এক
আমার জীবনে দারুণ এক অনুচ্ছেদ তৈরি হয়, যখন আমি বয়সে যুবক।
তার আগে, আমার বাপ-মায়ের যৌগিক অক্বা পাওয়ার ঘটনার পরে আমার অর্থ-কড়ি বিষয়ক চরম সংকট শুরু হয়। আমি একটা নিশ্চয়তা পাওয়ার আশায় চতুর্দিকে তদবির ছড়িয়ে দেই, যতটুকু আমার সামর্থ্যে কুলায়। কিন্তু তীরের মতো শুধু হতাশাই ছুটে এসে বুকে বিঁধে আহত করে তুললে আমি প্রায় মাটিতে পড়ে যাই। তখন বন-পাহারার চাকরিটা পেয়ে পুনরায় সোজা হয়ে দাঁড়ানোর শক্তিটুকু ফিরে পাই।
লোকসকল যারা আমার কাছের কিংবা কাছের নয় কিংবা কিঞ্চিৎ কাছের, তারা আমাকে এই চাকরিতে জীবনের হুমকি দেখায়। বিষয়গুলো আমি শুনি, বুঝিও খানিকটা এবং কিছু বলি না। কারণ ওসব ভয় অন্তত এই সব জীবনের চেয়ে তুচ্ছ বিষয় মনে হয়। সুতরাং চাকরির বাইরে অন্য কোনো দিকে তাকানোর ফুসরত আর কই!
কিন্তু চাকরিতে এসে ভয়ের অনেক বিষয়ের মুখোমুখি হতে থাকলেও পাত্তা না দেওয়ার অনুষঙ্গগুলোও খুঁজে নিতে সচেষ্ট থাকি। কিন্তু এটা তো এক ফাঁকির নাম, যেটা সব সময় সফলতার মুখদর্শন করে না। তখন জীবনের পরিহাসগুলো নগ্ন আর উন্মাদ হয়ে চোখের ওপরে বাইজি নাচে। আমি বোধ হয় এর থেকে মুক্তি পেতেই মনের ভেতরে একটা সংঘ প্রতিষ্ঠা করি, যার কাজ হলো মুক্তির পথ খোঁজা।
সংঘ প্রথমত আমাকে একটা সম্পর্ক খোঁজার কথা বলে, যার কারণ আমি একটা সজীব প্রাণ। আর কোনো সজীব প্রাণই আদতে সম্পর্ক ছাড়া বাঁচে না, হোক সে সম্পর্ক নোংরা কিংবা পরিচ্ছন্ন। হোক তা কাক কোকিলের মতো সম্পর্ক কিংবা মুসা নবি ফেরাউনের মতো সম্পর্ক। সজীব প্রাণ সম্পর্ক ছাড়া বাঁচে না। আমিও তাই একটা সম্পর্কই খুঁজতে থাকি আর এই খোঁজার সবচে বড় সহযোগী হলো সংঘ, যেটা আমি নিরপেক্ষ অভিমতে মনের ভেতরে প্রতিষ্ঠা করেছিলাম।
পৃথিবীর সমস্ত কিছুর সম্পর্ক আসলে জটিল কিন্তু সেটা মধুর হয় কোনো সম্পর্কে জড়ানোর পরে। সাপের সঙ্গে বেজির সম্পর্ক যে মধুর নয়, সেটা আমরা মাথায় হাত রেখে কইতে পারলেও বুকে হাত দিয়ে হয়তো পারবো না। সে জন্যই কিনা, যে নদী আমার বাপ-মায়ের প্রাণ খেয়েছে, তেমনি এক নদীর কথা বলে সংঘ আমাকে তাগাদা দিলে আমি নদীর কাছে এসে বসি। যে নদীর নাম বিনসিড়া এবং আমার ডিউটি অঞ্চলের ভেতরেই এর অবস্থান। এখানে এসে দেখলাম কেমন হাওয়া বয় মাতাল করা আর তার ছোঁয়ায় জল কেমন ঘুরে ঘুরে কথা কয়। আমি হয়তো বাতাসের আর জলের সম্পর্ক বুঝি কিন্তু আমার সম্পর্ক অতটা পরিষ্কার করতে পারি না। কিন্তু যখন দেখলাম নদী আমাকে ডাকছে আর আমিও আসছি ছুটে ছুটে, তখন আমি আমার সম্পর্কের জায়গা নির্ণয় করে ফেলি।
সম্পর্ক আসলে আমার আর নদীর, আমার আর বনের, জলের আর হাওয়ার। পরস্পর আমরা শুধু ঘুরে ঘুরে কথা কই।
দুই
একসময় হরিণদের সমৃদ্ধ অঞ্চল হলেও পুরো বনে তখন আর কোনো হরিণ দেখা যায় না। কিন্তু বন পাহারা দিতো যে লোকটা, তার মুখে একবার ভাষ্য শোনা গিয়েছিল, সে নাকি বিনসিড়া নদীর কাছে একদা একদিন একটা হরিণের দেখা পেয়েছিল। কিন্তু আমরা এর বেশি কিছু জানতে না পারলেও সেই সময়ে সয়লাব হওয়া একটা হরিণ, ইলিশ আর অন্যান্য বিষয়ের গল্প আমরা শুনেছিলাম।
ব্যাপারটা নাকি উদ্ভট ছিল না বরং এর পেছনে এক কঠিন বাস্তবতা ছিল। বিনসিড়া নদীর হঠাৎ করেই যৌবন লুট হয়ে গেলে রাতারাতি সে বুড়িয়ে গেলো। জলের সবটাই প্রায় তাকে বয়কট করতে করতে কোন অতলে যে লুকালো, তা আর জানা গেলো না। তবে জলের সবটাই বয়কট করে চলে গেলো না, আসলে বয়কট করে যেতে সক্ষম হলো না। নদীর শরীর যেখানে যেখানে গভীর হয়ে ছিল, সেখানে আটকে গেলো জল আর তার ভেতরে সবচে গভীর যে জায়গা, সেখানে আটকে গেলো এক ইলিশ। কিন্তু সংকীর্ণ জলের সঙ্গে ইলিশের কোনো সম্পর্ক হয় না বলে সে শুধু ঘুরে ঘুরে কান্না করলো, কথা বলার মতো কোনো সম্পর্ক সে আর খুঁজে পেলো না।
যে হরিণটার কথা শোনা যাচ্ছিল, সম্ভবত সেই হরিণটাই, তার প্রজাতিও সেখানে আর টিকে ছিল না। এর পেছনেও ছিল নাকি কঠিন এক বাস্তবতা। মানে এই ব্যাপারটাও উদ্ভট কিছু ছিল না। তার প্রজাতিদের সেখানে আসলে টিকতে দেওয়া হয়নি। প্রথমত একবছর প্রায় পুরো বনে আগুন লাগলে প্রচুর হরিণ কাবাব হয়ে গেলো। যারা টিকে ছিল তাদের লাল মাংস হয়ে গেলো খয়েরি। তারা পোড়ার ক্ষত নিয়ে আবার সংসার গড়লো, বনের সবুজ ফিরে আসতে আসতে তাদেরও নতুন প্রজন্ম এলো। তারপর তারা হয়তো সুখে শান্তিতে বসবাস করতে লাগলো। কিন্তু তেমন বাস্তবতা দীর্ঘায়ু পেলে এই গল্প ভ্রূণ থেকে কোনো শরীর পেতো না। তাই তারা সুখে শান্তিতে বসবাস করতে পারলো না।
বন বিভাগের ঘুমিয়ে কাটানোর সুযোগে সে বছর উজান বেয়ে শিকারী এলো মাছের মতো ঝাঁকে ঝাঁকে। শত শত হরিণের প্রাণ স্বাধীনতা পেয়ে শূন্যে উড়াল দিলো আর অক্ষম দেহগুলো মানুষের অধিকারে গেলো। সে বছর পার হতে হতে বন বিভাগ ঘুম থেকে জেগে উঠে দেখলো, এই বনে এক প্রজাতির প্রাণ লুকোচুরি খেলতে খেলতে কোথাও আড়াল হয়েছে। তাদের মনও এমন একত্ববাদী বিশ্বাস থেকে কখনো টললো না। কেবল বনের কোথাও কোথাও পুরনো রক্তের ঘ্রাণে তাদের অলৌকিক কিছু মনে হলো। কিংবা তারা হয়তো ভৌতিকতায় ডুবলো, কারণ কোনো একসময় কারও ভাষ্য শোনা গিয়েছিল যে, পুরনো রক্তের গন্ধ হলো ভৌতিকতার নিশানা।
একটি প্রাণ অবশ্য থেকে গেলো গোপনে, অনেক আলোর ভেতরে অলৌকিক একটু অন্ধকার হয়ে। এজন্য হয়তো, তার সখ্য হয়েছিল অন্ধকারের সঙ্গে, তার সম্পর্ক হয়েছিল সে সবুজের সঙ্গে, যে সবুজের সঙ্গে আলোর হৃদ্যতা কম। তাই শিকারি চোখ তার ওপরে পড়লো ঠিকই কিন্তু তখনই পিছলে গেলো। তাই সে বেঁচে গেলো আর বেঁচে গেলো বলে অনেক ঘটনা ঘটলো।
প্রথমত সে তাৎক্ষণিক মৃত্যুর স্বাদ থেকে বঞ্চিত হলো।
দ্বিতীয়ত তার মৃত্যু অনেক বিলম্বিত হলো।
তৃতীয়ত সে বেঁচে থেকে তীব্র মৃত্যুগন্ধ স্বাদ পেলো।
চতুর্থত তার মৃত্যু আরো ট্র্যাজেডিক হলো।
ট্র্যাজেডিক হলো কারণ সে নতুন নতুন সম্পর্কে জড়ালো আর পুরনো সম্পর্ক তার আরও গাঢ় হলো। কিন্তু যে জীবনটা ছিল ঘাসের, অন্ধকারের, হরিণের সঙ্গে তার দেখা হচ্ছিলো না বলে এসবের সঙ্গে ঘুরে ঘুরে কথা কয়ে তার তৃষ্ণা মিটলো না। তাই সে অন্ধকার থেকে বের হয়ে বিনসিড়ায় এসে শীতল জলে মুখ ডোবালো। আর মুখ ডুবিয়ে সে কিঞ্চিৎ শীতল হতে হতে মিহি কান্নার বিলাপ শুনলো। কিন্তু এখানে কে কাঁদে, তার মনে হলো জলতরঙ্গে গতি পেয়ে তার অন্তরের কান্নাই উপগত হচ্ছে তার কানে। বিষণ্ন অপেরার মতো এই কান্না তার দারুণ ঘনিষ্ঠ মনে হলে শীতল জলে ডুব দিয়ে সে আবারও হৃদয়ের দিকে কান পাতলো। মিহি কান্নার গতি বাড়লে এবার সে দেখতে পেলো রূপালি জলে বিষণ্ন বুদ্বুদ তুলে এগিয়ে আসছে রূপার মতো ঝকঝকে এক ইলিশ।
সম্ভবত তখনই, কিংবা এমনি একটা দিনে, ইলিশ আর হরিণের সম্পর্কের ঘনিষ্ঠ সময়ে যখন তারা মগ্ন হতো একান্ত আলাপে, বন পাহারা দিতো যে লোকটা সে দেখে ফেলেছিলো তাদের অসতর্ক মুহূর্তে।
গল্প এক-এর অংশ
আমার জীবন আসলে মানুষের না, হয়তো শুকনো পাতার, ঘাসের, কিংবা জলের ও হাওয়ার। মানুষের সঙ্গে আমার দেখা হয় না বলে আমার শান্তি আসে। এই জেনে সংঘ আমাকে কখনো মানুষের কথা বলে না। তাই আমি দীর্ঘসময় শুকনো পাতা মরমরিয়ে সবুজ পাতার গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে হেঁটে যাই। দক্ষিণ থেকে আরও দক্ষিণে যাই উত্তর থেকে আরও উত্তরে যাই ফিরে আসার লোভে। আমি ইচ্ছে করে পথ ভুল করি এসবের সঙ্গে সখ্য বাড়াবো বলে। তারপর বিনসিড়ার কোলে বসে দীর্ঘ দীর্ঘ সময় টেনে টেনে আরও দীর্ঘ করি। কিন্তু মানুষের কথা আমি ভাবি না আমার জীবন আসলে মানুষের না। মানুষের জন্য আমার কোনো সময় নেই।
কারণ, আমি অন্ধ তবু দৃষ্টি দৃষ্টি খেলা খেলি না।
কারণ, মনের ভেতরে আমার কোনো দৃশ্যপাপ আসে না।
কারণ, আমি প্রেমিক নই তবু ভালোবাসার ইতিহাস সমাজে প্রতিষ্ঠা করি না।
কারণ, যোনি ও শিশ্নপ্রধান সমাজে আমি কোনো টিপসই দেই না।
কারণ, ভুল সময়ে দীর্ঘশ্বাস ওঠে না বলে গভীর কোনো অসুখের ইঙ্গিত পাই না।
কারণ, হঠাৎ মায়াবী খেয়ালে আমার মনের ভেতরে জল ও হাওয়ার বিপরীতে পরিচ্ছন্ন কোনো মুখ জাগে না।
তাই মানুষের জন্য আমার কোনো সময় নাই। আর মানুষের জন্য আমার কোনো সময় নেই বলে আমার বুকের ভেতরে করুণ উচ্চাঙ্গসঙ্গীতের সন্ধ্যা আসে। দুপুর ও রাত্রি আসে। আমি বিনসিড়ার জলে ও হাওয়ায় তাই উৎসব দেখি। ধূসর আর সবুজ পাতার গলাগলি করে শুকনো পাতার ঘরে নৃত্য করতে দেখি। আমি এদের সবার সঙ্গে ঘুরে ঘুরে কথা কই আর অন্ধকার ঘিরেই আলোর উৎসব করি। কারণ আলো ফুরিয়ে গেলে অন্ধকার নিয়েই বাঁচি। এভাবে, আমার জীবনে দারুণ এক অনুচ্ছেদ তৈরি হয় তখন আমি যুবক।
কিন্তু অনুচ্ছেদ হলো রাঁধুনীর হতের মাছ ভাজা, শুধু উল্টেপাল্টে যায়। আর আমিও দেখতে থাকলাম উল্টানো অনুচ্ছেদ, যেটা কোনো অর্থেই আর দারুণ নয়।
যে বনের ঝরা পাতায় মরমরিয়ে দক্ষিণ থেকে আরও দক্ষিণে আমি হেঁটে যাই, সেখানে গভর্মেন্ট ব্যাপক এক প্রজেক্ট নিয়ে এসেছে। দারুণ উৎসবে গাছ কাটা চলছে আর সংঘ আমাকে বায়ান্ন যোগ উনিশ একাত্তর দিনের শোকপ্রস্তাব করেছে।
গল্প দুয়ের অংশ
ইলিশ ও হরিণের সম্পর্ক সকালের রোদের মতো কথা বলে উঠলো। তাদের জীবন হয়ে উঠলো হরিণের, ইলিশের। এখন তারা ঘুরে ঘুরে শুধু কথা কয় আর কথা কয়। হরিণ তার নতুন দুঃখের কথা বললো।
হ. দক্ষিণ দিকের বন যেখানে আমাদের আদি নিবাস ছিলো সে বনের এখন মৃত্যু হচ্ছে। এখানে আর কোনো আশা ভরসা নাই।
ই. আমরা বড্ড বেজন্মা সময়ে জন্মোছি, আমাদের চোখে আর কোনো কান্না জমা নাই।
হ. কান্নার সমৃদ্ধ সময়ে কেন্ যে আমরা কান্না সঞ্চয় করি নাই।
ই. কিন্তু এমন কেনো হলো, আমি শুধু ঘুরে ঘুরে কান্না যোজনা করি এই ভেবে যে, আমাদের তো শুধু পরের জন্ম আছে, আগের কোনো জন্ম নাই তাই পাপ নাই। তবু কেন পরিতাপ আর পরিতাপ।
হ. মানুষ চলে গেলে যদি নতুন ঈশ্বরের অভিষেক ঘটতো, আমি তবে দুয়েকটা অভিযোগ দিতাম।
ই. আমারো মানুষ বিষয়ে কোনো ভাষ্য নাই।
হ. কিন্তু ইলিশ, তুমি আর কটা দিন সবুর করে লেজের ভেতরে পরানটা ধরে রাখো। সামনের দেড়টা মাস তারপর বর্ষা এলে বিনসিড়ায় ভরা জোয়ার। কিন্তু শোক আমার জন্য। বনে কখনো জোয়ার আসে না। তুমি তাই আমার স্মৃতি বাঁচিয়ে রেখো কারণ তুমি জলের প্রাণ, আর জলের মতো পৃথিবীময় কোনো সম্পর্ক হয় না।
ইলিশ আবার স্বপ্ন দেখতে শুরু করলো আর সেই স্বপ্নে হরিণ আশা জোগাতে জোগাতে দেখলো গভীর জল দিনে দিনে অগভীর হয়। ইলিশের প্রাণও লেজ থেকে আরও নিচে নেমে এলো। তখন হরিণ শুধু ঘুরে ঘুরে ছলছল চোখে তাকালো কিন্তু মুখে কোনো কথা জোগালো না। তার মনে হলো এ জীবন আসলে হরিণের নয়, ইলিশের নয়, অন্ধকার ও সবুজ ঘাসের নয়। এ জীবন যেনো কিসের, হয়তো সংক্ষিপ্ত সময়ে দীর্ঘ কান্না যোজনা করার।
তারপর হরিণ দেখলো সবুজ শীতল জলে রূপালি শরীরের ইলিশ ভেসে উঠলো। আর হরিণ তার গলার কাছে এসে আটকে থাকা পরাণকে সে ছুটি দিয়ে দিলো। কিন্তু তাদের সম্পর্কের যাবতীয় অনুচ্ছেদ এখানেই শেষ হলো না।
গল্প এক-এর বাকি অংশ
বায়ান্ন যোগ উনিশ একাত্তর দিন আমি শোক প্রস্তাব গ্রহণ করে শোক পালন করতে থাকি। কিন্তু আমার পরাণের রক্ত মাংস থেকে বিষাদ কমে না কেনো এ বিষয়ে সংঘ আমাকে কোনো সহায়তা করতে পারে না। তাই সংঘের কার্যকারিতা সম্পর্কে আমার ভেতরে সন্দেহের সৃষ্টি হলে আমি সংঘ ভেঙে দেই। আমি আসলে বুঝতে পারি আমার হৃদয়ের সমৃদ্ধির দিন শেষ হতে চলেছে, আর সময় হাজার ওল্টালেও পুরনো সমৃদ্ধির দিনে ফেরে না।
এখন আমি আর ঝরাপাতা বনে দীর্ঘ পথ হেঁটে যাই না। উত্তরের দিকে শুধু কান্নার মতো পদক্ষেপে একটুখানি পথ চলি তারপর একটু শান্তি খুঁজবো বলে বিনসিড়ার কোলে এসে বসি। বিনসিড়ার জল হাওয়াই আমার রক্ত মাংসের বিষাদ খানিকটা কমায়। কিন্তু একদিন ভোর বেলা হলে, আধো আধো ঘুমে স্বপ্ন এসে দৃশ্য দেখায় বিনসিড়ার দুকূল উছলে উছলে উঠছে। আর তিনটে হলুদ পাতা তুমুল স্রোতে ভাসতে ভাসতে নোনা অঞ্চলের দিকে যাচ্ছে। তাই দেখতে গিয়ে পা হড়কে পড়ে যেতে যেতে আমার আধো ঘুম আর হঠাৎ স্বপ্ন দুই-ই ভেস্তে গেলে আমি হুড়মুড় করে উঠে বসি। তারপর দীর্ঘ দীর্ঘ শ্বাস নিতে নিতে একটু ধাতস্থ হলে, বিনসিড়ায় এসে দেখি সমস্ত জল রাতারাতি ভেলকিপ্রিয়দের মতো প্রস্থান করেছে।
হায় রে, এত ভাঙন ও দুঃখ আমার জীবনে আর আসে নাই রে। আমি তাই বালিকাদের মতো নিঃসংকোচ কান্না করি, মাথা চাপড়ে বুক চাপড়ে শোকের মাতম করি। কিন্তু ভেতর থেকে আমার আর কান্না ফুরোয় না। হায় বিনসিড়া, যা ছিলো আমার শেষ আশ্রয় আর সকল সম্পর্কের বিন্দুকেন্দ্র। আমি এখন কার সঙ্গে ঘুরে ঘুরে কথা কবো, কার কাছে যাবো? আমার জীবন তো আসলে মানুষের না।
সংঘ ভেঙে দিয়েছি বলে এবার আর কেউ এগিয়ে এসে শোকপ্রস্তাব করে না। অবশ্য তার দরকারটুকু পড়ে না কারণ যে শোক আমার আমৃত্যু, সেখানে নির্দিষ্ট দিনে বেঁধে ফেলা যায় না। আমি তাই শোক যাপন করতে করতে, কয়েকটা বিন্দুর ভেতরে ঘুরে ঘুরে একা একা কথা কইতে কইতে দেখি আমার জীবনীশক্তি বেশি আর বাকি নেই। আমি তাই আরেকবার বিনসিড়ার দিকে যাই যদিও তাকে দেখলে চোখে আমার রক্তকান্না ছোটে, তবু যাই। গিয়ে আমার বিনসিড়ার বুকের ওপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বেশ খানিকটা এগিয়ে দেখি, জমাটবদ্ধ অগভীর জলাশয়ে ভেসে আছে রূপালি ইলিশ আর আধেক জলে শরীর ডুবিয়ে মরে আছে ধূসর হরিণ। এই দেখে আমার চোখ থেকে রক্তকান্না ছোটা বন্ধ হয় কিন্তু আমার চোখে বুঝি গ্রহণ লাগে তাই অন্ধকার প্রধান হয়ে ওঠে। তাহলে কি আমার চোখের সমান্তরালে আছে মৃত্যের ছায়া!
এক ও দুয়ের সমাপ্তি
একটি রূপালি ইলিশ, ধূসর হরিণ আর একজন মানুষের (যার জীবন আসলে মানুষের না) সম্মিলিত মৃত্যুর পর বিনসিড়ার অঞ্চলজুড়ে সময়ের আগেই বর্ষা এলো। নতুন জোয়ারের টানে ভেসে এলো অগণন রূপালি ইলিশ। আর তারা ঠুকরে ঠুকরে খেলো একটি রূপালি ইলিশ, ধূসর হরিণ আর একজন মানুষের দেহ। সেই থেকে ইলিশের স্বাদ হলো জগতের তাবৎ মাছের চেয়ে আলাদা সুস্বাদু। মানুষ এই স্বাদু মাছ খেতে গিয়ে দেখলো পিঠের ওপর দিয়ে খয়েরি মাংস। হরিণ ইলিশকে স্মৃতি রাখতে বলেছিল বলে হয়তো তাই, মানুষ গল্প বানালো, একদা এক হরিণ আর ইলিশ দৌড় প্রতিযোগিতা দিলো এই শর্তে, যে হারবে সে খানিকটা মাংস কেটে পুরস্কার দেবে বিজয়ীকে। তারপর প্রতিযোগিতা হলো আর হরিণ হারলো বলে খানিকটা মাংস কেটে পুরস্কার দিলো ইলিশকে। ইলিশের পিঠের এই খয়েরি মাংস হলো আদতে হরিণের।
কিন্তু গল্প আসলে এটা ছিলো না। গল্প হবে মূলত প্রতিযোগিতা হয়েছিলো তিনজনের। একটি রূপালি ইলিশ, ধূসর হরিণ আর একজন মানুষের। কিন্তু প্রতিযোগিতায় জিতে গেলো ইলিশ আর হরিণ। জনপদবাসী তাই হরিণ আর ইলিশের প্রতিযোগিতার গল্প বললো কিন্তু মানুষের পরাজয়ের কথা কেউ জানলো না। এজন্য হয়তো, তার জীবন আসলে মানুষের ছিল না।