[তুষার কবির—একমাত্র পরিচয় কবি। জন্মেছেন ১৯৭৬ সালের ২ ফেব্রুয়ারি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিংয়ে সম্মানসহ স্নাতকোত্তর। এই পর্যন্ত প্রকাশিত তার কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে—বাগ্দেবী আমার দরজায় (২০০৬), মেঘের পিয়ানো (২০০৭), ছাপচিত্রে প্রজাপতি (২০০৮), যোগিনীর ডেরা (২০০৯), উড়ে যাচ্ছে প্রেমপাণ্ডুলিপি (২০১০), কুহক বেহালা (২০১২), রক্তকোরকের ওম (২০১৪), ঘুঙুর ছড়ানো ঘুম (২০১৫), তিয়াসার তৃণলিপি (২০১৬), হাওয়াহরিৎ গান (২০১৭), ধূলি সারগাম (২০১৮), তাঁবুকাব্য (২০১৯)। কবিতা-বিষয়ক প্রবন্ধ: কুঠুরির স্বর (২০১৬)। সম্মাননা : ‘কালি ও কলম তরুণ কবি ও লেখক পুরস্কার’। আজ এই কবির জন্মদিনে প্রকাশিত হলো তার একগুচ্ছ কবিতা।]
পিয়ানো
তোমার আদুরে বেড়ালটি নিঃশব্দে ঘুমিয়ে ছিল অই দুর্গের ভেতরে! ওটা আসলে এক প্রাচীন ক্যাথেড্রাল—স্বর্গের পিয়ানো শব্দ করে বেজে ওঠে ওর পুরনো হৃৎপিণ্ডে! তোমার লাল ভেলভেটের বিছানাটিও রাখা ছিল স্যাঁতসেঁতে দুর্গের মেঝেতে। বেড়ালটির নরম পশমে এখনও লেগে আছে তোমার স্তনের ঠাণ্ডা কিছু রোঁয়া। ঝাড়বাতিগুলো এখন নিভানো দুর্গের বৈঠকখানায়; জলদস্যুদের ক্ষয়ে যাওয়া ম্যাপটি রাখা আছে কীটদষ্ট গ্রন্থাগারে—নাশপাতির ভরা টেবিলে কয়েকটি ঠাণ্ডা গ্লাস আর সোনার চামচ পড়ে আছে। তুমি চাইলেই ওগুলো উপচে পড়বে চোলাই করা মদে! দুর্গের ভেতরে এখন আর কোনো রক্তমাংসের মানবীর স্বর শোনা যায় না; শুধু মাঝে মাঝে প্রত্ন প্রান্তরের হাওয়ায় এক ডাকিনীর আর্তনাদ ভেসে আসে!
ছাতিম বালিকা
ছাতিম বালিকা, তোমাকে রাধার মতো লাগছিল বিকেলের ধূলিচেরা রোদে।
তোমার কুমুদ সুরে—ডাহুকী ও ডাকিনীর স্বরে—দ্যাখো এ শরতে আমি হেঁটে যাচ্ছি কোনো নীল ময়ূরীর পুরনো ডেরায়—অরণ্যের সরুপথে—জেগে ওঠা ঘাসের জঙ্গলে! তার পাখসাটে শুনে যাচ্ছি শুধু বেজে ওঠা ঘুমের কিন্নরী!
সান্ধ্য মাধুকরী, আমি টের পাচ্ছি তোমারই হাওয়া হরিৎ গান—এ শরতে সোনা পুড়ে যাওয়ার ঘ্রাণ ভেসে আসে কোনো সোনারুর পাতার কুটিরে!
মুঠোভরা রঙিন টিকিট হাতে আমাকে ডাকছে দ্যাখো টিনশেড শেফালি অপেরা!
ছাতিম বালিকা, তোমারই ভেজা ভেজা শাড়ির আঁচলে আজো খুঁজে পাই কাশফুলের প্রকাশবিভা, কামিনীর ধূপজ্বলা ঘ্রাণ আর শারদীয়া রাধার তনুকা!
প্রেম ও প্র্যাকটিস
এতদিন ঘুরে ঘুরে তুমি বুঝে নিয়েছ যেনবা প্রেম কিছু নয়; কেবল একটা প্র্যাকটিস!
যেমন চায়ের কাপে তুমি রোজ যে ক’চামচ চিনি খাও, আপেলে কামড় বসানোর পর তা যতক্ষণ চিবোতে থাক, পপকর্ন খেতে খেতে উড়ে যাও হাল্কা হাওয়ার ভেতর, রেস্তোরাঁয় বসে বসে বিড়বিড় করে সুর ভাঁজ, ভাঁটফুলে বুঁদ হয়ে যেমন খুঁজতে থাক কোনো ভ্রমরের পদচ্ছাপ!
ভুলে যাওয়ার পর প্রেমিকাকে মনে হতে পারে ওটা এক সাদাকালো আর্কাইভ—যেমন কবিতা লেখা ভুলে গেলে একদিন তোমারও মনে হতে পারে ওগুলো আর কিছুই নয়—খালি টুকরো টুকরো ছন্দ আর শব্দের ফসিল!
ভগ্ন
সৈকতের তীর ঘেঁষা এই
তাঁবু ও বাতিঘর—
বিকেলের ধূলিরেখা ধরে হেঁটে গিয়ে
আমি খুঁজে পাই
শুধু এক বুকঝিম্ ঝাড়বাতি
আমলকী পাতার বিছানা
ভগ্নপ্রায় মৃদুশিখা এক রক্তাভ লণ্ঠন—
সরোবর থেকে উপচে পড়ছে
রক্তফেনা—কোরকের ঘুম—
জানি এই পথে হেঁটে গিয়েছিল
সব দিকশূন্য নাবিকের দল
আর প্রেমশূন্য গণিকার সারি—
স্বরময় সরাইখানার খোঁজে
তারা কড়া নেড়েছিল প্রত্ন কুঠুরিতে—
চেরাকাঠ খসে পড়া ডেরা ধরে
তারা খুঁজেছিল প্রণয়ী প্যাঁচার ছাপচিত্র
সমুদ্রের সান্ধ্যগীতি
আর ভেসে আসা শঙ্খস্বর—
মর্মচেরা মার্মেইড—আমি খুঁজে যাচ্ছি
তোমারই ভগ্নগাথা—স্রােতকান্না—
তাঁবু ও বাতিঘরে দ্যাখো খুঁজে যাচ্ছি
সূর্যাস্তের জলছাপ—ঝিনুকের অনুষ্টুপ—
আর ভাঙা বেহালার ছড়!
ভ্রম
যে পথে দেখেছ তুমি ধূলিরেখা; ভ্রামণিক ভাঁটফুল, তিয়াসার তৃণলিপি—হরিৎ চিরল বাঁশপাতা চিরে ভেসে আসে যে পথে অলীক বনঘুঘু’র গান—রক্তপাথরের ঘুম থেকে ময়ূর যে পথে জেগে ওঠে পাথুরে ডেরায়—নগ্ন বনদেবী যে পথে গাইতে থাকে আত্নরতিগান, পদ্মভাসা সরোবরে—স্নানঘর থেকে ঠিক যেখানে সটান বেয়ে পড়ে শুদ্ধ জলধারা, কৌমুদিনী স্বরে—সেই পথে, ঠিক সেই পথে, লুকোনো রয়েছে সব মোহ, মায়া, ভ্রম—বিষাদের দাহগাথা, মর্মচেরা দুঃখক্রম!