[পর্ব-দুই: জন্ম ও শৈশব]
তারেকের বাবার গোঁড়ামি আর কুসংস্কারে বলি হয় আসমার জীবন, মৃত্যু তার সব যন্ত্রণা অসুস্থতা সারিয়ে দেয়। প্রথম সন্তান আসমাকে হারিয়ে মুষড়ে পড়েন তারেকের মা। তিনি তখন সন্তানসম্ভবা ছিলেন। প্রচণ্ড মানসিক আঘাতে তিনি তখন নিশ্চুপ হয়ে যান। চারপাশে থই থই করছে বন্যার পানি।
ঘরের সামনে, উঠানে, পেছনের জমিতে—সব জায়গায় পানি। এত পানির মধ্যে আসমাকে কোথায় সমাহিত করা হবে, তা নিয়ে চিন্তিত সবাই। পরে সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো তারেকের নানা বাড়ি, যেখানে বন্যা এতটা প্রবল নয়, সেখানেই সমাহিত করা হবে আসমাকে। নৌকা এসে ভিড়লো তারেকদের উঠানে। কাঠের বাক্স করে আসমাকে নৌকায় তোলা হলো। পাশাপাশি দুটো নৌকা চলছে। একটিতে আসমার লাশের সঙ্গে বাড়ির কেউ কেউ। অন্য নৌকায় তারেক রয়েছেন মামা চাচাদের সঙ্গে।
তারেক মাসুদের নানা বাড়ি নগরকান্দার ফুলসুতি গ্রামে। ফুলসুতি গ্রামে আসমাকে চিরদিনের জন্য রেখে আসতে যাচ্ছে দুটো নৌকাভর্তি লোক। কিছুদূর যেতেই তারেক কান্না জুড়ে দিলেন আসমার নৌকায় যাওয়ার জন্য। বুঝিয়েও থামানো গেল না তাকে। নৌকা থামিয়ে তুলে দেওয়া হলো আসমার নৌকায় তারেককে।
যে কাঠের বাক্সে রাখা হয়েছিল আসমার লাশ, সে বাক্সের গায়ে চোখ লাগিয়ে বাক্স জড়িয়ে ধরে সারাটা পথ বসেছিলেন ছোট তারেক। বোনকে শেষবারের মতো দেখে নিচ্ছিলেন প্রাণ ভরে তিনি। আসমার মৃত্যু গভীরভাবে প্রভাব ফেলে তারেক মাসুদের মনে। পরবর্তী সময়ে তিনি কুসংস্কার আর গোঁড়ামির বিরুদ্ধে সোচ্চার হন।
আসমার মৃত্যুর ঠিক ৮ দিন পর জন্ম নেয় তারেকের আরেকটি বোন, নাম রাখা হয় সালমা। সালমার জন্মের পর স্বাভাবিক কারণেই তারেক মাসুদকে বেশি সময় দিতে পারেন না তার মা। যত্নও করতে পারেন না ঠিকমতো। তারেক তখন একেবারেই একা হয়ে পড়েন। তখন জবার মা থাকতেন তারেকদের বাড়িতে। তারেককে জবার মা খুব ভালোবাসতেন। তারেক তাই সবসময় জবার মা’র চারপাশেই ঘুরতে থাকতেন। জবার মা যেখানেই যান, তারেকও তার পিছু পিছু গিয়ে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকেন। তারেক মাসুদকে গোসল করানো, খাওয়ানো, ঘুম পাড়ানো—সবই জবার মা করতে থাকেন। জবার মা’র যা ইচ্ছে, তাই খাওয়াতেন তারেককে। রুটি বানাচ্ছেন, তারেক গিয়ে পিঠের ওপর হেলান দিয়ে আছেন, জবার মা আটার একটা গোলা বানিয়ে খেতে দিয়ে দিতেন তাকে। কখনো কখনো ভাতের মাড়, ভর্তা, পান্তা ভাতের টক খিচুড়ি খাওয়াতেন। এসব দেখে নুরুন নাহার বেগম তারেকের পেট খারাপের ভয়ে নিষেধ করেন জবার মাকে এসব খাওয়াতে, কথা শোনেননি জবার মা। আর তারেকও ভালোবেসে হাসিমুখে খেয়ে নিতেন সব। জবার মা তারেককে সন্তানের মতোই ভালোবেসে আগলে রাখতেন ছোট তারেককে।
এখানে জবার মার পরিচয়টা দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করছি।
জবার মা ছোটবেলায় ভারতের তামিলনাড়ুর ভেলোরে হারিয়ে যান। বাবা-মা’র কথা বাড়ির কথা, কিছুই মনে করতে পারেননি তিনি। ভেলোরেই বড় হতে থাকেন বাংলাদেশের হারিয়ে যাওয়া মেয়ে। ভাঙ্গার এক ব্যবসায়ী ব্যবসার কাজে যান ভেলোরে। তখন জানতে পারেন জবার মা’র সব। যদিও তখন তিনি জবার মা হিসেবে পরিচিতি পাননি। তখন কিশোরী বয়স তার। ভাঙ্গার ব্যবসায়ী বাংলাদেশে নিয়ে আসেন তাকে। কিছুদিন পরে বিয়ে করেন তাকে। জন্ম হয় জবার। জবার মা’র ভিড়ে তার নামটাই হারিয়ে যায়। জানা হয় না আর, কেউ বলতেও পারেন না তার নাম। জবার জন্মের পর জবার বাবা জড়িয়ে পড়েন একটা মামলায়।মামলায় পড়ে জবার বাবা নিঃস্ব হয়ে পড়েন। শোকে কষ্টে শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন তিনি। আস্তে আস্তে অবস্থা খারাপ হয়ে পড়ে তার। কিছুদিনের মধ্যেই মারা যান। তারপর থেকেই জবার মা জবাকে নিয়ে তারেকদের বাড়িতে ঠাঁই পান। আর এখন জবার মা ছাড়া তারেকদের বাড়ির কোনো কাজই হয় না।
চলবে…