ঠায় বসে আছি। কোনো নড়াচড়া নেই। চাইলেই গড়াতে পারি না। মাঝে মাঝে কিছু শব্দের উঁকিঝুঁকি আমার কাছে-পিঠে এসে পড়ে। একটা দেয়ালের ভেতর বড় হচ্ছি। হ্যাঁ, এই আমি, এক পোয়া আমি। মাটিগন্ধা চারপাশে এভাবেই আছি, আছে ভাবনা শত শত। বাইরে বিশাল মাঠ, মানুষের আগাগোনা। শুধু শুনতে পাই, দেখতে পাই না কিছুই।
ভেতরটা লাল! ঠিক তেমনটা নয় যে, গোলাপের পাপড়ি লাল। আবার রক্তের লালও নয়। আগুনের ফুলকি ভেবে যে লালা রক্তাক্ত হয়, সেই লালাও নই আমি। মিহিদানা চিনির ওপর যে পিঁপড়াজোড়া হেঁটে বেড়ায়, ওদের মতো কেউ নই আমি। আহা কী এক জমাট লালে জন্ম আমার, এতদিন তাতেই ডুবে ছিলাম! কতদিন মনে নেই, ঠিক কতদিন—আমার সত্যি মনে নেই। মাসখানেক হতে পারে, আবার নাও হতে পারে। তরমুজ বলে চেনে যাকে লোকে, এমন একটা তরমুজের ভেতর জন্ম আমার। বেড়ে ওঠা আর আমার বেঁচে থাকা এই সবুজাভ পাঁচিল ঘিরেই। একটু একটু করে পুঞ্জিভূত জলকণার আমি ছোট থেকে বড় হলাম সবুজ মায়ার এ দেয়ালঘেঁষে। আমার মাঝে আছে বীজ, আবারও জন্ম নেওয়ার আকুতি নিয়ে মাঝে কথা হয় তার সঙ্গে। আমি তাকে ভাসাই আবার কাঁদাই। সেও উল্লাসে আমাকে জাপটে ধরে। আমি নীরবে ভাসি। এক পোয়া আমি জলের জলকণা, লাল কি লালের কাছাকাছি কোন রঙ, তাই বুঝতে পারিনি তখনো সবুজ মায়ার দেয়ালের ভেতর।
মাটি-কাদা-রোদ-বৃষ্টির বাহুপাশে হাওয়ার দোল খেতে খেতে একদিন শুনতে পাই চাষিদের উল্লাস! হুম, আমরা বিক্রি হয়ে গেছি! এ পুরো ক্ষেত কিনে নিয়েছে শহরের কোনো এক আড়তদার। একে একে আমাদের তুলে নেওয়া হচ্ছে। প্রতিবেশী ছোটবড় তরমুজ ফলের চলে যাওয়া শুনি। আমি আমার অপেক্ষায় থাকি। হয়তো কাল কিংবা পরশু, আজও হতে পারে আমার বিদায়কাল। আমাদের মাঝে কাউকে উপড়ে ফেলার শব্দ শুনতে শুনতে এলো আমার পালা। ঠিক কেমন বোঝাতে পারছি কি! এই এক মিশ্র অনুভূতি, এই মাটি-কাদা-রোদ-বৃষ্টির মাঝে যে জমিন একদিন আমাকে তার বুকে জায়গা দিয়েছিল, আজ তার বিদায়ের পালা। কী এক মমতার বাঁধনে জড়িয়ে ছিলাম, সে-ই আজ আমাকে ছুটি দেবে—যে ফলাবে অন্য কোনো ফল, অন্য কোনো ঋতুতে।
শুনতে পেলাম একটা হলুদ ট্রাকে আমাদের জায়গা হয়েছে। একটু ওপরের দিকে। আমি তখনো দেখতে পাই না পৃথিবীর আলো, যা কিছু শুনতে পাই, তা শুধু আমাকে ঘিরে থাকা এই সবুজ দেয়ালটির কাছে। তার আছে ভেতর ও বাইরে দুটো চোখ, আছে কান, আছে শব্দ পৌঁছে দেওয়ার কণ্ঠও আমাদের মাঝে! সে সুধালো আমরা মাঠের পর মাঠ আর গ্রামের পর গ্রাম পেরুচ্ছি। তারপর রাত পোহালে শহরের অলিগলি ঘুরে এসে খোলাবাজারে পৌঁছে যাই আমরা একদল তরমুজ ফল। আমাকে ঘিরে থাকা সবুজ দেয়ালের সুঠাম গায়ে আঁচড় পরে, হঠাৎ! ভেতরে আমরা নড়ে-চড়ে বসি। এক পোয়া আমি আর আমার মাঝে আটকে থাকা গুটিকয়েক বীজ। হয়তো দোকানির অসাবধানতায় আমাদের দেয়ালে দাগ লেগে গেছে। দামদর শুনি, কিন্তু বিক্রি হয় না এ তরমুজের। পড়ে রইলাম দোকানঘরে! এর দুদিন পরে এক লোকের কাঁধে করে চলে এলাম তার ঘরে। কোনো মাঠের পাশে ছোট্টঘরের এক কোণে পড়ে আছি। সারাবেলা। বাচ্চাদের হল্লা শুনি, তাদের মায়ের বকুনিও।
ওদের মা দিন শেষে ফিরে এসে ক্লান্ত মুখে একটা ছুরি এসে বসায় আমার পেট বরাবর। তরমুজটা দুই ফালি হতে হতেই একটা খোলা পৃথিবী দেখতে পেলাম। এই প্রথম! আহা, এই আলো, এই বাতাস, কী শান্তি! এতদিনের শুনে থাকা এই পৃথিবীর ঝিমিয়ে পড়া কোনো বস্তির আলো-আঁধার আজ আমাকে মুক্তি দিলো অবশেষে! একটা থালা ভর্তি করে জমা হচ্ছি আমি ও আমরা। টুকরো টুকরো আমাদের তুলে মুখে তুলে নিচ্ছে ওদের বাবা, মা, ছেলেমেয়েরা। বাচ্চাগুলো নোংরা হাতে খেতে গিয়ে কিছুটা পুঞ্জিভূত এই আমাকে মাটিতে ফেলে পা দিয়ে মিশিয়ে দিচ্ছিল বারবার। মায়ের চোখ এড়িয়ে ওরা আমাকে খানিকটা জামায় লুকিয়ে মুছেও নিয়েছে দুটো হাত। একটু একটু করে ফুরিয়ে যাচ্ছি আমি। স্বাদে কিংবা মিষ্টি গন্ধে আমি চলে যাচ্ছি অন্য কোথাও। এই আধখানা তরমুজের পেয়ালায় তখনো আমার খানিকটা লাল লেগেই আছে।
রাতে উচ্ছিষ্ট এই আমাদের ওরা বস্তি ঘরের বাইরে ফেলে রেখে ঘুমিয়ে পড়ে। কিছু বীজ তখনও ভেসে আছে আমার মাঝে। আর আমরা একসঙ্গে তরমুজের ক্ষতবিক্ষত পেয়ালায় ঠাঁই নিয়ে খোলা আকাশের দিকে চেয়ে আছি। ভোরের আলো ফোটার আগেই বীজের নিঃশ্বাস টের পাই আর আমার ঘুম ভেঙে যায়! মিশকালো বীজ! যে আবারও জন্মের আকুতি নিয়ে মাটির কাছে যেতে চায়, বুকের গভীরে মিশে যেতে চায়! আর আমি? আমি কী চাই? তখনো জানি না কিছুই। বৃষ্টি হবে বলেই আকাশে মেঘের ছুঁই ছুঁই কান্না। চেয়ে থাকি উঁচুতে মেঘের ঘরের দিকে চোখ। যদি বৃষ্টি হয়! অবেশেষে হলো বৃষ্টি। আমাদের আধপেয়ালায় এসে জমা হয় মেঘের ঝিরঝির। পেয়ালা ভরে গেলো! নিজেকে দেখি, তখন কী আমার রঙ? লাল কিংবা গোলাপি? কেউ বলে না। টুপটাপ টুপটাপ বৃষ্টি পড়ে। আমি মিশে যাচ্ছি অন্য কোনো জলে! যার স্বাদ মিষ্টি না হয়েও মিষ্টি! অনভ্যাসে আমি মিশে যাচ্ছি কারও সঙ্গে! আমি মাথা ঠুকতে-ঠুকতে জানতে চাই—এই এখন আমার গায়ের রঙ কী? কী আমার পরিচয়? নিদেনপক্ষে গোলাপি তো? এরইমাঝে বৃষ্টিকণা আমার সঙ্গে মিলে মিশে আধভাঙা পেয়ালায় ঠাঁই নিয়েছে। স্বচ্ছ এ জলকৌটায় মাথার ওপর একটা ভাঙা টিনের বেড়া কী দারুন সখ্যে দূরে রাখে সব ধুলার লুটিপুটি। আমাদের ছোঁয় না কোনো ধুলোর ঝড়। আজ দুদিন হলো! আছিতো বেশ, মাঠের ওপাশে দেখতে পাই খেলছে ওরা। বাচ্চাগুলোর হাসি শুনতে শুনতে আমাদের বেঁচে থাকা এ পৃথিবীটা আরো মায়াময় হয়ে ওঠে। মনে হয় কোনো একদিন যদি সত্যি খেলতে পারতাম ওদের মতো দিনভর, মায়ের বকুনি খেয়েও আমি খেলতাম, আহা কোনো একদিন! বেঁচে থাকতে ইচ্ছে হয় আরও, এইখানে এই আধপেয়ালায়।
বিকেলে কী যে হলো—আমি ঝিমিয়ে পড়তেই কোথা থেকে কিছু মশা এসে আমাদের ধারে কাছে ঘুরে গেলো। শুনেছি এই পতঙ্গ পাড়াময় মানুষের রক্ত শুষে বেড়ায়! এরপর হঠাৎ টের পাই, একটি মশা তার বাদামি লার্ভা আমাদেরই স্বচ্ছ শরীরে টুপ করে রেখে দিয়ে চলে গেছে! সবুজ আধপেয়ালা তখনই আমাকে শুধায়, এ পতঙ্গ মৃত্যু ভালোবাসে, শরীরে বাসা বেঁধে রক্তের হোলি খেলে রোজ! কী করি তবে? কী করার আছে এই ক্ষতবিক্ষত পরিত্যাক্ত তরমুজ পেয়ালার? তখন জীবনচক্রে এটুকু লার্ভা প্রতিমূহূর্তে আমাদের জলে-জমিনে বড় হতে থাকে! আমরা আমাদের মৃত্যু কামনা করি প্রতিমুহূর্তে! আমি ও আমরা শেষ হয়ে যেতে চাই, কোনো ঝড়ে, নয়তো বাতাসের দৌরাত্ম্যে! কিন্তু না! থেমে থাকে না মৃত্যুনেশা, এডিস নামের এ পতঙ্গ খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে। আমি মানতে পারি না, এক পোয়া আমি, মিশকালো বীজ আর আধপেয়ালার জীবনসঙ্গে পাপের বেদনায় ঘন হয় বিষ। সব প্রশ্ন ম্লান করে দিয়ে একটা রঙবিহীন পৃথিবীতে কী আছে বলো? এইসব শিশুর হাসিখেলা বাঁচিয়ে রাখতে লাল কিংবা গোলাপি আমি নিঃস্ব হয়ে যেতে কেন পারছি না? কোথাও কোনো মানুষ কিংবা একটা কুকুর এই বিষের পেয়ালা উল্টে ফেলে বাঁচাতে পারবে নিষ্পাপ হাসিখেলা মাঠ? আছে কেউ আপনাদের মাঝে?