[পর্ব-৩: জন্ম ও শৈশব]
তারেকের বয়স যখন সাড়ে তিন বা চার বছর তথন সালমা হামাগুড়ি দিতে শিখে গেছে। তখন চারপাশেই হঠাৎ করেই সাপের উপদ্রপ বেড়ে যায়। সাপের উপদ্রপ থেকে বাঁচার জন্য তারেকের নানা (তারেকের বাবার মামা) বাড়ির সব খাটের পায়াগুলোর সঙ্গে এসিডের শিশি বেঁধে রাখতে শুরু করলেন। সালমার সঙ্গে তারেক খেলতেন সময় পেলেই, এখন সালমাও তার খেলার সাথী। একদিন দুজন বসে খেলছিলেন, সালমা হামাগুড়ি দিয়ে খাটের পায়ার সঙ্গে বাঁধা এসিডের শিশি মুখে পুরে দেয়। তারেকের বয়স খুব বেশি না থাকায় তিনিও তখন সালমাকে খেয়াল করতে পারেননি। সঙ্গে সঙ্গেই অসুস্থ হয়ে পড়ে সালমা। সবাই এসে সালমাকে ঘরের বাইরে নিয়ে যান। সালমা হাতের মধ্যেই নিস্তেজ হয়ে ঢলে পড়ে। কান্নাকাটির রোল পড়ে যায় বাড়িতে। তারেকের বাবা কোনো চিকিৎসা করাতে রাজি নন। তার ধারণা মারা গিয়েছে সালমা। তিনি কালিমা পড়তে শুরু করেন। কালিমা পড়া শুনে ভয় পেয়ে যায় তারেক মাসুদ। তিনি বোনের মৃত্যু মানতে পারবেন না, দৌড়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে যান।
তারেকের মা এবার সন্তানের ভালোর জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেন। সব শাসন নিয়মের বাইরে গিয়ে ফুসে ওঠেন তিনি, চিকিৎসা না করে মেয়েকে চলে যেতেন দেবেন না তিনি, আসমার সঙ্গে যে অন্যায়টা হয়েছে, তার পুনরাবৃত্তি তিনি হতে দিতে চাননি। ডাক্তারকে খবর দেওয়া হলো। ডাক্তার আসার পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত সালমার মাথায় পানি ঢালা হয়। ডাক্তার এসে সালমাকে ওষুধ দিলে জ্ঞান ফেরে সালমার। সালমার জ্ঞান ফিরলে খোঁজা শুরু হয় তারেককে, অনেক খুঁজে তাকে বাড়ি ফিরিয়ে আনা হয়।
এ ঘটনার কিছুদিন পর তারেকের বাবা ৪ মাসের চিল্লায় করাচি চলে যান। তখন তারেককে টিকা দেওয়া হয়, ওই সময়ের টিকা ছিল সম্পূর্ণ একটা আতঙ্কের নাম।
সুঁচ পুড়িয়ে মাংসের মধ্যে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেওয়া হতো সে টিকা। তারেকের টিকার জায়গাটা ইনফেকশন হয়ে গিয়েছিল। প্রচণ্ড জ্বর হয়েছিল তার। কোনো হুঁশ ছিল না তখন তার। সারারাত তারেকের মাথায় পানি ঢালছিল সবাই পালাক্রমে। জবার মা আর রুবি (তারেকের ফুফাতো বোন) ছিলেন সেদিন তারেকের পাশেই। তারেকের মা দিশেহারা হয়ে পড়েছিলেন, বাড়িতে কোনো পুরুষ মানুষ নেই, এত রাতে ডাক্তার কিভাবে ডাকবেন—এসব ভেবে।
তখন রাত ৮ কি ৯ টা বাজে। হঠাৎ দরজার বাইরে তারেকের বাবার জুতার আওয়াজ পাওয়া যায়। জুতার আওয়াজ ক্রমশ দূর থেকে কাছে আসতে আসতে দরজার সামনে স্থির হয়। ঘরের সবাই স্পষ্ট সে শব্দ শুনতে পাচ্ছে, নিশ্চুপ সবাই। এই বুঝি দরজার কড়া নাড়ে। ভেবে ভেবে ঘরের ভেতরের সবাই ভয়ে ঠাণ্ডা হয়ে গেছে যেন! একটু পরে জুতার আওয়াজটা আবার দূরে চলে যেতে যেতে মিলিয়ে যায়। কিন্তু তারেকের বাবার করাচি থেকে আসারও কোনো সুযোগ ছিল না তখন। তাহলে কার জুতার আওয়াজ ছিল বাইরে? কে হতে পারে? এমন প্রশ্ন যখন ঘরের সব মানুষকে ভাবিয়ে তুলছে, ঠিক তখন রুবি খেয়াল করলেন, হঠাৎ করেই তারেকের জ্বর কমতে থাকে। রাতের মধ্যেই তারেক সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠেন।
ওবায়দুর রহমান ছিলেন তারেকের সেজ কাকা। সবাই তাকে ভোলা চাচা বলে ডাকত। তিনি তখন কোহিনুর কোম্পানিতে কাজ করতেন। থাকতেন ঢাকার মগবাজারে। তখন রবিবার ছিল ছুটির দিন। ভোলা চাচা বাচ্চাদের খুব ভালোবাসতেন। বেশিরভাগ ছুটির দিনগুলোতে তিনি গ্রামে চলে আসতেন। বাড়ির সব ছেলেমেয়ে ঘিরে থাকতো ভোলা চাচার চারপাশ। ভোলা চাচা তারেককে সবচেয়ে বেশি পছন্দ করতেন।তিনি ফল কিনতে পছন্দ করতেন। ঝুড়ি ঝুড়ি ফল কিনে আনতেন বাড়িতে।বাড়ির সব বাচ্চাকে নিয়ে টিউবওয়েল এর সামনে চলে যেতেন ভোলা চাচা। সব ফল বালতিতে ঢেলে নিয়ে টিউবওয়েল এর নিচে রেখে বালতিতে পানি ভরতেন তিনি। বাচ্চারা বালতি থেকে সেই ফল ধুয়ে ধুয়ে ইচ্ছোমতো খেতে থাকতো।তারেক ফল খেতে খুব ভালোবাসতেন। ভালোবাসতেন ভোলা চাচাকেও।
তারেক ছোটবেলা দুধভাত আর গুড় খেতে খুব ভালোবাসতেন। ছোটবোন সালমার সঙ্গে গুড় নিয়ে তার খুনসুটি লেগেই থাকতো। খুব শান্ত স্বভাবের ছিলেন তারেক মাসুদ ছোটবেলা থেকেই। কারও সঙ্গে কখনো ঝগড়া মারামারি করতেন না। ছোট-বড় সবাই তাকে খুব পছন্দ করতো। খেলাধুলা করতেও খুব ভালোবাসতেন তিনি। পছন্দ করতেন বন্ধুদের সঙ্গে মিশতে। ব্যাট বল নিয়ে খেলা করতে খুব ভালোবাসতেন তিনি। বাড়ির সামনের খোলা জায়গাটিকে মাঠ হিসেবে ব্যবহার করতেন।
একবার লোহার একটা বল পেয়ে তাই দিয়েই খেলা শুরু করেন তিনি। খেলতে গিয়ে বল হঠাৎ করে এসে লাগে তারেক মাসুদের ঠোঁটে। সঙ্গে সঙ্গে ঠোঁট কেটে রক্ত পড়তে থাকে। তখন তারেকের বাবা বাড়িতেই ছিলেন। তারেক মাসুদ খুব ভয় পেয়ে যান, বাবার ভয়ে তিনি বেশ কিছুদিন খেলাই বন্ধ করে দেন।
তারেকের ভোলা চাচা একবার তারেকের জন্য সিল্কের কাপড়ের খয়েরি রঙের প্যান্টের সঙ্গে নীল শার্ট কিনে দিয়েছিলেন। শার্টের সঙ্গে প্যান্টের বোতামে দুটো ফিতা দিয়ে আটকানোর ব্যবস্থা ছিল। এই পোশাকটি তারেকের খুব প্রিয় ছিল। তিনি এ পোশাক পরলে আর খুলতে চাইতেন না। এ পোশাকে আরও বেশি চমৎকার লাগতো তাকে। সবাই মুগ্ধতা নিয়ে তাকিয়ে থাকতো তার দিকে। তারেকের বাবার মামা, যাকে সবাই ছোট খোকা নামেই চিনতো। তার একটি ক্যামেরা ছিল। ছোট খোকা তারেকের ছবি তুলতে আসতেন শুধু। কিন্তু তারেকের বাবার কড়া নিষেধ ছিল ছবি তোলার ক্ষেত্রে। ছবি তুললে গুনাহ হবে এই ভয়ে তারেকের বাবা পরিবারের কারো ছবি তুলতে দিতেন না। তাই তারেকের শৈশবের তেমন কোন ছবি পাওয়া যায় না।
চলবে…
আরও পড়ুন: তারেক মাসুদ: ছবির ফেরিঅলা-পর্ব: ২॥ শারমিন রহমান