শরীরটা কিছুতেই বশে আসছে না আর। সেই সঙ্গে মেজাজও চলে যাচ্ছে নিয়ন্ত্রণের বাইরে। এলাকায় ঠাণ্ডা মাথার মানুষ হিসেবে পরিচিতি ছিল তার। লোকজন তাকে চেনে খুবই ধীরস্থির, গভীর বুদ্ধির মানুষ হিসেবে। হিসেব ছাড়া এক পা ফেলেন নি কোনোদিন। হিসেবী মানুষ তিনি। সারা জীবন হিসেব কষে পথ চলেছেন, ছক ক’ষে এগিয়েছেন প্রতিটি পা। সেই তার মেজাজ ইদানীং একেবারেই নিয়ন্ত্রণে থাকছে না আর। রেগে যাচ্ছেন যখন তখন। মুখ খারাপ করছেন যার তার সঙ্গে। শরীরটা যত খারাপ হচ্ছে, মেজাজটাও সেই সঙ্গে চড়া হচ্ছে সমানুপাতিক হারে পাল্লা দিয়ে কিংবা আরও বেশি। আম্বিয়া খাতুন পারতপক্ষে তাকে ঘাঁটাচ্ছেন না। নির্দেশ মেনে চলছেন যথাযথ। কিন্তু লোকটা যেন ক্ষেপে উঠছে আরও দিন দিন। ছেলে-মেয়ের সঙ্গে পরামর্শ করেছেন তিনি। তারা বলেছে, মুজতবা খানের সঙ্গে তর্কে না যেতে। শুধু সিগারেট বা অন্যকিছু, যেগুলো ডাক্তারের নিষেধ, সেসব একদম না দিতে, নাগালের মধ্যেই না রাখতে। আম্বিয়া খাতুন চেষ্টা করছেন সাধ্য মতো। কিন্তু লোকটাকে সামলানো মুস্কিল হচ্ছে তার পক্ষেও। নীরবে চোখের জলও ফেলছেন তিনি। লোকটার জন্য কষ্ট হচ্ছে খুব। এ অবস্থায় লোকটাকে একদম মানাচ্ছে না। অচেনা লাগছে একদম।
সকাল থেকে গুম হয়ে আছেন মুজতবা খান। ঘুম থেকে উঠেই দেখলেন আম্বিয়া খাতুন তার জন্য টেবিলে নাশতা দিয়ে বসে আছেন বারান্দায়। আগ্রহ নিয়ে নাশতার টেবিলে গিয়ে বসলেন তিনি। আজকাল খিদে পায় না তার। সব খাবারই বিস্বাদ, পানসে লাগে। তবু বসলেন। বাঁচতে হবে তাকে। খেতে হবে সে কারণেই। ঢাকনা তুলে নাশতার আইটেম দেখেই মেজাজ সপ্তমে চড়ে গেল তৎক্ষণাৎ। পাতলা দুটো সাদা আটার রুটি। সঙ্গে তেল মশলা ছাড়া চালকুমড়োর ঘ্যাঁট। একটানে ছুঁড়ে ফেললেন তিনি তরকারির বাটি, রুটির প্লেট। চেঁচিয়ে উঠলেন বাঁজখাই গলায়।
তুমরা মাও-ছাওয়াল মিলে ডাক্তারের সাতে যুক্তি কইরে আমাক মারার পিলান করোচো তায় না? সে অচ্চে না, জাইনে রাহো! চালির আটার রুটি বানাবা এহন, সাতে গরুর গোস্ত ভুনবা মেলা কইরে তেল মশলা দিয়ে। জলদি কর, রাঁদবা, তেয় খাব। তা না অলি খানা মুহিই তোলব না আর, কয়া থুলাম। শালার বেটা শালারা! আমার সাতে চালাকি কর এ্যাঁ? অত সুজা না! টাহার অবাব পড়েছে আমার, নাহি? আমি খাব ওসপ ফহিরে খাবার?
চিৎকার থামে না মুজতবা খানের। শরীরের সব শক্তি এক করে বকে যান তিনি। শেষে নেতিয়ে পড়েন চেয়ারে। হাঁপান। হাপরের মতো ওঠানামা করে বুক। সেখানে সেলাইয়ের দাগগুলো তখনও শুকোয় নি। স্পষ্ট ফুটে আছে, গলার একটু নিচ থেকে পেট অবদি। আম্বিয়া খাতুন অসহায়ভাবে দেখেন। কী করবেন ভেবে পান না। মুজতবা খান কিছুটা ধাতস্থ হতেই তিনি রান্না ঘরের দিকে যান।
কপালে যা আছে হবে। দেখা যাক কত খেতে পারে লোকটা। এমনিতেও খেতে পারছে না কিছু, না খেয়েই মরবে শেষে। তারচে যা খেতে ইচ্ছে হয় সেটা খেয়েই মরুক –মনে মনে ভেবে নিয়ে রান্নায় বসলেন আম্বিয়া খাতুন।
রান্না শেষে আবার খেতে বসলেন মুজতবা খান। দুটো রুটি খেলেন জোর করে, দু টুকরো মাংসও। জল খেলেন অনেকটা। সঙ্গে সঙ্গেই পেট ফুলে উঠল তার। উঠে পড়লেন। সামান্য পরেই শুরু হলো পাতলা পায়খানা। নিজের ওপরে যেমন বিরক্তি বাড়ল তার, তেমনি বাড়ল আম্বিয়া খাতুনের ওপরও। বেকুব মেয়েছেলে! না হয় চেয়েছেইছি জোর করে খেতে, তা ব’লে নিষেধ জেনেও সেটা দিতে হবে! হারামী মাগি! মরলে বাঁচিস, না? –ঘর আর টয়লেট, টয়লেট আর ঘর করতে করতে দাঁত কিড়মিড় করে বলতে থাকলেন তিনি। ক্লান্ত, অবসন্ন শরীরে কেমন ধাঁধা দেখতে থাকলেন চোখে।
অনেক মিলিটারি। পুরো গ্রাম ঘিরে ফেলেছে। চোখে সুরমা, ইস্ত্রি করা পাজামা-পাঞ্জাবি আর মাথায় টুপি পরা, দাড়িতে আতর লাগানো পঁচিশ বছরের তাগড়া মুজতবা খান আর তার সাঙ্গপাঙ্গরা পাকসেনাদের সেবায় কোন কোন বাড়িতে মুক্তিসেনা আছে তার খবর দিচ্ছে, যুবতী মেয়ে-বউদের নিজেরাই ধরে এনে হাজির করছে পাকসেনাদের খেদমতে। অদূরে মস্ত হাঁড়িতে রান্না চড়েছে। হাতের কাছে বড় যে খাসিটা জুটেছে সেটাই জবেহ করে চলছে ভোজের আয়োজন। কাছেপিঠে যত ডাবগাছ ছিল সব প্রায় ডাবশূন্য। আহা। পাকসেনাদের দিল ঠাণ্ডা তো দুনিয়া ঠাণ্ডা। তারা হলো পাকিস্তানের শান্তি-দূত। আল্লাহর খাস বান্দা। গ্রামের সন্দেহভাজন জওয়ান পুরুষ যতগুলো পাওয়া গেল সবগুলোকে পিঠমোড়া করে বেঁধে দাঁড় করানো হলো একসারিতে। তারপর গর্জে উঠল পাকসেনাদের রাইফেল। একসঙ্গে অনেকগুলো। ধুপধাপ পড়ে গেল মানুষগুলো। কেউ কেউ নড়েচড়ে উঠল এক-আধটু। কেউ কেউ নিভে গেল পড়েই। যুবতী মেয়েদের আটকে রাখা হলো একটা ঘরে। সেনারা যাওয়ার সময় তাদেরকে সঙ্গে নিয়ে যাবে। সবচে কাছের সেনাক্যাম্পে অতিথি হিসেবে থাকবে তারা। তাদের নসিব ভালো। পাকসেনাদের সেবা করার দূর্লভ সুযোগ পাবে। মিলিটারিদের শুনিয়ে শুনিয়ে মুজতবা খান আর তার সাকরেদরা বলতে লাগল। শুনে পাকসেনাদের মুখে হাসির জেল্লা ফুটল যারপর নাই। নিজেদের মধ্যে কী একটা উর্দুতে বলে তুমুল হাসির লহর ছোটাল তারা। একজন পাকসেনা হাসিমুখে উঠে এসে সোল্লাসে পিঠ চাপড়ে দিল মুজতবা খানের। গলায় প্রশংসা ফুটিয়ে বলল, তুম বহত আচ্ছে ইনসান হো। সাচ্চে পাকিস্তানি! তুমহারা খেদমত পিয়ে ইয়ে পাকিস্তান কিয়ামততক জিন্দা রাহেগা! বোলো, পাকিস্তান জিন্দাবাদ!
প্রশংসায় গ’লে গেল মুজতবা খান। সে এ অঞ্চলের শান্তি-বাহিনীর কমান্ডার। তার প্রশংসায় সাগরেদদের বুক গর্বে ফুলে উঠল আরও। সমস্বরে ধ্বনি তুলল তারা, পাকিস্তান জিন্দাবাদ! নারায়ে তকবির! আল্লাহু আকবর!
আকাশে বাতাসে ছড়িয়ে পড়ল সে শ্লোগান। আবেগে কেঁপে উঠল শান্তিবাহিনীর সদস্যদের কলিজা। পারলে তক্ষনই তারা এমনকি নিজেদের মা-বোনদেরও লাগিয়ে দেয় পাকসেনাদের খেদমতে। এরমধ্যেই কে একজন এসে কানে কানে কিছু একটা বলল মুজতবা খানের। শুনে মুখটা একটু শুকিয়ে গেল তার। মাথাটা উঠল ঘুরে। কী করবে বুঝতে পারল না কিছুক্ষণ। তারপর কাচুমাচু মুখে এগিয়ে গেল পাকসেনাদের দিকে। ততক্ষণে তারা খাওয়া-দাওয়া সেরে যাত্রার প্রস্তুতি নিচ্ছে। পানাহার, মৌজ, সে-সব ক্যাম্পে ফিরে হবেক্ষণ। জেনানাদের আলাদা গাড়িতে তোলা হচ্ছে, ব্যবস্থা পাকা। পাকসেনাদের একজন, মুজতবা খানের ফ্যাকাসে মুখ আর কিংকর্তব্যবিমূঢ় ভাব দেখে করুণাদ্র সুরে জিগ্যেস করল, কীয়া হুয়া তুমকো ভাই? কীয়া মুসিবত মিলেগা তুমকো সাথ?
সাহস পেল মুজতবা খান। এগিয়ে গিয়ে বলল, স্যার, মেরি একথা আরজি হ্যায় আপকো পাছ।
আরজি? কীসি লিয়ে? জলদি বোলো মেরে ভাই। কোই পেরেশানি নেহি তুমহারা, জলদি বোলো!
ভাঙা ভাঙা উর্দুতে মুজতবা খান যা বলল, তার সারমর্ম হলো, তার ভাইয়ের বউকেও অন্যান্য মেয়েদের সঙ্গে ধরে আনা হয়েছে। ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তাকেও। পাকসেনারা এলেমদার আদমি, তারা যেন দয়া করে ছেড়ে দেয় তার ভাবীজানকে।
পাকসেনা খুব মন দিয়ে শুনল মুজতবা খানের বক্তব্য। তারপর মুজতবা খানের কাঁধে হাত রেখে সান্ত্বনার চাপড় দিল। মিলিটারিদের জিপ ততক্ষণে স্টার্ট নিয়েছে, হর্ন বাজিয়ে তাকে ওঠার তাড়া দিচ্ছে। সেদিকে চোখ রেখে, মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে সরিয়ে দিল মুজতবা খানকে। জিপের দিকে এগোতে এগোতে বলল, পাকিস্তানের সেবায় দুয়েকটা দিন সেনাক্যাম্পে থাকুক মুজতবার ভাবীজান, তারপর ফিরে আসবে বহাল তবিয়তে, সে যেন একদম চিন্তা না করে! খোদার দরবারে সে যেন পাকিস্তান আর তার রক্ষাকারী পাকসেনাদের জন্য খাস দিলে দোয়া করতে থাকে।
ধুলো উড়িয়ে চলে গেল মিলিটারি সেনাদের জিপ। তার আগে আগে গেলো নারীভর্তি আরেকটা জিপ। সেদিকে তাকিয়ে মুজতবা খান দেখল অনেকগুলো চোখ অসহায়ত্ব, হতাশা, ভয় আর ঘৃণার আগুন নিয়ে তাকিয়ে আছে তাদের দিকে, তার দিকে। অনেক চোখই চেনা তার। তার মধ্যে দুটো চোখ একটু বেশিই চেনা। হাবিবুর রহমান খানের বউ হেলেনের। তার মুক্তিসেনা বড় ভাইয়ের বউ। তাকে না জানিয়ে পাকসেনাদেরকে তার বাড়িও চিনিয়ে দিয়েছে কেউ। ঘৃণার আগুন নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে তার ভাবী, হেলেন। সে চোখের দিকে তাকিয়ে কেমন কুঁকড়ে গেল মুজতবা খান, কেঁপে উঠল হঠাৎ। মিলিটারি জিপ থেকে এত কাছে কী করে এলো হেলেন? এত ঝুঁকে তার দিকে কী দেখছে সে? ঝাপটায় তাকে সরিয়ে দিতে চাইল মুজতবা খান। চিৎকার করতে চাইল।
আব্বা! ও আব্বা!
চোখ মেলে দেখলেন মুজতবা খান। কী হয়েছে? হেলেন হঠাৎ তাকে আব্বা ডাকছে কেন? পাগল তো হবি ভাই, তার বউ হেলেনও হলো নাকি?
এখন কেমন লাগতেছে আব্বা? –ঝুঁকে এলো মুখটা আরও। এবার চিনতে পারলেন তিনি। তার মেয়ে, দোলন। বড় ভাইয়ের রাখা নাম। নাম রাখায় ওস্তাদ ছিলেন তিনি। পাগল হলেও লোকজন ছেলে-মেয়ের নাম রাখতে তার কাছে আসত। অদ্ভুত অদ্ভুত নাম দিতেন তিনি। শেষ দিয়েছিলেন একমাত্র নাতনির নাম। তিতলির মেয়ের নাম দিয়েছিলেন অরুন্ধতী। মানে কী কে জানে! বলতেও দাঁত ভেঙে যায়।
ইংল্যান্ডে নেমে দুটো দিন শুয়ে বসে কাটালো দীপন। ইচ্ছেমতো ঘুমিয়ে মুছে ফেললো যাত্রার ক্লান্তি। সুযোগ মতো কাছে পিঠে ঘুরে ঘুরে চিনে নিল এলাকাটা, যদ্দুর সম্ভব।
চলবে…
আরও পড়ুন: ঝিঁঝিলাগা দিনগুলো-২৪॥ শিল্পী নাজনীন