নাচনসাহা গ্রামনিবাসী বেণুকর মণ্ডলের কয়েক বিঘা জমি আছে, তা চষবার লাঙল আছে এবং লাঙল টানিবার বলদ আছে; কারও কাছে কিছু পাওনা আছে, কারও কাছে কিছু ঋণ আছে; গৃহসংলগ্ন খানিক পতিত জায়গা আছে। সেখানে বাসি-উনুনের ছাই ঢালা হয়; স্তূপীকৃত ছাই বিছিয়ে দেয় আর মাটি খুঁড়ে শাক জন্মানো হয়, এটুকু শখ বেণুকরের আছে।
এ-সব ছাড়া তার স্ত্রী আছে, জানকী; আর আছে মনে একটা ক্ষোভ। আর কেউ নেই, কিছু নেই!
বেণুকরের রূপও কিছু আছে, তবে জাঁকালো তেমন নয় এবং বুদ্ধিও কিছু আছে, তবে ধারালো তেমন নয়। তবে কৃষি-সংক্রান্ত ব্যাপারে এবং দেনা-পাওনা হিসাবে তার ভুল হয় না।
আবার এও উল্লেখযোগ্য যে, একটা দোষ তার আছে, ভোরে তার ঘুম ভাঙে না, রোদ উঠলে ভাঙে।
বেণুকরের বয়স এই ছাব্বিশ চলছে। স্ত্রী জানকীর বয়স এই উনিশ। চার বছর হলো তারা বিবাহিত হয়েছে।
বিবাহিত জীবনের চার বছর বয়সটা কম নয়–-মুর্হূতের পর মুহূর্ত অতীত হয়ে খুব ধীরে ধীরে সময়টা কাটছে।
সুতরাং আশা করা যেতে পারে যে, বেণুকরের সম্ভোগের ধারণায় একটা পরিচ্ছন্নতা আর আকাঙ্ক্ষায় একটা স্থৈর্য্য এসেছে। ভূষণহীন আটপৌরে অবস্থায় এসে জীবনের বাহিরাবয়বটা নিস্তরঙ্গ হয়ে চার বছর বিবাহিত জীবন যাপন করা হলো দেখে এমন একটা ধীরতা আর সন্তোষ মানুষের কাছে মানুষ আশা করে; কিন্তু এটা করে পরের বেলায়, নিজের কথা নিজের মন জানে। পারিবারিক শ্রান্তি ও জড়তাকে সংযম মনে করে মানুষ নিজের বেলায় ঐ ভুলটি করে, করতে বাধ্য হয়।
কিন্তু মনের ভেতরটা আকুল হয়ে নিঃশব্দে ছটফট করলে তার বিরুদ্ধে বাধাটা কী!
বলতে কি, বেণুকর মণ্ডল আকুল হয়েই থাকে এবং তার মনে একটি ক্ষোভ আছে।
শেষ পর্যন্ত দাঁড়ালো এই কথাটাই যে, স্ত্রীর পক্ষ হতে মানসিক একটা সৃজনলীলা—রূপের পর রূপের আবর্তন আর রসের অন্তে রসের উদ্ভব দেখবার জন্য লাঙল আর বলদের মালিক চাষী গৃহস্থ বেণুকরের মন লালায়িত হয়ে উঠেছে।
বেণুকরের এই ক্ষোভের জন্ম কোথায় অনুসন্ধান করতে গেলে এই নিদারুণ সত্য বিস্মৃত হলে চলবে না যে, তারা চার বছর হলো বিবাহিত হয়েছে এবং অল্পায়ু মানুষের পক্ষে চারটি বছর খুবই দীর্ঘ সময়। সুতরাং খুবই দীর্ঘ চারটি বছরের অবিরাম সাহচর্যবশত স্ত্রীর ভঙ্গি আর গঠন যদি চোখের সামনে পুরনো হয়ে উঠতে থাকে তবে উপায় কী! প্রতিরোধ করবার উপায় মানুষ খোঁজে, কিন্তু পায় না। এই নিরুপায় অবস্থাটা বড়ই লোভের সৃষ্টি করে, বেণুকরের তাই করেছে।
জানকীর বয়স এই উনিশ। তার বয়স যখন পনেরো ছিল তখন হতে চার বছর ধরে উঠতে-বসতে অষ্টপ্রহরের সঙ্গিনীরূপে স্বামী বেণুকরের জীবনে সে পরিব্যাপ্ত হয়ে গেছে—কেবল ভাবের দিক দিয়ে নয়, কাজে-কর্মেও। জানকী চাষের কাজে, বলদ পালনে, শাক উৎপাদনে অনুকম্পা আর সহযোগিতা করে বেণুকরকে মুগ্ধ করে।
কিন্তু ক্রমাগত সহযোগিতার ফলেই যদি পনের বছরের স্ত্রীকে, চার বছর পরে উনিশ বছরে একটু স্তিমিত আর দূরবর্তী বলে বেণুকরের মনে হয় তবে তাকে ক্ষমা করা যেতে পারে—সেটা তার অনন্যসাধারণ বিকৃত মনের অপরাধ না-ও হতে পারে। মানুষ মাত্রেই মনে মনে স্বভাবতই অধার্মিক এবং মানুষ মাত্রেরই স্নায়ুরোগ ভিতরে থাকেই—এটাই তার কারণ। পনের বছরের প্রথম পদক্ষেপ শুরু হয়ে উনিশ বছরে উপনীত হতে যে-সময়টা কেটেছে, তা আয়ুকে ক্ষয় করেছে, কিছু দান করেছে, কিছু অপহরণ করেছে, বেণুকর তা গ্রাহ্য করে না; কিন্তু মদিরায় অজানা জিনিসের ভেজাল মিশিয়ে তাকে হীনবল করে দিয়েছে, এইটাই বড় সাংঘাতিক—বেণুকরের মনে ওতে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। মানুষের এই ক্ষোভটি সাংঘাতিক এবং তা না জন্মালে যৌবনের ওপর নূতন নূতন সজ্জা প্রসাধনের প্রয়োজন হত না—কটাক্ষ-কৌশল বিলুপ্ত হয়ে যেতো। তার ওপর, এই চার বছর ধরে যে যৌবনোদ্দমতাকে একমাত্র জানকীরই নিজস্ব শক্তি, অর্থাৎ টেনে রাখার কলাময় রজ্জু বলে বেণুকরের মনে হতো, তা যেন এখন আর হয় না। বেণুকরের মনে ক্ষোভ আছে বলা হয়েছে, সেই ক্ষোভের উৎপত্তি ঐখানে। জানকীর রক্তাধর আর শুভ্র দর্শন তেমনি চমৎকারই আছে—দেহের নিবিড়তাও অশেষ—কিন্তু ঐ পর্যন্তই; আর এমন কিছুরই উদ্ভাবন সেখানে নেই যার নাম দেওয়া যায় লীলাময়িত্ব, আর যা তাকে নিত্যই নূতন করে তুলবে এবং বেণুকরের লুব্ধতা আর প্রীতি আর আকর্ষণ এবং তারপরে তৃপ্তির আর অন্ত থাকবে না।
শেষ পর্যন্ত দাঁড়ালো এই কথাটাই যে, স্ত্রীর পক্ষ হতে মানসিক একটা সৃজনলীলা—রূপের পর রূপের আবর্তন আর রসের অন্তে রসের উদ্ভব দেখবার জন্য লাঙল আর বলদের মালিক চাষী গৃহস্থ বেণুকরের মন লালায়িত হয়ে উঠেছে। তার মনে হয়, ধুর, একঘেয়ে আর ভালো লাগে না।
জানকী রাঁধে সুন্দর, গোছালো তেমনি, আর দ্রুত কাজ সারতেও তেমনি পটু। সে জানে সবই—সূঁচ হাঁটিয়ে ছেঁড়া কাপড় সূক্ষ্ণভাবে রিফু করতে যেমন জানে, তেমনি জানে ঢেঁকি পাড়িয়ে চাল, চিঁড়ে প্রস্তুত করতে; কিন্তু জানে না যে, বস্তু হিসেবে তার স্বকীয়তা এবং দর একটু কমে এসেছে।
আজ হঠাৎ তা জানা গেলো।
ঘর-দোর ঝাঁট দিয়ে সন্ধ্যা-প্রদীপ জ্বালবার পর কিছুক্ষণ গৃহস্থ বধূর হাতে কাজ থাকে না। চারদিকে তখন শাঁখ, ঘণ্টা বাজতে থাকে। মানুষ যখন বর্বর ছিল—বাসস্থানকে সুরক্ষিত করতে শেখেনি, সন্ধ্যাকে বন্য জন্তুর ভয়ে ভয়ঙ্কর মনে হয় তখন ওই প্রচুর ধাতব শব্দ উৎপন্ন করবার প্রয়োজন ছিল, কিন্তু এখন বাজে আরতির সময় মন্দিরে। সে যাই হোক, এই সময়টা বিরামের সময়।
বেণুকরের গৃহেও এই সময়ে কর্মবিরতি দেখা দিয়েছে—বসে বসে নিবিষ্টভাবে হুঁকো টানছে আর জানকী অদূরে পা মেলে বসে—উভয়ই নীরব হুঁকো টানতে টানতে প্রদোষ অথচ শুভ এই সময়ে বেণুকরের দৈবাৎ মনে হলো, জীবনের মধুস্বাদে যে-অপরিমেয় নিবিড়তা ছিল তা যেন আর নেই—তৃষ্ণা যেন নিঃশেষ হয়ে মিটছে না—কে যেন দ্রাক্ষারসে জল ঢেলে দিয়েছে। তার পূর্বোক্ত ক্ষোভটা আকস্মাৎ পূর্ণবেগে জেগে উঠল।
হুঁকো টানা বন্ধ করে বেণুকর আকাশের দিকে তাকাল—সেখানে কিছুই ছিল না, কিছুই তার চোখে পড়ল না। তেল ফুরিয়ে দীপের শিখা যখন নিবে আসে তখন একটা নিঃশব্দ হাহাকার যেন কোথায় ওঠে, মনে কী শিখায় তার ঠিক নেই, তেমনি একটা পরাজিত অশক্তের শোকের ছায়া যেন আকাশে রয়েছে, কিন্তু বেণুকর মণ্ডলের সে-চোখ নেই যে-চোখে আকাশের বর্ণ, ভাষা, গতি সচেতনভাবে প্রতিফলিত হয়। তবু সে খানিকক্ষণ আকাশের দিকে হাঁ করে চেয়ে রইলো। তারপর সে চোখ নামিয়ে তাকালো স্ত্রী জানকীর দিকে—তাকিয়ে মলিনতার হাসি হাসলো, যেন একটা উদ্বেগ সে গোপন করতে চায়।
জানকী স্বামীর চোখের ওঠা-নামা লক্ষ করেছিল, জিজ্ঞেস করল, ‘কী?’
বেণুকর বলল, ‘কিছু না। তবে শুধোচ্ছিলাম একটা কথা।’
মিষ্ট কণ্ঠে জানকী বললো, ‘বলো শুনি।’
বেণুকর আবার হাসলো। তার ধারণা, হাসির দ্বারা তার পশ্চাদ্বর্তী কথার পথ সুগম হচ্ছে। তারপর বললো, ‘শুনি মেয়েমানুষের আঠালো কলা—সত্যি নাকি?’
বক্তা কী বলতে চায়, তা জানকী তৎক্ষণাৎ বুঝলো, বললো, ‘সত্যি নয়। কলা আঠার তো নয়ই, তার ঢের বেশি—কেউ বলে ছত্রিশ, কেউ বলে চুয়ান্ন।’
পরদিন সকালবেলা বেণুকর আবার মাঠে যাবে; কিন্তু তার আগে অর্থাৎ খুব ভোরে জানকীকে শয্যা ত্যাগ করতে দেখা গেলো এবং তারপর আরও দেখা গেলো, ন্যাকড়ার একটা পুঁটলি আর ধারালো একটা খুরপি নিয়ে সে পুবের মাঠে দিকে ছুটছে।
দেখা গেলো, জানকী একদা যে কুড়ির ঘর পর্যন্ত নামতা কণ্ঠস্থ করেছিল, তা সে বিস্মৃত হয়নি। বেণুকর বিস্মিত হলো, কয়েকবার হুঁকো টেনে বললো, ‘এত? কিন্তু তোর তো তার একটাও দেখিনে!’
‘তা আশ্চর্য কী এমন! দেখাইনে তাই দেখো না।’
বেণুকর চুপ করে রইলো। একটা মানুষ যা দেখাতে পারে কিন্তু দেখায় না, সেটাকে দেখাও বলে তার কাছে আবদার করা যেতে পারে; কিন্তু আবদার করে আদায় করার মতো জিনিস স্ত্রীলোকের কলা নয়—সংখ্যায় তা যতই হোক।
জানকী জিজ্ঞেস করলো, ‘কার ঢঙ দেখে ভালো লেগেছে? না কেউ সুর ধরিয়ে দিয়েছে?’
বেণুকর বললো, ‘তা সব কিছু নয়। অমনি মনে হলো, বললাম।’
‘দেখবে?’
বেণুকর এবার লজ্জা পেলো। মনে মনে যার অভাব অনুভব করে বেণুকর তৃষিত হয়ে উঠেছিল, সেই জিনিসটা দিতে চাইলেই কেমন বেখাপ্পা হয়ে উঠলো। উদ্দেশ্য প্রচ্ছন্ন থাকে বলে যে-দান অমূল্য করে পাওয়া হয়, তা জানিয়ে-শুনিয়ে দিতে গেলে ভালো লাগে না। কেমন লাগে তা ভাবাই যায় না।
বেণুকর হুঁকো রেখে মুখ নামিয়ে রইলো।
জানকী বললো, ‘চাষার ঘরে কলা! আচ্ছা দেখাব।’
শুনে বেণুকর খুব অপদস্থ হয়ে মুখ ফিরিয়ে প্রস্থান করল।
বৈশাখের শেষ। বৃষ্টিতে মাটি একটু ভিজলেই চাষের কাজ শুরু করা যায়, কিন্তু মেঘের দেখা নেই। বৃষ্টির অভাব দারুণ দুশ্চিন্তার বিষয় হয়ে উঠেছে। এমন সময় দেবতা একদিন দয়া করলেন। তুমুল গর্জন করে একদিন বিকালে মেঘ বারিবর্ষণ করলো। জল প্রচুর নয়, তবে সূত্রপাত হিসেবে আশাপ্রদ। কৃষিজীবীরা আনন্দিত হয়ে উঠলো। মাঠে এবার লাঙল চলবে।
বেণুকর বলল, ‘যাক বৃষ্টি তো হলো।’
জানকী বললো, ‘এবার আমায় ছেড়ে বলদের আদর হবে।’
বেণুকর বলল, ‘ধ্যেৎ!’
স্বর খানিকটা তিক্ত করে জানকী বললো, ‘ধ্যেৎ কেন?’
তারপর মনের কথাটা চেপে বললো, ‘কালই মাঠে বেরুতে হবে তো!’
‘হবেই তো।’
‘আগে চষবে কোন্ মাঠটা?’
চার বছর ধরে স্বামীর সঙ্গে কায়মনোবাক্যে সহযোগিতার ফলে জানকী তাদের সব জমিই চেনে।
বেণুকর বললো, ‘পুবের মাঠে তিন কিত্যে এক লাগাও। তাতেই হাত দেব আগে। দু-দিন লাগবে। দক্ষিণ দিকটা নামো। কাজেই উত্তর থেকে লাঙল দিতে হবে। তবে তাড়াতাড়ি তেমন নেই।’ বলে ক্ষেত্রকর্ষণের ব্যবস্থা করে বেণুকর আকাশের দিকে চাইলো। আকাশে মেঘের আনাগোনা রয়েছে।
পরদিন প্রত্যূষে নয়, সকালবেলা, রোদ উঠবার পর গুড়-মুড়ি আর জল খেয়ে বেণুকর লাঙল আর বলদ নিয়ে, আর হুঁকো আর কলকে প্রভৃতি নিয়ে অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে মাঠের উদ্দেশে বেরুচ্ছে এমন সময় জানকী পিছু ডাকলো; বললো, ‘টানকাঠির বাক্স নিয়েছ?’
বেণুকর ফিরে দাঁড়িয়ে বললো, ‘এঃ, প্রথম দিনটাতেই পিছু ডেকে ফেললি! নিয়েছি।’
জানকী বললো, ‘ঘরের যুবতী বউ পিছু ডাকলে ভালো হয়।’
বেণুকর বললো, ‘ধ্যেৎ!’
‘ধ্যেৎ কেন? কাঠির বাক্স মাটিতে নামিয়ে রেখো না, ভিজে উঠবে।’
বেণুকর বলল, ‘বেশ।’ বলে বেরিয়ে গেলো।
কিন্তু সেদিন দু-কিতার বেশি জমিতে লাঙল দেওয়া সম্ভব হল না—রোদের তেজ খুব, আর অতিরিক্ত রোদ সহ্য করে, তাড়াতাড়ি করবার দরকারও তেমন নেই।
খেতে বসে বেণুকর বললো, ‘দক্ষিণের খানা বাকি রইলো; কাল ওটা হলেই ও-মাঠটা শেষ হয়।’
পরদিন সকালবেলা বেণুকর আবার মাঠে যাবে; কিন্তু তার আগে অর্থাৎ খুব ভোরে জানকীকে শয্যা ত্যাগ করতে দেখা গেলো এবং তারপর আরও দেখা গেলো, ন্যাকড়ার একটা পুঁটলি আর ধারালো একটা খুরপি নিয়ে সে পুবের মাঠে দিকে ছুটছে।
চাষের কাজে সে অবশ্যই যায়নি। গিয়েছে অন্য কাজে।
সকালবেলা, সূর্যোদয়ের খানিক পরে, গুড়-মুড়ি আর জল খেয়ে বেণুকর আগের মতো মাঠে লাঙল দিতে এসেছে। রাত্রির গরমের পর গ্রীষ্মের প্রাতঃকাল ভারি স্নিগ্ধ লাগায় বেণুকর সানন্দে বলদ জুড়লো। পাচনখানা বাগিয়ে ধরে সে আল ছেড়ে ক্ষেতে নামলো।
বলদ তার আদেশ বোঝে। চলে থামে তার কথায়। তার আদেশে বলদযুগল লাঙল টেনে চলতে শুরু করলো। চতুষ্কোণ ক্ষেত্র বেড়ে লাঙল মন্থর গতিতে চলতে লাগলো। লাঙলের জোরে নিচেকার শুষ্ক মাটি পিণ্ডের আকারে উৎপাটিত আর স্বতন্ত্র হয়ে লাঙলের ফালে খনিক মৃত্তিকার দু-পাশে যেন গজিয়ে উঠতে লাগলো। দেখতে ভারি আরাম, যেন অপরূপ নূতন কিছুর সৃষ্টি হচ্ছে! বেণুকরের কৃষি-স্ফূর্তি বেড়ে গেলো।
কিন্তু তার কৃষি-স্ফূর্তি স্থায়ী হলো না। লাঙল দু-বার ক্ষেত্রের চারকোণ বেড় ঘুরে এসে তৃতীয়বারের মাঝামাঝি আসতেই উন্মূলিত মাটির দিকে চেয়ে বেণুকর বিস্ময়ে একেবারে হতবাক হয়ে রইলো। মাটি কেটে আর মাটি ওলটপালট করেই লাঙল এই পর্যন্ত এসেছে, কিন্তু ঠিক এই স্থানটিতে লাঙল কেবল নিচের মাটিই ওপরে তোলেনি, মাটির নিচ থেকে আরও কিছু তুলেছে। লাঙলের ফালে আধ হাত আড়াই পোয়া মাটির ভেতর থেকে উঠেছে, ফুল নয়, ফল নয়, শস্য নয়, শামুক নয়, কচ্ছপের ডিম নয়, টাকার ঘটিও নয়, জীবন্ত একটি মাগুর মাছ! কৃষিজীবী বেণুকর মণ্ডল কৃষিকর্ম, বলদ, লাঙল, ক্ষেত, খামার, ধান, কলাই, বৃষ্টি, বৈশাখ, ছায়া, রৌদ্র প্রভৃতি সমুদয় বিস্মৃত হয়ে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল মাগুর মাছটির দিকে। অপূর্ব আবির্ভাব তা। দেড় পোয়া সাত ছটাক ওজনের জলবাসী মাছ মাটির ভেতরেও কেমন তরতাজা বলিষ্ঠ ছিল। কাত হয়ে কানে হেঁটে মাছটি খোঁড়া মাটির গুঁড়ো আর ঢেলার ভিতর দিয়েই চলবার চেষ্টা করছে!
মাগুরটির দিকে নিষ্পলক চক্ষে তাকিয়ে থেকে থেকে বিস্ময়ের পর বেণুকরের মনে জন্মাল অনন্ত আনন্দ। এরই নাম অদৃষ্ট। ঈশ্বর যদি দেন তা ছাপ্পর ফুঁড়েই দেন, কথাটা সত্যি; কিন্তু তার চাইতেও কল্যাণের কথা এই যে, ঈশ্বর যদি দেন তো মাটির ভিতর সজীব মাগুর মাছ রেখে দেন! ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মানুষের প্রতিদিনের আহার ব্যাপারের দিকেও ব্রহ্মাণ্ডপতির কেমন নজর দেখ! তুচ্ছ বেণুকর আহার করবে বলে স্নেহবশত তিনি কী আশ্চর্য কাণ্ডই না ঘটিয়েছেন!
লাঙল, বলদ এবং হুঁকো-কলকে মাঠে রেখেই বেণুকর মাগুর মাছের মাথা আঙুলে চেপে ধরে আর স্নেহময় ব্রহ্মাণ্ডপতির প্রতি কৃতজ্ঞতায় উদ্বেলিত হয়ে বাড়ির দিকে দৌড়ালো।
বেণুকর ঝোলের দিকে চেয়ে বললো, ‘আবার হিঞ্চের ঝোল করেছিস কেন? তোর বড় রান্নার শখ।’
জানকী হয়তো বৈশাখের অখাদ্য বেগুন ভাজবার আর বড়ি-পোস্ত করবার আলু-কুমড়োর টক রাঁধবার কথা ভাবছে। আজ আর সেসব কিছু নয়। আজ খালি মাগুর মাছের ঝোল আর ভাত। আর কিছু নয়। মাগুর মাছের মাথার চাইতে লেজই মিষ্ট বেশি।
পথে দেখা রাজীব হাজরার সঙ্গে। রাজীবের ইচ্ছা হলো, দাঁড়িয়ে দুটি কথা কয়, আর মাটি-মাখা মাগুর মাছ হাতে করে বেণুকরের বাড়ির দিকে দৌড়াবার কারণটা কী তা জিজ্ঞাসা করে! কিন্তু বেণুকর থামলো না–-‘পেয়ে গেলাম দৈবাৎ’ বলে রাজীবের জিজ্ঞাসু দৃষ্টির জবাব দিয়ে সে তেমনি দ্রুতপদে অগ্রসর হয়ে গেলো।
পেছনে দুপদাপ শব্দ শুনে জানকী ঝাঁটা থামিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। সে উঠোন ঝাঁট দিচ্ছিল। চেয়ে দেখলো, স্বামী অসময়ে বাড়ি এসেছেন, হাতে তার তাজা মাগুর মাছ, আর মুখময় হাসি।
‘শোন এক তাজ্জব ব্যাপার!’ বলে শুরু করে বেণুকর মৎসপ্রাপ্তির ইতিহাস বললো।
পরিশিষ্টে নীতি-হিসেবে সে এটাও বললো যে, ঈশ্বর যখন দেন তখন শুকনো মাটির ভেতর মাটির মাছ রেখে দেন, খাওয়াবার উদ্দেশ্যে। তারপর অধিকতর পুলকের সঙ্গে বললো, ‘নে মাছ রাখ্। এই মাছের ঝোল আর ভাত, আর কিছু না আজ।’
আদ্যন্ত শুনে জানকী প্রশ্ন করলো, ‘মাছ কোথায় পেলে গো? দিব্যি মাছটি তো!’
প্রশ্নের জবাবে কথার সুরে আদর ঢেলে বেণুকর বলল, ‘শুনলি কী তবে এতক্ষণ! মাঠে লাঙল দিচ্—হঠাৎ দেখি, মাটির ভিতর থেকে উঠেছে লাঙলের মাটির সঙ্গে এই মাছ!’ বলে সে চোখ বড় করে তাকিয়ে রইলো।
কিন্তু জানকী এই কথা শুনে বললো, ‘মিছে কথা।’
‘মিছে কথা! তোর দিব্যি, ভগবানের দিব্যি।’
‘তবে রাখ এই হাঁড়ির ভেতর—খানিক জল দিয়ে রাখ।’
হাঁড়ির ভেতর জল দিয়ে মাগুর মাছ তখনকার মতো জিয়িয়ে রাখা হলো স্বামী-স্ত্রী পরস্পরের প্রতি পরম সহানুভূতির সঙ্গে। জল পেয়ে মাছ ক্রীড়াশীল হয়ে উঠেছে। সেই দিকে তাকিয়ে বেণুকর বললো, ‘আজ এই মাছের ঝোল আর ভাত খাব। সকাল সকাল ফিরব মাঠ থেকে।’ বলে বেণুকর মাঠের উদ্দেশে ফিরে দাঁড়ালো।
যেতে যেতে দরজায় দাঁড়িয়ে হেসে বললো, ‘কী অদেষ্ট দেখ্।’
জানকী বললো, ‘হুঁ।’
জানকীর সকাল সকাল রান্না শেষ হয়েছে। বেণুকরও সকাল সকাল মাঠ হতে ফিরেছে। বললো, ‘চান করতে চললাম। ভাত বাড়।’
জানকী বলল, ‘বেশ এসো গে।’
মাগুর মাছের ঝোল খাবার ব্যগ্রতায় বেণুকর ষোল আনা আরাম আদায় করে স্নান করতে পারলো না। পুকুরের জলে তাড়াতাড়ি দুটো ডুব দিয়ে সে উঠে পড়লো।
তার ফিরবার সাড়া পেয়ে জানকী জিজ্ঞাসা করলো, ‘ভাত বাড়ব?’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, কাপড় ছাড়ছি।’
কাপড় ছেড়ে এসে বেণুকর পিঁড়িতে বসলো, ‘আন্ দেখি।’
জানকী থালায় দিল ভাত আর বাটিতে দিল ঝোল।
বেণুকর ঝোলের দিকে চেয়ে বললো, ‘আবার হিঞ্চের ঝোল করেছিস কেন? তোর বড় রান্নার শখ।’
জানকী প্রশংসা পেয়েও কথা কইলো না।
বেণুকর শাকের ঝোল মেখে বাড়া-বাতের চার ভাগের এক ভাগ খেয়ে তিন ভাগ রেখে দিল মাগুর মাছের ঝোলের জন্য। বললো, ‘মাছ দে।’
মাঠের মাটির ভেতর মাগুর মাছ পেয়ে বেণুকর যতই বিস্মিত হোক, দিশেহারা হয়নি, সে-বিস্ময়ের অন্ত ছিল, তাতে তার মস্তিষ্কের পরিস্থিতি একেবারে নষ্ট হয়নি; কিন্তু মাছ চাওয়ার পর জানকীর কথায় তার যে বিস্ময় জন্মালো সে-বিস্ময়ের সীমা-পরিসীমা মাপ-পরিমাপ ওজন-আধার কিছুই যেন নেই। তা এতই বেশি! জানকী স্পষ্ট বলল, ‘মাছ কোথায় পাব?’
বেণুকর জন্মাবধি ঠাট্টা বোঝে না; বুঝলে কথাটাকে ঠাট্টা মনে করতে পারতো—বিস্ময় দুঃসহ হয়ে তার মাথা এমন ঘুরে উঠত না।
শরীর খাড়া করে বেণুকর বললো, ‘মাছ কোথায় পাবি? যে-মাছ এনে দিলাম তখন তা কী হলো?’
‘মাছ তুমি কখন আনলে?’
‘মাছ আমি কখন আনলাম? মাছ আনিনি? কুকুর-বেড়াল দিয়ে খাইয়েছিস বুঝি?’
‘নেও, এবার থাম। আর একটু শাক-ঝোল দেই, খেয়ে ফেল ভাত কটি। আর খ্যাপামি কোরো না মাছ মাছ করে!’
‘খ্যাপামি করব না মাছ মাছ করে? দে বলছি মাছের ঝোল শিগগির, নইলে ভালো হবে না।’ বলে বেণুকর চোখ দুটো লাল করে তুলল যে, তার সম্মুখে প্রতিবাদ আর না চলবারই কথা।
কিন্তু জানকী বলল, ‘মন্দ-ই বা কী করতে পার মিছিমিছি?’
‘মন্দ-ই বা কী করতে পারি মিছিমিছি? এখনো বলছি ভালোভাবে। রাগাস্ নে বেশি।’
‘মাছ কোথায় পাব যে তোমায় ঝোল রেঁধে খাওয়াব? কী মুশকিলেই ফেললে তুমি আমাকে!’
‘কী মুশকিলে ফেললাম তোকে? তবে দেখ্ মুশকিল কাকে বলে।’ বলে বেণুকর এঁটো হাত বাড়িয়ে জানকীর চুল ধরতে যেতেই, তাতেই স্বামীর সেই যৎসামান্য প্রচেষ্টাতেই, ভয় পেয়ে জানকী এমন চিৎকার করলো যে, বেণুকরই চমকিয়ে হাত টেনে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো।
আশেপাশে অনেক লোক বাস করে। বিপন্না প্রতিবেশিনীর আর্তনাদ শুনে তাদের তিন-চার জন দৌড়ে এলো।
‘মোড়ল রয়েছ? কী হল ম’ল্যান?’ প্রবীণ নধরগোপাল চৌধুরী উঠোন হতে প্রশ্ন করে এগুতে লাগলো।
নন্দগোপাল চৌধুরী উকিলের মুহুরি ছিলেন। বৃত্তির পয়সা চুরি করে একবার এবং উকিলের টাকার হিসেব মিলোতে না পেরেও চোখ গরম করায় আর-একবার মার খেয়ে গ্রামে এসে বসেছে। নধরের এক ছেলে কলকাতায় এক দোকানে বেচাকেনার কাজ করে। ভয়ঙ্কর আদালতের ভয়াবহ জটিল সব ব্যাপার তার কাছে জলের মতো পরিষ্কার, এই জন্যে এবং ছেলের মারফত কলকাতার আভিজাত্যের সঙ্গে সংযুক্ত বলে নধরের গ্রামে প্রতিপত্তি খুব। বিবাদের মীমাংসায় কর্তা সাজতে তার যেমন আনন্দ, তেমন আর কিছুতেই নয়।
এই নধর চৌধুরী বেণুকর এবং জানকীকে প্রশ্ন করে জানতে চেয়েছে ব্যাপার কী?
কিন্তু রান্নাঘরের ভেতর থেকে বেণুকরের কোনো জবাব আসলো না। জবাব দিলো জানকী। বলল, ‘আমাকে অনর্থক মারতে উঠেছে।’
‘আঠারো কলা দেখতে চেয়েছিলে না! এ তারই একটি। রাগ কোরো না, তোমার পায়ে ধরি।’ বলে জানকী সত্যই স্বামীর পা ধরে বললো, ‘মাগুর মাছের ঝোল রেঁধেছি। এস খেতে দিগে।’
‘কেন?’ বলে নধর চৌধুরী প্রভৃতি…বেণুকরের রান্নাঘরের সম্মুখে এসে দাঁড়ালো।
জানকী মাথার কাপড় একটু টেনে দিলো; বললো, ‘শোনো তোমরা ওকে শুধিয়ে। কী বলছে সব আবোল-তাবোল মাছ মাছ করে।’
বেণুকর বললো, ‘কী বলছি সব আবোল-তাবোল মাছ মাছ করে? শোনো নধর-দা; সক্কালবেলা গেলুম মাঠে লাঙল দিতে। দু-বেড় চষতেই দেখি, একটা মাগুর মাছ, এত বড় তাজা মাগুরটা মাটির ভিতর থেকে উঠে পড়েছে।’
বিবাদের বিষয়ের জটিলতা দেখে নধর পুলকিত হলো; বললো, ‘আচ্ছা। মাটির ভেতর মাগুর মাছ! তারপর?’ বলতেই তার দৃষ্টি বিচারকের দৃষ্টির মতো সূক্ষ্ণ হয়ে উঠলো।
বাদী বেণুকর বলতে লাগলো, ‘ছুটে এলুম ঘরে। বললাম, এই মাছের ঝোল আর ভাত খাব আজ। রাঁধ্ ভালো করে। বলে মাছ ঐ হাঁড়িতে জল দিয়ে রেখে গেলুম আবার মাঠে।… চান করে খেতে বসলুম—দিলে হিঞ্চে শাকের ঝোল খালি। রাগ হয় না মানষের?’
প্রতিবাদিনী জানকী বললো, ‘শুনলে লোকের কথা! মাছ নাকি এনে দিয়েছে!’
বিচারক নধর চৌধুরী উভয় পক্ষের বাদ-প্রতিবাদ শুনে বললো, ‘বেণু, ভাই, ঠাণ্ডা হও। মাঠের জল শুকিয়েছে কার্তিক মাসে। এটা হচ্ছে গিয়ে বোশেখ। মাটির ভেতর মাগুর মাছ তো তাজা কী মরা কোনো অবস্থাতেই থাকতে পারে না।’
‘বললেই হলো থাকতে পারে না! আমি দেখলাম, পেলাম, হাতে করে বাড়ি নিয়ে এলাম—আর তুমি পঞ্চায়েতি করে বলে দিলে আন্দাজের ওপর, থাকতে পারে না।’
সকলে হাসতে লাগলো। কালীপদ বললো, ‘মাথা বিগড়েছে।’
জানকী বললো, ‘সেই মাছের ঝোল রাঁধিনি বলে আমায় মারতে উঠেছে।’
‘মারবই তো।’ বলে বেণুকর পুনরায় রুখে উঠতেই কালীপদ প্রভৃতি রান্নঘরে ঢুকে তাকে ধরে ফেললো।
নধর চৌধুরী বললো, ‘অকারণে মারধর কোরো না, বাপু! মাছ তুমি পাওনি! অসম্ভব কথা বললে চলবে কেন? আদালতে এ-কথা টিকবে না। দেখি চোখ।’ বলে নজর করে বেণুকরের চোখ দেখে নধর চৌধুরী বললো, ‘লাল হয়েছে।’
গুণময় পাল বললো, ‘শুনছ, বেণুকর, হাত ধুয়ে ঠাণ্ডা জায়গায় একটু বসো। এখুনি সেরে যাবে। বোশেখের রোদ হঠাৎ মাথায় লাগলে চোখে অমন সব ভ্রম লোকে দেখে। সেবার আমারই হয়েছিল অমনি। মাঠ থেকে ফিরছি ঠিক দুপুরবেলা লাঙল আর গরু দুটো নিয়ে, কিন্তু মনে হচ্ছে, গরু যেন দুটো নয়, চারটে।’ বলতে বলতে গুণময়ই ঘটিতে করে জল এনে বেণুকরের হাত ধুয়ে তাকে ঠাণ্ডা জায়গায় বসিয়ে দিলো; জানকীকে বললো, ‘ভয় নেই, ভালো হয়ে যাবে।’
বেণুকর একেবারে নিবে শেষ হয়ে গেলো। তার তখন প্রায় অচেতন অবস্থা।
বারান্দায় সে ঘাড় গুঁজে বসে রইলো। হাতে নেড়ে জানালো, তোমরা এখন যাও।
প্রতিবেশীগণ বেরিয়ে গেলো।
হিতসাধগণের অগ্রণী নধর চৌধুরী বলে গেলো, ‘আর যেন চেঁচামেচি শুনিনে।’
খানিক চুপ থেকে জানকী একটু হাসলো; তারপর বললো, ‘আঠারো কলা দেখতে চেয়েছিলে না! এ তারই একটি। রাগ কোরো না, তোমার পায়ে ধরি।’ বলে জানকী সত্যই স্বামীর পা ধরে বললো, ‘মাগুর মাছের ঝোল রেঁধেছি। এস খেতে দিগে।’
বেণুকর উঠে খেতে গেলো, কিন্তু রাগের জ্বালায় কথা কইলো না।