[পর্ব-১৭]
ট্রেনে গাদাগাদি ভিড়। পা ফেলার জায়গা নেই। ঠেলেগুঁজে তবু উঠে পড়ে তরুণ। ঝোলাটা কাঁধে ফেলে আগলে রাখে হাতে। সাত-সকালে কাউকে কিছু না বলে চুপিসারে নিজের ঝোলাটা নিয়ে কেটে পড়েছে সে। আখড়ার সামনে অটোরিকশা দাঁড়িয়ে থাকে সবসময়। তারই একটায় চড়ে সোজা রেলস্টেশন। তখনো অনেক ভোর। ট্রেনের দেরি ছিল ঘণ্টাখানেক। কাছের একটা ঝুপড়ি দোকান থেকে চা’য়ে ডুবিয়ে একটুকরো পাউরুটি খেয়ে স্টেশনের বারান্দায় সটান শুয়ে বেশ একটু ঘুমিয়ে নিয়েছে। ট্রেনের ঘণ্টা বাজতেই উঠে গিয়ে টিকিট করে নিয়েছে ঝটপট। পঁয়ত্রিশ টাকার টিকিটে সে পৌঁছে যাবে গোয়ালন্দ ঘাট অব্দি। আপাতত কিছুদিন সেখানেই থাকবে। জিনিয়া তাকে খাতির-যত্ন করে বেশ। কাছেই মাজার। রাতে সেখানে ঘুমোয়। দিনে পথে পথে। খাবার সংকটে পড়লে জিনিয়ার ডেরায় উঁকি দেয় মাঝে মধ্যে। তার মতে, মেয়েদের ভালোবাসা হলো কর্পূরের মতো। তোষামোদের হাওয়া লাগলেই উবে যায়। তাদের রাখতে হয় উপেক্ষার জলে চুবিয়ে। তবেই তারা প্রেমে পূর্ণ হয়, কাতর হয় ভালোবাসার তীব্র আকাঙ্ক্ষায়। তার প্রতি জিনিয়ার আকাঙ্ক্ষা টের পেয়ে সে তাই দূরত্ব মেপে চলে ইচ্ছে করেই। জোহরাকে ভালোবেসে, তার প্রেমে ডুবে দেখেছে, যত জোহরার জন্য ব্যকুলতা তৈরি হয়েছে মনে, জোহরা তত সরে গেছে দূরে। ততই বাড়িয়ে নিয়েছে ব্যবধান। অথচ একসময় জোহরা নিজেই ছিল তরুণের প্রেমের জন্য উদগ্রীব, অধীর! মানব চরিত্র দুর্জ্ঞেয়! তারও বেশি স্ত্রী চরিত্র!
কামরাটা মিলিয়ে নিয়ে সে ঠেলেঠুলে জানালার পাশের একটা সিটে জায়গা করে নেয়। গেরুয়া বসন আর হাতের একতারা দেখে জানালার ধারের লোকটা আপষেই জায়গা ছেড়ে দিলো বসার। বসলো রতন। মুখভর্তি দাড়িগোঁফে কাছের মানুষেরাও তাকে চিনতে পারে না আজকাল। এটা মস্ত এক সুবিধা তার। পরিচিত মানুষ মানেই মায়া, চেনা মুখ মানেই স্নেহের ফাঁদ। তাতে সে পড়তে চায় না আর। মাঝে মাঝে তিতলির মুখটা মনে পড়ে। বুকটা কেমন করে তখন। খুব ইচ্ছে হয় একবার দেখে বোনটাকে। কতদিন যে দেখা হয় না তিতলির সঙ্গে! আর অরুন্ধতী! তরুণকে দেখলেই মামা মামা ব’লে ঝাঁপিয়ে পড়তো কোলে। তার টুলটুলে মুখটা দেখলেই বুকের মধ্যে ঢেউ উঠত স্নেহের। তরুণ সেই যে পালালো তিতলির ডেরা থেকে, তারপর ওমুখো হয়নি আর। মেয়েটা নিশ্চয়ই অনেক বড় হয়ে গেছে এতদিনে। হোক। বড় হোক সবাই। মঙ্গল হোক সবার। শুধু সে চায় নিঃশর্ত মুক্তি। মায়ার শেকলে সে জড়াবে না আর। বাঁধা পড়বে না আর কোনো সংসারের খুঁটোয়।
সাঁইজি! গান ধরেন একখান!—পাশের যাত্রী হাতে থাকা একতারায় চোখ রেখে একগাল হেসে বলে ওঠে। জানালা দিয়ে প্রকৃতি দেখছিল তরুণ। লোকটার কথায় চোখ ফিরিয়ে দেখে। ময়লা শার্ট, কনুই অব্দি হাতা গুটোনো। পরনে পুরোনো চেক লুঙ্গি। পায়ে প্লাস্টিকের চটি। ভাঙা গাল, পান খাওয়া লাল দাঁত, উঁচু। বাবড়ি চুল। দেখে বোঝা যায় সংসারে মন নেই লোকটার। একহারা পোড় খাওয়া চেহারা। তাতে নির্লিপ্তির আস্তর জমেছে। চোখদুটো তীক্ষ্ণ, চঞ্চল। লোকটার চোখে চোখ রেখে মৃদু হাসে তরুণ। পৃথিবীতে হাসিই একমাত্র ভাষা যা সার্বজনীন। একদিনের শিশুও সম্ভবত এ ভাষা বোঝে, কথাটা ভেবে আরেকবার হাসল তরুণ, শব্দ করে। তারপর লোকটার থেকে চোখ সরিয়ে নিলো। আবার চোখ রাখলো বাইরে। ছুটছে। দুরন্ত গতিতে ছুটছে সব। ঘরবাড়ি, গাছপালা, মাঠঘাট, সব। না-কি ট্রেনটা ছুটছে? চোখ বন্ধ করে আবার ভাবে। সময় ছুটছে। মানুষ ছুটছে। পৃথিবীও। মূলত সমস্তই ছুটে চলেছে তার কেন্দ্রাভিমুখে। তুমুল গতিতে ছুটছে সবই। কোনোটা দৃশ্যমান, কোনোটা নয়। একতারায় টুংটাং সুর তোলে তরুণ। গান ধরে গুনগুন। বাড়ির পাশে আরশিনগর…
প্রথমে গুনগুন করলেও পরে গলা ছেড়ে গায় তরুণ। ভিড় জমে যায় কামরায়। গানের সুরে অন্য কামরার যাত্রীরা উঁকিঝুঁকি দেয়, চলে আসে এ কামরায়। তরুণ চোখ বুঁজে গেয়ে যায়। ট্রেন ছুটে চলে কু ঝিকঝিক। তরুণের গানের সুরও ভেসে যায় হাওয়ায় ঢেউ ছড়িয়ে। তরুণ নিজেও ছুটে যায় কোন এক অপ্রতিরোধ্য টানে, কোনো এক অজানা কেন্দ্র লক্ষ করে। মাঝে মাঝে টের পায় সে টান। তীব্র, অনুপেক্ষণীয়।
গান থামিয়ে তরুণ হঠাৎ বাদাম কেনে একঠোঙা। টাকা দিতে যেতেই বাদাময়ালা জিব কাটে দাঁতে। টাকা ধরা হাতটা সরিয়ে দিয়ে বলে, টাকা লাগবি না গুরুজি। আপনের গান শুনে মন ভইরে গেচে। আরেকটা গান শুনায়া দেন তারচায়া।
তরুণ হাসে। এ তার কাছে নতুন নয়। বরং এই-ই তার জীবন। গান গেয়ে যে দুচার পয়সা রোজগার হয় তাতেই দিন চলে তার। কেউ দিলে সে হাত পেতে নেয়। না দিলে নাই। কখনো খাবার জুটলে খায়। না জুটলে উপোস। অবশ্য খাবার জুটেই যায়। প্রকৃতি কাউকে নিরাশ করে না। কোনো না কোনোভাবে পূর্ণ করে তোলে শূন্যের পেট।
ট্রেন এগিয়ে যায়। স্টেশনের পর স্টেশন আসে। ট্রেন থামে, যাত্রী ওঠে, নামে। আবার এগোয় ছন্দ তুলে। লুঙ্গি পরা, ভাঙা গালের লোকটা গা ঘেঁষে বসে আলাপ জমাতে চায় তরুণের সঙ্গে। তরুণের তাতে ঘোর আপত্তি। আলাপ মানেই পরিচয়। পরিচয় মানেই প্রশ্ন। প্রশ্ন থেকে শেকড়ের খোঁজ। তাতে শেকড়ের প্রতি টান বেড়ে যায়। ছিঁড়ে যাওয়া তার আবার বেজে উঠতে চায় টঙ্কারে। তরুণ তাই নির্লিপ্ত থাকে। হু হ্যাঁ দিয়ে দায় সারে। লোকটা বারবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে জানতে চায় কোথায় যাবে তরুণ, কোথায় থাকে, কোত্থেকেই বা আসছে সে। তরুণ বিরক্ত হয়। কোথায় যাবে জানে না, পথে পথে থাকে, আসছে সাঁইজির আখড়া থেকে বলেই চোখ বোঁজে সে। জানালায় মাথা রেখে গুনগুন সুর ভাঁজে, গুরু কে বোঝে তোমার অপার লীলে…
লোকটা মাথা দোলায় গানের তালে তালে। তরুণ খেয়াল করে লোকটাও গুনগুন করে সুর ভাঁজছে। গানের গলা ভাল। চর্চা আছে, বোঝা যায়। তরুণ থেমে যায়। লোকটার গান শোনে মন দিয়ে। এতক্ষণে নিশ্চয়ই আখড়ার অনেকেই খেয়াল করেছে তরুণের অনুপস্থিতি। বিশেষত তারা বোষ্টমী। আখড়ায় কারও আসা বা চলে যাওয়া তেমন বড় কোনো ঘটনা নয়। যে যখন ইচ্ছেমতো আসে আবার চলেও যায়। কিন্তু তারার ব্যাপারটা ভিন্ন। সেদিনের পর থেকে তারার সঙ্গে আর স্বাভাবিক হতে পারেনি তরুণ। কিন্তু তারা স্বাভাবিক ছিল একদম। তবে তরুণের প্রতি একটা বাড়তি মনোযোগ দিচ্ছিল তারা, টের পাচ্ছিল তরুণ। কেমন একটা অধিকারবোধ জন্ম নিচ্ছিল তার মধ্যে তরুণের প্রতি। আর সেখানেই যত ভয় তরুণের। সঙ্গে আবার ছিল জোহরার ভূত। যদি সেদিন জোহরাকে দেখতে না পেতো তরুণ, তাহলে তার মনের মধ্যে অমন ঝড় উঠতো না হঠাৎ। জোহরার প্রায় মুছে যাওয়া ছায়া আবার অমন ডালপালা ছড়িয়ে দখল করত না তার মন, আর তাহলে তারার সঙ্গে ব্যাপারটা অমন হুট করে ঘটতো না। সেক্ষেত্রে আখড়ায় আরও কিছুদিন থাকা হতো হয়তো। একদিক দিয়ে অবশ্য ভালোই হলো। আরও বেশিদিন থাকা মানে শেকড় গজিয়ে যাওয়া। শেকড় মানেই মায়া। গভীরতর প্রেম। নাহ্। তারচে’ এই ভালো। এই অবিরাম ছুটে চলা। তাতে জোহরাদের ছায়া পড়ে না মনে। তাতে বাবার উন্মাদ, শেকলবন্দি চেহারা কষ্ট হয়ে চেপে ধরতে আসে না শ্বাস, মায়ের ঝুলন্ত লাশ ছন্দ হয়ে দুলতে থাকে না চোখের কোণে, তিতলির জলে ভরা শুকনো মুখ ফ্যালফ্যাল তাকিয়ে থাকে না সরকারি শিশু পরিবারের বারান্দা থেকে তার অস্তায়মান ছায়ার দিকে। এইই ভালো। কষ্টহীন, বাধা-বন্ধনহীন এক নিরূপদ্রব জীবন। ছুটে চলা নিরন্তর।
চলবে…
আরও পড়ুন:ঝিঁঝিলাগা দিনগুলো-১৬॥ শিল্পী নাজনীন