[‘মুক্তিযুদ্ধে খ্রিষ্টান সম্প্রদায়’ মহান মুক্তিযুদ্ধে খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের অবদান নিয়ে রচিত। লেখক নির্মল রোজারিও ও রঞ্জনা বিশ্বাস। বইটির প্রকাশকাল ডিসেম্বর/২০১৮। গত ২৪ ডিসেম্বর গণভবনে বড়দিন উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে বইটির মোড়ক উন্মোচন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বইটি থেকে একটি প্রবন্ধ এখানে প্রকাশিত হলো]
মুক্তিযুদ্ধে খ্রিষ্টান চার্চগুলোর ভূমিকা
‘বাংলার হিন্দু/বাংলার খ্রিষ্টান/বাংলার মুসলমান/আমরা সবাই বাঙালি’। ৭১ X ৪৮.৫০ সেন্টিমিটার পরিমাপের পোস্টারটি মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও প্রচার দফতরের পক্ষ থেকে মুদ্রিত ও প্রকাশিত হয়। এই পোস্টারটি অঙ্কন করেন শিবাগী দেবদাস চক্রবর্তী। পোস্টারটিতে মন্দির মসজিদ, প্যাগোডা ও গির্জার স্থাপত্য শৈলীকে মোটিফ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। কালো, কমলা ও সাদা রঙের সন্নিবেশ ঘটানো হয়েছে এতে। মোটিফগুলো কালো, জমিন কমলা ও বাংলার হিন্দু, খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ, মুসলমান এই লেখাগুলোতে সাদা রঙের ব্যবহার দেখতে পাওয়া যায়। বাঙালি শব্দটিতে কমলা ও সাদা রঙের ব্যবহার করা হয়েছে। পোস্টারটি প্রকাশের মূল উদ্দেশ্যই ছিল জাতি হিসেবে বাঙালিকে একত্রিত করা। বিফলে যায়নি সেই প্রচেষ্টা। হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ সবার মতো এদেশের খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ও মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন।
বাংলাদেশে খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের সংখ্যা কত, তার উত্তর দেওয়ার আগে দেশের খ্রিষ্টান সম্প্রদায় সম্পর্কে কিছুটা ধারণা থাকা দরকার।
বাংলাদেশে নৃতাত্ত্বিকভাবে খ্রিষ্টান সম্প্রদায় দুইটি ভাগে বিভক্ত। একটি বাঙালি, অন্যটি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মধ্যে গারো সম্প্রদায়ের প্রায় ৯৯ শতাংশই খ্রিষ্ট ধর্মাবলম্বী। অন্যদের মধ্যে আছে সাঁওতাল, হাদি, কোচ, তরাও, হাজং প্রভৃতি। এক জরিপে দেখা যায়, বাংলাদেশে মোট খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের একটি বড় অংশই হচ্ছে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী। বাঙালি ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর এই ধর্ম সম্প্রদায়টি আবার দু’টি বিশেষ ধর্মসংস্থার অধীন। একটি ক্যাথলিক অন্যটি প্রোটেস্ট্যান্ট।
বাংলাদেশে প্রোটেস্ট্যান্টদের তুলনায় ক্যাথলিকরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। সারা বিশ্বের ক্যাথলিকরা রোমের পোপ কর্তৃক পরিচালিত। ফলে ক্যাথলিকরা এক বিশেষ প্রতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার আওতায় থেকে যাবতীয় ধর্মীয় ক্রিয়াকর্ম করে থাকে। বাংলাদেশের ক্যাথলিকরাও তাই। বাংলাদেশকে দু’টি ‘মহাধর্ম’ প্রদেশে বিভক্ত করা হয়েছে। এই মহাধর্ম প্রদেশ (Archdiocese) দুটি হলো ঢাকা মহাধর্ম প্রদেশ ও চিটাগাং মহাধর্ম প্রদেশ। এসবের প্রধান হলেন মহামান্য আর্চ বিশপ। এ ছাড়া রয়েছে স্বতন্ত্র ছয়টি ধর্ম প্রদেশ (Diocese)। এগুলো হলো: দিনাজপুর, খুলনা, ময়মনসিংহ, রাজশাহী, সিলেট, ও বরিশাল। এ সব ধর্ম প্রদেশের অধীনে রয়েছে ছোট ছোট ধর্মপল্লী ও উপধর্মপল্লী। নিচে এক নজরে মহাধর্মপ্রদেশ, ধর্ম প্রদেশ ও ধর্মপল্লীগুলোর সংক্ষিপ্ত পরিচয় তুলে ধরা হলো :
ঢাকা মহাধর্মপ্রদেশ
১৬ শতকের শেষদিকে ক্যাথলিক সম্প্রদায় পূর্ববঙ্গে আসে। আগস্টিয়ান সম্প্রদায়ের উদ্যোগে নাগরিতে ১৬৯৫ সালে এবং তেজগাঁওয়ে ১৬৭৭ সালে চার্চ স্থাপিত হয়। ক্রমেই ক্যাথলিক সম্প্রদায়ের পরিধি বাড়তে থাকে। এর ফলে ১৮৫২ খ্রিষ্টাব্দে পূর্ববাংলা ও পশ্চিমবাংলার ধর্মপ্রদেশ আলাদ হয়ে করা হয়। ১৮৮৬ খ্রিষ্টাব্দে ১ সেপ্টেম্বর ঢাকা ধর্মপ্রদেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। সেই সময় ঢাকা ধর্ম প্রদেশের অধীনে ছিল চট্টগ্রাম (বর্তমান চট্টগ্রাম মহাধর্ম প্রদেশ), শিলচর (আসাম, ভারত) ও প্রমি (মায়ানমার)। ১৯২৭ সালে ঢাকা আর্চ ডায়োসিস থেকে চট্টগ্রামকে আলাদা করা হয়। ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত ঢাকা ধর্ম প্রদেশ কলকাতা মহাধর্ম প্রদেশের অধীনে ছিল। দেশ ভাগের পর ঢাকা ধর্ম প্রদেশ স্বতন্ত্র একটি সহধর্ম প্রদেশের মর্যাদা লাভ করে। বর্তমান মানিকগঞ্জ, ঢাকা, মুন্সীগঞ্জ, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও কুমিল্লা ঢাকা মহাধর্ম প্রদেশের অধীনে। এই ধর্ম প্রদেশের বর্তমান আর্চ বিশপ হলেন—কার্ডিনাল পেট্রিক ডি রোজারিও (সিএসসি), অক্সিলারি বিশপ হলেন—রেভা. শরৎ ফ্রান্সিস গমেজ, এমিরিটাস অক্সলারি বিশপ হলেন—রেভা. থিওটনিয়াস গমেজ (সিএসসি)। তাদের অধীনে প্রশাসনিক সকল কাজ সম্পন্ন হয়।
আর্চ ডায়োসিসের অধীনে প্রায় ১৫টি কমিশন রয়েছে। যারা বিভিন্ন ভিন্ন বিষয়ের সমস্যা সমাধানে নিযুক্ত থাকে। যেমন ক্যাথলিক্যাল ও বিবলিক্যাল কমিশন, জাসটিস অ্যান্ড পিস কমিশন, হেলথ কমিশন, ফেমিলি কমিশন, অ্যাডুকেশন কমিশন, ইয়ুথ কমিশন, ল্যান্ডম্যাটার কমিশন ইত্যাদি। এ সব কমিটির রয়েছে নির্ধারিত কনভেনর ও সেক্রেটারি। প্রায় ২৪টি চার্চ ও ১০টি সাব-সেন্টারের তদারকি করে ঢাকা মহাধর্ম প্রদেশ। রয়েছে বিভিন্ন ধরনের ধর্মীয় সোসাইটি বা সন্ন্যাসী সম্প্রদায়। যেমন—সিএসসি, ওএমআই বা অবলেট ফাদার, এমএম বা ম্যারিকনল ফাদার, পিমে বা পিমে মিশনারিজ সম্প্রদায় জেভিরিয়ান সম্প্রদায় বা এসএক্স, এসজে সম্প্রদায় বা জেসুইট ফাদারস, টিও আর সম্প্রদায় , সিএইচ, সি বা হলিক্রস ব্রাদার্স সম্প্রদায় , আরএনডিএম সিস্টারস সম্প্রদায় , হলিক্রস সিস্টারস সম্প্রদায় , মিশনারি অব চ্যারেটি, মারিয়া বামবিনা সিস্টারস, পিমে সিসটারস, এমএম সিসটারস, এসএমআরএ সিসটারস, ইত্যাদি। এসব সন্ন্যাসী সম্প্রদায়ের মাধ্যমেই সমাজসেবার নানা রকম প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হয়। এই মহাধর্ম প্রদেশের অধীনে ১২টি লোয়ার প্রাইমারি, ৩২টি প্রাইমারি, ৬টি জুনিয়ার হাইস্কুল, ১৮টি হাইস্কুল, ৮টি কলেজ, ১টি ইউনিভার্সিটি ৩টি ভোকেশনাল ও টেকনিক্যাল স্কুল, ৩টি অরফানেজ, ১৮টি হোস্টেল ও ১৩টি হেলথ সেন্টার রয়েছে। বর্তমানে প্রায় ৭৮ হাজার ৮১৪ জন ক্যাথলিক রয়েছেন এই আর্চ ডায়োসিসের অধীন।
১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকা আর্চ ডায়োসিসের অধীনে ছিল গাজীপুর, নরসিংদী, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লা মুন্সীগঞ্জ মানিকগঞ্জ, ময়মনসিংহ, শেরপুর, জামালপুর, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ ও টাঙ্গাইল। আর্চ ডায়োসিসের সর্বময় কর্তা হলেন তখন আর্চ বিশপ টি.এ গাঙ্গুলী, যিনি অমল গাঙ্গুলী নামেই পরিচিত। তিনি ১৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকা আর্চ ডায়োসিসের বিশপ নিযুক্ত হন। একজন বাঙালি বিশপ হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে তার নৈতিক সমর্থন ছিল।
যিশুখ্রিস্টের অমোঘ বাণী—যা রাষ্ট্রের, তা রাষ্ট্রকে দাও; যা ঈশ্বরের, তা ঈশ্বরকে দাও। বাক্যের প্রতি বিশপ ফাদাররা অবিচল আস্থা ও বিশ্বাস রাখেন। যেকোনো ভাবেই রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িত হওয়াকে সমর্থন করেন না তারা। ফলে ১৯৭১-এর পরিস্থিতি অনেক ফাদার বিশপকে এক ধরনের সংকটের মধ্যে ফেলে দিয়েছিল। রাষ্ট্র বলতে পাকিস্তান কিন্তু সেই রাষ্ট্রটি একটি বৃহত্তর জাতির সঙ্গে ষড়যন্ত্র করছে, তাদের অধিকার হরণ করছে। টি.এ গাঙ্গুলী এই ষড়যন্ত্র, বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে সোচ্চার হতে পারেননি। কিন্তু তিনি সব ধর্মপল্লীর ফাদারকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে তার নীতিগত অবস্থানকে পরিষ্কারভবে অবগত করেন। তিনি তাদের অনুমোতি দেন সাধ্যমতো সকল বাঙালি এবং বিশেষ করে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করতে। তার নৈতিক সমর্থনের জন্যই ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে বিভিন্ন অঞ্চলের পেরিস বা মিশনগুলো বাড়িয়ে দিয়েছিল সাহায্যের হাত। ফাদার ইভান্স ফাদার, হোমরিক, ফাদার টমাস জিমার ম্যান প্রমুখ তাদের ৭১-এর ভূমিকার জন্য এখনও উজ্জ্বল নক্ষত্র হিসেবে বাংলাদেশের খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ে বিবেচিত হন। আর্চ বিশপ থিওটনিয়াস আমল গাঙ্গুলীর এই সমর্থনের জন্য বুদ্ধিজীবী হত্যার তালিকায়ও তার নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল বলে জানা যায়।
‘নাগরী মিশন সেন্ট নিকোলাস অফ টলেনটিনো চার্চ’ নামে পরিচিত এই মিশনটি স্থাপিত হয় ১৬৯৫ খ্রিষ্টাব্দে। মিশনটি গাজীপুর জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার নাগরী গ্রামে অবস্থিত। এই মিশনেই প্রথম রচিত হয় পর্তুগিজ-বাংলা অভিধান। বর্তমানে এই মিশনের অধীনে ৮ হাজার ২ শত ক্যাথলিক সদস্য রয়েছেন। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে নাগরী মিশনের দায়িত্বে ছিলেন ফাদার গ্রেডার (সিএসসি)। এপ্রিলের শুরুতেই ভীতসন্ত্রস্ত শরণার্থীরা এসে তার কাছে সাহায্য চাইলে ফাদার তাদের জন্য খুলে দেন চার্চ সংলগ্ন স্কুলঘর ও চার্চের দরজা তাদের জন্য উন্মুক্ত হয়। হাজার হাজার শরণার্থী এসে চার্চে আশ্রয় নেওয়া শুরু করে। তাদের চিকিৎসা ও খাদ্যের ব্যবস্থা করেন ফাদার। শরণার্থীদের জন্য প্রায় ৯ মাসই নাগরী মিশনের লঙ্গরখানা খোলা ছিলো। যুদ্ধের পরেও মুক্তিযোদ্ধারা মিশনে ক্যাম্প করেছিলেন মানুষের সেবার জন্য। একবার পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী মিশনে এলে, ফাদার গ্রেডারভ পরিষ্কারভাবে বললেন, ‘আমার এখানে কোনো মুক্তি নেই। কোনো হিন্দু নেই। এখানে আর যেন আসা না হয়।’ ফাদারের নিজের তখন বন্দুক ছিল। তিনি নিজেই পাহারা দিতেন, খবর রাখতেন সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে। যোগাযোগ রাখতেন রাঙামাটি মিশন তুমিলিয়া মিশন ও মঠবাড়ি মিশনের সঙ্গে। তার তত্ত্বাবধানে পাজোরা সিস্টারস হাউজের স্পিনে সারিতে মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা সেবা দেওয়া হতো। কখনো কখনো রাতের আঁধারে সিস্টার মুক্তিযোদ্ধার বাড়ি গিয়ে চিকিৎসা-সেবা দিয়েছেন। ফাদার গ্রেডারের সাহসী ভূমিকার জন্য নাগরী অঞ্চল ছিল সম্পূর্ণ নিরাপদ। প্রায় দশ হাজার শরণার্থীকে তিনি আশ্রয়, খাবার ও চিকিৎসা দিয়েছিলেন। সুবিধামতো সময়ে শরণার্থীদের নিরাপদ আশ্রয় যেতেও সাহায্য করেছিলেন। ফাদারের নৈতিক সমর্থন ছিল বলেই এলাকার অবস্থাপন্ন খ্রিষ্টান পরিবারগুলোও শরণার্থীদের আশ্রয় দিতে এগিয়ে এসেছে।
রাঙামাটিয়া মিশন
মিশনটির মূলনাম স্যাকরেড হার্ট চার্চ ১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। বর্তমানে এই মিশনে ৫ হাজার ১১১ জন ক্যাথলিক সদস্য রয়েছেন। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে এই চার্চের দায়িত্বে ছিলেন ফাদার। মিশনটি গাজীপুর জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার রাঙামাটিয়া গ্রামে অবস্থিত। বাড়িয়া গ্রামে পাকিস্তানি হানাদাররা নৃশংস হত্যাযজ্ঞ চালালে হাজার হাজার অসহায় মানুষ বিল পার হয়ে রাঙামাটিয়া মিশনে আশ্রয় নেয়। মিশনে ধারণক্ষমতা কম থাকায়, ফাদার তাদের তাৎক্ষণিক সেবা দিয়ে পাঠিয়ে দিতে থাকেন নাগরি মিশনে। এছাড়া রাঙামাটিয়া গ্রামটিও ছিল বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। ২৬ নভেম্বর রাঙামাটিয়া গ্রামেও হত্যাযজ্ঞ চালায়। আগুন দিয়ে বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয় হানাদার বাহিনী। তবু সাধ্যমতো সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল ফাদার।
তুমিলিয়া মিশন
সেন্ট জন দ্য ক্যাপিস্ট চার্চটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৪৪ খ্রিষ্টাব্দে। বর্তমানে এই চার্চে ৪২ হাজার ৭৯৩ জন ক্যাথলিক সদস্য রয়েছেন। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে বিচ্ছিন্নভাবে কিছু পরিবার এখানে আশ্রয় নিয়ে ছিল। চার্চটির পাশেই ছিল রেললাইন ও আরিখোলা স্টেশন। চার্চটির কাছে খালের পাশেই ছিল হানাদারদের বাংকার। ফাদার-সিস্টাররাই ছিলেন সবসময় ভীত-সন্ত্রস্ত। এমতাবস্থায় তুমিলিয়া মিশনে আশ্রয় ক্যাম্প করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু ফাদার সিস্টারদের নৈতিক সমর্থন ছিল। মিশনটি গাজীপুরের কালীগঞ্জ জেলার তুমিলিয়া গ্রামে অবস্থিত।
ধরেন্ডা মিশন
সাভার উপজেলার ধরেন্ডা গ্রামের এই চার্চটি সেন্ট যোসেফ চার্চ নামে পরিচিত। ১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দে চার্চটি প্রতিষ্ঠিত হয়। ধরেন্ডা মিশনে বর্তমানে ৬ হাজার ক্যাথলিক সদস্য। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে মিশনের দায়িত্বে ছিলেন লিউ.জে.সালিভেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ ঢাকায় গণহত্যা হলে হাজার হাজার মানুষ ঢাকা ছেড়ে পালাচ্ছিল। সেই সময় ফাদার হিন্দু মুসলিম প্রায় ৫শ জনকে খাদ্য ও চিকিৎসা সেবা দিয়ে ছিলেন। তার নৈতিক সমর্থনের কারণে এলাকার অবস্থাপন্ন খ্রিষ্টান পরিবারগুলোও শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়েছে।
নবাবগঞ্জ বক্সনগর মিশন
মিশনটির মূল নাম হলো সেন্ট আত্থান অব পাদুয়া চার্চ। ১৮৬১ খ্রিষ্টাব্দে মিশনটি প্রতিষ্ঠিত হয়। এই মিশনটি গোল্লা মিশনের অধীন একটি সাব-মিশন ছিল। বর্তমানে গোল্লা ও বক্সনগর মিশনে প্রায় ৩ হাজার ৪৩২ জন ক্যাথলিক সদস্য রয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধে গোল্লা মিশনের দায়িত্বে ছিলেন ফাদার উইলিয়াম ইভান্স সিএসসি।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ফাদার ইভাস উদ্বাস্তুদের সাহায্যের পাশাপাশি মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা ও নৈতিক সাহস দেন। নবাবগঞ্জ এলাকায় স্থাপিত গির্জাগুলো প্রধান সড়কসংলগ্ন হওয়ায় এই এলাকায় শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়া সম্ভব হয় নি। বক্সনগর গির্জাটির অবস্থান বিচ্ছিন্ন এলাকায়। ওই এলাকার মিশন স্কুলে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য গোপন আস্তানা তথা ক্যাম্প স্থাপন করার অনুমতি দেন ফাদার ইভান্স।
ওস্তাদ পিসি গমেজের ছেলে মুক্তিযোদ্ধা রিচার্ড মুকুল গমেজ বলেন, মূলত বক্সনগরের মিশন স্কুলে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প স্থাপন করার জন্যই তাকে হত্যা করা হয়।’ ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ১৩ নভেম্বর। ফাদার ইভান্স গোল্লা মিশন থেকে বক্সনগর যাচ্ছিলেন। তার সঙ্গে প্রবাসীদের কিছু টাকা ছিল। মূলত ওই অঞ্চলের করাচি প্রবাসীরা তাদের বাড়িতে মিশনের মাধ্যমে টাকা পাঠাতেন। ফাদার ইভান্সের কাছে বক্সনগরের কিছু পরিবারের টাকা ছিল। ফাদার ইভান্সকে মুক্তিযোদ্ধারা বারবার সতর্ক করেছিলেন বক্সনগর না যাওয়ার জন্য। কিন্তু তিনি যখন নাছোড়বান্দা, তখন তাকে কয়েকজন ঘুরপথে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করেছিলেন। কেননা তখন নবাবগঞ্জ পাইলট স্কুলে পাকিস্তানি হানাদারদের ঘাঁটি ছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের কথা শুনলেন না ফাদার। তিনি সোজা পথেই রওনা হলেন। যা হওয়ার তাই হলো। ক্যাম্পের সৈন্যরা তাকে নৌকা থামাতে বললো। নৌকা থেকে তাকে নামিয়ে ক্যাম্পের ভেতরে নিয়ে যায় তারা। বেশ কিছুক্ষণ পর তাকে ছেড়ে দেওয়া হয় কিন্তু ফেরার পথেই তাকে গুলি করে হানাদাররা। তার মৃত দেহ পড়ে যায় ইছামতিতে। পরদিন এক বেদে বহরের কাছে তার লাশ ভেসে ওঠে। বেদেরা তার লাশ তুলে রাখে। অবশেষে মুক্তিযোদ্ধা অ্যানগমেজসহ কয়েকজন লাশ নিয়ে আসেন গোল্লা মিশনে। সেখানেই তাকে সমাহিত করা হয়। এই কাজটি করা হয় অতি সতর্কতার সঙ্গে, যেন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বিষয়টি আঁচ করতে না পারে। নবাবগঞ্জে তার নামে একটি স্মৃতিফলক নির্মিত হয়েছে।
নটরডেম কলেজ
বিখ্যাত নটরডেম কলেজটি ঢাকা আর্চ ডায়োসিসের অধীনে পরিচালিত একটি প্রতিষ্ঠান। এটি ১৯৪৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৭১ সালে নটরডেম কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন ফাদার পিসাতো। মুক্তিযুদ্ধের সময় কলেজটির ছিল চূড়ান্ত সংকট কাল। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে নৈতিক সমর্থনের কারণে অধ্যক্ষের প্রতি বারবার হত্যার হুমকি আসে। ১৯৭১ সালে কলেজটি বন্ধ থাকলেও অধ্যক্ষের প্রতি এই হুমকি বারবার চলছিল। কারণ খবর ছিল এমন, কলেজটিতে মুক্তিযোদ্ধাদের গোপনে আশ্রয় দেওয়া হয়। শেষদিকে এই কলেজটি জাতিসংঘ ও রেডক্রস তাদের কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য বেছে নেয়। জাতিসংঘের ৪৪জন কর্মকর্তা-কর্মচারী এখানে থেকে তাদের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেছেন।
ময়মনসিংহ ডায়োসিস
বিশ শতকের শুরুতে ময়মনসিংহে খ্রিস্টধর্ম প্রসার লাভ করে। ১৯১২ খ্রিষ্টাব্দে ময়মনসিংহে প্রথম চার্চ স্থাপিত হয় ফাদার ফ্রান্সিস (সিএসসি)-এর উদ্যোগে। এর ২৫ বছরে মধ্যে ময়মনসিংহের বিভিন্ন স্থানে ৫টি মিশন প্রতিষ্ঠিত হয়।
১৯৭৮ সালে ঢাকা আর্চ ডায়োসিস থেকে বেরিয়ে এসে ময়মনসিংহ একটি স্বতন্ত্র ডায়োসিস হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। বর্তমানে ময়মনসিংহ ডায়োসিসের অধীনে রয়েছে জামালপুর, শেরপুর, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইল জেলা। ১৯৭১ সালে ময়মনসিংহ ডায়োসিস ছিল ঢাকা আর্চ ডায়োসিসের অধীনে। ময়মনসিংহ ডায়োসিসের বর্তমান বিশাপ হলেন রেভা পোনিন পল কুরি (সিএসসি)। তার অধীনেই ডায়োসিসের প্রশাসনিক সব কাজ সম্পন্ন হয়। ক্যাথলিক্যাল ও বিবলিক্যাল কমিশন, জাসটিস অ্যান্ড পিস কমিশন, হেলথ কমিশন, ফেমিলি ওয়েল ফেয়ার কমিশন, অ্যাডুকেশন কমিশন, লেইট কমিশন, ইয়ুাথ অ্যান্ড হলি চাইল্ড হুড কমিশনসহ ১২টি কমিশনের চেয়ারম্যান বিশপ।
প্রায় ১৬টি মিশন, ৪টি সাব-মিশন তদারকি করে ময়মনসিংহ ডায়োসিস। রয়েছে বিভিন্ন ধরনের ধরনের ধর্মীয় সোসাইটির সন্ন্যাসী সম্প্রদায়, যেমন—সিএসসি বা হলিক্রস ফাদার্স, এমএম; এসএক্স বা জেভিরিয়ান সম্প্রদায়, এসডিবি বা ডন বসকো, সিএসসি হলিক্রস ব্রাদার্স, সিএসসি বা হলিক্রস সিসটারস, পিসিপিএ, মিশনারি অব চ্যারিটি, আরএন ডিএম বা আরএন ডিএম সিস্টারস প্রভৃতি। এসব সন্ন্যাসী সম্প্রদায়ের মাধ্যমেই সমাজসেবার বিভিন্ন কাজ সম্পন্ন হয়। এই ডায়োসিসের মাধ্যমে ১৪৭টি প্রাইমারি স্কুল, ৪টি জুনিয়র হাইস্কুল, ৯টি হাইস্কুল, একটি কলেজ ৪টি ভোকেশনাল টেকনিক্যাল স্কুল, ১০টি হেলথ সেন্টার ও ক্লিনিক ৩০টি হোস্টেল ও কনভেন্ট ও একটি অরফানেজ পরিচালিত হয়। বর্তমানে প্রায় ৮১ হাজার ৪ শত ৬৭ জন ক্যাথলিক রয়েছেন এই ডায়োসিসের অধীন। ১৯৭১ সালে ময়মনসিংহ ডায়োসিস ঢাকা আর্চ ডায়োসিসের অধীনে ছিল। আর্চ মিশপ থিওটনিয়াস অমল গাঙ্গুলী নৈতিকভাবে মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করার কারণে ময়মনসিংহ অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত সব মিশনে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ ভূমিকা রেখেছে।
জলছত্র মিশন
মিশনটির মূল নাম কর্পাস খ্রিষ্ট চার্চ। বর্তমানে এই মিশনে ৫ হাজার ৫৫৪ জন ক্যাথলিক সদস্য রয়েছেন। ১৯৭১ সালে এই চার্চের দায়িত্বে ছিলেন মার্কিন নাগরিক ফাদার ইউজিন-ই-হোমরিক। তিনি মধুপুর অঞ্চলে ধর্মপ্রচার ও কুষ্ঠ হাসপাতাল পরিচালনার দায়িত্ব পালন করছিলেন। এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন ফাদার রোনাল্ড। জলছত্র মিশনে তারা হাজারের বেশি শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়েছিলেন। এই সব শরণার্থীর দেখাশোনা খাওয়া-দাওয়া চিকিৎসা ইত্যাদি ফাদার হোমরিক নিজেই করতেন। এই সময় ফাদার ট্রিপির অধীনেও ইদিলপুর গ্রামে হাজার খানেক শরণার্থী আশ্রয় গ্রহণ করে। সেখানে তারা ছয়মাস অবস্থান করে। একবার জলছত্র মিশনের কাছে কয়েকটি গ্রামের দেড় শতাধিক লোককে লাইন করে দাঁড় করানো হয়। খবর পেয়ে ফাদার হোমরিক ছুটে যান সেখানে। পাকিস্তানি হানাদারদের সামনে গিয়ে দাঁড়ান। বলেন, ‘ওদের গুলি করার আগে আমাকে গুলি করো।’ অনেক বাকবিতণ্ডার পর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তাদের সবাইকেই ছেড়ে দেয়। একবার বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি সৈন্যরা জয়দেবপুর থেকে ময়মনসিংহ যাওয়ার পথে মেজর সফিউল্লাহর নেতৃত্বে বেশ কয়েকজন অফিসার কয়েকদিন জলছত্র মিশনে অবস্থান করেন। এদিকে, যশোরের ফাদার মারিওকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী গুলি করে হত্যা করলে মার্কিন দূতাবাস ১২ এপ্রিল দুজন কর্মকর্তা জর্জ মলিতা ও বার কলিথকে ফাদার হোমরিকের কাছে পাঠান। তারা ফাদার হোমরিককে ঢাকায় নিরাপদ স্থানে চলে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। কিন্তু ফাদার হোমরিক জলছত্রের নিরীহ মানুষকে বিপদের মধ্যে ফেলে রেখে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যেতে রাজি হননি। ১৮ এপ্রিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী মধুপুর অঞ্চল দখল করে নিলে শুরু হয় নির্যাতন-লুটপাট-হত্যা-ধর্ষণ। প্রায় ২০ হাজার মানুষ নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে ছুটে আসে মধুপুর বনাঞ্চলে। ওই সময় মধুপুরের চেয়ারম্যান অমূল্য নিয়োগীসহ অনেকেই লুকিয়ে ছিলেন জলছত্র মিশনে। ফাদার সব শরণার্থীকে ধর্মপল্লীর গারো আদিবাসীদের বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা করে দেন। যুদ্ধের সময় ফাদার হোমরিক ময়মনসিংহ থেকে ওষুধ ও চিকিৎসা সামগ্রী এনে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে নির্যাতিতদের জলছত্র কুষ্ঠ হাসপাতালে গোপনে চিকিৎসা সেবা দিতে থাকেন। এই সময়ে সিস্টার সিসিলিয়া ও সিস্টার দস্তা হাসপাতালের সার্বক্ষণিক সেবা কাজে নিয়োজিত ছিলেন। এ সব কাজের জন্য ২৪ জুলাই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তাকে গ্রেপ্তার করে সেনাক্যাম্পে নিয়ে যায়। মার্কিন নাগরিক হওয়ার কারণে তারা ফাদার হোমরিককে মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা না করার নির্দেশ দিয়ে ছেড়ে দেয়। আগস্ট মাসের মাঝামাঝি মুক্তাগাছায় রাজাকারদের সহায়তায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী মাইকোনা গ্রামে নির্বিচারে গুলি চালায়। সেই সময় ফাদার হোমরিক আহতদের চিকিৎসাসেবা দিয়ে সুস্থ করে তোলেন। ফাদার হোমরিকের নৈতিক সমর্থনের কারণেই টাঙ্গাইলের অনেক খ্রিষ্টান যুবক যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। ১১ ডিসেম্বর মধুপুর হানাদার মুক্তহলে মধুপুরবাসীরা স্বাধীন দেশের পতাকা নিয়ে বের হয়ে আসে। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদান রাখার জন্য এফ জে সেক্টরের পক্ষ থেকে ফাদার হোমরিককে মুক্তিযোদ্ধা সনদ প্রদান করা হয়। উল্লেখ্য, ফাদার হোমরিক হচ্ছেন একমাত্র ফাদার যিনি মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির পক্ষে বন্ধুক হাতে যুদ্ধ করেছেন।
দিনাজপুর ডায়োসিস
১৭ শতকেই দিনাজপুর ডায়োসিসে এসসিএম সম্প্রদায় যুক্ত হয়। ১৮৫৫ খ্রিষ্টাব্দে পিমে মিশনারিরা কৃষ্ণনগর এলাকায় আসতে শুরু করেন। ১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দে পুরো উত্তরবঙ্গ নিয়ে দিনাজপুর ডায়োসিস প্রতিষ্ঠিত হয়। দেশ ভাগের পর ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে ভারতের দুমকা রায়গঞ্জ এবং জলপাইগুড়ির কিছু অংশ দিনাজপুর ডায়োসিস থেকে আলাদা হয়ে যায়। ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দে পাবনা জেলা দিনাজপুর ডায়োসিসের অন্তর্ভুক্ত হয়।
বর্তমানে দিনাজপুর ডায়োসিসের অধীনে রয়েছে দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়, রংপুর, নীলফামারী, কুড়িগ্রাম, লালমনির হাট, গাইবন্ধা ও জয়পুরহাটের পাঁচবিবি উপজেলা।
১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে সমগ্র নর্থ বেঙ্গল দিনাজপুর ডায়োসিসের অধীন ছিল। বর্তমানে দিনাজপুর ডায়োসিসের বিশপ হলেন রেভা সেবাস্টিয়ান টুডু। তার অধীনেই ডায়োসিসের প্রশাসনিক সব কাজ সম্পন্ন হয়। ক্যাথলিক্যাল ও বিবলিক্যাল কমিশন, জাসটিস অ্যান্ড পিস কমিশন, হেলথ কমিশন, ফ্যামিলি ওয়েল ফেয়ার কমিশন, অ্যাডুকেশন কমিশন, লেইটি কমিশন, ইয়ুথ অ্যান্ড হলি চাইল্ডহুড কমিশন ১৪টি কমিশন/কমিটির চেয়ারম্যান হলেন বিশপ। প্রায় ১৮টি মিশন, ৭টি সাব-মিশন তদারকি করে দিনাজপুর আর্চ ডায়োসিস। রয়েছে বিভিন্ন ধরনের ধর্মীয় সোসাইটির সন্ন্যাসী সম্প্রদায়, যেমন—সিএসসি বা হলিক্রস ফাদার্স; এমএমএস এক্স বা জেভিরিয়ান সম্প্রদায়; এসডিবি, সিএসসি বা হলিক্রস ব্রাদার্স, সিএসসি বা হলিক্রস সিস্টার; পিসিপিএ বা মনস্ট্রি সিস্টার্স; মিশনারি অব চ্যারিটি; আরএনডিএম বা আর এনডিএম সিস্টারস; এসসি সম্প্রদায় ; এসএসআই সম্প্রদায় ; এসএমআর সম্প্রদায় প্রভৃতি। এসব সন্ন্যাসী সম্প্রদায়ের মাধ্যমেই সমাজ এ অঞ্চলের সমাজসেবার বিভিন্ন কাজ সম্পন্ন হয়। এই ডায়োসিসের মাধ্যমে ২৮টি প্রাইমারি স্কুল; ৬টি জুনিয়র হাইস্কুল, দুইটি ভোকেশনাল/ট্রেড স্কুল, দুইটি হাইস্কুল, একটি কলেজ, ২১টি অরফানেজ বোর্ডিং, ১টি হসপিটাল, ৯টি হেলথ সেন্টার ও ডিসপেনসারি পরিচালিত হয়। বর্তমানে এই ডায়োসিসের অধীনে প্রায় ৫৯ হাজার ৮৫২ জন ক্যাথলিক রয়েছেন।
১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকা আর্চ ডায়োসিসের আর্চ বিশপ থিওটনিয়াস অমলগাঙ্গুলী নৈতিকভাবে মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করার কারণে সব ডায়োসিস ও মিশনগুলায় মুক্তিযুদ্ধর পক্ষে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ ভূমিকা পালন করেছে।
রুহিয়া মিশন
মিশনটি মূল নাম হলো—ফাতেমা রানি চার্চ। মিশনটি ১৯৫৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। বর্তমানে এই মিশনে ৭ হাজার ৪৩৬ জন ক্যাথলিক সদস্য রয়েছেন। ১৯৭১ সালে এই চার্চের দায়িত্বে ছিলে পাদার লুকাশ মারাত্তী। মিশনটিতে শরণার্থীরা আশ্রয় নেননি, কারণ তা ছিল বর্ডারের কাছেই। ফাদার এলাকার যুবকদের যুদ্ধে যাওয়ার জন্য অনুপ্রাণিত করতেন এবং যুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্নভাবে সাহায্য করতেন। তিনি ভারত থেকে ওষুধ সংগ্রহ করে ডিসপেনসারিতে রাখতেন এবং আহতদের সেবা দিতেন। এই খবর রাজাকাররা-পাকিস্তানি হানাদারদের জানালে পাকহানাদার বাহিনী রুহিয়া মিশনে এসে তাকে গুলি করে হত্যা করে।
মারিয়ামপুর মিশন
এই মিশনটির মূল নাম আওয়ার লেডি অব সরোস চার্চ। এটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৩০ সালে। বর্তমানে এই মিশনে ৭ হাজার ১৯৪ জন ক্যাথলিক সদস্য রয়েছেন। ১৯৭১ সালে এই চার্চের দায়িত্বে ছিলেন ইতালিয়ান ফাদার কার্ল মিনা পাচে। যুদ্ধপরিস্থিতির ভয়াবহতা লক্ষ করে তিনি ঘোড়াঘাটবাসীকে ডাকেন। তিনি তাদের বলেন, ‘আপনারা খ্রিষ্টান হউন বা না হউন, আপনারা সবাই ক্রশ ব্যবহার করুন এবং নিজেকে খ্রিষ্টান বলে পরিচয় দিন।’ এরপর তিনি সবার মধ্যে কাঠের ক্রশ বিতরণ করেন। এ ছাড়া তিনি মারিয়মপুর চার্চে শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়েছিলেন। বিনামূল্যে তাদের খাদ্য ও ওষুধ সরবরাহ করেছিলেন।
রাজশাহী ডায়োসিস
রাজশাহী ডায়োসিস ১৯৯০ সালে বৃহত্তর দিনাজপুর ডায়োসিস ভেঙে রাজশাহী ডায়োসিসের জন্ম। বর্তমানে রাজশাহী ডায়োসিসের অধীনে রয়েছে রাজশাহী, নাটোর পাবনা, সিরাজগঞ্জ বগুড়া, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ ও পাঁচবিবি বাদে সম্পূর্ণ জয়পুরহাট। রাজশাহী ডায়োসিসের বর্তমান বিশপ হলেন—রেভা গেরভাস রোজারিও। তার অধীনেই ডায়োসিসের যাবতীয় প্রশাসনিক কাজ পরিচালিত হয়। ক্যাথলিক্যাল ও বিবলিক্যাল কমিশন, জাসস্টিস অ্যান্ড পিস কমিশন, হেলথ কমিশন, ফ্যামিলি ওয়েলফেয়ার কশিন, অ্যাডুকেশন কমিশন, লেইটি কমিশন, ইয়ুথ অ্যান্ড হলি চাইল্ডহুড কমিশনসহ ১৯টি কমিশন সেন্টার-এর চেয়ারম্যান হলে বিশপ। প্রায় ২৩টি মিশন বা প্যারিস, ৫টি সাব-মিশন বা প্যারিস তদারকি করে রাজশাহী ডায়োসিস। রয়েছে বিভিন্ন ধরনের ধর্মীয় সোসাইটি সন্ন্যাসী সম্প্রদায়।
বোর্নি মিশন
মিশনটির মূল নাম Moria Virgo Ptens Church. মিশনটি ১৯৪৯ সালে স্থাপিত হয়। বর্তমানে এই মিশনে ৪ হাজার ৮৬১ জন ক্যাথলিক সদস্য রয়েছেন। ১৯৭১ সালে এই মিশনের দায়িত্বে ছিলেন ফাদার কান্তন পিথে। মুক্তিযুদ্ধের কঠিন পরিস্থিতিতে তিনি সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়ান। যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের গোপনে আশ্রয় ও চিকিৎসা দেন। প্রায় ২৫০ হিন্দু পরিবারকে গোপনে আশ্রয় খাদ্য ও নিরাপত্তা দেন। তার বলিষ্ঠ ভূমিকার কারণে সমগ্র জোনাইল এলাকা ছিল মুক্তাঞ্চল।
বনপাড়া মিশন
মিশনটির মূল নাম—আওয়ার লেডি অব লর্ডস। ১৯৪০ সালে মিশনটি প্রতিষ্ঠিত হয়। বর্তমানে এই মিশনে ৩ হাজার ৮৫০ জন ক্যাথলিক সদস্য রয়েছেন।
১৯৭১ সালে বনপাড়া মিশনের দায়িত্বে ছিলেন ফাদার পিনোস (পিমে) ও ফাদার গেরেল্লো (পিমে)। যুদ্ধের সময় মে মাসে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গাড়ি এসে থামে বনপাড়া মিশন গেটে। মেজর শেরওয়ানি আর তার সহযোগীরা মিশন অফিস স্কুলঘর, মহিলা হোস্টেল তল্লাশি করে। তারা সেখানে আশ্রিত সব যুবককে বাইরের মাঠে এনে দাঁড় করায়। ফাদার পিনোস বারবার বাধা দেন। কিন্তু কোনো লাভ হয় না। ওইদিন ঘটনা স্থলে দিনাজপুর ধর্ম প্রদেশের বিশপ মাইকেল রোজারিও ছিলেন। তিনিও তাদের কাছে অনুরোধ করেন। কারও অনুরোধই শোনেনি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। ওইদিন তারা প্রায় একশজনকে ধরে নিয়ে যায়। জুন মাসের শেষদিকে বনপাড়া এলাকা থেকে প্রায় চলিশজনকে ধরে নিয়ে যায় ঈশ্বরদী ক্যাম্পে। তাদের স্বজনরা ছুটে আসে ফাদার পিনোসের কাছে। ফাদার পিনোস ছুটে যান ক্যাম্পে। তার অসম্ভব বুদ্ধিমত্তা ও সাহসের কারণে সেদিন চলিশজন মানুষের প্রাণ বেঁচে যায়।
আন্ধারকোঠা মিশন
১৯০৭ সালে এই মিশনটি রাজশাহীতে স্থাপিত হয়। বর্তমানে এই মিশনে ৩ হাজার ৬৪৫ জন ক্যাথলিক সদস্য রয়েছেন। ১৯৭১ সালে আন্ধারকোঠা মিশনের দায়িত্বে ছিলেন ইতালিয়ান ফাদার জেকো মিলি। তার রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ বারবার তাকে নিরাপদ আশ্রয় ফিরে যাওয়ার জন্য তাগাদা দিলেও তিনি তা শোনেননি। তিনি গোপনে মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করতে থাকেন। গ্রামবাসীদের নগদ অর্থ দিয়ে সাহায্য করেছেন, যেন তারা পানির দামে ধান বিক্রি করে দেশত্যাগ করতে না চায়। তিনি গ্রামবাসীদের দেশত্যাগ করতে নিরুৎসাহিত করেন। তার মিশনটি ছিল রাজশাহী চাঁপাইনবাবগঞ্জ মহাসড়ক সংলগ্ন। ফলে সেখানে শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়া ছিল ঝুঁকিপূর্ণ। তিনি নিজে কখনো বাইসাইকেলে, কখনো মোটরসাইকেলে চেপে গ্রামের মানুষের খোঁজ-খবর নিতে থাকেন। একবার পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তার চলার পথ আগলে তাকে জেরা করতে শুরু করে। তিনি স্বাভাবিক উত্তর দেন। এরপর তারা তাকে সতর্ক করে দিয়ে যাওয়ার সময় তার মুখে চড় মারে। এতে ফাদার হতভম্ব হয়ে যান। কিন্তু কিছুক্ষণ পরই তিনি তা ভুলে যান। আগস্ট মাসে হানাদার বাহিনী মেজর আব্দুল্লাহর নেতৃত্বে মিশন এলাকা থেকে প্রায় ১৫/২০ জনকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। খবর পেয়ে ফাদার জেকোমিলি ছুটে যান। তার মধ্যস্থতায় তারা প্রাণে বেঁচে যায়।
‘মুক্তিযুদ্ধে খ্রিষ্টান সম্প্রদায়’
নির্মল রোজারিও ও রঞ্জনা বিশ্বাস
উৎসর্গ: জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
প্রকাশকাল: ডিসেম্বর/২০১৮
প্রচ্ছদ: আবুল ফাতাহ।
প্রকাশক : রোদেলা প্রকাশনী।
মূল্য: ৫০০ টাকা।