
তাই দৃষ্টি সীমানার বহুদূরে পাথরটি ছুড়ে মারে সে
হায়! অ্যামারাল্ডটিকেই
হেঁটে যায় অজানার পথে।
জীবনের শুরুতেই মানুষ জেনে যায় তার লক্ষ্য
তবু কেন যে হাল ছেড়ে দেয় সে।
পাখিরা নিয়ে গেছে উষ্ণতা
শীতের পাখিরা নিয়ে গেছে উষ্ণতা কবেই
তবু ভুল করে ফেলে গেছে
কিছুটা বাড়তি বিষণ্নতা
পালকের সাথে
ছায়াদের দীর্ঘ হওয়ার মরসুমে
বদলে গিয়েছে কত ক্যামেলিয়ার অচেনা ওম
অথচ পথ চলার কথা ভেবেই যেদিন
প্রথম তোমার হাতটি ধরেছিলাম,
পরিত্যক্ত পালকের সাথে
ওরা ফেলে গেছে আমাকেও সেইদিন…
পাললিক গল্পের নায়ক
(কালিদাস কর্মকারকে)
রঙের ঝর্ণাকে ঈশ্বরের দিকে ছুড়ে দেবে বলে
আবহমান বাংলার পাললিক গল্প
বলতে চেয়েছিলে। তাই এখানে সেখানে
জীবনের চিত্রকর্ম আঁকতে আঁকতে
নিষিদ্ধ লাটিম হয়ে ঘুরেছ মাটিতে
নকশীকাঁথায় ফোঁড় তুলে কেটে গেছে
তোমার ভোরের আলো, দুপুর কিংবা নগ্ন রাত
সুডোকু কি অংশত মেলাতে পেরেছিলে তবে বলো?
শিবের নৃত্যের তালে শাপ-লুডু খেলে
দেশে দেশে লুকোচুরি করো
অথচ শোকের জংশনে এসে তোমার
আয়ুরেখা থেমে যায় লম্ব উপাংশে
তাহলে মৃত্যু কি কোনো অচেনা প্রস্থান?
রাহুর গ্রহণ লেগে গেলে
ক্যানভাস ভিজে যায় পোড়া রক্তের লু হাওয়ায়?
বুকের দেয়ালে ঝুলে থাকে বোবা ঘড়ি
চোখের পর্দায় ছেঁড়া ছেঁড়া স্মৃতি আর
দ্রৌপদির শাড়িতে জড়ানো নীলদেহ
তোমার রঙের কম্পন নিস্তেজ হয়ে গেলে কেন
দূর কাফেলার পথ ধরে হেঁটে যাও নিরুদ্দেশে?
ধ্যানমগ্ন হয়ে ঘুমিয়ে পড়ো স্যাক্সাফোনের সুরের লহরে?
কবিতা চিরদিন বেঁচে থাকে
একদিন তুমি বলেছিলে, কবিতা তো শান্তির জন্যই
আটা থেকে তৈরি হয় রুটি আর শান্তি থেকে জন্ম হয় কবিতার
তাই যুদ্ধ ও আগুন লাগানোর দল,
দাঙ্গাবাজ আর নেকড়ের দল
কবিকে পুড়িয়ে মারার জন্যই
পৃথিবীর রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে মরে।
যুদ্ধের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গিয়েই
বায়রন প্রাণ দিয়েছিল গ্রিসে
তরবারিবিদ্ধ পুশকিনের নিষ্প্রাণ দেহটি
পড়েছিল খোলা উদ্যানের মধ্যে
ফ্যাসিস্টরা খুন করে মহত্তম কবি ফেদেরিকো লোরকাকে,
এসবের মধ্যেও তো তুমি বেঁচে ছিলে আলবের্তি
যদিও তোমাকে বহুবার বহুভাবে মারার চক্রান্ত করা হয়েছিল
গ্রানাদায়, বাদাহোসে মৃত্যুফাঁদ পাতা হয়েছিল
এমনকি তোমার গ্রামের বাড়িতেও হানা দিয়েছিল নেকড়ের দল
মাদ্রিদের রাস্তায় চলতে চলতেই
জনতার কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে হারিয়ে গেছ তুমি,
জন্মেছিলে সমুদ্রের সংগীতের মধ্যে
তাই তো তোমার কবিতায় ছিল
শীতকালে ফোটা লাল গোলাপের মতোই মাধুর্য
সেই গোলাপের ঔজ্জ্বল্যের আভা
ছড়িয়ে পড়তো অ্যাস্পানিয়ার রাস্তায়
যেখানে চলতো ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে নিরন্তর যুদ্ধ
তুমি বলেছিলে, বিড়ালের জীবনের মতোই
কঠিন প্রাণপ্রাচুর্য সম্পূর্ণ কবিতার মৃত্যু নেই
কবিতাকে হয়রানি করা যায়
টেনে-হিঁচড়ে, থুতু ছিটিয়ে মশকরা করা যায়
জেলে ভরে রাখা যায়, হয়তো বা নির্বাসনেও দেওয়া যায়
গুলি চালিয়ে জখম করা যায়, তবু কবিতা কখনো মরে না।
বরং সে তার সৌন্দর্যকে দিকদিগন্তে ছড়িয়ে দিয়েই
নবান্নের হাসি নিয়ে চিরদিন বেঁচে থাকে।
নোটবুক
প্রতিদিন নিয়ম করেই লিখছি নোটবুক
ভাবনাগুলো তবু তন্ময় ঢেউয়ে বাঁধা
কাঁপায় শিল্পের মতো ঘোরগ্রস্ত প্রকৃতিকে
অফসেটে ভুলভাল অভিনয় টুকে রাখি
তবু কোনোদিন শ্রীকৃষ্ণকীর্তন শুনতে শুনতে যদি
মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যায়
বরফের কুচি এনে দেয় কোলাহল
আকাঙ্ক্ষার অতলে দাঁড়িয়ে জড়িয়ে ধরবো
ভীষণ নার্ভাস তোমাকেই
আর নিমগ্নতা প্রতি পায়ে পায়ে কাছে এসে
বেদনার জলে মিশে হয় নীল আর শাদা
অনুমতি দাও এবার আমায় মরীচিকা
অনাবৃত জীবনে বাজাই তৃষাতুর মদির সানাই
কবিতার গায়ে ঝরে পড়ি ফুল হয়ে।
দস্তখত
গাছের বাকলে লেখা নাম মুছে গেলে
মিথ্যে করে লেখা চিঠিটির জন্য তবে
কেন হয় এত শোক! চোখের ওপর
আরেকটি মৃতদিন খসে গেলে জেনে
গেছি, সীমারেখা ভেঙে ফেলেছে শেখানো
ভণিতা। তবু মাটির সিথানে হেঁটে যেতেই বুঝেছি
হারিয়ে ফেলেছি কবে আমি নিজেরই দস্তখত!
জাদু বাস্তবতা
পুরনো ক্যানভাসে আঁকা নানারঙের মায়াবী স্নানে!
চাঁদের ওপর জোনাকির জ্বালে জ্বালে সেদ্ধ হচ্ছে
আউসের রাঙা চাল
সাদা মৃত্তিকার ভেতর ঘুমিয়ে থাকে
পুণ্যবতী মায়াগাছগুলো
কৃষ্ণপক্ষের জ্যোৎস্নায় গান গায়
নীলনদ পাড়ে ভেজা ত্রিপল টাঙিয়ে বসে আছে
একটি জিপসি জাদুকর!
একশ বছরের নীরবতা ভেঙে বাজিয়ে চলেছে
সে বিষণ্ন অর্কেস্ট্রার সুর;
দাঁড়িকমাসমেত নিজের আলখেল্লা পরে ডুবে যাচ্ছে
এক গোলাপি সভ্যতা!
হঠাৎ বৃষ্টির মতো মিহি স্মৃতি এনে
ঝরাপাতা বনে হেঁটে যায় কোনো কালোছায়া আর
উইথড্রয়াল সিনড্রোমে ভুগে ভুগে
ডাইরির পাতা ছিঁড়ে ছিঁড়ে পড়ে চলেছি এমনই
সব জাদু-বাস্তবতা;
হয়তো কখনো তারা বন্দি হয়ে ছিল কোনো ভুল
সময়ের দেয়ালের বুকের ভেতর…