[পর্ব-সাত]
কিন্তু কাজ করতে গিয়ে দেখলেন ইচ্ছা আর চিন্তার জগৎ থেকে ব্স্তব জগৎ অনেক ভিন্ন। তারেকের প্রায় দেড় দুই লাখ টাকা ছিল। তিনি ভেবেছিলেন ছবিটা সম্পূর্ণ করতে ওই অর্থ যথেষ্ট। কিন্তু তিনি যা করতে চেয়েছিলেন, ওই অর্থে তার সিকি ভাগও হয়নি। সম্পূর্ণভাবে ফেঁসে গেলেন তিনি। যেখানেই পেয়েছেন ধার-দেনা করেছেন। বিভিন্ন জায়গা থেকে সাহায্য সহযোগিতা পাওয়ার আশায় ছুটে বেড়িয়েছেন। তবে তিনি ডিএফপি (ডিপার্টমেন্ট অব ফিল্ম অ্যান্ড পাবলিকেশন্স) থেকে অনেক সহযোগিতা পেয়েছেন। লোকজন ধরে, মন্ত্রণালয় ধরে কখনো কখনো ক্যামেরা ফ্রি পেয়েছেন। এডিটিং করতে পেরেছেন। আসলে এস এম সুলতানের মতো এক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির ওপর ছবি করছেন বলেই অনেকেই সাহায্য সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু ছবি করতে গেলে তো শুধু ইন কাইন্ড সাপোর্ট হলে হয় না, অর্থও প্রয়োজন।
ছবির শ্যুটিং করার জন্য পাকিস্তান যাওয়ার প্রয়োজন পড়লো। কারণ সেখানেই এস এম সুলতানের এক বিরাট অধ্যায় রয়ে গেছে। কিন্তু টাকা কোথায় পাবেন! ১৯৮৩ সালে তারেক মাসুদ বিমানের দুটি টিকিট ফ্রি পেলেন।মি. নাজিমউদ্দিন হাসিম ছিলেন তখন মন্ত্রণালয়ে। তিনি ছিলেন শিক্ষিত, সংস্কৃতিমনা মানুষ। তিনি বিষয়টি বুঝতে পেরেছিলেন। টিকিট ছাড়াও তো আনুষঙ্গিক অনেক খরচ রয়েছে। সেগুলো জোগাড় করতে থাকেন তারেক মাসুদ।
ওই সময় বিখ্যাত ফটোগ্রাফার আনোয়ার হোসেন দশ হাজার টাকা ধার দিয়েছিলেন। মূলত তারই ক্যামেরাম্যান হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ওই সময়ই ইউনেস্কোর স্টিল ফটোগ্রাফির একটা অ্যাসাইনমেন্টে আফ্রিকা চলে যান। ফলে অ্যাসিস্ট্যান্ট ক্যামেরাম্যান হয়ে যার কথা ছিল তিনিই মূল দায়িত্ব পালন করেন। আর তিনি ছিলেন শহীদ বুদ্ধিজীবী মুনির চৌধুরির ছেলে মিশুক মুনির। শ্যুটিং করতে গিয়ে তারেক মাসুদ বুঝলেন যে কষ্টকর আর বৈরী পরিবেশের মধ্যে তাদের কাজ করতে হচ্ছে, সেখানে আনোয়ার হোসেনের মতো বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষ খুব কষ্ট পেতেন। তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনির একরকম সাপ, ব্যাঙ, মুরগির বিষ্ঠা, পচা ক্যানভাস ইত্যাদির মধ্যে রাত যাপন করেছেন। এসএস সুলতানের দুই ঘণ্টার ফুটেজের জন্য তার কাছে থাকতে হতো দুই সপ্তাহ। কারণ তার মতো করে থাকতে হতো। কারণ সব সময় সুলতানের শ্যুটিং করলে তিনি বিরক্ত হতেন। এসএম সুলতান বলতেন, ‘ছবি থেকে জীবন অনেক বড়। চলুন, আমরা বিজয় সরকারের বাড়ি ঘুরে আসি।’
তারেকরা ক্যামেরা নিতে চাইলে তিনি বলতেন, ‘রাখুন না ক্যামেরা, যন্ত্রটন্ত্র থাকুক। আপনার ক্যামেরা দিয়ে ক্যামেরার কাজ হবে। কিন্তু বিজয় সরকারের বাড়িতে গিয়ে যে অভিজ্ঞতাটা হবে, সেইটে আর উপলব্ধি করতে পারবেন না।’
সুলতানের সান্নিধ্যে এসে তারেক মাসুদ একধরনের বাউলাঙ্গের চলচ্চিত্র নির্মাণে যুক্ত হয়ে পড়লেন। হয়তো সেটা ওই বয়সেরই ধর্ম। ছবি শেষ করতে হবে এটা নিয়ে তাদের কোনো মাথাব্যথা ছিল না। তখন তারা ব্যস্ত সুলতানের সঙ্গে ঘুরে বেড়াতে। বিভিন্ন লোক উৎসবে যাচ্ছেন। এ যেন বাংলাদেশকে সুলতানের চোখ দিয়ে নতুন করে দেখছেন তারা। সুলতানের সঙ্গে ঘুরে এতই আনন্দে ডুবে ছিলেন যে, তারেক ও মিশুক মুনিরের কাছে ফিল্ম বানানোটা বাই-প্রোডাক্টের মতো ছিল। সুলতানের আশকারা ও উসকানিতে তারা প্রচুর অর্থ, সময়, ফুটেজ ব্যয় করছেন। বিভিন্ন লোকজ উৎসব—যেমন কুমিল্লার পাগলা মেলা থেকে শুরু করে চট্টগ্রামের মাইজভান্ডারি, কুষ্টিয়া থেকে শুরু করে ময়মনসিংহের বিভিন্ন উৎসব, ফরিদপুরের নৌকাবাইচ, ধামরাইয়ের রথযাত্রা—এ রকম যেখানেই শুনেছেন লোকসংস্কৃতির কোনো যজ্ঞ, সেখানেই ক্যামেরা নিয়ে হাজির হয়ে যেতেন তারা, করেছেন প্রচুর শ্যুটিংও।
চলবে…