আমরা যাত্রা শুরুর আগেই বোঝাপড়া শেষ করতে চাই। যদিও এই বোঝাপড়া প্রক্রিয়াটির শুরু অনেক আগে আর আজই নিশ্চিতভাবেই তা শেষ হতে চলেছে, কিন্তু শুরুতে এর যে প্রয়োজন ছিল, শেষটায় আসলে আর কোনো প্রয়োজন নেই। তবু দুজনের দুটি পথ বেঁকে যাওয়ার আগে নিজেরাই নিজেদের জন্য অনুভব করি কিছু তাগিদ কিংবা অনুশোচনা। আহা! কী হতে পারতো আর কী হতে পারতো না—এই দুই সম্ভাবনারই অসমাপ্ত আক্ষেপের প্রায়শ্চিত্ত করতে চাই আমরা। নিষ্প্রয়োজন জেনেও। হয়তো দুর্ভাগাদের তাই হয়। স্ক্রিপটিং হয়, কাস্টিং হয়, রিহার্সেল হয় কিন্তু শেষ পর্যন্ত কাঙ্ক্ষিত প্রচারের পরিণতি আর কপালে জোটে না।
সন্ধ্যায় নানির হাতে পাতানো দইয়ের মতো জমে ওঠার আগেই জ্বলে ওঠে রাস্তার নিয়ন, রাতের অন্ধকার কেমন ছাড়া ছাড়া দুধছানা হয়ে বিছিয়ে থাকে চারপাশে। করপোরেট গাড়ির সারি বিরক্ত হয়ে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে ভেতরে বসে থাকা যান্ত্রিক মানুষগুলোকে ঠিকানায় পৌঁছে দেওয়ার জন্য। রাস্তার ওপাশে হাইরাইজ বিল্ডিংয়ের ৫৫ ইঞ্চি পর্দা ফুঁড়ে ভেসে আসতে থাকে, কল্যাণের জন্য এসোর আহবান। দেখি দূরে একটা ফ্ল্যাটের জানালায় টিনএজ ছেলেটার চা কিংবা কফি কিংবা হরলিক্সের মগে স্বপ্নময় একটা ভবিষ্যৎ চুপ মেরে বসে থাকে। ছেলেটার মুখভঙ্গি বদলায় সামনের টিভি স্কিনের সঙ্গে সঙ্গে। সে আনন্দে হাসে, বিরক্তিতে কপাল কুঁচকায়। কাপটা টিভির সামনে রেখে দিয়ে টিভি অফ করে দেয়। মোটা একটা বই হাতে নিয়ে ঘরের এ মাথা ও মাথা করে। চুপ করে বসে থাকা ভবিষ্যৎটা এবার বেশ গতিতে ছেলেটার সঙ্গ নেয়।
হয়তো কোন স্পটে আজকের মতো শুটিং প্যাকড আপ হয়। আমার কিছুই হয় না। এই ক্যামেরা, লাইট অ্যাকশন। পুনরায় সেলিব্রেটি হওয়ার উদগ্র বাসনা আমাকে কুরে কুরে খায়। পুরো একটা নাটক, সিনেমা না হোক, দুই মিনিটের বিজ্ঞাপন হলেও এমুহূর্তে আমি ছাড়তে চাই না। তাও হয় না। আমার ফ্যাশন, পার্লার, কনভেন্স—সবকিছুর তাল কেটে যায়। অল্প কয় বছরের অভ্যাস, তবু এই বেতাল অনভ্যাস মেনে নেওয়াটা অসহনীয় হয়ে দাঁড়ায় আমার কাছে। আমি আয়নার সামনে নিজেকে পরখ করি। হ্যাঁ, পেটের চারপাশে মেদের পুরুষ্ট স্তর। কোমরটা মাত্রা ছাড়ানো ভারী। কী করব? খ্যাতির আলোর নিচে একবার দাঁড়ানোর পর অনিবার্য নেমে আসা অন্ধকারটা মেনে নেওয়ার কষ্ট আমার চেয়ে বেশি কেউ জানে না।
স্বীকার করি মামাদের সংসারে শুটকি সালুন আর কচুর লতা, পুঁটি খেয়ে বড় হওয়া আমি হঠাৎ আলোর ঝলকানির নিচে ত্রিশ পদের সালাদ, নাম না জানা ডজনখানেক মেইন ডিশ আর কুড়ি পদের ডেজার্ট দেখে হুঁশ হারিয়ে ফেলেছিলাম। ফলে দৈর্ঘ্যে-প্রস্থে সীমা ছাড়িয়ে অযোগ্য হয়ে পড়েছি। আচ্ছা মৌসুমী কি আমার চেয়ে মোটা নয়? অপু বিশ্বাস বাচ্চা হওয়ার পর তো কী ভীষণ মুটিয়ে গেছে। আর সব দোষ আমার? কেবল আমি অযোগ্য হয়ে পড়েছি?
সারারাত নয় বরং বিগত জীবনের অবরুদ্ধ কান্না তার বাঁধ ভেঙে ছড়িয়ে পড়েছে বাড়িময়। আমার পড়ার টেবিলে, আলনায়।
টিটু তবু এটা-ওটার সন্ধানে সকাল-সন্ধ্যা ছোটে। টুকটাক কিছু একটা জুটেও যায়। হয়তো সর্বক্ষণ জ্বলে থাকা ফ্ল্যাশের আলোর নিচে থাকা সেলিব্রেটি হওয়া হয়ে ওঠে না, হয়তোবা লাইট-ক্যামেরা-অ্যাকশনের মোহময়ী আহবানের স্বপ্ন সহজ কিংবা কঠিন হয়েও লভ্য হয় না, তবু এই সাজিয়ে রাখা ফ্ল্যাট আর যা হোক রাজধানীতে কোনোভাবে টিকে যাওয়ার ব্যবস্থাটুকু হয়ে যায়।
শুধু আমি এ শহরে বড় বেশি অপ্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছি। কবে থেকে? কেন হয়েছি? প্রয়োজনটুকুর অপ্রয়োজনে টার্ন নেওয়ার দায় পুরোটাই কি আমার? নিজেকে আমূল বদলে ফেলার আয়োজনে আমি ঠিকঠাক নিজেকে যোগ্য করে তুলতে পারিনি?
পরিস্থিতি মেনে নেওয়ার এক স্থিতিস্থাপক গুণ আছে টিটুর। আমার নেই। আমাকে হতাশা গ্রাস করে, অসম্ভব জেনেও আমি অনেককিছু সম্ভব করে মুঠোয় পুরতে চাই। আমার হতাশা ঠিক সংক্রমিত হয় না টিটুর মাঝে, তবে টের পাই আমার প্রতি দুর্বলতা ওকে দুর্বল করে দেয়। ও কঠোর কিছু বলতে পারে না, নানাজনের খোঁজ খবর দেয়। ডিরেক্টর, প্রোডিউসার। আমি পড়িমরি আশার তীব্র তাড়ায় হাত বাড়িয়ে দৌড়াই, হতাশার মুঠো গুটিয়ে ফিরে এলে টিটু মুচকি হাসে, সে হাসিতে ছায়া ফেলে রাখে যে বেদনা, তা আমার বেদনাকে ছাপিয়ে যায় না বটে, কিন্তু আমার দৃষ্টি থেকে লুকাতেও পারে না। মোলায়েম গলায় বলে, তোর আসলে বুঝে-শুনে এ লাইনে আসা দরকার ছিল। এখানে প্রতিদিন নিজেকে প্রমাণের পরীক্ষা। উত্থান-পতন পাশাপাশি থাকে, দুটোই মেনে নেওয়ার জন্য নিজেকে প্রস্তুত রাখতে হয়।
একদম, একদম তাই। এখন বুঝতে পারছি। আমার উত্তরে হো হো হাসে টিটু, আমারও হাসি পায়। আমি ত্রস্ত হয়ে চারপাশটা দেখি। কেউ শুনতে পেলো কি না! না। সবার মুখে শোকের মুখোশটা অক্ষতই ঝুলে আছে। টিটু বলে, আমরা যে গ্রামের মাটি গায়ে লেপ্টে বড় হয়েছি, টের পেলি তো গা থেকে সেই মাটিমাখা গন্ধ চামড়া সুদ্ধ তুলে না ফেললে এখানে টেকা কঠিন? আমি স্বীকার করি, সত্যি বলেছে টিটু। আমাদের গায়ে এখনো গোবর দিয়ে মাটিলেপা উঠানের উৎকট গন্ধ বিদেশি পারফিউমে মিশে ভ্যানিশ হতে পারেনি। আঙুলে শুটকি সালুনের গ্রাম্যতা, বুফে খাবারের সারিতে একটু আধটু বদহজম লুকাতে পারি না। আর কথায় যে ধানক্ষেতের বাষ্প, সুযোগ পেলেই শীতাতপনিয়ন্ত্রিত সভ্যতায় বেরিয়ে পড়ে।
আমি ফ্রিজে জিনের বোতল রাখতে পারি না। কারণে-অকারণে পার্টি থ্রো করতে পারি না। হয়তো পারতাম, করতামও। কিন্তু গ্রাম্যজল শহুরে তেলের সঙ্গে ভালোমতো মিলমিশ হওয়ার আগেই দেখি ভাঁড়ারে টান! আমার আড়ংয়ের দামি গিফট নিয়ে অকারণে ভাবিদের বাসায় গিয়ে সারপ্রাইজ দেওয়া হয় না। ভাইয়াদের গা ঘেঁষে আর বসা হয় না। যমুনা রিসোর্ট কিংবা গাজিপুরে লং ড্রাইভ বিনিময় হয় না। আমি জানি না, তা নয়। পারিনি। কখনো সামর্থ্যের কারণে, কখনো পেছন টেনেধরা গ্রাম্য জড়তার কারণে।
আর তারপর, ভাবমূর্তি সমুন্নত রাখার আবশ্যিক অনুষঙ্গ গাড়ি, ফ্ল্যাট কেনার সামর্থ্য হওয়ার আগেই ক্যারিয়ারে ধস। আসলেই আমার বুঝে-শুনে এ লাইনে আসা দরকার ছিল।
মায়ের করুণ চেহারাটা আমার দিকে ঘোমটা ফেলে ফিরে তাকায়। মাকে বলার কিচ্ছু নেই। মায়ের কাছে অপরাধী আমি। মায়ের প্রচণ্ড আপত্তি ছিল। মা আমাকে ছেড়ে দিতে চাননি। আমি মায়ের নিষেধ শুনিনি। সোনালি জগতের হাতছানির লোভ সংবরণের শক্তি সাধারণের থাকে না। অতি সাধারণ অদূরদর্শী মেধা পথটা দেখে, পথের শেষে খাদটা দেখে না। যেদিন চলে আসি, তার আগের রাত মা খাননি। সন্ধ্যাবেলায় বাতি নিভিয়ে মশারি টানিয়ে শুয়েছিলেন। পাশের রুমে আমি টের পেয়েছি মা সারারাত কেঁদেছেন। সকালে বিদায় নিতে গেলে মা ফিরেও তাকাননি। আমার চোখও জলে টলমল করছিল। তবু নিকানো উঠানের টিনের বাড়িটাতে মাকে আর নানিকে ফেলে যেতে যেতে মনে মনে কঠোর প্রতিজ্ঞা ছিল, আমি কিছু হয়েই ফিরে দেখাবো মা। তোমাকে মুক্তি দেব এই ত্রস্ত পরাধীন জীবন থেকে। তখন তুমি সবাইকে বলবে, দেখো দেখো আমার মেয়ে।
দুপাশে সর্ষে ক্ষেত, দূরে স্কুলের ঢং ঢং ঘণ্টা, একমনে ঘাস খাওয়া গরুর দল, নসরত চাচার চায়ের টং পাশ কাটিয়ে রেলস্টেশনমুখী যেতে যেতে রিকশায় বসে বসে আমি ঠিক কল্পনা করতে পারছিলাম, তখন আমার মা চিৎকার করে কাঁদছিলেন। আছাড়ি-পিছাড়ি কাঁদছিলেন। সারারাত নয় বরং বিগত জীবনের অবরুদ্ধ কান্না তার বাঁধ ভেঙে ছড়িয়ে পড়েছে বাড়িময়। আমার পড়ার টেবিলে, আলনায়। টিনের দেয়ালে ঝোলানো আয়নায়, খাটের পাশে ঋণ করে কেনা শখের হারমোনিয়ামে। পাউডারের কৌটায়, অপু বিশ্বাস আর দীপিকা পাড়ুকোণের পোস্টারে। শখের বেলি, হাস্নাহেনা, গোলাপের বাগানে।
দিনরাত এক করে ঘরের পাশে বাগানখানা করেছি আমি। জেলা সদরের নার্সারি থেকে চারা এনে, সময় সময় জৈব সার দিয়ে, পানি দিয়ে। কী যে নেশা চেপেছিল বাগান করার, হারমোনিয়াম কেনার মতো নেশা। মামিদের কাছে ঋণ করে চেয়ে চিনতে কিনে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন মা। আমি পালবাড়ির শিপ্রাদির কাছে শিখে এসে বাসায় বাজাতে বসলে মামিরা টিপ্পনি কাটতো—সাবিনা ইয়াসমিন না রুনা লায়লা! বাগানটা করতেও না কি বাধা দিয়েছে তারা, এখানে করোলা,ঝিঙ্গা, লাউ মাচাং করলে খেয়ে শেষ করা যেতো না। ভাগ্যিস মামারা বাপমরা মেয়েটার শখ আহ্লাদ একটু আধটু পূরণ করতে দিয়েছেন। মাকে ডেকে বলে দিয়েছেন, ঘরের বউদের হকল কথা গায়ে মাখানি লাগে না।
আব্বা মারা যাওয়ার পর নানির বাড়িতে আশ্রিতা আমার মা। শুধু আমার দিকে তাকিয়ে নিজের জীবন যৌবন অস্বীকার করে মামিদের ফুট ফরমাশ খাটা আমার মা। বুঝ হওয়ার পর থেকেই দেখে এসেছি কোন মামি কখন রাগ করে তার হিসাব করতে করতে নিজের দিকে তো দূরের কথা আমার দিকেও ভালো করে তাকানোর সময় পাননি মা।
আচ্ছা আমার বাগানটা কেমন আছে? মা কি গাছগুলোতে পানি দেন এখনো? নাকি মামিরা সেখানে লাউয়ের মাচা বানিয়েছে? আচ্ছা আমার মা এখন কী করছেন? তিনি কি এতক্ষণে খবরটা পেয়ে গেছেন?
টিটু দেখি অভ্যাসমতোই হাত বাড়ায়। আহা! আমার কষ্ট লাগা বাড়তে থাকে। যদি ওর বাড়িয়ে রাখা হাতটা ভরসা নিয়ে ধরে থাকতে পারতাম! পালবাড়ির পতিত মাঠে খেলতে একদিন হাওয়া হয়ে যাওয়া টিটু হলুদ খামে করে আমাকে আমাকে পাঠিয়েছিল মুক্তির আহ্বান। এর আগে জানতাম, স্কুলে যাওয়ার নাম করে পাশের লন্ড্রিতে বইখাতা জমা রেখে তিরিশ মাইল দূরে হলে সিনেমা দেখতে চলে যেতো সে। ফিরে এসে মাঠের ধারঘেঁষে বসে বসে নায়কের মতো ইশারা করে গান গাইতো—বাবা বলে ছেলে নাম করবে…। তার ইশারার এলোমেলো আহ্বান এদিক-সেদিক ঘুরে আমার চোখেই স্থির হয়ে যেতো অব্যর্থ নিশানায়। বাঁশঝাড়ের আড়ালে একটুখানি পতিত জমি, ঘাসের দল সেখানে সতেজ বসে থাকে অপ্রয়োজনে। কারও তেমন প্রয়োজন পড়ে না যেখানে, সেখানে বসে গল্প শোনাতো টিটু, কী করে মৌসুমীকে নিয়ে পালিয়েছে সালমান শাহ। হাত ধরে ঠিক নায়কের ভঙ্গিতে বলতো, তোরে নিয়া আমিও পালামু একদিন।
মধ্যরাতে নামি ডিরেক্টরের কল স্কিনে ভেসে উঠলেই, আমি ফোন রিসিভ করে রুক্ষ ক্রুদ্ধ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করি, কী ভাবি বাসায় নেই?
রাজপুত্র ডালিমকুমার জানতো আমি রাক্ষসপুরীর রাজকন্যা। তখনো টগবগে ঘোড়া জোটাতে পারেনি বলেই হয়তো হলুদ খাম জুটিয়েছিল টিটু, আমার জন্য।
ফুল্টুকি আর বৌবন্দি খেলার ফাঁকে টিটু আমার হাত ধরে টান মারতো। একদিন-দুদিন। ওর এই টানে কী যাদুমন্ত্র ছিল, আমার মনে রঙ ধরা শুরু হয়ে গিয়েছিল, সেই খেলার বয়সেই! সেই টানেই ঘর ছেড়েদিলাম আমি। আহা যদি ওর হাতটাই ধরে থাকতাম।
কিন্তু কী হয়েছিল আমার, অন্ধকারে আমি দেখেছিলাম কোন ভূত! আজ এই মুহূর্তে যা স্পষ্ট বুঝতে পারছি, তা কেন এতদিন বুঝতে পারিনি? একটা সময় ঘোর শত্রু মনে হয়েছে টিটুকে। আমার যাত্রাপথে কাঁটা বিছিয়ে ধরছে ভালোবাসার লোভ দেখিয়ে। এই ভালোবাসা, ঘর সংসার ঠিকানা আশ্রয়ের চেয়ে আমার কাছে বড় হয়ে উঠেছিল নিজেকে প্রমাণ করা।
প্রমাণ করার জন্য কীই না করেছি আমি! সেই শুরু থেকে। হলুদ খামে পাঠানো বিজ্ঞাপনটা দেখে আবেদন করার পর থেকে। ঢাকায় এসে ইন্টারভিউ দিয়ে টিকে যাওয়ার পর থেকে। শুরুটা ভালোই ছিল। স্কুলের বান্ধবী অরুর হোস্টেল থেকে নিজের নেওয়া এই ফ্ল্যাট অবধি। মায়ের নিষেধ থেকে টিটুর নিষেধ ডিঙিয়ে দেখিয়ে দেওয়া অবধি। প্রথম ছবিটা হিট করে গেলো। পত্রিকা, মিডিয়া—নিয়মিত কন্ট্রাক্ট সাইন। আমার আর পেছন তাকানোর ফুসরত কই? বরং আমার পেছন পেছন ক্যামেরা-বুম-লাইট…।
আজও সব হাজির। লোকে লোকারণ্য। অনুচ্চ অস্পষ্ট পারস্পরিক আলোচনা-ফিসফাস। ইলেকট্রনিক মিডিয়া, প্রিন্টিং মিডিয়া, ক্যামেরা, বুম। স্মৃতি, আফসোস, কান্না শোক আর সবকিছু মুড়িয়ে একটা মুখোশ। এই মুখোশটার আড়ালের চেহারাগুলো যে আমি জানি, তা তারাও জানে। আমিও জানি তারাও জানে, আমরা সবাই নিপুণ অভিনেতা। জীবিকার জন্য অভিনয় করতে করতে অভিনয় কখন আমাদের মজ্জায় মিশে যায়, আমরা নিজের সঙ্গেই নিজেই অভিনয় শুরু করে দেই, তা জানি না।
শেষ কয়টা মাস, একটু ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে অভিনয় করব বলে কতজনের কাছেই না ধর্ণা দিয়েছি। কেউ আশ্বাস দিয়েছে, কেউ ওজন কমাতে বলেছে, কেউ বলেছে আহা, দুটো দিন আগে আসতেন, মাত্র নতুন কাস্টিংটা শেষ হলো। তারা যোগাযোগ রাখার পরামর্শ দেয়। প্রথম প্রথম আমি বিশ্বাস করি। তারপর দেখি, যতটা যোগাযোগ আমি রাখি, তারচেয়ে বেশি যোগাযোগ তারা রাখে। রাত গভীর হলে তাদের ফোন সচল হয়। তারা তাদের একাকিত্বের কথা বলে। অসুখী দাম্পত্যের কথা বলে। এক ফাঁকে তারা বুকের সাইজটাও জিজ্ঞেস করে, যেন বা তাদের নতুন কাজে কাস্টিংয়ের জন্য সাইজটা জানা খুব জরুরি। কিন্তু তারা নতুন কাজের কথা বলে না। তারপর আমি অবিশ্বাস করি। মধ্যরাতে নামি ডিরেক্টরের কল স্কিনে ভেসে উঠলেই, আমি ফোন রিসিভ করে রুক্ষ ক্রুদ্ধ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করি, কী ভাবি বাসায় নেই? ওরা সকালের কাকুতি করা আমার সঙ্গে রাতের আমাকে মেলাতে না পেরে ফোন কেটে দেয়। ওই যে গ্রাম্য জল, শহুরে তেলে মিশতে চাই, অথচ এর আধুনিক প্রক্রিয়াটার সঙ্গে মিশে যাওয়ার পূর্বমুহূর্তেই চর্চাহীনতার ফুটো গলে বেরিয়ে পড়ে।
টিটু আমাকে ফিরে যেতে বলে গ্রামে, মায়ের কাছে। বলে, চল একসাথে ফিরে যাই। আমার বাপের কম নাই। দুজনে ঘর-সংসার করবো। বাচ্চাকাচ্চা হবে। আমার বাপও খুশি হবে, তোর মাও। আমি ঠাঠা আকাশ কাঁপিয়ে হাসি। কী অবাস্তব কথা! আমি মিডিয়া সেলিব্রেটি, আমি নাকি গ্রামে ফিরে যাব! টিটুদের গোলার ধান রোদে শুকাতে দেব। সেদ্ধ করে চাল বানাবো আর মুড়ি ভাজব! বলে কী উন্মাদ! ফিরে যেতে বলিস তো ডাকলি কেন, তুই এলি কেন?
আমি আক্রমণে ওকে বিধ্বস্ত-পরাস্ত করতে চাই। সালমান শাহ হইবার স্বপ্ন দেখছিলাম—কী যে ভুল করছিলাম, কী যে ভুল! যে রকম ভুল সালমান শাহ নিজেও করছিল। মানুষের ভুল কী জানস, ভুলরে ভুল জাইন্যা ভুল করন। জীবনের ভুল য্যান এক সুন্দরী রাজকন্যার রূপ ধরা ডাইনি। চোখে ধান্ধা লাগাইয়া ধ্বংসের দিকে টানে। একদম গ্রাম্য ভাষায়, ওর ক্ষরিত হৃদয়ের আর্তনাদ। আক্ষেপ, হতাশা, অনুশোচনা। আরও একটা কিছু। কী যেন আমি ঠিকঠাক ধরতে পারি না।
প্রথম প্রথম পরপর কয়েকটা হিট সিনেমার পর নিজেকে সফল আর প্রবল আত্মবিশ্বাসে আমি যখন নিজেকে প্রায় শাবনাজ, মৌসুমী পর্যায়ের কিছু ভাবতে শুরু করে দিয়েছি, তখন মাকে কয়েকবার এখানে আনতে চেয়েছি। মা আসেননি। মামিদের অবহেলায় অবাঞ্চিত জীবনেও নিজের ব্যক্তিত্বপূর্ণ অবস্থানের সঙ্গে আপস করেনি মা। ভাগ্যিস!
সফেদ পাঞ্জাবি, জিন্স-প্যান্ট আর গায়ে চাদর ঝুলিয়ে লোকটি আসে। ঠিক আমাদের যাত্রার পূর্বমুহূর্তে। আমরা একে অন্যের দিকে তাকাই এবং নিরর্থক জেনেও আমাদের পারস্পরিক বোঝাপড়ার ইচ্ছেটা আবার জেগে ওঠে। লোকটির হাতে একটি বিশাল ফুলের তোড়া। মুখে বেদনার্ত মুখোশ। লোকটি ফুলের তোড়াটা দিতে এগিয়ে আসে। আমরা, আমি আর টিটু দুজনেই তার মুখের ভাঁজে ভাঁজে লুকানো ভণ্ডামিগুলো পড়ার চেষ্টা করি। আজ কি অন্তত একটু অনুতাপের অন্ধকার জমেছে সেখানে? শহরে এসে এর বাসায় আশ্রয় পেয়েছিল টিটু। যখন কোথাও থাকার জায়গা ছিল না তার, লোকটি নিজের কাছে রেখেছিল। প্রোডাকশন বয়ের কাজ দিয়ে আপাত টিকে থাকার পথ করে দিয়েছিল। এমন সে প্রায়ই নানাজনের জন্য করে। তার মহত্ত্ব আর উদারতা ইন্ড্রাস্টিতে কিংবদন্তি সম।
সে আত্মবিশ্বাসে জানায়, নিশ্চিত অস্কারে ফাইট দেওয়ার মতো ছবি হতে যাচ্ছে এটি। কাস্টিংয়ে আছে বিরাট চমক। কোথাও উচ্চারিত হয় না আমার নাম।
ফুল দিয়ে এককোণে দাঁড়িয়ে যায় সে নিজের জায়গা করে। সঙ্গে সঙ্গে একগাদা ক্যামেরা তাক হয়ে যায় তার দিকে, সঙ্গে উজ্জ্বল আলো আর কিছু বুম। প্রতিথযশা ডিরেক্টর সে। তার হাত গলে এক এক করে বেরিয়ে গেছে খ্যাতনামা ডজনখানেক ছবি। ওজন, গ্ল্যামার ইত্যাদি অন্যদের কাছে যা মুখ্য, তার কাছে তা গৌণ, অভিনয়ের প্রতিভাটাই মুখ্য। ‘এ ক্ষতি অপূরণীয়’—বলে রুমালে চোখ মুছে সে।
আমরা উচ্চস্বরে হেসে উঠি। নিজেদের সামলে নিয়ে চারপাশটা আবার দেখি, না কেউ শুনতে পায়নি। ঘরময় পাতিয়ে রাখা শোকের আবহটা অক্ষতই আছে। তার কাছে শেষমেশ আমাকে পাঠিয়েছিল টিটু। বলেছিল, তার কাছে পাঠানোটা ঠিক হচ্ছে না মোটেই, তবু পাঠাচ্ছি। আর যাই হোক, লোকটা মেধা চেনে। কিন্তু সাবধান। ‘সাবধান’ শব্দটি খুব অপ্রয়োজনীয় হয়ে মিইয়ে থাকে আমার প্রস্তুতি আর উদগ্র আকাঙ্ক্ষার কাছে। আমি যাই তার কাছে। প্রথম দর্শনেই মুগ্ধ হওয়ার সব গুণ রয়েছে তার। আমি মুগ্ধ হই যথারীতি। কাজের আশ্বাস পাই।
আমার মুগ্ধতায় প্রথমবার টিটুকে বিরক্ত হতে দেখি। টিটুর বিরক্তি আমার বিরক্তি বাড়ায়। অনেক অনেকদিন পর আমি হতাশা আর আত্মবিশ্বাসহীনতার বিপরীতে নিজেকে একটু প্রমাণের সুযোগ পাই। লোকটি আমাকে স্ক্রিপ্ট ধরিয়ে দেয়। তার বাসায় রিহার্সেলে ডাকে। আমি স্বপ্নাতুর হই। এটি বিশাল প্রজেক্ট তার। বিশাল আয়োজন। প্রতিদিন প্রেস, মিডিয়া লাইভ। সে আত্মবিশ্বাসে জানায়, নিশ্চিত অস্কারে ফাইট দেওয়ার মতো ছবি হতে যাচ্ছে এটি। কাস্টিংয়ে আছে বিরাট চমক। কোথাও উচ্চারিত হয় না আমার নাম।
আমি মেইন কাস্টিং। চ্যালেঞ্জিং ক্যারেকটার। একটাতেই বাজিমাত করে দেব আমি। মহাসমারোহে ফিরে আসব আবার। উৎসাহ আর আনন্দের আতিশয্যে রাতে আমার ঘুম টুটে টুটে যায়। আমিই পারব, আমিই। আমি নিজেকে ফিরে পাই।
আমি নিজেকে তার মাঝে হারাই। সে আমার পাঠ শুনে, রিহার্সেল দেখে। তার মুগ্ধতা হাততালি হয়ে বেজে ওঠে। বাহবা দিতে সে জড়িয়ে ধরে আমাকে, আশ্চর্য ইন্ডাস্ট্রির মানুষ তোমার মতো রত্নকে চিনল না। আমার দুর্বল জায়গাটুকুতে সে বিশ্বাস ফিরে পাওয়ার মলম বোলায়। আমি তার মাঝে হাবুডুবু খাই। এভাবে আমাকে আবিষ্কার করতে পারেনি কেউ।
আমি স্বপ্নের মাঝে ডুবে যাই। আমি টের পাই, এ যেন আরেক রূপকথার রাজপুত্র। নিজেকে তুচ্ছাতিতুচ্ছ ভাবার তন্দ্রাবিষ্ট সময়ে সোনার কাঠি রূপার কাঠি ছুঁইয়ে জাগিয়ে দিচ্ছে আমাকে। আমি তার মাঝে মগ্ন হয়ে যাই। লং ড্রাইভ থেকে ফোকফেস্ট। ম্যারিন ড্রাইভ থেকে সাজেক ভ্যালি। স্বপ্নের শুটিংস্পটগুলোয় মুহুর্মুহু ফ্ল্যাশ জ্বলে। ক্যামেরা-লাইট-আ্যকশন। আমি আবার সেলিব্রেটি হতে যাচ্ছি। রাতে স্ক্রিপ্ট আওড়াই, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে এক্সপ্রেশন ঝালাই করি আর দিনে মেপে ভাত খাই, লেডিস জিমের খোঁজ খবর করি।
তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখায় টিটু। নিজেকে প্রমাণ করতে যাচ্ছ তুমি। নিজেকে বিলিয়ে দিতে নয়। টিটুর এই বিষয়টাকে নাক গলানো ধৃষ্টতা মনে হয় আমার। দুঃসময়ে আমার পাশে ছিল বলে প্রোডাকশন বয় টিটু আমার স্বত্ব কিনে নেয়নি। টিটুর কণ্ঠে রূঢ়তা, নিষ্ঠুরতা—লোকটি ভালো নয়। আমি তীব্র প্রতিবাদ করি। তার মতো ভালো মানুষ ইন্ড্রাস্টিতে আর একজনও নেই। সে কতটা ভালো আমার চেয়ে বেশি কেউ জানে না—টিটু আক্ষেপে চিৎকার করে। অসহ্য লাগে টিটুকে, অনধিকার-অযাচিত স্পর্ধা মনে হয় তার আচরণ। আমি বেপরোয়া, টিটুকে ধাক্কা দিয়ে ঘর থেকে বের করে দেই—আর কোনোদিন আমার বাসায় আসবি না। বন্ধ করে দেওয়া দরজার বাইরে টিটু ঠিক কী করে, আমি আর দেখতে পাই না, শুনতেও না। ওর সঙ্গে আর সম্পর্ক রাখব না সিদ্ধান্তে স্থির হয়ে যাই। আমার উত্থানের প্রাথমিক আয়োজনে ও ঈর্ষাকাতর, এমন বিশ্বাস আমার সিদ্ধান্তকে পোক্ত করে।
টিটুর জন্য লাশবাহী ফ্রোজেন গাড়ি আর আমার জন্য পুলিশের ভ্যান মুখোমুখি দাঁড়ায় গেটের সামনে, দুটি পথে বেঁকে যাবে দুজনের গন্তব্য।
তার কিছুক্ষণ পর লোকটির দরজার বাইরে থেকে আমি টিটুর তীব্র গলার আওয়াজ শুনতে পাই। ছি! ছি! ছি! ভেবেছিলাম অন্তত আমার প্রেমিকা জেনে ওর দিকে হাতটা বাড়াবেন না আপনি। লোকটি চুপ। টিটু আরও জোরে চেঁচায়, ওকে ছেড়ে দিন আপনি। প্লিজ। আমার ভুল হয়েছে ওকে আপনার কাছে পাঠানো। আমি জানি, এই সিনেমায় ওকে কাস্ট করবেন না আপনি। আপনি তলে তলে অন্য নায়িকার শিডিউল নিচ্ছেন। আমি জানি। লোকটি তখনো চুপ। টিটুর চিৎকার স্পর্ধার মতো লাগে আমার কাছে। আমি ভেতরে ঢুকতে চাই। টিটু তখনই তার শার্টের কলার চেপে ধরে, শালা প্রতারক, ভণ্ড। আশ্রয় দেওয়ার সুযোগে দিনের পর দিন আমাকে এবিউজ করেছিস তুই শালা! ওকেও ছাড়বি না! মেরেই ফেলবো তোকে।
এবার আমি দ্রুত ঘরে ঢুকি। বাঁচাতে চাই। না লোকটাকে নয়। খুনের দায় থেকে টিটুকে। টিটু। টিটু আর আমি দুজন একই লক্ষ্য আর উদ্দেশ্য নিয়ে গ্রাম ছেড়ে উঠে আসা দুই উত্তুঙ্গু প্রজাপতি। শহরের রঙিন জগতে পথ হারানো পথিক। বাঁচব আমরা, একসাথে বাঁচব। নিমিষে সিদ্ধান্ত নেই। গ্রামেই ফিরে যাব। গ্রাম কী আর গ্রাম আছে এখন? পাকা রাস্তা, ঘরে ঘরে ইলেক্ট্রিসিটি। গ্রামের মানুষ দুই চারদিন টিপ্পনী কাটবে—বিলাতফেরত! তারপর সবাই সবকিছু ভুলে নিজেদের জীবনে ব্যস্ত হয়ে পড়বে অভ্যাসমতো। অতপর আমরাও সুখে শান্তিতে…। গত কয় বছরে ফিরে যাওয়ার মুহূর্তটির কথা যেখানে কল্পনাতেও আনতে পারিনি আমি, কিংবা আনতে চাইনি, সেখানে আজ নিমিষে ভবিষ্যতের পুরো জীবনচক্রটা চক্কর দিয়ে ফেলি।
কিন্তু কী হয়, নিয়তি; অনিবার্য নিয়তি! যে নিয়তি হলুদ খামে করে আমাকে টেনে আনে এই শহরে, যে নিয়তি সম্পন্ন ঘরের ছেলে টিটুকে ছুড়ে দেয় প্রোডাকশন বয়ের জীবনে, যে নিয়তির স্ক্রিপ্ট আগেই লেখা হয়ে থাকে অলক্ষ্যে কোথাও, মানুষের কী সাধ্য এড়ায় তারে? নইলে টিটুকে বাঁচানোর চেষ্টা আমার বিপরীতমুখী হয়ে লোকটিকে বাঁচিয়ে দেয় কেন? দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে নিষ্পন্দ হয়ে যায় টিটু। আর হাসপাতাল থেকে ডেথ সার্টিফিকেটসহ টিটুকে নিয়ে বাসায় প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গেই পুলিশ এসে আমার হাতে হাতকড়া পরিয়ে দেয়।
আমার আর টিটুর মাঝে আর কোনো ভুল বোঝাবুঝি থাকে না। আমরা দুজনে অবাক চোখে দেখি দিনের পর দিন যারা কাজ না দিয়ে ফিরিয়ে দিয়েছিল, তারা পাল্লা দিয়ে শোক আর সহমর্মিতা প্রকাশ করছে। তারা মুহুর্মুহু ফ্ল্যাশ আর বুমের সামনে প্রতিক্রিয়ায় ফেটে পড়ছে এ নেহাৎ দুর্ঘটনা। যেভাবেই হোক তারা আমাকে মুক্ত করে আনবে। এভাবে বিনাঅপরাধে একজন শিল্পী শাস্তি পেতে পারে না। আমার অনুপস্থিতি ইন্ড্রাস্টির জন্য বিরাট ক্ষতি।
টিটুর জন্য লাশবাহী ফ্রোজেন গাড়ি আর আমার জন্য পুলিশের ভ্যান মুখোমুখি দাঁড়ায় গেটের সামনে, দুটি পথে বেঁকে যাবে দুজনের গন্তব্য। আমরা ম্লান হেসে বিদায় দেই একে অন্যকে। অনেককটি ফ্ল্যাশ জ্বলে ওঠে একসঙ্গে। লাইট-ক্যামেরা-অ্যাকশন। আমরা শেষবারের মতো সেলিব্রেটি হয়ে উঠি।