[পর্ব: ৯]
ক্যাথরিন মাসুদের সঙ্গে পরিচয়-বিয়ে
ক্যাথরিন লুক্রেটিয়া শেপিয়ার (Catherine Lucretia shapere) ১৯৬৩ সালের ২৭ মে আমেরিকার শিকাগো শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি আমেরিকার ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগ থেকে গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন করেন। শিকাগো আর্টস ইনস্টিটিউট থেকে চারুকলা বিষয়ে পোস্ট গ্রাজুয়েশন করেন এবং নিউইয়র্ক থেকে চলচ্চিত্রের ওপর পড়াশুনা করেন। ক্যাথরিনের নানা আলফ্রেড বিংহ্যাম ছিলেন সাংবাদিক, তিরিশের দশকে শান্তিনিকেতনে এসেছিলেন রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করতে, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সমর্থন দিয়েছেন, বিপ্লব-উত্তর সোভিয়েত রাশিয়া গিয়েছিলেন, দেশে ফিরে বামপন্থী পত্রিকা বের করতেন। আর আলফ্রেডের বাবা হাইরাম বিংহ্যাম অ্যান্ডেজ পর্বতমালার ইনকা সভ্যতা খুঁজে বের করেছিলেন। সম্ভবত সেই উত্তরাধিকারেই ক্যাথরিন এসে তারেকের শিকড়সন্ধানী সিনেমা- সৃজনে সহযাত্রী হয়ে ওঠেন।
১৯৮৬ সালের দিকে ক্যাথরিন গবেষণা করতে ৬ থেকে ১ বছরের জন্য বাংলাদেশে আসেন। অল্প সময়ের জন্য বাংলাদেশে এলেও তিনি বারবার ভিসার মেয়াদ বাড়িয়ে যেতে থাকেন। কারণ, এ দেশকে তিনি ভালোবেসে ফেলেছিলেন। চারুকারুর প্রতি অসম্ভব ঝোঁক ছিল তার। সেই সূত্র ধরেই এসএম সুলতানের সঙ্গে ক্যাথরিনের যোগাযোগ হয়। এসএম সুলতানের মাধ্যমেই যোগাযোগ হয় আহমদ ছফার সঙ্গেও। ক্যাথরিনের চিন্তা-চেতনায় গভীর প্রভাব ফেলেন এই দুই মহান ব্যক্তি। আর এই দুই জনের মাধ্যমে তারেক মাসুদের সঙ্গে আলাপ হয় তার। তখন মফিজ চৌধুরী নামের বঙ্গবন্ধু সরকারের একজন সাবেক মন্ত্রী ইন্দিরা রোডের একটি একতলা পরিত্যক্ত বাড়িতে বাস করতেন। গুলশানে তার চমৎকার একটি বাড়ি থাকার পরও তিনি অবসর জীবনে স্ত্রী-আত্মীয় পরিজন ছেড়ে এই পরিত্যক্ত একতলা বাড়িতে এক অদ্ভুত জীবন-যাপন করতেন। ভদ্রলোক তার বাড়িতে তারেক, আহমদ ছফাসহ ওই সময়ের অনেক বোহেমিয়ান শিল্পী-সাহিত্যিককে থাকতে দিয়েছেন। আহমদ ছফার আমন্ত্রণে সেখানে যেতে শুরু করেন ক্যাথরিন। সেখানেই তারেক মাসুদ আর ক্যাথরিনের দেখা হয়।
ক্যাথরিন বিস্মিত হন তার সঙ্গে তারেক মাসুদের চিন্তা-ভাবনা আর মতের এতটা মিল দেখে। তারেক ও ক্যাথরিন একই ধরনের কবিতা বা গান পছন্দ করতেন। তাদের দুজনের বৈশ্বিক ধারণাও ছিল একই রকমের। দুজনের মধ্যেই ছিল জীবনকে তাৎপর্যপূর্ণ করে তোলার তাড়না। সে সময় তারেক মাসুদের ‘আদম সুরত’ ছবিটার ইংরেজি ভার্সন ক্যাথরিনকে করার অনুরোধ করা হয়। ক্যাথরিন তাতে সানন্দে রাজি হয়ে যান। মূলত এ কাজটা করার মধ্য দিয়েই দুজনের একসঙ্গে যাত্রা শুরু হয়। সিনেমা তৈরির মধ্যে যে আনন্দ, তা ক্যাথরিন এই প্রথম অনুভব করলেন। তারেক চেয়েছিলেন ক্যাথরিন সিনেমা তৈরি থেকে দূরে থাকুক। ক্যাথরিনকে নিরুৎসাহিত করেছেন তারেক মাসুদ বারবার। কিন্তু ক্যাথরিন সিনেমা তৈরির রহস্য ও পরিশ্রমকে কাছ থেকে দেখতে উৎসাহী ছিলেন। ক্যাথরিন প্রথম ডিএফপির এডিটিং রুমে ঢুকলেন, ওখানে দেখতে পেলেন শুধু সেলুলয়েডের টুকরো আর টুকরো। সেগুলো দেয়ালে ঝুলছে, মেঝেতে পড়ে আছে। ক্যাথরিনের কাছে বিষয়টা চমৎকার লেগেছিল এটা ভেবে যে, এই টুকরো টুকরো বিষয় থেকেই তৈরি হচ্ছে চমৎকার সৃষ্টিশীল কিছু। ক্যাথরিনও হতে চাইলেন এই প্রক্রিয়ার অংশ। এরপর ক্যাথরিন শর্টফিল্ম ফোরামের সংস্পর্শে আসেন এবং তারেকের মাধ্যমে তাদের আন্দোলনেরও অংশ হয়ে যান।
ক্যাথরিনকে জীবনবোধ সম্পর্কে কিছু গুরুতর বিষয় শিখিয়েছিলেন তারেক। তারেক বিশ্বাস করতেন তাকে প্রচলিত গৎবাঁধা নিয়মের বাইরে চিন্তা করতে হবে। তাদের নিজেদের সামর্থ্যের সীমাবদ্ধতার মধ্যে আবদ্ধ থাকলে চলবে না, তাদের অনেক বড় স্বপ্ন দেখতে হবে। ক্যাথরিনকে তারেক শিখিয়েছিলেন ব্যর্থ হয়ে কখনো কিছু ছেড়ে না দিতে। তারেক মাসুদ বিশ্বাস করতেন, একজন মানুষ কতবার দাঁড়াতে ব্যর্থ হলো সেটা বিষয় নয়, আসল বিষয় হলো দাঁড়ানোর পথ খুঁজে পুনরায় শক্তভাবে দাঁড়ানো। কিভাবে সংগ্রাম করতে হয়, কিভাবে এগিয়ে যেতে হয়, তারেক তা খুব ভালো করে জানতেন। ক্যাথরিন তার সব কাজে সহযোগী হতে পেরেছিলেন বলেই একই বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে পড়েন দুজন। দুজন দুজনকে আবিষ্কার করেন নতুন নতুন রূপে, মুগ্ধ হতে থাকেন দুজন দুজনের প্রতি। তারচেয়েও বেশি বুঁদ হতে থাকেন যেন সিনেমা নিয়ে। ছবিই তাদের সংসার হয়ে উঠলো। সিনেমার বাইরে অন্যকিছু ভাবতে পারেননি তারা। কিন্তু একটা সময়ে তাদের দুজনের মনেই সন্তানের স্বপ্ন উঁকি দিতে শুরু করলো। তারেক মাসুদ বাচ্চাদের খুব ভালোবাসতেন। দুজনের স্বপ্ন পূরণ করতে ঘর আলো করে এলো তাদের একমাত্র ছেলে নিষাদ। ২০১০ সালের ২১ এপ্রিল নিউইয়র্কের একটি হাসপাতালে তাদের একমাত্র সন্তানের জন্ম হয়। তারা সন্তানের নাম রাখেন নিষাদ বিংহ্যামপুত্র মাসুদ।
সন্তান পাওয়া যে কতটা আনন্দের তা তারা উপভোগ করলেন। তারেক মাসুদ ও ক্যাথরিন মাসুদ এই ভেবে দুঃখ পেতে থাকলেন যে, কেন তারা আরও আগে সন্তান নেননি। তাদের অনেক আগে সন্তান নেওয়া উচিত ছিল, শুধু এ কথাটাই মনে হতে থাকে। ক্যাথরিনের পরিবার, তারেক মাসুদের পরিবার সবাই খুব খুশি নিষাদকে পেয়ে। তারেক সম্পূর্ণভাবে নিজেকে সমর্পণ করেছিলেন ছেলে নিষাদের জন্য। তারেক মাসুদ তার সন্তানের সব কিছু নিজের হাতে করতে পছন্দ করতেন। ডায়াপার পাল্টানো থেকে শুরু করে নিষাদের কাপড় চোপড় ধোয়া, গোসল করানো; সবকিছুতেই তারেকের আনন্দ ছিল সীমাহীন। নিষাদের প্রতিটি বিষয়ে তারেক মজা পেতেন খুব। এ সময়ে ক্যাথরিন যেন অন্য এক তারেক মাসুদকে খুঁজে পান। ছেলে নিষাদের প্রায় সবকিছুই ধরে রাখতে চাইতেন তারেক, করতেন ছেলেকে নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা শ্যুটিংও।
তারেক মাসুদের সফল চলচ্চিত্রকার হয়ে ওঠার পেছনে ক্যাথরিন মাসুদের ভূমিকা অনন্য। তারেক মাসুদের একজন যোগ্য সঙ্গী ক্যাথরিন মাসুদ। তারেক মাসুদের মায়ের কাছ থেকে জানা যায়, তারেক এমনটাই চাইতেন। তার জীবনে এমন কেউ আসুক, যে তারা একে অন্যের জন্য কাজ করতে পারবেন। আর তার ঠিক মনের মতো সঙ্গী হিসেবে তিনি ক্যাথরিনকে খুঁজে পান। ক্যাথরিন শুধু তারেক কে নয়, ভালোবেসেছেন বাংলাদেশকে, বাংলা ভাষাকে। তিনি একজন আামেরিকান হয়েও অসাধারণ বাংলা বলেন। কতটা ভালোবাসা আর শ্রদ্ধা থাকলে সেটা সম্ভব হয়, তা সহজেই অনুমেয়।
চলবে…