[পর্ব-১৪]
মুক্তির গান
লিয়ার লেভিন ছিলেন আমেরিকার সফল বিজ্ঞাপন নির্মাতা। যুক্তরাষ্ট্রের সেরা ১০ বিজ্ঞাপন নির্মাতার একজন ছিলেন তিনি। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ বিশ্বের প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় বেশ গুরুত্ব পায়। প্রায় প্রতিদিন বিশ্বের নামিদামি সংবাদ মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের খবর, ফিচার, প্রবন্ধ, নিবন্ধ ও গণহত্যার ছবি প্রকাশিত হতে থাকে। সিবিএস, এনবিসির মতো চ্যানেলগুলো মুক্তিযুদ্ধের সময় ব্যাপকভাবে বাংলাদেশকে কাভার করেছে। এগুলো ছিল নিউজ রিল। এসব চ্যানেলে প্রতিদিনই দুই থেকে পাঁচ মিনিটের ফিচার ধরনের প্রতিবেদন প্রচারিত হতো। ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে অনুষ্ঠিত ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ সারা পৃথিবীতে অভূতপূর্ব সাড়া ফেলে দেয়।
এই ঘটনাপ্রবাহ তরুণ বিজ্ঞাপন নির্মাতা লিয়ার লেভিনের সংবেদনশীল হৃদয়ে প্রবল অভিঝাতের সৃষ্টি করে। তিনি বাংলাদেশের জনগনের অপরিসীম দুর্দশায় ব্যথিত হতে থাকেন। ঠিক ওই সময়ে লিয়ার লেভিন ও তার স্ত্রী তাদের প্রথম সন্তানকে বরণ করার জন্য উদগ্রীব ছিলেন। এরপরও তিনি চুপচাপ বসে থাকতে পারলেন না। স্ত্রীকে একা রেখে চলে এসেছিলেন। লেভিন ৫০ হাজার ডলারের আর্থিক সামর্থ্য, আধুনিক ক্যামেরা ও শ্যুটিংয়ের ছোট্ট ইউনিট নিয়ে আমেরিকা থেকে দিল্লি হয়ে কোলকাতায় চলে আসেন। ১৯৭১ সালের অক্টোবর মাস তখন। আমেরিকান বলে সিআই-এর চর ভেবে একজন সন্দেহভাজন ব্যক্তির তালিকায় রাখা হয়। মাত্র ছয় সপ্তাহ ভারতে থাকার অনুমতি পান তিনি। শরণার্থী শিবিরের মধ্যেই তার চলাচলকে সীমিত করে রাখা হয়।
আবেগপ্রবণ, উদ্যোগী লিয়ার লেভিন এত বিধিনিষেধ মানতে পারেননি। একদিন শরণার্থী শিবিরের বাইরে চলে যান শ্যুটিং করতে। এর জেরে তিনি দণ্ডপ্রাপ্ত হন। তাকে একদিন একরাত হাজত বাস করতে হয়। এভাবে বাঙালিদের কথা সেলুলয়েডে ধারণ করার জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করেন তিনি। কাজের মধ্যে ডুবে থাকতে থাকতে লিয়ার লেভিন ‘বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রামী শিল্পী সংস্থা’র ট্রাকটি দেখে ফেলেন। সেই দিন থেকেই তিনি এই গানের দলের সঙ্গে ঘুরতে থাকেন শরণার্থী ক্যাম্প থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে। অক্লান্ত পরিশ্রমী এই আলোকচিত্রশিল্পী তার ৩০তম জন্মদিন (নভেম্বর ১০) পালন করেন গোলাবারুদের গন্ধের ভেতর বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে। লিয়ার লেভিন প্রায় ২০ ঘণ্টার ফুটেজ শ্যুটিং করে ফেলেন।
একাত্তরের ৩ ডিসেম্বর সর্বব্যাপী যুদ্ধের প্রাক্কালে লেভিনকে ভারত ত্যাগে বাধ্য করে ব্যুরোক্রেসি। বিশ্বের অন্যতম সিনেমাটোগ্রাফার, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের এক মহৎপ্রাণ বান্ধব, জাতির অভ্যুদয়ের সাক্ষী হতে পারলেন না। লেভিনের আশা ছিল পাকিস্তানিদের সহিংসতার কথা আমেরিকানদের জানাতে ‘জয় বাংলা’ নামে একটি প্রামাণ্য চিত্র নির্মাণ করবেন। আর সেটা হবে নিউজরিলধর্মী ছবির চেয়ে আলাদা কিছু, শৈল্পিক কিছু। যা এই অঞ্চলের মানুষের সংগ্রামের ভেতরের শক্তিটাকে আবিষ্কার করবে। তার সংবেদনশীল প্রতিভার ছোঁয়ায় বাংলা ও বাঙালির হৃদয়স্পন্দন মুদ্রিত হবে সেলুলয়েডে। নিউইয়র্ক ফিরে গিয়ে অজস্র ফুটেজ ঘেঁটে, প্রচুর কেটেছেঁটে আমেরিকার দর্শকদের জন্য ছবিটির একটি সম্পাদিত রূপ দাঁড় করান। নাম ‘জয় বাংলা’। জয় বাংলা ছবিটি অনেকটা সঙ্গত কারণেইড মানবতাবাদী। সেখানে বাংলাদেশের মানুষের অন্তর্গত শক্তি আর সৌন্দর্যের গাথাই মূর্ত হয়ে ওঠে, আর যুদ্ধ ছিল অনেকটা আবহমান দৃশ্যপট। তিনি চেয়েছিলেন এটি গতানুগতিক প্রামাণ্যচিত্রে মতো হবে না। সরল অথচ সংঘবদ্ধ একটি গল্প তিনি বুনেছিলেন। জয় বাংলা ছিল মূলত মার্কিন দর্শকদের রুচির কথা ভেবে তৈরি করা। দুঃখের কথা হলো, লিয়ার লেভিনের ছবিটি কখনোই তার কাঙ্ক্ষিত দর্শকদের কাছে পৌঁছাতে পারেনি। তার আমেরিকা প্রত্যাবর্তনের কিছুদিন পরেই যুদ্ধ থামে, বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করে। সম্পাদনার পেছনে মাসখানেক খাটাখাটুনির পর লিয়ার দেখলেন, বাংলাদেশকে নিয়ে উৎসাহের যে জোয়ার ছিল, তাতে ভাটা পড়ছে। এখন আর কে তাকে অর্থ জোগান দেবে? এভাবেই তার সব উদ্যোগ সেল্ফবন্দি হয়ে পড়ে রইলো বেসমেন্টে প্রায় ২০ বছর।
নব্বইয়ের দশকে তারেক মাসুদ ও ক্যাথরিন মাসুদ ছিলেন আমেরিকায়। তারেক মাসুদ তখন ‘স্ট্রান্ড বুকস’ নামক একটা বড় বইয়ের দোকানে কাজ করতেন। ওই দোকানটা ছিল সম্ভবত নিউ ইয়র্ক শহরের সবচেয়ে বড় পুরনো বইয়ের আড়ত৷ এই দোকানটি ছিল পাঁচতলা।তখন তারেক মাসুদ ও ক্যাথরিন মাসুদ তখন স্ট্যাটেন আয়ল্যান্ড নামা এক দ্বীপে বাসা নিয়ে থাকতেন। বাসাটি ছিল কাঠের ঘর। তারেক মাসুদ ভালো রান্না করতে পারতেন। কাঠমিস্ত্রীর কাজটাও খুব ভালো করতেন। নিজের বাসার ছোটখাটো মেরামতের কাজ তিনি নিজেই করতেন। কখনো কখনো ভাড়াও যেতেন।
শিল্পী মাহমুদুর রহমান বেণু ছিলেন তারেক মাসুদের চাচাতো ভাই। মাহমুদুর রহমান বেণুর কাছে লিয়ার লেভিনের শ্যুটিংয়ের খবর তারেক মাসুদ পেয়েছিলন। কিন্তু লেয়ার লেভিন কোথায় আছেন, বেঁচে আছেন কি না—এসবের কিছুই তারা জানতেন না। শুধু জানতেন, লেয়ার লেভিন ২০ঘণ্টার শ্যুটিং করেছেন, তা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের এক প্রাসঙ্গিক মানবিক দলিল। তারেক মাসুদ ও ক্যাথরিন মাসুদ নেমে পড়লেন এক অতি দুরূহ সন্ধানকর্মে প্রত্নতাত্ত্বিকের ধৈর্য আর নিষ্ঠা নিয়ে। তারা শুরু করলেন আমেরিকার টেলিফোন ডিরেক্টরির মাধ্যমে। বিশাল বিশাল টেলিফোন ডিরেক্টরির Lবর্ণমালার পাতায় চলে যান। আর লিয়ার লেভিন নামে কাউকে পেলেই রিং দেন। কেউ টেলিফোন ধরলেই তারেক দম্পতি বিনীতভাবে প্রশ্ন করেন, ‘স্যার, আপনি কি লিয়ার লেভিন?
—বলছি।
—স্যার, আপনি কি ১৯৭১ সালে ভারত গিয়েছিলেন?
—না।
চলবে…