[পর্ব: ১২]
আদম সুরত
সুলতানকে নিয়ে ছবি বানানোর ইচ্ছের শুরুর দিক থেকেই তারেক মাসুদের সঙ্গে বিখ্যাত ফটোগ্রাফার আনোয়ার হোসেনের কাজ করার কথা ছিল। কিন্তু যখন তারেক মাসুদ কাজ করার দিনক্ষণ ঠিক করলেন, ঠিক তখনই আনোয়ার হোসেন ইউনেসকোর স্টিল ফটোগ্রাফির একটা অ্যাসাইনমেন্টে চলে যান। কিন্তু তারেক মাসুদের কাজটা পেছানোর কোনো উপায় ছিল না। কারণ তার কাজ করার আবেগ তখন তুঙ্গে। এছাড়া, সুলতান তখন খুবই অসুস্থ হয়ে পড়েন। এ কারণেই তাড়াহুড়া করা।
তারেক মাসুদ একদিন পুরনো পল্টন দিয়ে রিকশায় যাচ্ছিলেন। তার বন্ধু ফটোগ্রাফার মিশুক মুনির অন্যদিক থেকে রিকশায় আসছেন। তারেক মাসুদ তার রিকশা থামিয়ে মিশুক মুনিরের রিকশাটা আটকে দাঁড়ালেন। মিশুক মুনিরকে জানালেন, তিনি শেষপর্যন্ত ছবিটা করছেন। আনোয়ার হোসেন যেতে পারছেন না। কিন্তু তিনি যাবেনই।
সুলতান গণমাধ্যম বা ক্যামেরার সামনে আসতে রাজি হতেন না। তবে, শেষপর্যন্ত যে শর্তে রাজি হলেন, তা হলো, তিনি যেন ছবির প্রধান বিষয়বস্তু না হন। তিনি বলেছিলেন, ‘আমি বরং নিমিত্ত, আমাকে উপলক্ষ করে আপনারা বরং গ্রাম-বাংলার কৃষকের ওপর ছবি বানান। আমি আপনাদের সঙ্গে ক্যাটালিস্ট হিসেবে থাকবো।’
সে শর্তে রাজি হয়ে সুলতানকে কথা দিয়েছেন তারেক মাসুদ, অনেক কষ্টে রাজি করানো গেছে, এখন যদি তিনি না যান, তাহলে পরে সুলতান রাজি না ও হতে পারেন। মিশুক মুনির বললেন, ‘যাই চলো, কিন্তু আমি তো ক্যামেরা চালাতে জানি না।’
তারেক মাসুদ হেসে বলেছিলেন, তিনিও ছবি পরিচালনা করতে জানেন না। দুজনে মিলে সিদ্ধান্ত নিলেন, তারা গাড়িতে যেতে যেতে শিখে নেবেন। মিশুক মুনিরের একটা আমেরিকান সিনেমাটোগ্রাফারস ম্যানুয়াল ছিল। ম্যানুয়ালটা সারাপথ পড়তে পড়তে আসলেন তারা। মিশুক মুনিরের ক্রাংক ক্যামেরা ছিল। কিছুক্ষণ দম দিয়ে সর্বশেষ ১ মিনিট বা ২ মিনিটের শর্ট হতো। ফিল্মে Spool ছিল ১০০ ফিটের। ২ মিনিটের মধ্যে ফিল্ম শেষ। আবার ফিল্ম বদলাতে হতো। দুই জনে রওনা হয়ে গেলেন স্বপ্ন পূরনের পথে কিন্তু মিশুক মুনির শিখছেন, কিভাবে ক্যামেরা সেট করতে হয়।
এদিকে, তারেক মাসুদের হাতে কোনো চিত্রনাট্য নেই। তিনি নিজেই বলতেন, যে দিক থেকেই হোক, পাকামোর জন্যই হোক, আমি ভেবেছিলাম কোনো চিত্রনাট্য থাকবে না ছবিতে। আমি যা পাবো, যেটা স্বাভাবিক হবে, সুলতান যা করে তাকে অনুসরণ করবো। সুলতান যেখানে যাবেন, তাকে অনুসরণ করবো। একটা free fluid এবং open canvas এর মতো। আদম সুরত-এর চিত্রনাট্যকে তারেক মাসুদ ‘চিত্রনাট্য’ না বলে ‘নাট্যহীন চিত্র’ বলতেন। যদিও কোনো ধরাবাঁধা চিত্রনাট্য ছিল না। কিন্তু গাইডলাইন ছিল। চূড়ান্ত ছবিতে ভোর থেকে রাতের যে ধারাবাহিক কাঠামো রয়েছে, গোড়াতেই তা লেখা ছিল। সকাল-দুপুর-বিকেল-সন্ধ্যা-রাতের ধারাক্রমটা অনুসরণ করতে চেয়েছিলেন তারেক মাসুদ। ছবিতে কী থাকবে আর কী থাকবে না, তার একটা বিস্তারিত তালিকাও ছিল। যেমন, বিশেষজ্ঞ বা চিত্রসমালোচক অথবা সুলতানের ঘনিষ্ঠ সহকর্মী বা চিত্রশিল্পীদের সাক্ষাৎকার থাকবে না। আদি পরিকল্পনা ছিল ধারাভাষ্য একদমই থাকবে না। সম্পাদনার পর্যায়ে এসে অবশ্য সীমিত ধারাভাষ্য ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নেন তিনি।
আলি মোরশেদ নোটন ও আর্ট কলেজের এক বন্ধু (যার বাড়ি যশোরে) আরিফুল হক পিয়াল শেষের দিকে তারেক মাসুদের সঙ্গে যোগ দেন কাজে। তখন যে অবস্থার মধ্যে তারা থেকেছেন, তারেক মাসুদের মনে হয়েছে ফটোগ্রাফার আনোয়ার হোসেনের মতো বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষ না আসায় খুব ভালো হয়েছে। যে অবস্থায় তারা খেতেন, থাকতেন, মাথার ওপরে ছাদ নেই, ভাঙা দালান, সত্যিকারের সাপ, বাদুড় থেকে শুরু করে ব্যাঙ, মুরগির বিষ্ঠা, ২২টা বিড়াল আরও কতো কী! ক্যানভাসগুলো ছিল তাদের বিছানা।
তারেক মাসুদ ইচ্ছে করেই অনেক ভয়াবহ বিষয় বাদ দিয়েছেন, যেগুলো দেখতে খুব Exotic লাগবে। কারণ, সবটা রাখলে সেটা সুলতানের বর্ণাঢ্য জীবনের দিকে চলে যাবে। তাই সেদিকে তারেক মাসুদ যাননি। শুধু বিড়ালগুলো রেখেছিলেন। মিশুক মুনির ইতস্ততা করছিলেন শ্যুট করতে। কিন্তু তারেক মাসুদ মিশুক মুনিরকে বললেন, যত কাঁচা হাতই হোক না কেন তিনি মিশুক মুনিরকে দিয়েই শ্যুট করাবেন। যেভাবে সুলতান চেয়েছেন, সেভাবেই কাজ করেছেন তারেক মাসুদ। তাতে যত সময়ই লাগুক না কেন, কোনো ব্যতিক্রম করেননি তিনি। যখন ক্যামেরা বন্ধ করতে বলেছেন, ক্যামেরা বন্ধ করে রেখেছেন তারেক মাসুদ। সুলতান যখন বলতেন, তখনই শ্যুটিং করা হতো। সুলতান হয়তো বলতেন, চলুন বিজয় সরকারের বাড়ি ঘুরে আসি।
তারেক মাসুদ সঙ্গে ক্যামেরা নিয়ে যেতে চাইলে সুলতান বলতেন, রাখুন না ক্যামেরা, যন্ত্রটন্ত্র থাকুক।আপনার ক্যামেরা দিয়েই কাজ হবে। কিন্তু বিজয় সরকারের বাড়িতে গিয়ে যে অভিজ্ঞতা হবে, সেটা আর উপলব্ধি করতে পারবেন না। সবাই মিলে সুলতানের সঙ্গে বের হয়ে যেতেন ঘুরতে। তার সঙ্গে ঘুরতে হতো তার মতো করেই। সব সময় সুলতানের শ্যুটিং করলে সুলতান বিরক্ত হতেন। বলতেন, ‘ছবি থেকে জীবন অনেক বড়।’ এভাবে সপ্তাহের পর সপ্তাহ তারা কাটাতেন। সুলতানের আশকারায়, উসকানিতে প্রচুর অর্থ, সময়, ফুটেজ ব্যয় করেছেন তারেক মাসুদ। বিভিন্ন লোকজ উৎসব, যেমন— কুমিল্লার পাগলার মেলা থেকে শুরু করে চট্টগ্রামের মাইজভান্ডারি, তারপর কুষ্টিয়া থেকে শুরু করে ময়মনসিংহের বিভিন্ন উৎসব, ফরিদপুরের নৌকাবাইচ, ধামরাইয়ের রথযাত্রা—যেখানেই শুনতেন লোকসংস্কৃতির কোনো যজ্ঞ চলছে, সেখানেই ক্যামেরা হাতে হাজির হয়ে যেতেন তারা। কিন্তু ছবি শেষ করতে হবে তা নিয়ে কোনো মাথাব্যথা তাদের ছিল না।
চিত্রা নদী দিয়ে আদম সুরতের দৃশ্যের শুরু, শেষ দৃশ্যের আগেও দেখানো হয়েছে চিত্রা নদী।
সুলতান এই চিত্রা নদীকে প্রচণ্ড ভালোবাসতেন। চিত্রা নদীতে প্রচুর স্রোত। তারেক মাসুদ বলেন, ‘এমন স্রোত অন্য নদীতে সাধারণত দেখা যায় না। সেই স্রোতে নৌকা ভেসে চলছে, সুলতান বসে আছেন সিঁড়িতে। এই চিত্রা নদীকে ভালোবেসে, মাটির টানে মূলত সুলতান তার যশ, খ্যাতি ফেলে ফিরে আসেন।’
১০০ ফিটের ফিল্ম, ১০০ ফিটের মধ্যেই দৃশ্যটা সিকুয়েন্স করতে হবে। দুই থেকে আাড়াই মিনিটের সময়। কিন্তু এত সুন্দর সুন্দর নৌকা যাচ্ছিলো নদী দিয়ে, সেই দৃশ্য কয়েকবার ধারণ করতে করতে বিকেল হয়ে আসছিল।
সুলতানকে নিয়ে একটা মাস্টার শট নেওয়ার কথা ছিল। সুলতান নদীর পাড়ে বসা, আলো কম থাকলেও ক্লোজআপের জন্য লাইট যথেষ্ট থাকবে ভেবেছিলেন তারেক মাসুদ। কিন্তু যখন ক্লোজআপটা নিতে যাবেন, তখন দেখলেন ফিল্মের স্টকও প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। আর আলোও শেষ। এমন ঘটনা বহুবার ঘটেছে।
তারেক মাসুদ তার ‘আদম সুরত’ চলচ্চিত্রে দুইটা দিক তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। প্রথমত, এস.এম সুলতানের দার্শনিক জায়গাটা তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। তিনি মনে করতেন, বড় বড় অনেক শিল্পী আছেন, কিন্তু সবার মধ্যে এই দার্শনিক জায়গাটা থাকে না।
দ্বিতীয়ত, শুধু সুলতানের জীবন বোধ নয়, তার জীবনের যে বৈশিষ্ট্য, তার সঙ্গে তার শিল্পের যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক, এটাই তারেক মাসুদকে সবচেয়ে বেশি আকৃষ্ট করেছিল। আর এটাই তিনি ‘আদম সুরত’ চলচ্চিত্রে ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছেন।
চলবে…