প্রায় তিন দশকের নিরবচ্ছিন্ন লেখালেখির মধ্য দিয়ে স্বতন্ত্র স্বর তৈরি করে নিয়েছেন বীরেন মুখার্জী। প্রবন্ধ ও গল্পে এবং প্রধানত কবিতায় তিনি তাই সহজেই শনাক্তযোগ্য। সাহিত্যের প্রায় সকল শাখায় তার স্বতঃস্ফূর্ত বিচরণ থাকলেও কেবল একজন কবি হিসেবেই তিনি দীর্ঘ আলোচনার দাবিদার। তার প্রকাশিত কবিতাগ্রন্থের সংখ্যা নয়। প্রতিটি কবিতাগ্রন্থে ভিন্নতর কাব্যবোধের সাবলীল প্রকাশের পরও সেগুলোতে এক অভিন্ন ভাষা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
গত শতকের ত্রিশের দশকে প্রবল রবীন্দ্রশক্তি-বলয় থেকে বেরিয়ে এসে নতুন কবিতা লেখার যে প্রবণতা শুরু হয়েছিল, বাংলা কবিতার ইতিহাসে তা ছিল সর্বশেষ ও সর্বাপেক্ষা গুরুত্ববহ বাঁকবদল। বাংলা কবিতার ভাঁড়ারে তা নবতর সংযোজনও বটে। এরপরও দশকে দশকে বাংলা কবিতার অবয়ব বদলেছে, পাল্টেছে বিষয় ও প্রকরণ—কখনো কম কখনো চোখে পড়ার মতো।
মূলত, বিগত শতকের নিস্তরঙ্গতা ভেঙে যে দুটি বড় ঘটনা বিশ্বের মনুষ্য-মানসে তীব্র আন্দোলনের জন্ম দিয়েছিল, তা হলো প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। আর ধর্মের ভিত্তিতে সাতচল্লিশের দেশভাগ এবং একাত্তরের দুর্বার গণযুদ্ধে বাংলাদেশ নামের এক স্বাধীন দেশের জন্ম ছিল দক্ষিণ এশিয়ার দুটি বড় উল্লেখযোগ্য ঘটনা। এ সমস্তই বাংলা কবিতার প্রবাহকে প্রভাবিত করেছে দারুণভাবে। আশির দশকের শেষ পর্যায়ে একদিকে দেশের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন অন্যদিকে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙন বাংলাদেশের কবিকুলকে অধিকতর রাজনীতি-মনস্ক করে তোলে। এ সময়খণ্ডের কবিতায় তার প্রকট ও প্রচ্ছন্ন ছাপ বিদ্যমান। এর অব্যবহিত পরে বীরেন মুখার্জীর কাব্যশক্তির বিকাশ। তথ্য-যোগাযোগ ও প্রযুক্তির বলতে গেলে প্রচণ্ড বিস্ফোরণ ঘটেছে এই কালপর্বে, যা আজও পরিবর্ধমান। পাশাপাশি মানুষ সংক্রমিত হয়েছে আরও বেশি বিচ্ছিন্নতা আর আত্মকেন্দ্রিকতায়। বেড়েছে পরমত অসহিষ্ণুতা, অবক্ষয়িত হয়েছে মূল্যবোধ। এই সমস্ত কিছু নিয়ে একটি শতাব্দীর সমাপন ও নতুন শতকের প্রারম্ভ—এই সন্ধি-সময়ও তাই ইতিহাসের পাতায় বিশেষভাবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে, নিঃসন্দেহে।
প্রযুক্তির প্রসারের এই তিন দশকে কেবল বিশ্বকবিতা নয়, বাংলা কবিতাও বিবর্তনের মুদ্রাগুণে সময় সমুদ্রের সৈকতে তার পদচ্ছাপ রেখে এগিয়ে চলেছে সমান তালে। বাংলা কবিতায় যুক্ত হয়েছে বিচিত্র সব অনুষঙ্গ। এসেছে নতুন নতুন ‘টেকনিক্যাল’ শব্দ। বেড়েছে নিরীক্ষার প্রবণতা। বীরেন মুখার্জী এই সময়েরই একজন উল্লেখযোগ্য কবি। সঙ্গত কারণে, তাঁর কবিতায় স্বাভাবিকভাবেই হাজির হয়েছে আধুনিকতার যাবতীয় উপকরণ।
প্রকাশিত নয়টি কবিতাগ্রন্থের মধ্যে ‘পালকের ঐশ্বর্য (২০১৩)’ অন্যতম। এ কাব্যে বীরেন মুখার্জী একইসঙ্গে সময়ের সমান্তরালে এগিয়ে চলা নিসর্গ-নন্দন মুগ্ধ এক উত্তরাধুনিক ভাষ্যকার। কবিতাগ্রন্থের শিরোনাম থেকেই কবির প্রকৃতি প্রেমের প্রমাণ মেলে। প্রথম কবিতাতে তিনি গিলগামেশ ও বাল্মীকির নামোল্লেখের মধ্য দিয়ে দুটি প্রাচীন ও মহান সভ্যতার অবদানকে স্বীকার করে নিয়েছেন। এরপরই অতীতচারী কবিকে দিয়ে যাপিত জীবনের অভিজ্ঞতা উচ্চারণ করিয়ে নিয়েছে আধুনিকতা-প্রদত্ত হাতাশা। কবিতাটির শিরোনাম ‘দেহের গুঞ্জনে ফোটে পাতার সনেট’।
বীরেন মুখার্জীর কবিতায় যে জগৎ তৈরি হয়, তা যতখানি কল্পনা নির্মিত, ততটাই বাস্তব। এই সময়েরই এক নিখুঁত চিত্র উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে, যখন তিনি লেখেন-
‘প্রত্যাবর্তনের ঘুম মেখে গলে যায় চাঁদের শরীর, রোদের সাম্পানে দুলে ওঠে কার ছায়ামুখ, সময়ের বিপরীতে কে টানে নাইয়র? বহুদিন বুকের আঙুরে হিম হয়ে আছে বেদনার মদ; চারপাশ শূন্য করে নিভে গেছে ললিত পারদ।’ (সভ্যতার পানগৃহ, পৃষ্ঠা: ১০)।
বীরেন এমনই না-বাস্তব-না-কল্পনার অবভাসের মধ্যে দিয়ে সঞ্চারিত করেন গূঢ় জীবনাভিজ্ঞতার বোধ এবং গভীর দর্শনের অন্তঃসলিল প্রবাহ। যেমন ‘চিহ্ন’ কবিতায় তিনি বলেছেন-
‘ডুব দিলে নিঃস্ব হয়ে যাই—এমনই গলিত স্বভাব।
বিশুদ্ধ প্রশ্বাসে রাখি বিমূর্ত স্বকাল
মিলিত পদক্ষেপে বুঝি
সব পথই বিস্তৃত হয় পথের তাগিদে’ (পৃষ্ঠা: ৩১)
আবার ‘নিত্যযাম’ কবিতায় বলছেন- ‘অস্তিত্বের কোনো রঙ নেই, মনে হয় ছেঁড়া পাণ্ডুলিপি’। এইখানে এসে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানটি স্মরণ করা যেতে পারে,
‘আমি কান পেতে রই/ ও আমার আপন হৃদয়গহন-দ্বারে বারে বারে
কোন্ গোপনবাসীর কান্নাহাসির গোপন কথা শুনিবারে—বারে বারে
…
ও সে আমায় জানি পাঠায় বাণী গানের তানে লুকিয়ে তারে বারে বারে’
আপন হৃদয়-দ্বারে রবীন্দ্রনাথ যেখানে এক গোপনবাসীর বাণী শুনতে পান সেখানে নতুন শতাব্দীর কবি বীরেন মুখার্জী হৃদয় সরোবরে ডুব দিয়ে কেবল নিঃস্বতাই খুঁজে পান। আর বলে ওঠেন, অস্তিত্বের কোনো রং নেই। এই যে দেখা, একইসঙ্গে যেমন গভীর দর্শন-সঞ্জাত তেমনই নিবিড় জীবনাভিজ্ঞতা-প্রসূত।
এই দেখা থেকে মুক্তি মেলে না কবির। কেবলই তার মুক্তির আকাঙ্ক্ষা প্রবল হয়ে ওঠে। আর তাই ‘পালকের ঐশ্বর্য’ কবিতায় কবি নিজেই ঘোষণা দেন, ‘বোধের পরাগ উড়িয়েছি বহুকাল প্রমিত আলোর সন্ধানে, এখন নির্বাণকাল’।
এরপরই তিনি লিখলেন ‘জলের কারুকাজ (২০১৪)’। প্রকৃত সত্য এই যে, কবিতাতেই কবি কাঙ্ক্ষিত ‘নির্বাণ’ প্রাপ্ত হন। তাই বুঝি ‘জলের কারুকাজ’-এ এসে বীরেন মুখার্জী আরও বেশি নিসর্গ-নিবিষ্ট হলেন। এর অর্থ এই দাঁড়ায় যে, তার পাঠকদেরও তিনি বিশ্বের অসুহিষ্ণু দৃশ্যাবলি থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে দিলেন প্রকৃতিতে। ‘শরৎ কথন’ কবিতায় ‘আমি আজও বুঝিনি শিউলি, কাশফুল কিংবা শাদা মেঘের ভেলা এগুলো-ই কেন শরতের অনুষঙ্গ হবে?’ এই সত্য সন্ধানের অবকাশে সময়কে স্বীকার করেই সময়ের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি চাইলেন। যদিও এই পঙ্ক্তির গভীরে লুকিয়ে আছে তীব্র আয়রনি।
কবি জানালেন, অন্ধকার নেমে আসা পৃথিবীতে কবিতাই হবে তার আরাধ্য পথ। ‘যে ভোরে আলো ফোটেনি’ কবিতা থেকে উদ্ধৃত হলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে বলে আশা করি—‘নৈকট্যপ্রবণ মন আমার, কবিতার দিন ভেবে হেঁটে যায়, নৈঃশব্দ্যমুখরিত পথে। পকেটে পুরে মোম, অন্ধকার, নীল জ্যোৎস্না আর ফলভর্তি টবের নিরাকার দহন; করতলে ঠোঁটের আর্তনাদ ঝুলিয়ে তোমার পথে—যে ভোরে তুমি জ্বালাবে না একটিও ব্যাখ্যাযোগ্য দীপ!’ (পৃষ্ঠা: ৩৮)।
কবির এই যাত্রা, নিঃসন্দেহে বিশুদ্ধ কবিতার দিকে। ‘হেমন্তের অর্কেস্ট্রা’তেও তুললেন প্রকৃতির সুর। নিবিড় রোমান্টিকতা তুলে ধরলেন আধুনিক কাব্য বয়ানে। সে বিবেচনায় ‘হেমন্তের অর্কেস্ট্রা’ কাব্যে বীরেন মুখার্জী একইসঙ্গে রোমান্টিক তথা প্রকৃতি ও সৌন্দর্যপ্রেমী এবং অবক্ষয়িত আধুনিকতার পর্যবেক্ষক ও যন্ত্রণাগ্রস্ত জীবনাভিজ্ঞতার শৈল্পিক ভাষ্যকার।
এটাই স্বাভাবিক যে, শেষ পর্যন্ত শিল্পীর চোখেই নিরূপিত হয় সময়ের প্রবণতা ও বৈশিষ্ট্যাবলি। বীরেন মুখার্জীর কবিতাতেও ধরা পড়বে এর যথার্থ নিরূপণ। ‘রোদের কঙ্কাল’ কবিতায় তিনি বলছেন-
‘প্রতিদিন ছিঁড়ে যায় অবারিত ভাগ্যরেখা
করতলে নেচে ওঠে সার্কাসমুখরিত ভাবনা, আর
লোকচক্ষুর আড়ালে পান করি—মৃত্যুরাশি;’
(হেমন্তের অর্কেস্ট্রা, পৃষ্ঠা: ২৬)।
এই যে প্রতিমুহূর্তে মৃত্যুকে পান করে যাওয়া, ভাগ্যের কাছে কেবলই পরাজিত হতে থাকা এই অভিঘাত ও এর নিগূঢ় ব্যঞ্জনা কেবল একজন আধুনিক কবির পক্ষেই ফুটিয়ে তোলা সম্ভব। আবার ‘পরিকল্পক’ কবিতায় লিখেছেন-
‘হাঁটতে হাঁটতে এখন নিজেকেই খুন হতে দেখি
ঝরে যাওয়া হলুদ পাতা আর জীবন কী সমান্তরাল তবে!
সময়ের সঙ্গ-অনুষঙ্গ শাসিয়েছে বহুকাল;
তার মগজ-ভূমে রক্তবীজ রোপণ করব বলে
খুব গোপনে হয়ে উঠতে চেয়েছি—নিষিদ্ধ হন্তারক!’ (পৃষ্ঠা: ১৫)
বীরেন মুখার্জী এভাবেই যেমন সময়ের গহ্বরে লুকিয়ে থাকা দগদগে ক্ষত প্রকাশ্যে নিয়ে এসেছেন, তেমনি উসকে দিয়েছেন সম্ভাবনার আলোক উৎস। কবিতাতেই সঞ্চারিত করেছেন বিরুদ্ধ স্রোতে এগিয়ে যাওয়ার স্পর্ধা—
‘কাঁটাঅলা শাখা যতই ভেঙে যাক আজ—ফুলের ঘ্রাণে
আঘ্রাণ লোপাট করে হেঁটে যাবো খানিক দূর’
(শরবাহকের সঙ্গে, পৃষ্ঠা: ৪০)
বিশুদ্ধ কবিতার ভাষা সবসময়ই কিছুটা প্রপঞ্চময়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা দুর্বোধ্যতায় গিয়ে ঠেকে। অথচ, পর্যাপ্ত আড়াল সত্ত্বেও বীরেন মুখার্জীর কবিতার ভাষা দুর্বোধ্যতার স্তরে পৌঁছায় না। তাই তার কবিতা সহজেই পাঠকের মনোযোগ আকর্ষণ করে। বিশেষ করে, টানাগদ্যের কবিতাগুলোতে শব্দের পর শব্দ এসে যে নিরবচ্ছিন্ন প্রবাহ সৃষ্টি করে, তা কবিতাকে সুখপাঠ্য করে তোলে।
বীরেন মুখার্জী মূলত একজন প্রকৃতি বিলাসী ও প্রকৃতিনিমগ্ন কবি। তাঁর ‘পালকের ঐশ্বর্য’, ‘জলের কারুকাজ’ ও ‘হেমন্তের অর্কেস্ট্রা’ কবিতাগ্রন্থে যেমন একদিকে সময়ের সংলাপ বিধৃত হয়েছে, তেমনি নিখুঁত চিত্রিত হয়েছে নিসর্গের নিগূঢ় চিত্রকল্প। কবির সাহিত্যজীবনে তাই, গ্রন্থ তিনটি তার উল্লেখযোগ্য সৃজন-কর্ম হিসেবে বিবেচিত হবে।