হে জননী, বিষুবরেখায় হেলান দিয়ে চোখ মেলে দেখো—
নদীর মতো বয়ে চলেছি আমি
কাঁধে নিয়ে নিরন্তর কর্মপ্রবাহের জল
আমার সাথে আছ তুমিও
যতদূর গঙ্গা, ততদূর গঙ্গারিডি
যতদূর উড়ি আমি, ততদূর বিস্তৃত হও তুমিও।
আলেকজান্ডার যা পারেনি
যা পারেনি সুলতান সুলেমান
কিংবা রানি ভিক্টোরিয়া,
আমি তাই করে চলেছি
এখন কোনো মহাদেশেই আর অনুপস্থিত নও তুমি।
আর দ্যাখো, তোমার মুখের জবানকে
হাওয়ার মতো ছড়িয়ে দিয়েছি আমি
পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত!
কান পাতো মেরু হাওয়ায়—উত্তরে-দক্ষিণে
কান পাতো আটলান্টিকে—ঢেউয়ের গর্জনে, ঈগলের শিসে,
শুনতে পাবে আপন কণ্ঠস্বর;
আমি যেন সোলেমানি তখত
তুমি সওয়ারি
যতদূর অভিবাসন, ততদূর মাতৃভাষা
যতদূর মাতৃভাষা, ততদূর মাতৃভূমি।
স্বপ্নশাসিত শিশুকালেও ভাবিনি
স্বপ্নের সীমা এতটা সম্প্রসারিত হয়;
শিশুকাল বাল্যকাল, কিংবা কৈশোর
কোনো কালেই ভাবিনি
এতদূরে আসব কখনো,
কোনোদিন এতকাজ করতে হবে আমাকে।
আমার যেন কোনো ক্লান্তি নাই, শ্রান্তি নাই
বিশ্রাম নামক শব্দটি লেখা হয়নি
পরিযায়ী প্রাণের সিলেবাসে আমার।
কিন্তু কোথা থেকে আসে এত শক্তি!
কোথা থেকে আসে এত প্রেরণা!
সেটা ভেবে দেখার বিষয়
ভেবে দেখার সময়টুকু ওভারটাইম
ভেবে দেখার সময়টুকু ভয়!
তো ভেবে দেখবো কখন!
কাজই আমার পেশা
কাজই আমার নেশা।
অথচ মাঝে মাঝে কিছু অকৃতজ্ঞ কণ্ঠ
মাঝে মাঝে কিছু আবোল-তাবোল
কিন্তু এটাই সত্য যে
অভিবাসী কর্মীর প্রতিটি ঘামের ফোঁটা পড়ার সাথে
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভে
একটি করে ডলার পড়ার শব্দ হয়
তৃপ্তির চিত্রকল্প হয়ে হেসে ওঠে গভর্নর মহোদয়ের চোখ।
ঘর্মাক্ত দেহে জেগে ওঠে প্রেরণা
জেগে উঠি আমি।
অভিবাসীর রক্ত পানি হয়ে পড়ে প্রবাসের মাটিতে
স্বদেশে জমে ওঠে জ্বালানির জোগান
অর্থনীতির চাকা ঘোরে
গতি বাড়ে বিমানের ইঞ্জিনের
ইউনিফর্মের রেশনে জমা হয় শায়েস্তা খানের কাল
পুরাতন পতাকায় নতুন হাওয়া লাগে;
এসবই আমাকে ক্লান্তির বদলে আনন্দ দেয়
সার্ভিসিং হয় জীবনের; বেঁচে উঠি পুনর্বার।
হে জননী, সবাই বলে দাও, দাও, আরও দাও, আরও!
আমি তো দেওয়ার জন্যই অভিবাসী হয়েছি মা গো,
দিনরাত দিয়েই চলেছি
প্রবাসে দিচ্ছি, স্বদেশেও পাঠাচ্ছি
দেওয়া ছাড়া আর কীই-বা আছে করার!
দূর হতে আরেকবার নিবিড়চোখে চেয়ে দ্যাখো
আমি আনন্দের রাজ্যে অভিবাসী
আমি বেদনার রাজ্যে অভিবাসী
আমি অনুরাগের উঠোনে অভিবাসী
আমি অভিমানের ভূগোলে অভিবাসী
আমার হাসি পায় না সহগামী ঠোঁট
আমার কান্না পায় না প্রিয়তম দৃষ্টি
আমর আবেগ পায় না সংবেদনশীল বুক
যেখানে আমি, সেখানেই কাজ
যেখানেই কাজ, সেখানেই আমি
সবার জন্য যখন বিশ্রাম, আমার তখন ওভারটাইম
সবার জন্য যখন মিলন, আমার তখন নৈঃসঙ্গ
সবার জন্য যখন উৎসব,
তখন আমাকে জড়িয়ে অনিঃশেষ উৎসবহীনতা।
ড্রাইভিং শেষে গাড়িচালক মোছে তার গাড়ি
রাইডিং শেষে ঘোড়ার গায়ে হাত বোলায় ঘোড়সওয়ার
ঘাটে পৌঁছে নৌকার পাল গোটায় নৌকার মাঝি
কিন্তু আমার কোনো অন্তবর্তী গন্তব্য নেই
আমার জন্য নেই কোনো ক্লান্তি মোছার হাত।
অধিকন্তু সবাই নয়, দুই-একজন মালিকের কথা ভাবলে,
তালগোল পাকায় ভাবনা
জানি না—সবখানি উজাড় করে নিয়েও
কেন মন ভরে না সেসব মালিকের,
কেন তারা মাঝে মাঝে দাসযুগ ফিরিয়ে আনেন!
তখন আমাকে দেখে—
জাতিসংঘের ওয়ালে হেলান দিয়ে নীরবে কাঁদে
আইএলও কনভেনশন
বোবার মতো গোঙায় আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের ঘোষণা।
আর কষ্টের মাঝেও হাসি চেপে রাখতে পারি না
যখন দেখি
কতিপয় লোক ট্রাম্প-কণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠছে
অভিবাসন বিরোধিতায় আর তাদের গা থেকে
ছড়িয়ে পড়া গন্ধে প্রকটিত হয়ে উঠছে
অস্ত্রহাতে অভিবাসনের ইতিহাস।
হে জননী, বলতে পারো—
মানুষ এত স্ববিরোধী কেন?
কেন তারা অস্বীকার করতে চায়
নিজেদেরই রচা ইতিহাস ও ঐতিহ্য?
আমি তো কোনো জবরদখলকারী নই
আমার সাথে নেই কোনো
উপনিবেশবাদী জাহাজ কিংবা সাম্রাজ্যবাদী সাবমেরিন;
আদিমানুষের কোনো জনপদকে নতুন করে আবিষ্কারের
হাস্যকর দাবিও নেই আমার মনে;
আমি শুধু স্বল্প দামের শ্রমিক মাত্র
যা নেই, দিই তারচেয়ে অনেক বেশি
তবু কেন এই অদ্ভুত বিরোধিতা?
আমার কুঁড়েঘরে কোনো বোমা পড়েনি বটে
কিন্তু যাদের ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করেছে
টমাহক আর কার্পেট বোমা,
এবং অত্যন্ত অন্যায্যভাবে,
শুধু ধর্মীয় পার্থক্যের কারণে যারা
টেক্সটবুক একজাম্পল অব ইথনিক ক্লিনজিংয়ের শিকার,
তারা কেন নিরীহ প্রাণটা হাতে নিয়ে
যেতে পারবে না পৃথিবীর আনাচে কানাচে?
ভিটায় গর্জনশীল বোমা, সীমান্তে তাক করা রাইফেল,
এহেন পরিস্থিতি তৈরি করছে কারা?
অভিবাসীরা কেন গ্লোবাল বিশ্বের নন্দঘোষ হবে!
বিশ্বায়নের মঞ্চে প্রবাদের কণ্ঠের মতো সোচ্চার আলোকায়ন
তার বিউটি পার্লার মুখে কালি লাগা দেখে
আমার তো ভীষণ কষ্ট হয়, প্রভুগণের হয় না কেন ?
দাখো, অভিবাসন প্রকৃতিরই ধর্ম
সাইবেরিয়ার হংস-মিথুন এসে ডুডুল-লু
গান গেয়ে যায় তোমার উঠোনে
তুমি তালি দিয়ে উঠো—ওয়ান মোর! ওয়ান মোর!
জলের একতারা হাতে নদীরা চিরদিনই অভিবাসী
আর কান পেতে মুগ্ধ দুপাশের সবুজ ভূগোল;
দক্ষিণ সমুদ্রে স্নানসিক্ত হাওয়া অভিবাসী হয়ে আসে
তোমার চত্বরে আর ফুলে ও ফসলে ভরে ওঠে তোমার উঠোন;
চন্দ্র-সূর্য-তারা অভিবাসী প্রাণেই বিলিয়ে চলেছে আলো
আর পৃথিবী ভরে উঠছে
প্রাণে ও প্রাচুর্যে, স্বপ্নে ও সম্পদে
কখনো এপাশে, কখনো ওপাশে;
মানুষও মূলে অভিবাসী,
নিষিদ্ধ ফলের স্বাদ নিয়ে সেই যে এলো
স্বর্গের সিঁড়ি বেয়ে,
ফেরার বাসনা আদি বাগানের গন্ধ হয়ে
জড়িয়ে রেখেছে তার পরিযায়ী মন
L’Oreal কারখানায় তৈরি ইহলৌকিক পারফিউম
যা মুছে ফেলতে পারে না সবখানি,
পারে না নাস্তিকতার সেন্টের শিশিও।
যাক ওসব, আমি আদার বেপারি, অত বড় বড় জাহাজের
খবর হজম করতে পারবো না;
আমার কাজ পেলেই হয়
কাজ আমাকে মারে না
কাজ না পেলেই যমের ভয় এসে তাড়া করতে বসে
গর্ভবতী রমণীর মতো কাজের মজুদ নিয়ে বুকে
আমি ক্লান্তিকে শক্তিতে পরিণত করি
আমি অশ্রুকে শুকাই আনন্দের বাতাসে
আমি বেদনাকে অভিবাদন জানিয়ে রাখি
আমি জানি এসবের অবসান রচিত হচ্ছে দূরে
যেখানে আমি রেখে এসেছি
আমার সোনালি আমানত
হে জননী, তুমি আমার সব আমানত সামলে রেখো
আমার সন্তানের জন্য রেখে আসা চুমুটা রোজ
ওর কোমল অধরে দিও সকালে ও সন্ধায়;
যে প্রিয়জনকে রেখে এসেছি জলেভেজা শপথের সান্ত্বনায়,
তাকে যেন লুট করে না নিয়ে যায়
মতলববাজ মৌসুমি হাওয়া।
সেই কবেই তো জমিদারি প্রথা গেছে
কানু সর্দারের ডাকাতির রাত এখন পুরাঘটিত অতীত
কেন তবু প্রবাসীর রিজার্ভ রাতে ডাকাতের ভয়
কেন তবু তার অর্জিত রোদে চাঁদাবাজির উৎসব?
আরেকটি কথা, আমি কোনোভাবে দাঁড়িয়েছি ফের
কিন্তু তুমি কি জানো জননী,
প্রবাসগামীর খরচের খাত কত কিসিমের,
আর কত রকমের শুভঙ্কর বসে আছে—
চৌরাস্তার মোড়ে,
ছদ্মবেশী আড়ালে,
পরাক্রান্ত টেবিলে?
সবিনয় অনুরোধ, আমার মতো আর কাউকে যেন
অস্বীকৃত খরচের খপ্পরে পড়ে
ঋণের বোঝা বাড়িয়ে নিতে না হয়!
আর তোমার সকল ভুল ছিদ্রে তালা লাগাও জননী,
অতিব্যয় আর ভুলপথ সর্বনাশের মূল কারণ।
জানি, ফিরে গিয়ে আমি আর ফিরে পাবো না
আমার কৈশোর আকাশের কাশফুল দিগন্ত
যৌবন নদীর বেশকটি ঢেউ
হাতছাড়া হয়ে যাবে চিরতরে
আমি গিয়ে ফিরে পাবো না অতিক্রান্ত
মিলনের অগণিত রাত।
রেখে আসা শিশুর ঠোঁট থেকে ছিটকে পড়া হাসি
ফিরে পাবো না চৈতীচাঁদের আলো নিঙড়েও।
সেসব দুঃখ সয়ে নিবো আমি, সেসব সয়ে যাবে আমার
যদি প্রত্যাবৃত্ত চোখে দেখতে পাই—
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভের সাথে পাল্লা দিয়ে
চারপাশে গড়ে উঠেছে সমৃদ্ধির উঠোন
আর সেই উঠোনের এককোণে
আমার জন্য প্রতীক্ষারত—আধখানা সচ্ছল জীবন, অন্তরঙ্গ দুটি হাত।