[পর্ব-১৩]
তবু স্মৃতি মোছে না। জ্বলজ্বলে চোখে তাকিয়ে থাকে। যেন হিংস্র কোনো পশুর চোখ। চোখ বুজলেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বাবা যুদ্ধে গেছেন। হঠাৎ বাড়িতে অনেক মানুষ, মুখে কাপড় বাঁধা, পাকিস্তানি মিলিটারিও ছিল। দাদি তাকে কোলে নিয়ে আড়াল থেকে দেখছিলেন, মা আড়ালে যাওয়ার সময় পাননি। মিলিটারিরা তুলে নিয়ে গেছিল মাকে। দুই দিন পর বিধ্বস্ত, আধমরা অবস্থায় পালিয়ে এসেছিলেন মা। তাকে বুকে নিয়ে মায়ের সে বুকফাটা কান্না এখনো কানে বাজে তরুণের।
তারপর কানাঘুষা, মাকে নিয়ে গল্পগাথা, বাড়ির সবার তীব্র ভ্রূকুটি। শুধু বাবা অনড় ছিলেন। ট্রেনিং থেকে ফিরে বাবা যুদ্ধে ব্যস্ত, মাঝে মাঝে বাড়ি এসে সাহস দিতেন মাকে, অভয় দিতেন। এর মধ্যেই তিতলি এসে গেছিল মার পেটে। কেউ ভালোভাবে নেয়নি ব্যাপারটা। জারজ সন্তান পেটে এসেছে, মিলিটারির সন্তান বলে আত্মীয়-স্বজন সারাক্ষণ গালমন্দ করত তার মাকে। মুখ বুজে সহ্য করতেন মা, দাঁতে দাঁত চেপে থাকতেন। বাবা সঙ্গে ছিলেন মার, মানসিক সাহস যোগাতেন বাড়িতে ফিরলেই। বাড়ির সবাইকে পইপই করে বলতেন মাকে যেন কোনোরূপ গালমন্দ না করা হয়। কিন্তু বাবা যতক্ষণ বাড়িতে থাকতেন ততক্ষণ স্বস্তিতে থাকতেন মা, বাড়িতে বেশি সময় থাকা বাবার জন্যে নিরাপদ ছিল না সে সময়, চারদিকে শত্রু, যেকোনো সময় খবর চলে যেতে পারে শান্তিবাহিনীর কাছে। বাবা তাই আসতেন লুকিয়ে, অল্পসময় থেকে চলে যেতেন আবার। বাবা চলে গেলেই পুনরায় মার ওপর চলত অত্যাচার। এভাবেই চলছিল, তারপর এক অপারেশন শেষে বাবা ফিরলেন উন্মাদ হয়ে। উনিশ শ’ একাত্তরের নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে তার বাবা উন্মাদ অবস্থায় বাড়ি ফিরে এলেন। মার দুঃখ দ্বিগুণ হলো। বাহাত্তরের ফেব্রুয়ারিতে তিতলিকে পৃথিবীর আলো দেখিয়ে বিদায় নিলেন মা। বাড়ির কাছের লিচু গাছের নিচু এক ডালের সঙ্গে ঝুলতে দেখা গেলো তাকে। বাবার উন্মাদদশা মাকেও মানসিকভাবে পঙ্গু করে দিয়েছিল পুরোপুরি। তাতে ছোটকাকারও জোরাল ভূমিকা ছিল, তরুণের মনের মধ্যে এ ধারণা বদ্ধমূল করে দিয়েছিল কেউ। ফলে ছোটকাকার জন্য কোনো অনুকম্পা ছিল না তার। ছিল ঘৃণা। তীব্র আক্রোশ। সে কারণেই ছোটকাকার গণ্ডির মধ্যে যারা ছিল তাদের সবার প্রতিই একধরনের বিতৃষ্ণা ছিল, ছিল ক্ষোভও। জোহরার বাবাকেও সেইকারণেই এড়িয়ে চলতো তরুণ। তার জগৎ ছিল ছোট, সুরময়। সেখানে ছোটকাকা বা তার বন্ধুস্থানীয়দের প্রবেশাধিকার ছিলই না বলা চলে, তার মধ্যেই, কোন ফাঁক গলে যে ঢুকে পড়ল জোহরা, সেটা তরুণ নিজেও বুঝে উঠতে পারল না ভালো। পরে এ নিয়ে ভেবেও আর কোনো কুলকিনারা করতে পারেনি সে।
আরও পড়ুন: ঝিঁঝিলাগা দিনগুলো-১২॥ শিল্পী নাজনীন
কার্জন হলের পুকুর পাড়ে ক্লাসের অবসরে পা ছড়িয়ে বসে ছিল রতন। দুপুরে বেশিরভাগ ছেলেমেয়েই ক্লাসের ফাঁকে হলে চলে যায়, স্নান-খাওয়া সেরে আবার আসে ক্লাস থাকলে। রতন যায় না পারতপক্ষে। হলে ফিরলে স্নান-খাওয়া সেরে ক্লাসে আসতে দেরি হয়ে যায় তার। অল্প সময়ে খেতেও পারে না সে। অল্প খায়, কিন্তু অনেকটা সময় নেয় খেতে। স্নানেও একটু বেশি সময় লাগে তার। সময় বাঁচাতে তাই সকালের ক্লাস সেরে বেশিরভাগ দিনই রতন আশপাশ থেকে কিছু একটা খেয়ে নেয়। একবারে ক্লাস শেষে হলে ফেরে।
সেদিনও ক্লাস সেরে সবাই যখন হলে গেছে খেতে, রতন তখন পুকুরপারে বসল এসে। ঝালমুড়ি খেল একঠোঙা। বাদাম কিনলো দুই টাকার। ঝালমুড়ি শেষ করে সবেমাত্র বাদামের ঠোঙায় হাত লাগিয়েছে রতন, অমনি কোত্থেকে উড়ে এলো মাধবী, ঠোঙাটা হাত থেকে নিল প্রায় ছোঁ মেরে। তারপর চোখমুখ বিকট করে বললো, খুব কৃপণ তো তুমি! একা একা বসে বাদাম খাচ্ছ এখানে?আমার বুঝি খিদে পায় না?
রতন কিছু না বলে চুপ রইলো। চোখ পুকুরের জলে নিবদ্ধ। মাধবীর আগমনে বিরক্ত। আচরণে তা লুকানোর কোনো চেষ্টাও করল না। ইদানীং বড্ড জ্বালায় মাধবী। ভালো লাগে না। হাঁসফাঁস লাগে। সারাক্ষণ মনে হয়, কোনো একটা জালে কেউ আটকাতে চাইছে তাকে, বাঁধতে চাইছে খুব করে। মনে হয়, কোনো অদৃশ্য চোখ সারাক্ষণ নজর রাখছে তার ওপর। রতনের একদম ভালো লাগে না। সে কোথাও আটকে যেতে চায় না, চায় না বাঁধা পড়তে। স্বাধীনভাবে শ্বাস নিতে চায় বরং। মুক্তভাবে ঘুরতে চায়।
অত গভীর মনোযোগে কী দেখছ পুকুরের দিকে? মৎস্যকন্যা আছে?—গলায় ঝাঁঝ ঢেলে বলে ওঠে মাধবী।
না। অগ্নিকন্যা দেখে সব রকম কন্যাতেই আগ্রহ উবে গেছে।—নিরীহভাবে উত্তর দেয় রতন।
কী? আমি অগ্নিকন্যা?—ফুঁসে ওঠে মাধবী।
নও তো কী? সারাক্ষণ তো কেবল জ্বালাও।
রতন! আমি তোমাকে ভালোবাসি!
তুমি বোকা। সব বোঝ, এটুকু বোঝ না যে জোর করে কাউকে ভালোবাসা যায় না, কারও ভালোবাসা পাওয়াও যায় না।
কেন তুমি ভালোবাসো না আমাকে? কেন? কী করেছি আমি?
কিছুই করোনি। তোমাকে ভালোবাসি না, কেন বাসি না কী করে বলব! তোমার জন্য যদি আমার মধ্যে ভালোবাসা না জন্মে তাহলে আমি কী করব, বলো! সে আমার অক্ষমতা, আমাকে ক্ষমা করো। তুমি তো শিশু নও। বুঝতে চেষ্টা করো।
না! কিচ্ছু বুঝবো না! তোমাকে ভালোবাসি আমি, তুমিও ভালোবাসবে আমাকে! ব্যস! আর কিচ্ছু বুঝব না আমি!—তীব্রকণ্ঠে, জ্বলজ্বলে চোখে রতনের দিকে তাকিয়ে ঘোষণা করে মাধবী।
এমন অদ্ভুত কথায় আর আচরণে হেসে ফেলে রতন। হাসতে হাসতে মাধবীর দিকে না তাকিয়ে, পুকুরের অতল জলে চোখ রেখে আস্তে আস্তে বলে, তুমি পাগল! আস্ত পাগল!
হ্যাঁ, পাগল!—সঙ্গে সঙ্গে সায় দেয় মাধবী। তারপর রতনের দিকে একটু ঘনিষ্ঠ হয়ে, রতনের একটা হাত নিজের হাতের মুঠোয় টেনে নিয়ে গাঢ় গলায় বলে, তোমার জন্য।
ঝটকায় হাতটা ছাড়িয়ে নেয় রতন। বিরক্ত কণ্ঠে বলে, ধূর। কী সব বল। মাথামুণ্ডু নাই।
উঠে পড়ে। দ্রুতপায়ে ডিপার্টমেন্টের দিকে হাঁটা দেয়। মাধবী পিছু নেয়। এত সহজে হার মানবে না সে জানে রতনও। মেয়েটা জ্বালিয়ে মারছে খুব। মাঝে মাঝে মায়াও হয় মাধবীর জন্য। কিন্তু মায়া আর ভালোবাসা এক নয়, মেয়েটা বুঝতে চায় না একদম।
ক্লাস শেষে মাধবী পিছু নেয় আবার। রতন টের পায়। না দেখার ভান করে পাশ কাটাতে চায়। মাধবী নাছোড়। দৌড়ে পাশে এসে বলে, কোথায় যাবে এখন?
হলে।—রাস্তায় চোখ রেখে নির্লিপ্ত, ছোট্ট জবাব দেয় রতন।
আমার সঙ্গে গাড়ি আছে। চলো, তোমাকে পৌঁছে দিচ্ছি।
আমি হেঁটেই যেতে পারব। সামান্য পথ। প্রতিদিন হেঁটেই যাওয়া-আসা করি।
প্রতিদিন হাঁট বলে আজও হাঁটতে হবে এমন কোনো কথা নেই। গাড়িতে ওঠ।
রতন অতপর হাঁটা বন্ধ করল। দাঁড়ালো একপাশে। বড় করে শ্বাস ছাড়ল। বিরক্তির চরম সীমায় পৌঁছে গেছে সে। মাধবীকে কঠিন কিছু কথা বলতে হবে আজ। সে এবার মাধবীর চোখে চোখ রাখলো। মাধবী উজ্জ্বল চোখে তাকিয়ে আছে। প্রত্যাশায় ঝলমল করছে তার মুখ। মনে মনে একটু দমে গেল রতন। মাধবী শিশু নয়। কিন্তু এত বোকা কেন! কেন রতনকে বুঝতে এতটা সময় নিচ্ছে সে!
দেখো মাধবী!—যতটা সম্ভব কণ্ঠ নরম করে বললো রতন, আমি জানি তুমি অনেক ধনী পরিবারের মেয়ে। তোমাদের গাড়ি আছে, ঢাকায় অনেক বড় বাড়ি আছে। আমার কিছু নেই। বাবা মারা গেছে ঢের আগে। মা খুব কষ্ট করে আমাকে বড় করে তুলছেন। অনেক কষ্ট হচ্ছে আমার মা’র। ছোট ভাইটাকে বড় করতে হবে, মা’র কষ্ট দূর করতে হবে। আমার অনেক দায়িত্ব। তুমি এটা বুঝবে না। শুধু শুধু কেন সময় নষ্ট করছ আমার জন্য? তোমার গাড়িতে ওঠার কোনো ইচ্ছে নেই আমার। বন্ধুত্বের বাইরে অন্য কোনো সম্পর্কও তোমার সঙ্গে সম্ভব নয়। অযথা কষ্ট বাড়িও না, তোমার বা আমার।
আমার অপরাধটা কী? আমি ধনী পরিবারের মেয়ে, এটা?—ফুঁসে ওঠে মাধবী।
না। কোনো অপরাধ নেই। তোমার প্রতি আমার মধ্যে অন্যরকম কোনো অনুভূতি নেই। বন্ধু ভাবতে চাই তোমাকে।
নাকি পুরুষই নও তুমি?
একটু থমকে যায় রতন। একটু ঘা লাগে অহমে! তারপর সামলে নেয়। মৃদু হেসে বলে, হ্যাঁ! পুরুষই নই! যাও এবার।
তীব্র চোখে তাকিয়ে থাকে মাধবী। রাগে, অপমানে লাল হয়ে ওঠে মুখ। তারপর সামলে নেয়। ম্লান, শান্তস্বরে বলে, বন্ধু ভাবতে চাও, বললে না?
হ্যাঁ, চাই।
ঠিক আছে, বন্ধুই ভেবো। বন্ধু তো বন্ধুর গাড়িতে উঠতেই পারে, কী বল? চলো এবার! ওঠ গাড়িতে!
কী বলবে ভেবে পায় না রতন। মাধবীর পাগলামিটা মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে দিনকে দিন।
কী হল? ওঠ!—ধমকে ওঠে মাধবী।
অতগ্যা রতন মাধবীর গাড়িতে গিয়ে ওঠে।
আরও পড়ুন: ঝিঁঝিলাগা দিনগুলো-১১॥ শিল্পী নাজনীন
আজিজ মার্কেটের দিকে যাও।—ড্রাইভারকে নির্দেশ দেয় মাধবী। বিরক্ত রতন চুপচাপ বসে থাকে পেছনের সিটে। মাধবী সরে আসে, গা ঘেঁষে বসে তার। প্রতিবাদ করতে ইচ্ছে হয় না। প্রশ্ন করতে ইচ্ছে হয় না, হলে যাওয়ার কথা তার, মাধবীর তাকে হলে নামিয়ে দেওয়ার কথা, তাহলে কেন তার সম্মতির তোয়াক্কা না করেই মাধবী গাড়ি নিতে বলে আজিজ মার্কেটের দিকে! ক্লান্ত লাগে। বড্ড অশান্তি জমা হয় মনে। ততক্ষণে বেলা পড়ে গেছে প্রায়। আবছা বিকেল নেমেছে। কার্জন হলের উঁচু উঁচু গাছগুলোর ছায়া দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে হতে রাস্তা জুড়ে নিয়েছে প্রায়। গোধূলির সোনালি আভায় শহরটাকে কেমন অদ্ভুত মায়াবী লাগছে। গাড়ির গ্লাস নামিয়ে দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকে রতন। মাধবী তার কাঁধে মাথা এলিয়ে চোখ বুঁজে গান গাইছে গুনগুনিয়ে।
রাস্তা ফাঁকা। অল্প সময়েই আজিজে এসে দাঁড়িয়ে পড়ে গাড়ি। ড্রাইভার নেমে দরজা খুলে দেয়। মাধবী নেমে দাঁড়ায়। অগত্যা রতনও। কথা বলতেই ইচ্ছে করে না একদম। প্রচণ্ড খিদে পেয়েছে তার। দুপুরে খাওয়া হয়নি আজ। মাধবী একটা খাবার দোকানে গিয়ে ঢোকে। অর্ডার দেয় খাবারের। খাওয়া শুরু করে রতন। খিদেয় পেট জ্বলছে।
তুমি খাবে না?—খেতে খেতেই প্রশ্ন করে রতন।
না। আমিতো তোমার মতো দুপুরে না খেয়ে পুকুরপাড়ে বসে মৎস্যকন্যা দেখিনি। খিদে পেলে আমি না খেয়ে থাকতে পারি না।
কথা না বলে চুপচাপ খেয়ে যায় রতন। ধীরে ধীরে খায় সে। সামনের চেয়ারে বসে গভীর মনোযোগে রতনের খাওয়া দেখে মাধবী। অনেকক্ষণ পর রতনের দিকে তাকিয়ে বলে, প্রতিদিন দুপুরে অমন না খেয়ে বসে থাক কেন? খিদে পায় না?
খিদে কেন পাবে না! পায় তো!—সরল গলায় উত্তর দেয় রতন।
তাহলে খাও না কেন?
আমি তো বড়লোক নই তোমার মতো। হেঁটে হলে যেতে-আসতে সময় লাগে। তাছাড়া দেখছ তো, আমি অনেক সময় নিয়ে খাই। হলে খেতে গেলে ক্লাসে দেরি হয়ে যায়। সে কারণে যাই না।
অনেক অহঙ্কার তোমার, না?
অহঙ্কার? কিসের?—অবাক প্রশ্ন করে রতন।
এই যে, বড়লোক নও ব’লে!—ভ্রূ নাচিয়ে উত্তর দেয় মাধবী।
শব্দ করে হাসে রতন খাওয়া ফেলে। হাসতে হাসতে বলে, বড়লোক নই, এটা তো আমার অযোগ্যতা! এটা নিয়ে অহঙ্কারের কিছু আছে তাই তো জানি না!
প্রতিদিন এমনভাবে নিজেকে গরিব বলে জাহির করো, তাতে তো মনে হয় এটাই তোমার মস্ত যোগ্যতা!—কণ্ঠে শ্লেষ ঢেলে বলে মাধবী। রতনের খাওয়া ততক্ষণে শেষ। সে বলে, এবার হলে যাব মাধবী। পড়তে হবে। কালতো পরীক্ষা, তোমারও পড়া আছে।
হল পালিয়ে যাবে না, পড়ারও অনেক সময় পাওয়া যাবে। বস চুপ করে। কফি খাব এককাপ।
চলবে…