[পর্ব-২৬]
ইংল্যান্ডে নেমে দুটো দিন শুয়ে-বসে কাটালো দীপন। ইচ্ছেমতো ঘুমিয়ে মুছে ফেললো যাত্রার ক্লান্তি। সুযোগ মতো কাছে-পিঠে ঘুরে-ঘুরে চিনে নিলো এলাকাটা, যদ্দুর সম্ভব। সাতসমুদ্দর তেরো নদী পার হয়ে এই বিদেশ বিভুঁইয়ে এসে নিজেকে হঠাৎ কেমন স্বাধীন আর হালকা লাগলো বহুদিন বাদে। আহ্। শান্তি। সংসারের ঝামেলা নেই, অফিসের তাড়া নেই, তুলির শাসন নেই, রতনের অনুযোগ নেই, রুমকির জ্বালাতন নেই, তিতলির যখন-তখন গাল ফোলানো নেই, এ যেন সশরীরে স্বর্গপ্রাপ্তি। শুধু তিনবেলা রান্নার ঝক্কিটা বাদ দিলে স্বর্গ এখন হাতের মুঠোয় তার। না, আরও আছে। ঠাণ্ডাটা বড্ড জ্বালাচ্ছে। দেশে এখন খটখটে গ্রীষ্ম। ভয়ানক গরম। সেখান থেকে হঠাৎ এই শীতের দেশে এসে মানিয়ে নিতে বেগ পেতে হচ্ছে বেশ। ভয়ানক ঠাণ্ডা পড়ছে এখানে এবার। তুষারপাত হচ্ছে রীতিমতো। জীবনে এইই প্রথম নিজচোখে তুষারপাত দেখা তার। প্রথমটায় দেখে কেমন অভিভূত, বিমুগ্ধ হয়ে গেছিল দীপন। হালকা, পেঁজা তুলোর মতো বরফ হাওয়ায় ভেসে ভেসে নেমে আসছে আকাশ থেকে। হিম কুয়াশার মতো মিহিন তুষার কণাগুলো ঝুরঝুর ঝরে পড়ছে নিচে। কুয়াশার মতো! ভেবেই ফিক করে কিশোর ছেলেটার মতো হেসে ফেললো দীপন।
তুষার কি কুয়াশার মতো ঝরে? আসলে মানুষ তার অভিজ্ঞতার বাইরে যেতে পারে না, এমনকী কল্পনায়ও। তাই এই অসম তুলনা, ভাবলো নিজেই। বিস্ময়ের ঘোরে সে জানালা খুলে অপলক তাকিয়ে থাকলো ক্ষণকাল এই অপার্থিব, অভূতপূর্ব দৃশ্যের দিকে। ঘোর কাটলো চোখে মুখে এসে লাগা শীতের তীব্র কামড়ে, বাতাসে উড়ে এসে মিহি, শীতল তুষার কণাগুলো ভিজিয়ে দিলো তার চোখ, মুখ, চুল। চোখ বুঁজে তুষারকণাগুলোকে স্বাগত জানালো দীপন। জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে আরও বেশি স্পর্শ পেতে চাইল হীম তুষারের। দুহাত বাড়িয়ে ছুঁতে চাইলো এই অপূর্ব সৌন্দর্যের উৎসটুকু। ভিজে গেলো দীপনের মাথা, তুষারকণাগুলো গলে জল মুহূর্তেই। ঠকঠক কাঁপতে কাঁপতে ত্বরিতে জানালো বন্ধ করলো সে। নিজেকে মুছে নিয়ে আবার দাঁড়ালো এসে জানালার পাশে। মুহূর্তেই চারপাশ সাদা আর সাদা। আশবাড়ের বাড়িগুলো, গাছপালা, রাস্তাঘাট, সব ছেয়ে গেছে সাদা সাদা তুষারকণায়। ধর্মগ্রন্থে, পুরাণে যে স্বর্গের কথা বলা আছে, সে কি এই মুহূর্তের দৃশ্যের চে সুন্দর? প্রশ্নটা নিজেই নিজেকে করলো দীপন। মাথা নেড়ে নাকচ করে দিলো তখন তখনই। না। এরচে সুন্দর কোনো স্বর্গে লোভ নেই তার। পরক্ষণেই মনটা খারাপ হয়ে গেলো দীপনের। মাকে মনে পড়লো। রতনকেও। মা স্বপ্ন দেখতো, তার দুই ছেলে অনেক বড় হবে, দেশ-বিদেশ ঘুরবে, দশজনে চিনবে, অনেক নামডাক হবে তাদের। মাকে ভেবে বিষণ্ন একটু হাসলো দীপন। সব মায়েরাই বুঝি অমন ভাবে। সন্তানকে নিয়ে স্বপ্ন দেখে আকাশছোঁয়া। এরপর একদিন সেইসব স্বপ্নের অফোঁটা, ঝরে যাওয়া কুঁড়ি হাতে পাড়ি জমায় অনন্তে। ভেবে একটা দীর্ঘশ্বাস আপনা থেকে গড়িয়ে গেলো হাওয়ায়। রতন এখন পাগল। আর দীপন? সেও কেউকেটা কেউ নয়। একটি বেসরকারি উন্নয়নসংস্থার ছাপোষা এক চাকুরে বৈ নয়। হা হা। ঘর কাঁপিয়ে হাসে দীপন। কে যেন বলেছিলো না, মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়? তাকে দীপনের মায়ের গল্পটা বলতে পারলে বেশ হতো।
বাইরে চোখ রেখে একমনে তুষারপাত দেখে দীপন। সুন্দর কিছু, আনন্দময় কিছু একা উপভোগে মজা নেই। তার অন্তত ভালো লাগে না। প্রিয়জনদের মনে পড়ে। আহা। যদি তাদেরও এ থেকে ভাগ দেওয়া যেতো খানিক! তুলিকে ফোন করে দীপন। ভিডিওকলে রুমকিকে দেখায় তুষারপাত। রুমকি উত্তেজিত, বিস্মিত। হাসে দীপন। বুকের ভেতরটা কেমন কনকন করে। আহা। যদি তারা সবাই একসঙ্গে আসতে পারতো!
-পরেরবার আমরা সবাই একসঙ্গে আসবো, কেমন মা?
-সব্বাই যাবো বাবা? কাকাও যাবে?–রুমকির কণ্ঠে একইসঙ্গে উচ্ছ্বাস আর উদ্বেগ।
-হ্যাঁ মা। কাকাও আসবে। বলেই আনমনা হয়ে যায় দীপন। মেয়েটা কাকাঅন্তপ্রাণ। রতনের জন্য তার সীমাহীন উদ্বেগ, অগাধ ভালোবাসা। মানুষ নাকি ফিরে ফিরে আসে পৃথিবীতে। মা কি তবে ফিরে এলো রুমকি হয়ে? ভাবতে ভাবতে চোখে জল জমে দীপনের। আহা। রতন! কত ব্রিলিয়ান্ট ছিলো ভাইটা তার। কত কিছু করার কথা ছিল। শেষে কিনা পাগল হয়ে গেলো ছেলেটা। দীপনের এই ভাবান্তর রুমকির নজর এড়ায় না। সে থমকে গিয়ে বলে, কী হয়েছে বাবা? মন খারাপ? তোমার একা একা কষ্ট হচ্ছে, না বাবা? আমাদের জন্য মন কেমন করছে?
রুমকির কথায় হাসে দীপন। টুকটুক কথা বলে মেয়েটা। পাকনা বুড়ি একটা। রুমকি আর তুলির সঙ্গে কথা শেষে তিতলিকে ফোন দেয় দীপন। আসার পরে তাকে শুধু একবার জানানো হয়েছিল যে ঠিকমতো পৌঁচেছে, তারপর কথা হয়নি আর। রেগে নিশ্চয়ই টং হয়ে আছে তিতলি। ভেবে মৃদু হাসে দীপন। মেয়েটা শুধু ছেলেমানুষ না, বোকাও ভীষণ। কেন যে দীপনকে নিয়ে খামোখা এত উদ্বেগ তার, কে জানে।
তাছাড়া তার জীবনে তুলি অপরিহার্য এক নাম। তুলিকে বাদ দিয়ে একটি দিন কল্পনা করাও অসম্ভব তার পক্ষে। তাহলে কি সে সুবিধাবাদী? তুলিকে সম্পর্কটা গোপন করে সুবিধা নিচ্ছে সে? এই সম্পর্কটা তুলি কিছুতেই স্বাভাবিকভাবে নেবে না, যেমন নেবে না বাদলও। তাহলে তিতলি ও সে, দুজনেই সু্বিধাবাদী, দুজনেই অসৎ।
ঘুমঘুম কণ্ঠে ফোন ধরে তিতলি। অভিমান, রাগ, ক্ষোভ, পারলে সব একসঙ্গে উজাড় করে দেয় দীপনের ওপর। দীপন হাসে। মৃদুকণ্ঠে বলে, একটা জিনিস দেখবে? সব রাগ জল হয়ে যায় মুহূর্তেই। কিশোরীর ঔৎসুক্য ঝরে কণ্ঠে। -কী? বলে উৎকর্ণ অপেক্ষা করে জবাবের। হাসে দীপন। বলে, ভিডিও কল দিচ্ছি, দেখো।
রুমকির মতোই উচ্ছ্বসিত দেখায় তিতলিকে। চোখে-মুখে বিস্ময় ফেটে পড়ে। কী সুন্দর! অত শীতের দেশে শীত করছে না তোমার? সাবধানে থেকো কিন্তু! ঠাণ্ডা লাগিয়ে নিও না একদম। ওখানে তো দেখার কেউ নেই, সতর্ক থাকতে হবে তোমাকে, বুঝেছ?
তিতলির উচ্ছ্বাস শেষে উদ্বেগে গিয়ে ঠেকে। এইই তিতলি। তার সব ভাবনা গিয়ে শেষ হয় দীপনে। মেয়েটার জন্য মায়া হয় তার। অথচ নিয়তি তাদের মাঝখানে অপ্রতিরোধ্য দেয়াল হয়ে হাসে। না। সমাজ নয়। সমাজকে থোড়াই কেয়ার করে তারা। তুলি আছে। আছে রুমকিও। তিতলিরও আছে বাদল। আছে অরুন্ধতি। আসছে আরও একজন। এসবকে অগ্রাহ্য করে, নাকচ করে একসঙ্গে হাঁটার ইচ্ছে কারোরই নেই তাদের। তবু দুজনের বুকের ভেতর বেড়ে ওঠা ভীষণ সত্যি এই বোধটাকেও তো অগ্রাহ্য করতে পারছে না কেউই! তুলির প্রতি ভালোবাসায় একবিন্দু কমতি নেই তার। রুমকির জন্য দিয়ে দিতে পারে পুরো একটি পৃথিবী। তবু কী করে বুকের ভেতর মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে এমন বেয়াড়া এক অনুভূতি ভেবে নিজেই অবাক হয়ে ওঠে দীপন। ভীষণ দোটানায় পড়ে ভেতরে ভেতরে। অথচ তিতলিও অনেকখানি ভাবনাজুড়ে থাকে তার। মাথার ভেতর অনেকটা জায়গা এখন তিতলির দখলে। তিতলি যদিও জানে না খবরটা। তার ধারণা দীপনের ভেতর তার জন্য কোনো অনুভূতি নেই। শুধু সে-ই দীপনের জন্য বয়ে বেড়ায় ভালোবাসার পদ্মপুকুর। হা হা। মনে মনে হাসে দীপন। তিতলির প্রতি জন্মানো তার এই একান্ত ভাবনা সম্পর্কে তথাকথিত নারীবাদী আর নীতিবাগিশদের ভাবনাটাও ধরার চেষ্টা করে। নিঃসন্দেহে তাকে স্বার্থপর, পুরুষতান্ত্রিকতার দাস, মুখোশধারী শয়তান, ইত্যাকার নানান বিষেশণে বিশেষায়িত করতে কোমর বেঁধে লেগে পড়বে তারা প্রত্যেকেই। সেক্ষেত্রে তিতলির বিশেষণটাই বা কী হতে পারে? বেশ্যা? সমাজের হাতের কাছে নারীর জন্য এরচে সহজলভ্য বিশেষণ বিরল। তাদের সম্পর্কটাকেও ’পরকীয়া’ নামে অভিহিত করবে সমাজ, কোনো সন্দেহ নেই। তাহলে দীপন কি তিতলির পর? কিংবা তিতলি দীপনের? প্রশ্নটা তিতলিকে করতে হবে একদিন, ভাবে দীপন। পরক্ষণেই আরেকটা প্রশ্ন উঁকি দিয়ে যায় মাথার ভেতর। তুলি ও বাদল, তার আর তিতলির কাছে তারাও পর কেউ নয়।
তুলি তার একান্ত আপনার, তার বউ। বাদলও তিতলির বর, আপনজনও সম্ভবত। তাহলে কেন তাদের আরও আরও আপনারজন প্রয়োজন হয়ে পড়লো, বিশেষত তুলির? সমাজ এর খুব সহজ এবং নোংরা একটা ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়ে ফেলবে নিমেষেই। তাদের দুজনকে চরিত্রহীন আখ্যা দিয়ে দেবে মুহূর্তেই। কিন্তু ব্যাখ্যাটা আদতে অতটা সরল নয়। তার বা তিতলির কারও জন্যই নয়। সে নিজে তুলিকে ভালোবাসে, বউ হিসেবে, বন্ধু হিসেবে, মানুষ হিসেবেও। প্রয়োজনে, যদি তেমন সময় কখনো আসে, তার আর তিতলির সম্পর্কটা গোপন না করে বরং ব্যাখ্যা করার মতো সততাটুকু সে ধারণ করে নিজের ভেতর। তিতলিও, যতটুকু চিনেছে তাকে দীপন, বাদলের কাছে প্রয়োজনে ব্যাপারটার ব্যাখ্যা দিতে কুণ্ঠিত হবে না, বিন্দুমাত্র সত্য গোপন না করেই। তাদের নিজ নিজ অবস্থান বিবেচনা করেই কোনো হঠকারী সিদ্ধান্ত তারা নেবে না কখনোই। বিশেষত যেখানে রুমকি আর অরুন্ধতির ভবিষ্যৎ জড়িত। তাছাড়া তার জীবনে তুলি অপরিহার্য এক নাম। তুলিকে বাদ দিয়ে একটি দিন কল্পনা করাও অসম্ভব তার পক্ষে। তাহলে কি সে সুবিধাবাদী? তুলিকে সম্পর্কটা গোপন করে সুবিধা নিচ্ছে সে? এই সম্পর্কটা তুলি কিছুতেই স্বাভাবিকভাবে নেবে না, যেমন নেবে না বাদলও। তাহলে তিতলি ও সে, দুজনেই সু্বিধাবাদী, দুজনেই অসৎ। তবু এই বোধটাকে কেন যে সামলে রাখা গেলো না কিছুতেই! কিন্তু তুলিকে কোনো কারণেই অসম্মান করার, অপমান করার কথা স্বপ্নেও ভাবে না সে। হঠাৎ রবীন্দ্রনাথের শেষের কবিতার সেই উক্তিটা মনে পড়ে। ‘কেতকির সাথে আমার সম্বন্ধ ভালোবাসারই; কিন্তু সে যেন ঘড়ায় তোলা জল। প্রতিদিন তুলবো, প্রতিদিন ব্যবহার করবো। আর লাবণ্যর সঙ্গে আমার ভালোবাসা; সে রইলো দীঘি; সে ঘরে আনবার নয়, আমার মন তাতে সাঁতার দেবে।’
বাহ বা। এই তো। মুক্তি। ঠাকুদ্দা তো সব মুশকিল আসান করে গেছেন! সব ব্যাখ্যা তো এখানেই!
নিশ্চিন্তে হাত-পা ছড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়লো দীপন। সকাল থেকে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে কাজে। তুলি বা তিতলি কাউকে ভাবার সময় হবে না সারাদিন। শুরু হবে ইউরোপের ভীষণ কর্মব্যস্ত জীবন। ছুটির দিন ছাড়া শ্বাস ছাড়ার সময়টুকুও মিলবে না একদম।
চলবে…