—তুমি যা চাইছ, তা যে সম্ভব নয় কোনোদিন, এটা তুমি ভালো করেই জানো।
—তাইলে কি আমাদের আর দেখা হচ্ছে না!
—তা হবে না কেন? তবে এভাবে বাইরে নয়।
—হুম। বুঝতে পারছি।
এক.
রুক্সিনির প্রচণ্ড মন খারাপ হয়। শরৎকালের বিকেল। সারা আকাশ নীল-সাদায় ছুপছুপ—যেন ভ্যানগগের তুলির আঁচড়। হাতিরঝিলের কালো পানিতে-হাল্কা ঝিরঝির বাতাসে আর ঢেউয়ে আকাশের অবয়ব যেন কম্পমান ক্যানভাসে কাঁপা কাঁপা ছবি। ঝিলের ঠিক শেষ প্রান্ত—কাওরান বাজার রোড আর সাত রাস্তা ক্রসিংয়ের ঠিক আগে পুলিশবক্সের উল্টোদিকে ওরা যখন বসে, তখন সন্ধ্যা হয়। বেশ অনেকক্ষণ ধরে আলাপে মশগুল। দেখা হওয়ার পরই সত্যব্রতর কাছে নানান আবদার করছে রুক্সিনি। প্রথমত সে সত্যব্রতর সঙ্গে রিকশায় করে ঘুরতে চায়। দ্বিতীয়ত একান্তে কিছুটা সময়ও কাটাতে চায়। আবদার দুটোই রেখেছে সত্যব্রত। রিকশা করে ঘুরেছে ওরা গুলশান-নিকেতন হয়ে সাতরাস্তার অনেকটা। কিছুটা সময় বিরতি দিয়ে আবার রিকশা করেই ঝিল দেখতে এসেছে এদিকটায় একান্তে সময় কাটাবে বলে। যে সময়টা ওরা একত্রে কাটাচ্ছে প্রায় ৭ ঘণ্টা তো হবেই। নাগরিক কোলাহলের মাঝেই এ এক শান্ত পরিবেশ-হাতিরঝিল প্রকল্প। প্রকল্পে ঢুকে পড়লেই মনে হবে শহরের হট্টগোল থেকে নিরবচ্ছিন্ন অঞ্চল। তবে লাগাতার গাড়ির শা শা শব্দে তেমন ব্যত্যয় ঘটেনা আড্ডায়। এখানে প্ল্যান মাফিক সবকিছু। ঝিলের ওপর আড়াআড়ি ব্রিজগুলো; রাস্তাগুলো বেশ ছিমছাম, পরিষ্কার-চওড়া। শুরুর দিকদ্বয় মানে প্রবেশপথে শহুরে আমেজ রয়েছে বড্ড। গাড়ির প্যাঁ-পোঁ শব্দে কান ঝালাপালা। কিন্তু মাঝের পুরোটা অঞ্চল অদ্ভুত নিস্তব্ধতায় ডুবে যায় সন্ধ্যা হতেই। মনে হবে শহর থেকে বুঝিবা আলাদা।
রাস্তার দুই পাশে সৌন্দর্য বর্ধক গাছগাছালি আর একটু পর পর বসার জন্য সিমেন্ট-ইটের বেঞ্চি রয়েছে। মাঝে মাঝে আছে একটু বড় বড় গাছ যারা ডাল পাতা ঝুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ছায়া দেবে বলে। ওরা তেমনি এক গাছের তলায় দীর্ঘক্ষণ বসে আছে। রুক্সিনির সঙ্গে এই দেখা করার পেছনে সত্যব্রতর একটা উদ্দেশ্য আছে। একসময় যখন আসল কথাটা বলল সত্যব্রত, অবশ্য তার আগেই দুপুরের ভোজনটা সেরে নিয়েছে বুদ্ধি করে। প্রথমে রুক্সিনি বিশ্বাসই করতে পারেনি। ভেবেছে ঠাট্টা। কিন্তু যখন দেখে, সত্যব্রত সিরিয়াস, তখন থেকেই মন বিষন্ন হতে শুরু করেছে। রুক্সিনির বদ্ধমূল ধারণা ছিল, সে যদি কোনো পুরুষের সামনে গিয়ে ভালোবাসার কথা বলে, এ ফেরানোর সাধ্য পুরুষের নেই। এমন তার রূপ আর সৌন্দর্যের আকর্ষণ। ছোটবেলা থেকে এই রূপের জন্য কত জনেরই না নজর কেড়েছে, তার কি হিসাব আছে! অথচ কি এমন পুরুষ সত্যব্রত? যতটা না ওর ভালোবাসাকে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য রুক্সিনি আহত হয়, তার চেয়ে ঢের অপমানিত বোধ করে তার নারীত্ব। চরম আঘাত লাগে অহমে। এমনি জিনিস এই নারীত্ব, নারীত্বের এই অহম-ওখানে আঘাত লাগলে অপমানে যে কেউ দিশেহারা হবে। সত্যব্রত দেখতে সুদর্শন না হোক স্মার্ট, বুদ্ধিমান। ঠিক ধরেছে রুক্সিনির মনের কথা। পরিস্থিতি সামাল দিয়েছে।
—ঠিক আছে। আজ থেকে ঠিক পঁচিশ বছর পর তুমার সাথে আমার দেখা হবে প্যারিসে। তখন আমরা একত্রে একটা পুরো দিন কাটাবো। তারিখটা মনে রেখ।
আজ থেকে পঁচিশ বছর আগে সেটাই ছিল সত্যব্রতর প্রথম এবং শেষ প্রতিশ্রুতি। একান্তে রুক্সিনির সঙ্গে প্রথম এবং শেষ দেখাও ওটাই। এরপর আর এভাবে দেখা হয়নি দু’জনের। আজ কথাটার পঁচিশ বছর পূর্ণ হলো। তার মানে এই দিনটিতেই যে সত্যব্রতর সঙ্গে দেখা করার কথা ছিল, ওটা রুক্সিনি ঠিক মনে রেখেছে। সত্যব্রতরও কি মনে আছে!
আরও পড়ুন: নজরুল ও লোকায়ত চেতনা ॥ তপন বাগচী
সেই দিনগুলোতে সত্যব্রতর প্রতি সে কি মোহ ছিল রুক্সিনির! প্রথম দেখাতেই নাকি ভালোলাগা—রুক্সিনি জানিয়েছিল সে কথা সত্যব্রতকে। তারপর প্রেমে হাবুডুবু খাওয়া। প্রতিদিন গিয়ে কিউবিকলের সামনে কোন না কোন বাহানায় ঘুরঘুর করা। লম্বা করিডোর পেরিয়ে গ্লাসের দরজাটা খুলে পাঁচ কদম মত সামনে এগিয়ে ডানে ঘুরলেই দেখা যেত সত্যব্রত বসে আছে। হাতে মোবাইল নিয়ে কি যেন দেখছে স্ক্রিনে। মুখে হাসি। সে হাসি বোঝার সাধ্য ছিল না অনেকেরই। সে হাসি ছিল কেষ্ট ঠাকুরের মত দুর্বোধ্য, কুটিল। মোবাইলে কল দেওয়া আর মেসেজ আদান-প্রদান তো চলত সর্বক্ষণ রুক্সিনির সাথে। অবশ্য সত্যব্রতেও আস্কারা ছিল শুরুতে। কেমন সব হৃদকাঁপানো কবিতা পাঠাতো মেসেজে। কেবলি চোখের, কেবলি চুলের প্রশংসা। কেবলেই ভালোলাগা আর ভালোলাগা থাকতো ওগুলোতে। দু’লাইন চার লাইন করে করে এক একটা কবিতা। আজ রুক্সিনি হাসলো ঈষৎ। আসলেই কি ছেলেমানুষি না করেছে সেই দিনগুলোতে? তখন প্রতি ক্ষেত্রে তার মনে হতো, সত্যব্রতকে বুঝাতে হবে রুক্সিনি তাকে ঠিক ভালোবাসে। বুঝাতে হবে, কত করে যে ভালোবাসে! এখনো কি তার সেই ভালোবাসা আছে সত্যব্রতর প্রতি?
বোধহয় সত্যব্রতর পৌরুষিত অহঙ্কার ছিল আলাদা রকমের। আর ওটাই ছিল তার প্রতি আকর্ষণের মুলে। তাছাড়া রুক্সিনির প্রতি বাচ্চাসুলভ আচরণ ছিল সত্যব্রতর, যা তাকে শেষাবধি বেপরোয়া করে তুলেছিল। সেইসঙ্গে একসময় সত্যব্রতর নিজেকে পাশকাটানো নাটক ওকে আরও বেশি জেদি করেছিল। কী ছিল এই সত্যব্রতর? দেখতে তো শ্যামবর্ণের, হ্যাংলা-পাতলা চেহারা-অথচ এই রুক্সিনি? হাজারে একজন হয় সৌন্দর্যে। তাকেই পাত্তা দেয়নি সত্যব্রত? কত কত ছেলেই তো ওকে চাইতো নিজের করে, রুক্সিনিই গা লাগাতো না। ছেলেরা সরাসরি তাকে বলতে পারতো না, তবে নানাভাবে বোঝানোর চেষ্টা করতো। তাছাড়া সবাইকে ঢোল পিটিয়ে জানিয়ে দিয়েছিলো রুক্সিনি, সে একজনকে ভালোবাসে। সো নো এন্ট্রি বয়েজ। রুক্সিনি আজ ভাবে বরং সত্যব্রতর মহা ভাগ্যছিল যে, তার মতো একটা মেয়ে ওকে চাইতে গিয়েছিল।
সত্যব্রত তখন তেত্রিশের। স্ত্রী মোহিনীকে নিয়ে দিব্যি সংসার। মোহিনী সুগৃহিণী এবং পতিব্রতা। দেখতে মোটেও মন্দ নয় বরং হাজারে না হোক শ’য়ের মাঝে ঠিক গুনে নেওয়া যাবে সৌন্দর্যে। দীর্ঘ পাঁচ বছরের প্রেম, তারপর বিয়ে। আসলে বিয়েটা সত্যব্রত করেনি, করেছে মোহিনীই। সত্যব্রতর যেমন বিশ্বাস আর আস্থা ছিল মোহিনীর ওপর ঠিক তেমনি মোহিনীরও। তাছাড়া রুক্সিনি কি শুরুতে জানতো সত্যব্রত বিবাহিত? কি জানি? ঠিক মনে পড়ছে না রুক্সিনির।
তবে যখনই জানুক, অদ্ভুত নেশায় পেয়েছিল তার। কেন যেন মনে হতো সত্যব্রত ছাড়া তার চলবে না একমুহূর্তও। তখন তো গাঁট বাঁধা পণ ছিল রুক্সিনির, বিয়েই করবে না কোনোদিন। কারণ সে যাকে ভালোবাসে মানে সত্যব্রত—তাকে তো আর বিয়ে করা যাচ্ছে না? তাছাড়া সত্যব্রত অন্য কারো হোক, সেটা সে স্বপ্নেও মেনে নিতে পারছিল না তখন। অথচ সত্যব্রত তো অন্যেরই ছিল।
সত্যব্রতর প্রতি রুক্সিনির প্রেমের সময়কাল ছিল মাস পাঁচেক। এরই মাঝে একদিন সত্যব্রত পাড়ি জমাল দেশের বাইরে। উচ্চতর ডিগ্রি নেবে। সেই থেকে একেবারে যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতা। অবশ্য সত্যব্রতর দিক থেকে দেশ ছাড়ার মাসখানেক আগে থেকেই আস্তে আস্তে কমতে শুরু করেছিল আকর্ষণ। রুক্সিনি তা বুঝতে পেরেছিল। তারপরও বার কয়েক যোগাযোগের চেষ্টা করে আর এগোয়নি। কিন্তু ওদের দেখা হতো সপ্তাহে তিন/চার দিন। তবে সত্যব্রতর কর্মক্ষেত্রে। কথাও হতো টুকটাক। কারণও ছিল। সত্যব্রত ছিল রুক্সিনির সরাসরি ইন্সট্রাক্টর। রুক্সিনি যে প্রতিষ্ঠানে শেষ বর্ষের ইন্টার্ন করতে গিয়েছিল, ওখানকার টিচার ছিল সত্যব্রত। সুতরাং পড়াশুনার সুবাদেই হোক আর সম্পর্কের টানেই—রুক্সিনি মাঝে মাঝেই সত্যব্রতর কিউবিকলে এসে দাঁড়াতো। শেষ দিকে অবশ্য রুক্সিনির দিক থেকেও জোয়ারে ভাটা পড়েছিল।
জীবন থেমে থাকে না কিংবা জীবনের অনর্থ পণগুলো বাস্তবের আঘাতে প্রতিঘাতে চুরমার হয়। ঝনঝন করে ভেঙে যায় কাঁচের মতন। রুক্সিনির মনে হচ্ছে, এই যে তার জীবন বয়ে চলছে-মন্দ তো নয়? তবু একচিলতে বেদনা আছে তার হৃদয়ে। হালকা দহন হয় যখনই মনে পরে অতীত। সেই পঁচিশ বছর থেকে এক অব্যক্ত যন্ত্রণা কুরে কুরে খাচ্ছে! বয়ে বেড়াচ্ছে নীরব ঘাতকের মতো। কোনোদিন দেখা হলে শুধু একটা কথা বলার আছে রুক্সিনির, কিসের এত অহমিকা ছিল সেদিন সত্যব্রতর? শুধু এই জানতে চাইবে একবারটির জন্য। অবশ্য এখন আর সেই অধিকারটুকুও কি ফলাতে পারবে সে?
আরও পড়ুন: ঝিঁঝিলাগা দিনগুলো-১২॥ শিল্পী নাজনীন
উপেক্ষাটাই রুক্সিনিকে বেশি কষ্ট দিয়েছিল। প্রতিজ্ঞা করেছিল যে করেই হোক প্রতিশোধ নেবে। কার প্রতি বিতৃষ্ণা হয়ে এই প্রতিশোধ?আর কাকেই বা ঘায়েল করে এর শোধ নেয়া? সে তো সত্যব্রতর কাছে প্রতি পদক্ষেপে হেরে গেছে। শত বারের বিপরীতে সত্যব্রত একবারও বলেনি রুক্সিনিকে সে ভালোবাসে। ভালোবাসাটা ছিল একতরফা রুক্সিনির দিক থেকে। তবে কি রুক্সিনির প্রতিশোধ স্পিহার খড়গতলে দেবপ্রতিম?
সত্যব্রত আর দেবপ্রতিম দুই বন্ধু। এমনি সরল ওদের নিজেদের বোঝাপড়া যেন হরিহর আত্মা কিংবা পূর্বজন্মের যেন দুই সহোদর। শুরুতে ওরা সহকর্মী। পরে বন্ধুত্ব। রুক্সিনির ব্যাপারটা সত্যব্রত আগাগোড়া জানিয়েছিল দেবপ্রতিমকে। রুক্সিনি ঘূর্ণাক্ষরেও টের পায়নি, নইলে কি আর দেবপ্রতিমর সঙ্গেও একই ধরনের আস্কারায় মাত্তো? দেবপ্রতিম সব জেনেশুনেই রুক্সিনিতে সায় দিয়েছিল। বন্ধুতে বন্ধুতে সবকথা চালাচালি চলত কেবল রুক্সিনি বুঝতে পারেনি শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত। বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দ্বন্দ্বে রুক্সিনিকে এমন এক সীমানায় দাঁড় করিয়েছিল সত্যব্রত, সেই ধকল সইতে না সইতেই দেবপ্রতিম আবার নুন ছিটালো সেই কাঁটা ঘায়ে। ওই একই বিষয়ে দ্বন্দ্বিকতা বিশ্বাস-অবিশ্বাসে। দুই দিক থেকে চাপা খেয়ে রুক্সিনি তখন দিশেহারা। সত্যব্রত যাকে সে মনেপ্রাণে ভালোবাসে বলে নানান সময়ে বলেছে, সে রুক্সিনিকে অবিশ্বাস করে আর এর মূলে প্রসঙ্গ টেনে এনেছে দেবপ্রতিমের সঙ্গে রুক্সিনির যোগাযোগ। অথচ সবাই দেখেছে প্রতি মুহূর্তে ওরা দুইবন্ধু একসঙ্গে কি সাবলীলেই না চলাফেরা করেছে? আদতে দেবপ্রতিম প্রসঙ্গ সত্যব্রতকে কতটা রাগান্বিত করতে পারে রুক্সিনি তা জেনেছে সত্যব্রত থেকেই। সে আরো জেনেছিল তখন, রুক্সিনি যেখানে প্রাসঙ্গিক সেখানে সত্যব্রতর কাছে দেবপ্রতিম সম্পূর্ণ মৃত। অথচ শেষে কিনা সবকিছু উল্টে গেলো! তাহলে আসল কোনটা? রুক্সিনির জানাটা নাকি বন্ধুত্বের গোপন বোঝাপড়া? কালের পাতা উল্টায় রুক্সিনি।
রুক্সিনি ভাবে, এমনটা যদি হতো—আজ ঠিক ঠিক ওদের দেখা হতো প্যারিসে? তবে কি সত্যব্রতকে চিনতে কষ্ট হতো না তার? কে জানে পঁচিশ বছরে আজ সে কেমন হয়েছে দেখতে? কিন্তু দেখাতো হওয়ার নয়—কোথায় প্যারিস আর কোথায় ঢাকা শহর!
নিজেকে জীবন জোয়ারে ভাসিয়ে দিয়ে আজ অনেকটাই থিতু হয়েছে রুক্সিনি। নিজেও অনেকদিন বিদেশ থেকেছে স্বামীর সঙ্গে, স্বামী গত হলে সে বাবার ভিটায় ফিরে আসে। ছেলে-মেয়ে প্রতিষ্ঠিত। যার যার ভবিষ্যৎ বেছে নিয়েছে—রুক্সিনি বাধা দেয়নি। মেয়ের বিয়ে হয়েছে। আর ছেলেটাকে বিয়ে দিয়েই তার মুক্তি।
মানুষের জীবনে এমন হয় হামেশাই। আত্মচক্রে কিংবা নিয়তিতে ধরা পড়ে নিজেই। ছেলের পছন্দের মেয়েকে বিয়ে করাবে বলে ‘দেব ভিলায়’ যখন রুক্সিনি কনে দেখতে যায়, পঁচিশ বছর আগের স্মৃতি জেগে ওঠে ভয়ঙ্করভাবে। আজকের দিনেই সত্যব্রতর সঙ্গে তার দেখা করার কথা ছিল প্যারিসে। তবে এভাবে মুখোমুখি হবে—এ কল্পনাও ছিল না কোনোদিন। তবু দেখা হয়ে যায় সত্যব্রত নয় দেবপ্রতিমের সঙ্গে। আগে থেকে যদি জানতো ছেলে মৈনাক যাকে পছন্দ করেছে, সে দেবপ্রতিমের মেয়ে, তবে কখনোই এই সমন্ধে মত দিতো না সে। তবে এখনো সময় ফুরিয়ে যায়নি। বেঁকে বসলেই হলো। মুখে শ্লেষের হাসি নিয়ে যখন দেবপ্রতিমের মুখোমুখি হয় রুক্সিনি, অবাকের পালা।
রুক্সিনি ভাবছিল দেবপ্রতিম তাকে চিনতে না পারলেও সে চিনতে পারবে। কিন্তু যে মানুষটাকে সে দেখছে চোখের সামনে, সত্যিই চেনা দায়—যদি দেয়ালে ঝোলানো যুবককালের ছবিটা না চোখে পড়ত। তারপরও শিউর হয়ে নিয়েছে। হ্যাঁ, এই দেবপ্রতিম সাহা। সত্যব্রত রয়ের বোজম ফ্রেন্ড। রুক্সিনিকে সে দেখতে পায়নি কারণ দেবপ্রতিম অন্ধ। চোখে কালো চশমা। হাতে একখানা স্টিলের লাঠি। রোগা পাতলা গড়ন। মাথায় একরত্তি চুল নেই। কে একজন তাকে ধরে ধরে এনে সোফায় বসিয়ে দেয়। পরিচয় পর্বের মাঝে ইচ্ছে করেই রুক্সিনি তার নামটা বলেনি। গত হওয়া পতির নামের আগে মিসেস বসিয়ে পর্বটা সেরে নিয়েছে। কনে দেখা শেষ হলে এখানে কিছুই বলেনি বরপক্ষ। পরে জানাবে।
আরও পড়ুন: দৃশ্য ছাপিয়ে যাওয়ার পর ॥ ফারহানা রহমান
অন্তর্দ্বন্দ্বের জ্বালা কঠিন। দেবব্রতকে দেখার পর থেকে একদিকে রুক্সিনির পুরনো প্রতিশোধ চাড়া দিচ্ছে আবার অন্যদিকে ওর অসহায়ত্ব মানে অন্ধত্ব কিছুটা মমত্ববোধও জাগাচ্ছে। ভাবছে, ছেলেকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে ঠেকিয়ে দেবে কি এই বিয়ে? আবার ভাবছে—নাকি ছেলের জেদের কাছে নিজেকে অসহায়ভাবে সপে দিতে হবে। তাছাড়া যদি ঠেকিয়ে দিতে পারে বিয়েটা, কাজটা কি ঠিক হবে? পঁচিশ বছর আগের সেই প্রতিশোধ নির্ভর করছে তার একরোখা একটা মতের ওপর কিন্তু বিপরীতে আছে দুটো ছেলে-মেয়ের ভালোবাসা। আবার ভাবছে, পুরনো কাসুন্দি ঘাঁটাঘাঁটি হলে নিজেই তো হেয় হবে? সমাজ জানবে। না হয় শুরুতে এই সেই বলে বোঝানো যাবে মানুষ কিন্তু কতদিন গোপন থাকবে আসল খবর? সে সত্যব্রতকে ভালোবেসেছিল ঠিক, কিন্তু এই যে আজকের অন্ধ দেবপ্রতিম; তাকেও কি কিছুটা ভালো লাগতো না রুক্সিনির—নিজে নিজেই ভাবে সে। নইলে দেবব্রতের সঙ্গেও কেন তার হৃদ্য সম্পর্ক থাকবে? আর এরই রেশ ধরে দু’একবার কি একান্তে নিরিবিলি কোনো এক কফি শপে কিংবা ফাস্ট ফুডের কর্নারে বসে ওরা চুকচুক করে গল্প করেনি? হ্যাঁ, করেছে। তবে রুক্সিনি প্রতিশোধ নেবেই এই পণ। কিন্তু একটু অন্যভাবে, একটু মিষ্টি করে।
দুই.
বিয়েটা হবে ঠিকঠাক। বরপক্ষ জানিয়ে দিয়েছে কনে পক্ষকে দিনক্ষণ। তবে ছেলের বিয়ের পর রুক্সিনি যদি কোনোদিন জানতে পারে তার পুত্রবধূ দেবপ্রতিমের নয়, এক দুর্ঘটনায় মারা যাওয়া সত্যব্রতর একমাত্র বেঁচে যাওয়া মেয়ে, তবে? এক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছিল উভয় পরিবারের প্রায় সব সদস্য। ভাগ্যগুণে দুটি প্রাণ বেঁচে যায়। একজন দেবপ্রতিম কিন্তু মস্ত চোট পায় মাথায়। আস্তে আস্তে নিস্তেজ হতে থাকে চোখের রোশনি। এখন পুরোপুরি অন্ধত্ব বরণ করতে হয়েছে। সে যাত্রায় আর বেঁচে যায় সত্যব্রতর ছোট মেয়েটি, যাকে নিজের সর্বস্ব দিয়ে আগলে বড় করেছে দেবপ্রতিম; দিয়েছে নিজের সবকিছু উজাড় করে—বুঝতে দেয়নি কিছুই; না বাবার অভাব না মায়ের।
চোখের সামনে ঘুরঘুর করবে যে মেয়েটা, একসময় তার বাবা ছিল সেই মেয়ের শাশুড়ি মানে রুক্সিনির ভালোবাসা অথচ সে কথাটা জানতে পারার পরও রুক্সিনি না পারবে কাউকে বলতে, না পারবে সইতে? তখন কে কার প্রতি প্রতিশোধ নিলো বলে রুক্সিনি ভাববে? সত্যব্রত নাকি দেবপ্রতিমের প্রতি রুক্সিনি? নাকি রুক্সিনির প্রতি সত্যব্রত আর দেবপ্রতিম?
পঁচিশ বছর আগে রুক্সিনি যেভাবে প্রতি পদে হেরেছিল সত্যব্রতর কাছে ঠিক এমনিভাবে তো বাকি জীবনের জন্য হেরে গেলো আবার! এবারের হারটা তাহলে কার কাছে?