গঞ্জনপুরের সার্কাসমায়া
তুমি হয়তো ভাবছো-ভুলে গেছে মানুষ! সময় আড়াল হলেও চোখ কিন্তু ভোলে না রাত্রির গহন তামাশা। নদী চুপসে গেলেও রেখাগুলো ইতিহাসের পদচ্ছাপ। আমি এখনো তোমার জমিনের আল বরাবর হাঁটছি।
তোমার কোনো স্বপ্ন নেই। স্বপ্নগুলো বিচূর্ণ আয়নায় ললিতকলা। শাড়ির আঁচলে ঝুলে আছে ধোঁকাবাজি সংসার। তুমি উলঙ্গ হলেই আয়নায় ভাসে ক্লেদাক্ত প্রতিবিম্ব। বসন্তগুলো গঞ্জনপুরের সার্কাসমায়া। তুমি আয়নামতির জল; তারপর আয়নাটি ভেঙে গেলো!
তোমার রাত্রিগুলো এখনো হাত বাড়িয়ে আছে অচেনা সুরের দিকে। বাঁশির ছিদ্র দিয়ে ঝুরঝুর ঝরছে তোমার বিষাক্ত চুম্বন। চোখ বন্ধ হলেই ভেসে ওঠে গঙ্গামতির চর। রাতের শিহরণগুলো কি এখনো লুকিয়ে আছে বালিশের ছায়ায়!
তুমি যখন ছিলে তখনো মানুষ সাঁতার কাটতো। তুমি নেই; তবুও ধানের দুধে মৌমাছির গুঞ্জন ওঠে। আয়নায় ফলিত হয় তুমিবিম্ব; বিজ্ঞানের সূত্রগুলো আরো উজ্জ্বল হয়েছে। তুমিহীন এই চরাচরূআয়নায়; আরও আলোকিত প্রেমালয়।
কিংবদন্তী শাবক
ভুলে যেতে পারলেই ভালো। যারা চলে যেতে চায়, তাদের ধারণ করো না বুকের মায়ায়; ভাসিয়ে দাও ভুলো মনের ছায়ায়; তবুও মনে আসে-ভুলতে চাওয়া নদীর ঢেউ। অনেকদিন পর দাঁড়িয়ে আছে চারুকলার হাসি। লাইটের চোখ চারুলতার মুখ বকুলতলার বুক-ধীরে-ধীরে ছুঁয়ে যায় চলমান স্রোত। এখনো দাঁড়িয়ে আছ পুকুরপাড়ে। তোমার হাতে ঝুলে আছে নিউমার্কেটের বিপণীবিতান।
তোমার চিমটিকাটা হাসি তুরাগ নদীতে স্নান করছে। যেখানে দাঁড়িয়েছিলাম, তা সময়ের ছায়া। লজ্জাবনত ছবিগুলো কাকাতুয়া রোদ্দুর। চারুকলার পেইন্টিংয়ে তোমার ভিন্ন-ভিন্ন ছিন্নভিন্ন মুখ ও মুখোশ নেই; তাতে অবশ্য আমার কোনো অপেক্ষা নেই। আমরা জানি তোমার মুখগুলোই মুখোশের আয়না আর পিকাডিলি সার্কাস।
পিছনের রাস্তায় তোমার পদচ্ছাপ। সামনের আলোয় ময়ূরপেখম। মাঝখানে বৃত্তে-বৃত্তে ঘুরছে বৃত্তহীন প্রতিবিম্ব। প্রথমদিন মধ্যমদিন শেষদিন…তারপরও দাঁড়িয়ে আছে সময়ের দুর্বিনীত কাকলাস। খরগোশ আর কচ্ছপের নীতিশাস্ত্র আমরা ভুলতে পারি না। তুমি বারবার খরগোশের রূপ ধারণ করেছ; কিন্তু তুমি শুয়োর কিংবা গণ্ডারের কিংবদন্তী শাবক। কচ্ছপ ধীরে-ধীরে পেরিয়ে যাচ্ছে তিন শত বছরের টানেল…
মনিকার রোজী সেন
এতদিন কোথায় ছিলে পাখির নীড়ের মতো চোখ তোলে মনিকার রোজী সেন; আর অপলক তাকিয়ে আছে মিরপুরের প্রেমানন্দ বিশ্বাস! হেসে-হেসে উড়িয়ে দিয়েছো চালতা ফলের ঢেউ; কাছেই ছিলাম খুব আড়ালে জানতে পারেনি কেউ। যে নেই দৃষ্টির সীমানায় সে থাকে আড়ালিয়ায়।
চোখের চশমাটা ঠিক করো; উল্টে আছে ব্যানারের বানানের মতো। জানি, সবাই বাবা-মা’কে সবুজ আর ক্লোরোফিলের মতোই ভালোবাসে। তুমি ভালোবাসো জীর্ণ ভিখিরিনীর মতো। প্রয়োজনে বাংলাকে উল্টে দিয়ে হিব্রু-তামিল অথবা উর্দু-ফার্সিতে নামিয়ে আনতে পারো।
তোমার প্রোফাইল আঁধারে ঢাকা। তোমার বাড়ি আমার বাড়ি; মাঝখানে বয়ে গেছে সরল নদী। আমরা জল ছুঁয়েছি; নদী তার সাক্ষী। কিন্তু তোমার প্রয়োজনে গণিত হয়ে যায় দোকানের সস্তা মাল; আর বাড়ির পেছনে উড়ে যাওয়া ছাই হয়ে যায় স্বর্ণলতাগ্রাম। ‘তোমার-আমার’ মিল গ্যালাক্সি-গ্যালাক্সি দূরত্ব।
আমার আপনজন তুমি চিরদিনেরূকতোবার বলেছো এই ভয়ঙ্কর মিথ্যাটি। বিমানবন্দর থেকে শতবার উড়িয়ে দিয়েছ তোমার বিয়ের পতাকা। বারবার কবিতার মতো আবৃত্তি করেছ-আমি হতে চাই তোমার সন্তানের জননী; আর তুমি হবে আমার সন্তানের পিতা। অথচ দেখো এখন সকল বক্তা নীরব হয়েছে বোবা গাছের মতো। তুমি কি এখনো আইপিল কিনার জন্য ফেরারি সন্ধ্যায় জনারণ্য রাস্তা ছেড়ে নির্জন গলিপথে ঘুরছ!
হলুদনিয়ন কাম
টেবিলে হাত রাখতেই গাজর লাফিয়ে উঠলো
টমেটোর সস গড়গড় করে গড়িয়ে পড়লো,
মুখোমুখি তাকিয়ে রইলো অবোধ চোখের দৃষ্টি
অপেক্ষার ইথারে ঝরছে লাল-নীল বৃষ্টি;
দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে রাবারের রাতদিন
কামনার জলে জ্বলে প্রেমের-কামের আলপিন,
ডাকঘর-ডাকঘর খুঁজে-খুঁজে হারিয়ে যাচ্ছে ডাকপিয়ন
অলিখিত চিঠিগুলো ক্ষয়ে-ক্ষয়ে হয়ে যাচ্ছে হলুদনিয়ন;
জরস্থ কপালে এলোমেলো আঙুলের মখমল ওম
করমিলনের লেবুঘ্রাণে জলসিক্ত বিন্দু-বিন্দু ঘাম,
করসন্ধি চুঁইয়ে-চুঁইয়ে পড়ছে অনিশ্চিত অসম কাম;
গাজর-টমেটো হবে একদিন পাটাতনে অন্তর্যাম।
ফালুদার মেলোড্রামা
আইসক্রিমের মতো ঠাণ্ডা তোমার মুখ
তোমার চুলে কৃত্রিম বাতাসের সংসার,
তুমি আগের চেয়ে মসৃণ-মনোলোভা হয়েছো
কিন্তু ভিজে গেছে তোমার একাকী বালিশ;
ছেলেটি আগুনের ঢেউ-মেয়েটি বৃষ্টির ছোঁয়া
তুমি কি নির্জন পাহাড়ের শব্দ শুনতে পাও!
আমি বাঁশি হয়েছি তোমার সিথানে,
আমরা ‘তুমি’ হবো সমুদ্র-স্নানে;
তোমার যাপিত জীবনে পুঁটি মাছের হইচই
তুমি কি কখনো স্বপ্নে সূর্যসন্তান দেখেছ!
ফালুদার বাটিটি এখনো তোমার অপেক্ষা করছে
তোমার নামে গেঁথে আছে মেরি ওলস্টোনক্রাফ্ট;
অংকটা এখানেই শেষ না-মেলোড্রামা চলছে
তুমি রেগে গেলে জাহাজের ডেকে রাত্রি নামে,
বলটি ঘুরছে সারা মাঠজুড়ে-নির্বোধ দর্শকের হাততালি
তোমার নির্মিলিত চোখে থোকা-থোকা কাজলফুল;
তোমার মৌন কপালজুড়ে দীর্ঘ কথোপকথন
বাম হাতের ঘড়িটি টাইম স্কয়ারের জীবন,
তুমি যা নিয়ে এতো ব্যস্ত আছো-উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী
কোনোদিন শুনতে পাবে না; আমার করতলে তোমার চড়ুইভাতি খেলা।
হারানপুরের গান
পুনর্বার তোমাকে আর চিনতে চাই না
আর যেতে চাই না পুরাতন পুকুরঘাটে
আর চাষ করতে চাই না স্যাঁতস্যাঁতে জমিন
আর ফুল কুড়াবো না প্রাচীন বেলতলায়,
ভোরে-ভোরে জাগবে না ময়নামতির চর;
তুমি চলে গেলেই-সারা আঙিনাজুড়ে সূর্য উঠবে
টিউবওয়েলের লেদার আর নষ্ট হবে না
কদমফুল হাসতে থাকবে অনাবিল দুপুরে,
আমাদের নদীতে জোয়ার আসবে মাসে অন্তত তিনবার
অনাগত শিশুরা মিথ্যার আশ্রয়ে বেড়ে উঠবে না;
বুকের পিঞ্জরে যে-পাখি বাসা বাঁধে, সে-পাখি
গান গেয়ে-গেয়ে ঘুমায়-সে আমার একলা পাখি,
তোমার জন্য আকাশের প্লেনশিটে নিঝুম ভোর নামে,
তোমার জন্য একজন খুনিও ফুলের বাগান সাজায়;
যে-তুমি হারানপুরের গান-সে-তুমি বহুদূরের ছায়া
তোমাকে আর জ্যোৎস্না দেখাবো না ব্লু-ম্যারিন ছাদে,
এখন তোমার জন্য অপেক্ষা করবে তাঁতীবাজারের কসাই;
চাপাতির ধারালো ঠোঁটে রক্তাক্ত হবে তোমার লকলকে জিহ্বা।