বেলা বারটায় হোটেল থেকে চেক আউট করে দিল্লি রেলওয়ে স্টেশনে এসে পৌঁছলাম। আমি সেফ দ্য চিলড্রেনের ‘লেট চিলড্রেন স্পিক’ নামে একটি প্রজেক্টের অ্যাডভোকেসি অফিসার। শাহানা অ্যাসিস্ট্যান্ট অ্যাডভোকেসি অফিসার। দুজনই এসেছি দিল্লিতে সাউথ এশিয়ান রিজিওনাল কোঅপারেশন কনফারেন্সে যোগ দিতে। সত্যি চোখের নিমিষে কী করে সাত দিন কেটে গেলো বুঝতে পারলাম না!
দিল্লি স্টেশন থেকে রাজধানী এক্সপ্রেস ছাড়বে রাতে। লকারে জিনিসপত্র রেখে শাহানাকে নিয়ে ম্যাকডোনালসে গেলাম। এদিকে ভারতে আসার পর থেকে ভেজ-ননভেজের পাল্লায় পড়ে আমরা ভেজ হওয়ার চেষ্টায় আছি। ভেজিটেবল বার্গার, ম্যাক কফি আর আমার মোস্ট ফেভারিট পেস্ট্রি অর্ডার করে গত সাতদিনের প্রোগ্রাম নিয়ে শাহানার সঙ্গে কথা বলছিলাম। ওকে মনে করিয়ে দিলাম, ঢাকায় গিয়েই যেন সময় নষ্ট না করে যেন রিপোর্টটা তাড়াতাড়ি তৈরি করে ফেলে। এই সাতদিনে প্রায় প্রতিদিনই দিল্লির কোনো না কোনো বিখ্যাত পর্যটন স্থানগুলোয় ঘুরে বেড়িয়েছি। তাই আজকে আর কোথাও না গিয়ে বিকেলের মধ্যেই স্টেশনে ফিরে এসেছি। কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে শিব খেরার ‘ইউ কেন উইন’ বইটা কিনলাম। বইটি একটু সময় নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখবো। তাই বসার জন্য উপযুক্ত খালি বেঞ্চ খুঁজছি। হেঁটে একটু এগিয়ে যেতেই দেখালাম একটি বেঞ্চের কোণায় বসে ফেইড জিন্স আর ওশান ব্লু শার্ট পরা এককথায় অপরূপা সুন্দরী প্রায় আমার বয়সীই একটি মেয়ে বসে বসে ওরহান পামুকের ‘মাই নেম ইস রেড’ বইটি পড়ছে।
—এক্সকিউজ মি। ক্যান আই সিট হেয়ার?
—ওহ! শিওর।
আমার দিকে তাকিয়েই মেয়েটি একটু যেন চমকিয়ে উঠল মনে হলো। মুহূর্তেই চোখমুখ উজ্জ্বল করে হেসে বললো, আপনি কি বাংলাদেশ থেকে এসেছেন?
—হা হা, কী করে বুঝলেন?
আরও পড়ুন: আলো-ছায়া ॥ মঈনুল সানু
কথাটার কোনো উত্তর পেলাম না। যেন নিজেকেই শোনাচ্ছি, এমনভাবে ফিসফিস করে বললাম, হুম। বুঝতে পারছি না, সবাই কী করে বুঝে ফেলছে, আমরা বাংলাদেশ থেকে এসেছি। প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে তার কাছেই পাল্টা জানতে চাইলাম—আপনি? কলকাতায় থাকেন?
—নাহ! আমি ব্যাঙ্গালোরে থাকি। কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার। ওখানে বাগ্মেন টেকপার্কে কাজ করি। অফিসের কাজে দিল্লিতে এসেছিলাম। এখন কোলকাতায় যাচ্ছি।
জাহ্নবীর সঙ্গে এভাবেই আমার পরিচয় হয়। দিল্লি থেকে কলকাতা আসার পথে তা গভীর বন্ধুত্বে পরিণত হয়। রেল স্টেশনে আড়াই ঘণ্টা আর এরপর রাজধানী এক্সপ্রেসে আরও আঠারো ঘণ্টায় আমরা যেন এক জীবনের সব গল্পই বলে ফেললাম। জাহ্নবীকে নির্দ্বিধায় অপরূপা সুন্দরী বলা যায়। অন্তত আমার তো তাই মন হয়। বোম্বের নায়িকা টাবু আর প্রিন্সেস ডাইনার ফেস কাটিংয়ের কম্বিনেশন আছে কোথাও ওর মুখের আদলে। বেশ লম্বা ফর্শা আর স্লিম ফিগারের মেয়েটির নীল-সবুজ চোখে কোথায় যেন গভীর বিষণ্নতার ছায়া লুকানো রয়েছে।
লং উইন্ডো গ্লাসের আড়াআড়ি সিটে আমরা দুজন বসলাম। দুজন দুজনের হাঁটুতে হাঁটু লাগিয়ে হাত ধরে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছি। ওর নানা শেডের ভাইব্রেন্ট চুলগুলো পনিটেল করে বাঁধা। শার্টের ওপরের দিকটার খোলা চার বোতামের ফাঁক দিয়ে স্পষ্ট ফুটে আছে ক্লিভেজ। ওর ডেস্পারেট আচরণ দেখে বেশ অবাক হই। মনে মনে ভাবি, ইন্ডিয়ার মেয়েরা সত্যি বেশ অ্যাডভান্সড। অন্তত পোশাক-আশাকে। অথচ কথা বলেই বুঝতে পারি কতটা সংবেদনশীল মনের মানুষ এই অসাধারণ মেয়েটি।
আরও পড়ুন: পরাজয় ॥ ফারহানা রহমান
রেলগাড়ির বিরতিহীন ঝিকঝিক শব্দ আমাদের সময় কাল ছাড়িয়ে অন্য কোথাও নিয়ে গেলো। নানা বিচ্ছিন্ন অনুভূতির ভেতর তালগোল পাকাতে পাকাতে আমাদের চির অচেনা মনে নানা অনুভূতি ডানা মেলে। জানালার বাইরে দূরে বহুদূরে চলে গেছে একটি বিস্তৃত পিচসড়ক। রাস্তার দুই পাশে সবুজ বিস্তীর্ণ ধানক্ষেত। সরু কাঁচা রাস্তা নেমে গেছে ক্ষেতের কিনার ঘেঁষে। ঘন গাছের আড়ালে কয়েকটি নিঃসঙ্গ বাড়ি নিয়ে একেকটি ছোট ছোট গ্রাম গড়ে উঠেছে। মনে হয় বাংলাদেশেরই খুব চেনা কোনো গ্রামের ছবি ভেসে আছে। এভাবেই এক স্থানের ভেতর স্মৃতির মরীচিকা হয়ে ভেসে থাকে অন্য একটি স্থান। যেমন করে একটি সময়ের রেশ রয়ে যায় ভিন্ন কোনো কালেও। যেন স্মৃতিবিভ্রমের খেসারত দিতে হয় বারবার লেখা আর মুছে ফেলা পাণ্ডুলিপিতে। ট্রেনের ভেতর দুলে দুলে এভাবে চলতে চলতে কত যে কথা হয় জাহ্নবীর সঙ্গে। ওর শৈশবের গল্প, কিশোর বয়সে হোস্টেল জীবনের গল্প। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে অ্যামেরিকা যাওয়ার গল্প। পথের গতি মানুষকে কি ভীষণ অনুভূতিপ্রবণ করে তোলে! সেজন্যই বোধহয় ও ম্যারেড কিনা এই প্রশ্নটার উত্তর দিতে গিয়ে ও নিজের জীবনের সবচেয়ে গোপন কোথাগুলো আমার সঙ্গে শেয়ার করতে দ্বিধা করে না।
—আমার ফিওন্সের সঙ্গে কিছুদিন আগে ব্রেক আপ হয়ে গেছে।
—তোমার বয়ফ্রেন্ড কোথায় আছে এখন?
—আমার গার্ল ফ্রেন্ড।
আমি ভাবলাম ট্রেনের মধ্যে আছি তাই নিশ্চয়ই শুনতে ভুল করেছি।
—আমি লেসবিয়ান। আমার গার্লফ্রেন্ডের জন্যই আমি ইন্ডিয়ায় ফিরে এসেছিলাম।
কথা বলতে বলতে ও আসলে যা বলে গেলো, সে কথাগুলো শোনার জন্য আমি অন্তত প্রস্তুত ছিলাম না। বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান জাহ্নবী। মা সায়েন্টিফিক অফিসার, সরকারি চাকরিজীবী। বাবা ছিলেন ব্যবসায়ী। মায়ের পোস্টিংয়ের চাকরি। বারবার স্কুল শিফট করতে হচ্ছিল বলে একসময় ডিসিশন নেওয়া হয় ও বাবার কাছেই থেকে স্কুলিংটা শেষ করবে। বাবার চোখের মণি ছিল ও। পাগলের মতো ও বাবাকে ভালোবাসতো, বাবাও । সেই ভালোবাসাই একদিন দৈহিক ভালোবাসায় পরিণত হয়। ছোটবেলা থেকেই ওর বাবা ওকে কাছে নিয়ে ঘুমাত। ঘুমের মধ্যে বাবার হাত যত্রতত্র গোপন স্থানে ঘুরে বেড়াতো বলে ও ভাবতো এটাই বোধহয় আদরের নিয়ম। এভাবেই বোধহয় বাবারা আদর করে। ক্লাস থ্রিতে ওঠার পর ও হোস্টেলে চলে যায়। ছুটির সময় বাসায় এলেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতো। ক্লাস সিক্সে ওঠার পর হোস্টেল ছেড়ে দিয়ে পারমানেন্টলি বাবার সঙ্গে থাকা শুরু করলো জাহ্নবী। এভাবে চলতে থাকলো কয়েক বছর। ক্লাস সিক্সেই পিরিয়ড হয় ওর। তখন থেকেই দৈহিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে বাবা-মেয়ের। এভাবেই আরও কয়েক বছর কেটে গেলো। নানা কারণেই মার সঙ্গে দূরত্ব গড়ে ওঠে ওর। আর তাই মাকে কখনোই বলা হয়নি এসব কথা। তারপর কোনো একসময় প্রিয় বান্ধবী নিকিতাকে ও ব্যাপারটা শেয়ার করে আর তখনই বান্ধবীর চরম রিঅ্যাকশনে ও প্রথম বুঝতে পারে বিষয়টির অবৈধতা। বুঝতে পারে, কতটা অস্বাভাবিক একটা জীবন কাটাচ্ছে ও দিনের পর দিন ধরে।
আরও পড়ুন: নজরুল ও লোকায়ত চেতনা ॥ তপন বাগচী
পুরুষ জাতীর প্রতি তীব্র ঘৃণা বয়ে বেড়াচ্ছে এখন জাহ্নবী। প্রায় মনে হয়, ও যেন এক নিরর্থক জীবনকে শুধু শুধুই টেনে নিয়ে যাচ্ছে।
—যত দিন যাচ্ছে, আমার এই ঘৃণা গভীর থেকে গভীরতর হয়ে উঠছে যেন। পুরুষ মানুষ দেখলেই মনে পড়ে যায় বাবার সেইসব ঘৃণিত কার্যকলাপের কথা। কিছুতেই আর কোনো পুরুষকেই স্বাভাবিক মানুষ ভাবতে পারি না এখন।
জাহ্নবীর মা ছিলেন ক্যান্সারের রোগী। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মাকে কথাগুলো বলতে পারেনি ও। তবে মায়ের বিষণ্ন দুঃখী আর গভীর দৃষ্টি দেখেই বোঝা যেতো, তিনি হয়তো একসময় সবই বুঝতে পেরেছিলেন। একান্ত মায়ের ইচ্ছে আর উদ্যোগে একসময় জাহ্নবী অ্যামেরিকায় ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে যায়। মা বারবার অনুরোধ করতো যেন ও কখনো দেশে ফিরে না আসে আর। কিন্তু মায়ের কথা রাখতে পারেনি জাহ্নবী। ওর ফিওন্সে তৃষা দিল্লির একটি ইউনিভার্সিটিতে জয়েন করে কয়েকবছর আগে। তাই একরকম বাধ্য হয়েই ওকে বাগ্মেন টেকপার্কের একটি কোম্পানিতে দুবছরের একটি কন্ট্যাকচুয়াল প্রোজেক্টে জয়েন করতে হয়। তবে এরই মধ্যে ও বুঝে গেছে, তৃষা ওর ব্যাপারে কোনো কারণে ইন্টারেস্ট হারিয়েছে ।
—আসলে ইন্ডিয়ায় থাকার আর কোনো মানে হয় না। এখন কলকাতা যাচ্ছি। ওখান থেকেই সব ফর্মালিটিস শেষ করে ইউএসএতে ব্যাক করবো।
—আবার কবে আসবে?
—আর আসবো না। তবে তুমি চাইলে বাংলাদেশে যেতে পারি। অথবা তোমাকেও নিয়ে আসতে পারি নিজের কাছে।
আমি ওকে জড়িয়ে ধরি। গভীর আলিঙ্গনে বুকে জড়িয়ে ধরে আমরা দুজন একসময় কাঁদতে থাকি। আমি জানি জাহ্নবী কী বোঝাতে চেয়েছে। কিন্তু আমি তো স্ট্রেইট। আমার স্বামী, সন্তান, সংসার আছে। এসব নিয়ে আমি সুখী কী অসুখী সেসব, অন্য ব্যাপার। কিন্তু জীবনের যে পরিস্থিতির সঙ্গে যুদ্ধ করে ও আজ লেসবিয়ান হয়েছে, তার বিন্দুমাত্র কোনো উপসর্গ বা ছোঁয়াচ তো আমার জীবনে নেই। মনে মনে ভাবি, এতটুকু সুযোগ থাকলে আমি তোমার কাছে চলে যেতাম জাহ্নবী। জানি না নারীর সঙ্গে নারীর কী করে দৈহিক প্রেম হয়। তবে তোমার সঙ্গে আমার যে প্রেম হলো, তার রেশ আমি বয়ে বেড়াবো হয়তো আজীবন।
আরও পড়ুন: ঠিকানা ॥ কামরুন নাহার শীলা
ট্রেনের সিটে হাত ধরাধরি করে আমরা ভিন্ন পরিবেশে ভিন্ন অভিজ্ঞতা নিয়ে বেড়ে ওঠা দুজন সমবয়সী নারী স্থান কালের সীমানা ছাড়িয়ে কোন সুদূরে চলে গিয়েছিলাম, মনে নেই। সম্বিৎ ফিরে পেলাম ট্রেনের গতি কমে যাচ্ছে বুঝতে পেরে। একটু পরেই কলকাতার হাওড়া জংশনে নেমে চিরদিনের দুজন দুদিকে চলে যাবো। পরেরদিন সকাল ১১ টা ১৫ মিনিটে আমার আর শাহানার ফ্লাইট। ঢাকায় গিয়ে আবার সেই অজস্র ব্যস্ততার পাহাড়ে ডুবে যাওয়া। জাহ্নবী আর দুসপ্তাহ কোলকাতায় থাকবে হয়তো। অফিসিয়াল কাজ শেষ হয়ে গেলে ফিরে যাবে অ্যামেরিকায়। ও জানে না আর কখনো দেশে ফিরবে কি না। আমাদের হয়তো বা আর কখনো দেখা হবে না। এ কথা ভাবতেই বুকের ভেতর চিনচিন করে ওঠে। এক তীব্র হাহাকার বোধ করি। সবকিছু কেমন শূন্য শূন্য লাগে। জীবনে চলার পথে এভাবে কখন কোথায় কার সঙ্গে যে দেখা হয়ে যায়! কার মনের সঙ্গে মনের, ভাবনার সঙ্গে ভাবনার, বোধের সঙ্গে বোধের মেলবন্ধন তৈরি করে প্রেম, সেটা বোঝার কোনো উপায় তো নেই। অথচ এসব বিচ্ছিন্ন প্রেম আমাদের বয়ে বেড়াতে হয় জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত! এসব ভাবনার ডালপালা মেলতে মেলতেই দেখি দূর আকাশে শরতের ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘের ভেলা ভেসে চলেছে কোন অজানার প্রান্তে।
লাল, নীল, সোনালি বিচিত্র অপরাহ্ণের আভায় একাকার হয়ে ডুবে যাচ্ছে আমাদের সেই প্রাচীন লাল রঙের সূর্যটা।