[পর্ব-৯]
সকালটা ফাঁকা হয়ে যায়। রুমকীকে কোচিংয়ে দিয়ে রতনকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যায় দীপন। রান্না সচরাচর ময়না-ই করে। ছুটির দিনে তুলি করে দুই-চার পদ। আজ ইচ্ছে করে না। কেমন জ্বর জ্বর লাগে। বিছানায় শুয়ে থাকে কিছুক্ষণ। চা খায়। দুয়েকটা ম্যাগাজিনের পাতা উল্টায়। ভালো লাগে না। দীপনের পড়ার নেশা। তার বুকশেলফে হরেক রকম বই সাজান। দুষ্প্রাপ্য অনেক বইও মেলে তার কাছে। তুলির পড়ার নেশা তেমন নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি ডিঙিয়ে সে চাকরির প্রস্তুতি বাবদ পড়েছে শেষবার। চাকরিটা মিলে যেতেই তারও পড়ায় ইতি। এ নিয়ে দীপন তাকে ঠাট্টা করতে ছাড়ে না। দীপন সেই অর্থে পড়ুয়া ছিল না। ক্লাসের পড়ায় তার মন ছিল না কোনোকালে। সে পড়ত তার ইচ্ছেমাফিক। বিচিত্র সব বিষয়ে আগ্রহ তার। শিল্প, সাহিত্য থেকে শুরু করে রান্নাবান্নার বইও আগ্রহ নিয়ে পড়ে দীপন। রতন ছিল তার উল্টো। একাডেমিক পড়াশুনায় মারাত্মক সিরিয়াস ছিল রতন, শুনেছে তুলি। সেই সঙ্গে অন্যান্য বিষয়েও প্রচুর পড়াশোনা ছিল তার। দীপন বলে, ভাইয়ার কাছে আমি হলাম গণ্ডমূর্খ, বুঝেছ?
মাঝে মাঝে দীপনের বই পড়া নিয়ে বাড়াবাড়িতে বিরক্ত হয় তুলি। এমন অদ্ভুত সব বিষয়ের বই জোগাড় করে আনে দীপন হঠাৎ হঠাৎ! একবার সে আনলো ভারতীয় উপমহাদেশের ডাকিনী বিদ্যার ওপর কী এক অদ্ভুত বই! অবাক হয়ে তুলি বললো, এ বই দিয়ে তুমি করবে কী?
আরও পড়ুন: ঝিঁঝিলাগা দিনগুলো-৫॥ শিল্পী নাজনীন
ডাকিনী বশ করব! বইতে মুখ গুঁজে গম্ভীরভাবে উত্তর দিল দীপন।
—মানে?
–মানে বুঝলে না? সারাজীবন তো এক আস্ত ডাকিনী নিয়ে কাটাতে হবে! তাকে বশ করার বিদ্যেটা শিখতে চাই এবার!
তুলি হাসবে না কাঁদবে ভেবে পেলো না। দৌড়ে গিয়ে দীপনের পিঠে দুম করে এক কিল দিয়ে বললো, আমি ডাকিনী?
একটু সন্দেহ অবশ্য ছিল! কিন্তু কিলটা পিঠে পড়ার পর সেটুকুও নেই আর! তুমি হলে মহাডাকিনী! রাইবাঘিনী! পিঠ ডলতে ডলতে দীপনের জবাব।
আরেকবার সে পড়লো রান্নার বই নিয়ে। অদ্ভুত সব রান্না করে বই দেখে দেখে। অতিষ্ঠ হয়ে তুলি বললো, এসব বন্ধ করবে তুমি? নইলে বাসা ছেড়ে চলে যাব এবার!
—চলেই যাবে? রান্না করে খাওয়াচ্ছি বলে! সুখে থাকতে ভূতে কিলায় কি আর সাধে বলে!
—কে চাইছে অত সুখ? ছাইপাঁশ রাঁধো সব, মুখে তোলা যায় না। জিনিস নষ্ট, টাকা নষ্ট!
—আচ্ছা! আজ যা রেঁধেছি একবার চেখে দেখো! তারপর বলো, কেমন রেঁধেছি!
আরও পড়ুন: ঝিঁঝিলাগা দিনগুলো-৪॥ শিল্পী নাজনীন
চোখকান বুঁজে একবার মুখে দিলো তুলি। আগ্রহে চকচকে চোখ নিয়ে তুলির দিকে তাকিয়ে ভুরু নাচিয়ে দীপন বললো, কী? বলো এবার! কেমন রেঁধেছি!
—গতানুগতিক হয়নি!
—মানে?
—বুঝে নাও!
বেজার মুখে একটু বসে থাকলো দীপন। তারপর ঘর কাঁপিয়ে হো হো হেসে বললো, ভালো বলেছ তো! গতানুগতিক হয়নি!
খুব একচোট হাসল দীপন, কথাটা নিজের মনেই আওড়ালো আরও ক’বার। তারপর বললো, নাহ্! রান্নাটা আসলে গতানুগতিক একটা ব্যাপার! ও আমাকে দিয়ে হবে না।
হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো তুলি। বললো, যাক, বুঝলে অবশেষে!
—না বুঝে উপায় কী! যেমন বিদ্যাধরী স্ত্রীরত্ন তুমি আমার! বাসা ছেড়েই যেতে চাইছ! এই বয়সে ও-সব আমার পোষাবে না! শেষ বয়সে বিধবা থুড়ি বিপত্নীক হতে চাই না। বলেই হেঁড়ে গলায় গান ধরল, তুমি মা কল্পতরু…
—থামবে তুমি? ধমকে উঠল তুলি।
—আহা! আস্তে ধমক দাও! বুকের মধ্যে কেমন ধড়ফড় করে ওঠে!
—আস্ত একটা শয়তান তুমি!
—অর্ধেক হলে কি খুশি হতে?
আরও পড়ুন: ঝিঁঝিলাগা দিনগুলো-৩॥ শিল্পী নাজনীন
দীপনের সঙ্গে কথায় পেরে ওঠে না তুলি কোনোদিন। বিরক্ত হয়ে সে উঠে পড়ে শেষে।
কী মনে করে দীপনের বুকশেলফে খুঁটে খুঁটে দেখে। বইগুলোতে ধুলো জমছে। ময়নাটা কী করে সারাদিন কে জানে! বকতে হবে তাকে। তুলি আনমনে দীপনের বইগুলোতে হাত বোলায়। ধুলো ঝাড়ে। বইগুলোর জন্য দীপনের অনেক মায়া। সব বই দীপনেরও নয়। রতনের অনেক বইও এখানে আছে। তুলি দীর্ঘশ্বাস ফেলে অজান্তেই। রতন! বেচারা! কেন যে জীবনটা এমন এলোমেলো হয়ে গেলো তার! সঙ্গে সঙ্গে আরও একটা মুখও চলকে ওঠে স্মৃতির জলে। মুখ নয়, কাঁটা। এ কাঁটা সে উপড়ে ফেলতে চায়, মুছে ফেলতে চায়। পারে না। ঠিক ফুটে থাকে হৃদপিণ্ডের মাঝখানটায়। হঠাৎ হঠাৎ টের পাওয়া যায়, টের পাওয়া যায় কাঁটার ক্ষত।
গাড়িতে দীপনের পাশে বসে চুপচাপ জানালা দিয়ে শহর দেখছিল রতন। এসি তার সহ্য হয় না। দীপন তাই এসি বন্ধ করে জানালা খুলে দিয়েছে। রুমকীকে কোচিংয়ে নামিয়ে তারা যাচ্ছে ডাক্তারের কাছে। রতনের চোখ দেখাতে হবে আজ। চশমা নিতে হবে, সম্ভবত। আজ ড্রাইভারের ছুটি। ড্রাইভিং সিটে রতন। মিরর ভিউ এ চোখ রেখে রতনের সাথে দুই-একটা কথা বলে দীপন। রতন সাড়া দেয় না তেমন। অন্যমনস্ক। মাঝে মাঝে রতনের কথায় চমকে হুঁ হ্যাঁ করে আবার সে ডুবে যায় নিজের ভাবনায়। দেখে চুপ করে যায় দীপন। রতন কিছু একটা ভাবে। গম্ভীর, থমথমে মুখ।
রতন ভিড় দেখছিল। শহরের ক্রমবর্ধমান চাকচিক্য দেখছিল। শহরটা কি বদলে যাচ্ছে দ্রুত? কতদিন পর বের হলো সে শহরে? সাত মাস? না-কি আট? ঠিক মনে নেই। তার অসুস্থতার কথা মনে থাকে না। একবার অসুস্থ হলে মেয়াদ সম্ভবত সাত-আট মাসই থাকে তার। দীপনকে প্রশ্ন করে উত্তরটা জেনে নেওয়া যায়। ইচ্ছে করে না। থাক। কী হবে জেনে! আজকাল বেঁচে থাকাটাই অর্থহীন লাগে তার। তাকে তো কারও প্রয়োজন নেই আর। কখনো কী ছিল? ছিল! ছিল! মা’র, দীপনের। আর? আরও একজনের প্রয়োজন ছিল তাকে! ভীষণ প্রয়োজন! মাধবী!
মা নেই, দীপনেরও আছে এখন নিজস্ব জগৎ, আপন পৃথিবী। সেখানে রতন অতিরিক্ত, অপ্রয়োজনীয়। দীপন বুঝতে দেয় না কখনো। ভাইকে ভীষণ ভালোবাসে সে। তবু বুঝতে পারা যায় হঠাৎ হঠাৎ। সেদিন বলা রুমকীর কথাটা হঠাৎ পিনপিনিয়ে বাজে কানের মধ্যে, তুমি পাগল হয়ে গেলে মা আর বাবার মধ্যে খুব ঝগড়া হয় তখন। আমার একটুও ভালো লাগে না সেটা!
মাথার মধ্যে ঝিঁঝিটা তারস্বরে ডেকে ওঠে কি? দিশেহারা লাগে রতনের। মাথা চেপে ধরে যন্ত্রণায়।
আরও পড়ুন: ঝিঁঝিলাগা দিনগুলো-২॥ শিল্পী নাজনীন
—কী হলো ভাইয়া? খারাপ লাগছে তোর? দীপনের উদ্বিগ্ন কণ্ঠ।
মুহূর্তে ঝিঁঝিটা থেমে যায়। কেবল গাড়ির গর্জন, জীবনের কোলাহল। কোথাও ঝিঁঝি নেই পৃথিবীতে। লাল চোখে দীপনের দিকে তাকিয়ে স্মিত হাসে রতন। তাকে আশ্বস্ত করে বলে, না রে। ঠিক আছি। ভালো লাগছে। অনেকদিন পর বের হলাম তো।
মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দেয় দীপন। চোখ রাস্তায়।
সাঁ করে কার্জন হলের পাশ কেটে বেরিয়ে যায় গাড়ি। রতন ক্ষণকাল সেদিকে তাকিয়ে থাকে। দীর্ঘশ্বাস পড়ে অজান্তে। আহা! মাধবী! আজ তারও কোনো প্রয়োজন নেই এই রতনকে আর! হুড়মুড়িয়ে স্মৃতিরা হানা দিতে চায় আবার। ফার্স্ট ইয়ারে ভর্তি হতে না হতেই পড়াশোনার প্রচুর চাপ ছিল তার। বায়োকেমিস্ট্রিতে তাকে পড়তে হতো প্রচুর। পড়তে খারাপও লাগতো না তার। বরং পাগলের মতো পড়তো সে। ক্লাসের বই ছাড়াও অন্য অনেক বইতে আগ্রহ ছিল তার। তবে ক্লাসের পড়াকে সে গুরুত্ব দিতো বেশি। বাকি সময়টা ডুবে থাকতো অন্য বইয়ে। যে কারণে অবসর বলতে প্রায় কিছুই ছিল না তার। সে পড়ায় আনন্দ পেতো। অবসরের তেমন প্রয়োজনও ছিল না, সে অর্থে। মাধবী তারই ক্লাসমেট ছিল। বড়লোকের নাক উঁচু, সুন্দরী মেয়ে ছিল মাধবী। অনেকেরই আরাধ্য ছিল সে। রতন এড়িয়ে চলত তাকে। মাধবী কোনোদিন তাকে টানেনি তেমন। কোনো অতিরিক্ত বোধ তার মধ্যে ছিল না মাধবীর জন্য। কিন্তু প্রকৃতি অদ্ভুত রহস্যময়। মাধবী প্রেমে পড়লো রতনের। একদিন, ল্যাবে তখন আর কেউ তেমন নেই-ই বলতে গেলে, মাধবী রতনের পাশে বসল এসে। কার্জন হলে তখন বিকেল গড়িয়ে গেছে প্রায়। গোধূলির আলোয় কার্জন হলের মুখে নববধুর ব্রীড়া। মাধবী রতনের হাত থেকে প্রাকটিকেলের খাতাটা টেনে নিতে নিতে বললো, খুব ভাল ছাত্র তুমি, না? খুব অহঙ্কার তোমার?
চলবে….