চায়ের পানিতে বলক উঠছে। প্রতিদিনই ঘুম থেকে উঠে জীবনটাকে বদলে ফেলার ইচ্ছে থেকে খুব সাবধানে লুকিয়ে রাখা প্যাকেটগুলো বের করে। দুধ, চিনির সঙ্গে মিশিয়ে দিতে চায় কীটনাশক বিষ। বুকটা ধড়ফড় করে চিকন ঘামের সঙ্গে প্রবল ঝাঁকুনি অনুভব করে শরীরে। জানালার পাশের বেলকনিতে ফোটা দোপাটি ফুলগুলো মাথা দোলায়। কিছু যেন বলতে চায়। ভাবতে ভাবতে চা দিতে দেরি হয়ে যায়। অবধারিতভাবে জুটে মার। মাতাল হয়ে এসে জানোয়ারের মতো যখন ভোগ করে তার চেয়ে মার খাওয়া ভালো। চা দিতে দেরি হওয়া, ডালে নুন কম পড়া, বিয়ের চার বছরেও সন্তান দিতে না পারা—নানান অজুহাত।
মারটা সহনীয় হয়ে গেছে। সকালে একবার রাতে একবার। প্রতিদিনের খাদ্যাভাসের মতো। দুপুরে ঘরে ফেরে না বলে সে বেলাটা বেঁচে যায়। ওই সময়টায় ও পাড়ায় যায়। সেখানকার নিয়মিত খদ্দের। কাজে বেরিয়ে যাওয়া থেকে কাজ থেকে ফেরা পর্যন্ত এই সময়টুকু ওর নিজস্ব। দেড় কামরার ঘরটি গোছগাছ করে, হাত-পা ছড়িয়ে মেঝেতে বসে থাকে। কত কী যে ভাবে। বিষ কি ওর নিজেরই খাওয়া উচিত?
নিজের চোখে দেখেও যে থানায় স্বামীর পক্ষে আর ধর্ষণের শিকার বাচ্চা মেয়েটার বিপক্ষে বললো! সমস্ত অন্যায়, অবিচার সহ্য করেও যে মুখ বুজে মার খায়, তার কি বেঁচে থাকা উচিত! ভাইয়ের সংসারে বড় হওয়ায় ওর যে যাওয়ার জায়গাটুকুও নেই। বারান্দায় রাখা গাছগুলোর সঙ্গে কথা বলে। ওদের অভিমত চায়। ওরা সায় দেয় না ওর মৃত্যুতে। ওরা চায় জীবন। চায় বেঁচে থাকা। উপায় হিসেবে চিঠি লেখাকে অবলম্বন করে নেয়। প্রতি সপ্তাহে চিঠি লেখে। পিয়নের হাতে তুলে দেয়। তাতে থাকে না কোনো ঠিকানা। কোনো বন্ধুবান্ধব তো নেই। ডাকপিয়ন আর সব্জিওয়ালা ছাড়া কারও সঙ্গে কথাও হয়নি কোনোদিন। ওরা দুজনেই ওর মুখে, ঠোঁটে মারের কিছু চিহ্ন দেখেছে বিভিন্ন সময়। দুজনের চোখেই গভীর বিষাদ। গভীর মায়া। হঠাৎ গা গুলিয়ে আসে। দৌড়ে বাথরুমে গিয়েই হড়হড় করে বমি করে। কিছুই মুখে দিতে পারছে না কদিন ধরে। কঠিন কোনো অসুখ করেছে কি না কে জানে!
দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। ডাকপিয়ন। হাতে গতকালের প্রস্রাব পরীক্ষার রিপোর্ট। গত তিনমাসের অভ্যস্ততায় হাত ধরে টেনে নেয় ঘরে।
স্বামীর চৌকির পাশে নিচে মাদুর বিছিয়ে শোয় ও। মাদুরের তলা থেকে রিপোর্টটা হাতড়ে বের করে। কাঁপাকাঁপা হাতে এগিয়ে দেয়। এতদিন পর সন্তান আসতে যাচ্ছে। খুশির খবর। প্রচণ্ড আক্রোশে ফুঁসে ওঠার কারণ বোঝার আগেই জ্ঞান হারায় ও। জ্ঞান ফিরলে নিজেকে রক্তাক্ত অবস্থায় দেখে একটুও ভাবান্তর হয় না। তলপেটে লাথিটা পড়ামাত্রই জ্ঞান হারিয়েছিল, মনে পড়ে। মুখেও রক্তের নোনাস্বাদ। চা বানানোর আদেশ পেয়ে নিজেকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে রান্নাঘরে ঢোকে। পা গড়িয়ে রক্তের ধারা। বাথরুমে যাওয়ার তাগিদও অনুভব করে না। থাক, এভাবেই ঝরুক। সাহসের অভাবে মরতে পারে না যারা, তারা এভাবেই মরুক। শরীরের রক্ত ঝরিয়ে।
বাড়তি দুধ, চিনির সঙ্গে ঢেলে দেয় প্যাকেটের সবটুকু। কী আশ্চর্য! বুক কাঁপছে না। চিকন ঘামও দিচ্ছে না। এগিয়ে দেওয়া চায়ের কাপ এক চুমুকেই শেষ করে দিতে দিতে বললো, কার লগে শুইছস হারামজাদি! আমার কুনোদিন বাচ্চা হইব না, এইডা আমি আগের থনই জানি।
পরক্ষণেই গলা চেপে ধরেই নেতিয়ে পড়লো, কী দিছস, হারামজাদি। আমার এমুন লাগে ক্যা!
দু’পায়ের ফাঁকে বেরিয়ে যাওয়া মাংসপিণ্ডটি অনুভব করলো। ওর মা হওয়ার ক্ষমতা আছে। ও আবার মা হবে। মাংসপিণ্ডটি হাতে নিয়ে দোপাটির ছোটো চারাটার গোড়ায় দিলো। কলি এসেছে। কদিন বাদেই ফুল ফুটবে!