[পর্ব-২২]
লাঞ্চের আগ পর্যন্ত সময়টা যায় ভীষণ ব্যস্ততায়। দম ফেলানোর ফুরসত মেলে না একদম। লাঞ্চের পর একটু অবসর পেতেই বাসায় ফোন দিল তুলি। রুমকী ঘুমোচ্ছে, জানাল ময়না। রতনের কথা জানতে চাইতেই বলল, বারান্দায় বই নিয়ে বসে আছে, পড়ছে। শুনে স্বস্তির শ্বাস ছাড়ল তুলি। বেশ কিছুদিন থেকে রতন ভালো আছে অনেকটাই। এখন খুব কাছের মানুষ ছাড়া তাকে দেখলে কেউ বুঝবেই না যে তার কোনো সমস্যা আছে। কিছু কিছু স্মৃতি ভুলে যায় রতন। খুশবু বেগম মারা গেছেন অনেকদিন, কিন্তু রতন মাঝে মাঝে খুশবু বেগমকে খোঁজে। দীপনকে, তুলিকে তাড়া দেয় তাকে তাদের সাথে এনে রাখতে। ছোটবেলার কিছু কিছু স্মৃতিও হুটহাট মনে পড়ে তার। সেগুলোকে বর্তমানের সাথে গুলিয়ে ফেলে রতন। তাছাড়া মাঝে মাঝে রুমকী আর তুলিকে চিনতে পারে না একদম। রুমকীকে ভাবে খুশবু বেগম। অবাক হয়ে বলে, মা কী করে এত ছোট হয়ে গেল, বল তো দীপন!
তুলিকেও চিনতে পারে না হঠাৎ হঠাৎ। বলে, কে রে ভদ্রমহিলা? এ বাড়িতে কী করছে বলতো? তোর কী কোনো আক্কেলজ্ঞান হবে না আর? দিনের পর দিন একজন ভদ্রমহিলা এ বাড়িতে খাচ্ছে-দাচ্ছে, থাকছে, লোকে শুনলে বলবে কী? আর মা? মা জানলে তোকে আস্ত রাখবে ভেবেছিস? আর মহিলাই বা কেমন? এখানে কেন পড়ে আছে দিনের পর দিন!
দীপন বুঝিয়ে সুঝিয়ে ঠান্ডা করে রতনকে। রতন কী বোঝে তা সে-ই জানে। সব শুনে গুম হয়ে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর হো হো হাসে। বলে, আমি আসলে পাগল হয়ে গেছি, না রে? সব ভুলে যাই! কত সময় চলে গেছে! কিচ্ছু মনে থাকে না আমার! আচ্ছা, মাধবী কেমন আছে রে? সেদিনের পর আর এলো না কেন বলতো? কত ভালোবাসত আমাকে! একবার বলিস তো আসতে!
মাধবী! নামটা রতনের জন্য অভিশাপ। তার পরিবারের জন্যও। যখনই পুরোপুরি স্মৃতি ফিরে আসে রতনের, অনিবার্যভাবে তখন তার মনে পড়ে মাধবীকে। স্পষ্ট মনে পড়ে তার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের স্মৃতিগুলো, তখনকার সব কথা স্পষ্ট হতেই তীব্র হতাশায় আবার আচ্ছন্ন হয়ে যায় রতন। তার মধ্যে শুরু হয় ভাঙচুর। হতাশা আর অনুশোচনার ভারে আবার সে পুরোপুরি খেই হারিয়ে ফেলে। তুলি আর দীপন তাই সব সময় সতর্ক থাকে। মাধবীর প্রসঙ্গ ওঠা মানেই বিপদের পূর্বাভাস। তার মানে আবার পুরোপুরি মানসিক ভারসাম্য হারানোর সময় এসে যাওয়া। সাথে সাথেই তারা সতর্ক হয়ে যায় তখন। রুমকীকে সরিয়ে নেয় নিরাপদ দূরত্বে। দরজায় লাগিয়ে দেয় মস্ত তালা। দূর্বিষহ হয়ে ওঠে তখন জীবন। তাদেরও, রতনেরও। রতনের তো কোনো বোধ থাকে না তখন, ক্ষুধা-তৃষ্ণা ছাড়া। কিন্তু তাদের নিজেদের জীবন তখন বিষিয়ে ওঠে পুরোপুরি। তিক্ততা জমা হয় তার আর দীপনের মাঝখানে। এবার অবশ্য এখনো তেমন পরিস্থিতি আসে নি। রতন এখন পর্যন্ত মাধবীর প্রসঙ্গ তোলে নি একবারও। তুলি খোঁজ রাখে প্রতিদিন। দীপনও। রতন বেশ ভালো আছে। বেশ কিছুদিন এমন ভালো থাকে সে।
আরও পড়ুন: ঝিঁঝিলাগা দিনগুলো-২১॥ শিল্পী নাজনীন
দীপনকে ফোন দিল। কথা বলল টুকটাক। দীপনের ট্যুরের সময় এগিয়ে আসছে। এবার তাদের সেমিনারটা হবে ইউরোপে, বৃটেন আর ইতালিতে। গোছগাছ চলছে তার। অফিস শেষে প্রতিদিনই প্রায় বের হচ্ছে তারা। কেনাকাটা সারছে একটু একটু করে। এবার অনেক শীত পড়ছে ইউরোপ জুড়ে। শীতের কাপড় নিতে হবে কিছু। ওখানে অনেক দাম। কেনার সময়ও জুটবে না তেমন। তাছাড়া শুধু শুধু বাড়তি পয়সা খরচেরও মানে হয় না কোনো। দীপনের সাথে কথা সেরে ফোন রাখল তুলি। এসিটা বাড়িয়ে দিল আরেকটু। অনেক গরম। কেমন অস্থির লাগছে। উঠে জানালার পর্দা সরিয়ে বাইরে তাকাল। ঝকঝকে নীল আকাশ। সাদা সাদা মেঘ ভাসছে। নিচে রাস্তাগুলো চলে গেছে এঁকেবেঁকে। এত উঁচু থেকে চলমান গাড়ির সারি আর রাস্তাকে আলাদা করা যায় না প্রায়। রাস্তাটাকেই চলমান মনে হয়। ধাতব গাড়িগুলোর শরীরে রোদ পড়ে ঝিকিয়ে ওঠে আলো। ধাঁধা লেগে যায় চোখে। সেদিকে চোখ রেখে হঠাৎ মেহেদীর চিলেকোঠার সেই ঘরটি মনে পড়ে যায়। মেহেদীর চিলেকোঠার বারান্দায় বসলে এমন মনে হতো। ধাঁধা লেগে যেত চোখে। চোখ কচলে আবার তাকাত তুলি। নেশা ধরে যেত তার। মেহেদী হাসত। সেদিন, সেই দুপুরের পর থেকে সংকোচ কেটে গেছিল। কেটে গেছিল অস্বস্তি, দ্বিধা। প্রায় ছুটির দিনেই সে যেত মেহেদীর ছোট্ট এক কামরার চিলেকোঠার ফ্লাটে। এক সাথে রান্না করত, খেত, সময় কাটাত। মেহেদী তার জীবনে প্রথম পুরুষ ছিল, প্রথম ভালোলাগা, ভালোবাসা, প্রেম। মেহেদীরও প্রথম নারী ছিল সে। মেহেদী তেমনই বলত। তারা বিয়ের স্বপ্ন দেখছিল। সে, মেহেদী, দুজনেই। মাঝে মাঝে অফিস সেরে তারা শপিং এ যেত। নতুন সংসারের জন্য টুকিটাকি জিনিস কিনত। মেহেদীর ছোট্ট ঘরটাকে ইচ্ছেমতো সাজিয়ে নিত তুলি। কদিন পরই তো এঘরই হবে তার নিজের ঘর, একান্ত আপনার ঠাঁই। ভেবে আপ্লুত হতো তুলি। মামার বাড়ির সাথে সম্পর্ক তার চুকেই গেছিল প্রায়। অনেকদিন থেকে কর্মজীবী নারীদের হোস্টেলে থাকছিল সে। বিশেষ কোনো প্রয়োজন ছাড়া তার খোঁজ করত না কেউ, সে-ও না। শহরে আপন বলতে তখন একমাত্র মেহেদী। বিয়েতে সে মামার বাড়ির সবাইকে উপস্থিত থাকতে বলবে, ভেবে রেখেছিল। মেহেদীর সাথেও আলাপ করেছিল বিষয়টা। মেহেদীও সায় দিয়েছিল। একা একা, চোরের মতো বিয়ে করবে না তারা। সবাইকে জানিয়ে, নিয়ম মতোই মেহেদীর স্ত্রী হবে তুলি। তেমনই ভাবনা ছিল বরাবর।
মেহেদীর পরিবারে মেহেদী ছিল বড়। তার বাবা-মা, ভাই-বোন সবাইকে জানাবে মেহেদী। সবার সম্মতিতেই বিয়ে হবে। মেহেদীর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, তার পছন্দে কেউ আপত্তি করবে না। তুলিকে অবশ্যই পছন্দ করবে তার পরিবার। তুলিকে বারবার আশস্ত এ ব্যাপারে করত মেহেদী।
যদি করে? –ভয়ে ভয়ে প্রশ্ন করেছিল তুলি।
আরে দূর! -হেসে উড়িয়ে দিয়েছিল মেহেদী। করবে না, দেখ! –বলেছিল দৃঢ়কণ্ঠে।
তবু, যদি করে? –প্রশ্নটা আবার তুলেছিল তুলি।
করবে না বলছি তো! তবু যদি তেমন পরিস্থিতি আসে, তাহলে আমরা নিজেরাই বিয়ে করে নেব। জীবনটা আমাদের, আমাদের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। তুমি একদম ভেব না। রিল্যাক্স থাক। আমার ওপর ভরসা রাখ।
বুক থেকে ভার নেমে গেছিল তুলির। নিশ্চিন্ত ছিল সে। হোস্টেলের জীবন ভালো লাগছিল না আর। মেহেদীকে তাগাদা দিচ্ছিল পরিবারকে জানানোর। সময় নিচ্ছিল মেহেদী। যেন অতটা তাড়া নাই তার। ধীরে সুস্থে কোনো একদিন জানালেই চলে, কিংবা না জানালেও, ভাবটা ছিল অনেকটা তেমনই।
আরও পড়ুন: ঝিঁঝিলাগা দিনগুলো-২০॥ শিল্পী নাজনীন
জানালায় দাঁড়িয়ে নিচে রাস্তার দিকে চোখ রেখে হঠাৎ মাথাটা কেমন চক্কর দিয়ে ওঠে তুলির। সরে আসে। দীর্ঘক্ষণ আলোর দিকে তাকিয়ে থাকায় অন্ধকার লাগে সব। বসে পড়ে চেয়ারে। চোখ সইয়ে নেয় আলো। বছর দুয়েক আগে হঠাৎই পথ চলতে মেহেদীকে দেখেছিল সে। একই বাসে যাচ্ছিল তারা, একই গন্তব্যে। সিলেট। মেহেদীর পাশে তার মোটাসোটা, গহনায় মোড়া স্ত্রী! তারা কি সন্তান নেয় নি এখনো? –প্রশ্নটা মনে এসেছিল পলকেই। দীপন ছিল পাশে, ছিল রুমকীও। তুলি, মেহেদী, দুজনেই দেখেছিল দুজনকে। দূর থেকে। মৃদু হেসেছিল তুলি মেহেদীর চোখে চোখ রেখে। চোখ সরিয়ে নিয়েছিল মেহেদী। তার চোখে স্পষ্ট ভয়, সংকোচ। সাহস নেই তুলির চোখে চোখ রাখার। মাঝপথে যাত্রা বিরতিতে ফ্রেশ হতে নেমে গেছিল সবাই। দৃঢ়, অসংকোচ পায়ে এগিয়ে গেছিল তুলি, দাঁড়িয়েছিল সোজা মেহেদী আর তার বউয়ের সামনে।
কেমন আছ, মেহেদী?
বিব্রত, ফ্যাকাসে মুখে তাকিয়েছিল মেহেদী। বউয়ের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে প্রায় মিইয়ে যাওয়া গলায় অন্যদিকে তাকিয়ে বলেছিল, ভালো।
খিলখিল হাসিতে তাকে চমকে দিয়েছিল তুলি। তারপর দৃঢ়, স্পষ্ট উচ্চারণে দীপনের দিকে তাকিয়ে বলেছিল, এসো, পরিচয় করিয়ে দেই। এর নাম মেহেদী। এর কথা বলেছিলাম তোমাকে। আর মেহেদী, এই আমার বর, দীপন। সাথে আমার মেয়ে রুমকীও আছে। রুমকী, আংকেলকে সালাম দাও।
মেহেদীর সেই ফ্যাকাসে, বিব্রত মুখটা মনে পড়লে এখনো হাসি পায় তুলির। মানুষ কী করে অমন মেরুদণ্ডহীন হয়, অমন অরুচিকর! এখনো সে ভেবে পায় না কিছুতেই। কেমন বিবমিষা জাগে মনে, তেতো হয়ে যায় মুখ।
চলবে…