দৃশ্যবন্দি ইচ্ছেগুলো
বাতাসের মুখে-ঠোঁটে বিস্তর রোগ ছড়িয়ে যাচ্ছে। তারা জানে না—এই সব রোগ কতদিন ধরে চাষ হচ্ছিল বিবিধ ক্ষুধার মধ্যে। ক্ষুধা থেকে আমরাও জন্ম নিয়েছিলাম একদিন। আষাঢ়ের সরগমে আমরাও হাত উঁচু করে বলেছিলাম—আজ থেকে এই বৃষ্টির স্বাদ আমিও নিতে চাই। মুমূর্ষু চুম্বনের দাগ নিয়ে আমি দাঁড়াতে চাই আহত পাখির মিছিলে। চারদিকে তাকিয়ে থাকা মানুষ ও গাছসকল কেউ আমাদের হাত দেখেনি। আমরাও কাউকে দেখিনি। সেই দেখা, না-দেখার মধ্যে অনেক চোখ ছিল। অনেক চোখে ক্ষত ছিল। অনেক ক্ষতে মানুষের সমাধি ছিল। অনেক সমাধিতে বিধবা দুনিয়া ছিল। আমি তখনো বুঝতে পারিনি। মানুষের রোগ হলে সে কেন আরও মানুষ হতে চায়। নিজের মধ্যে লুকানো মানুষটাকে বের করে জানাতে চায়—আমি একজন মানুষ! আমি লুকিয়ে না থাকা প্রাণী। কিন্তু এই চিৎকার যে তাকে আরও লোকান্তরে মিইয়ে নেয়, সেটা সে বুঝতে পারে না। বুঝতে পারে রক্ত ও গোপন আবিষ্কারের নেশা। যে নেশায় তার দ্রুতগামী ফসল দৌড়াতে থাকে। রাত-বিরাতে দৌড়াতেই থাকে। এমন দৌড় দেখতে দেখতে আমরা মনের মধ্যে কিছু দৌড় চাষ শুরু করলাম। একহাতে চিৎকার—একহাতে দৌড়। মনে হলো আমরা বড় হয়ে গেছি! আমরা নিঃসঙ্গ প্লাটফর্ম দেখলে শুয়ে পড়তে জানি। গান শুনলে কান খুলে ছড়িয়ে দিতে জানি।
সকালে ঘুম থেকে উঠতে উঠতে প্রায় দিন ঘড়িতে দশটার কাটা পেরিয়ে যায়। এগারোটা ছুঁই ছুঁই অফিসের জন্য প্রস্তুত হয়ে বের হই। দশটার অফিস ১১টা থেকে সোয়া এগারোটা বেজে যায়। এই অনিয়ম আমাদের জীবনেরই একটা অংশ। বালক বেলা থেকেই কোনো কাজ নিয়ম মেনে করতে পারি না। হয়তো কখনোই পারবো না। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যাপনের রুটিনটা আস্তে আস্তে পাল্টে গেছে। পাল্টে যাচ্ছে জীবনের গোল কিংবা গোলহীনতার ঢোল। নিজেদের ঢোলের নিজেরাই পেটাই। বাজাই। ভাঙা কিংবা না ভাঙার কোনো ইচ্ছে থেকে এই অস্থিরতা নয়। অজান্তেই ঢোল বাজতে থাকে। বাজতেই থাকে। আমরাও তালে তালে নাচতে থাকি। নাচের মধ্যে শৈশব-কৈশোর তাততালি দেয়। আমরা হারানো উচ্ছ্বল দিনগুলোর দিকে করুণ চোখে তাকিয়ে তাকি। ভুলে যাই, কাছাকাছি চুম্বনের কথা। প্রিয় হয়ে ওঠা বালিকার কাতর কণ্ঠে নিগুঢ় আবেদনের কথা। ছলছল করে ওঠে স্থিরচিত্রগুলোর হা-হুতাশ। দেয়ালে দেয়ালে দোল খাই আমরা ও আমাদের ‘হ্যাঁ’ কিংবা ‘না’ হয়ে ওঠা জীবন। সেই ছোট্ট সময় থেকেই খেয়াল করেছি, কোনো কিছু নিয়ে প্রথম দিকে আমরা অনেক ক্ষিপ্র ও অস্থির থাকি। কিন্তু শেষ অব্দি কাঙ্ক্ষিত জিনিস কিংবা সেই গন্তব্যের কাছকাছি আসার সময় পুরো আগ্রহটাই উবে যায়। এই চরিত্রের সঙ্গে আমরা মিলেমিশে গেছি। কোনোভাবেই পাল্টাতে পারছি না। এটা গুণ কিংবা দোষ।
গুনগুন করতে ইচ্ছে করছে। করছিও। কী গান বাজছে মাথার মধ্যে, সেটা নিজেরাও জানি না। প্রয়োজনও মনে হয় না। জেনে কী হবে! সব কিছু জানার তো দরকার নেই। ঔৎসুক্য বাঁচিয়ে রাখতে কিছু দৃশ্য অনাবিষ্কৃতই থাকুক। সেই অদৃশ্যের প্রতি, আড়ালের প্রতি যেন গভীর রাতে নত হতে পারি। অন্ধকার রুমের মধ্যে জগজিৎ সিংয়ের সঙ্গে গলাগলি করে কান্না করতে পারি। কিংবা মোহাম্মদ রাফির কাঁধে হাত রেখে চোখ মুছতে মুছতে ভাবতে পারি—এ জীবন আমার না। এ জীবন সময়ের। তার কাছেই আমরা ফিরে যাবো।
সকাল হয়।
রোদের পড়শিরা ছোটাছুটি শুরু করে আগুনের তৃষ্ণায়। আমাদের হাতগুলো ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে।
আমাদের সকালগুলো বন্দিমুখের মতো আমাদের পকেটেই থাকে। পকেটের মধ্যে নিয়ে আমরা সারাদিন ঘুরে বেড়াই। দিন শেষে তাদের ক্ষুধা পেলে আমরা অন্ধকার খেয়ে ফেলি। ভাগাভাগি করে খাই। তারা কিছু কম আর আমরা কিছুটা বেশি। আমরা বুঝতে পারি—আমরা আবার প্রতারিত হচ্ছি। মনে মনে খুশি হই। শেষ সময়ও আমরা প্রতারিত হওয়ার যোগ্যতা রাখি!
কালো আবরণের অপেক্ষায় ধান কাটা ক্ষেত। দাঁড়ানো গাছের মমি সকল।
প্রতিটি পাখির ঠোঁটে ধান। তারা হইচই করে আমাদের দিকে আসছে। আমরা পরাজিত হাসি নিয়ে নিজস্ব কুলায় ফুল নিয়ে বসে আছি। হাতদের ইশকুল ছুটি হলে আমরা তাদের পিছু পিছু ধুলো কুড়াবো। তখন মনে হবে, সকালে ওঠা কিংবা বেলা করে ঘুম থেকে ওঠার বিবিধ পার্থক্যগুলো আসলে কোনো লৌকিক গণিতে স্থান পায় না। সরল জ্যামিতি তাদের থেকে অনেক দূরত্বে অবস্থান করে। আমাদের মনে হয়, কলস ভরতি জল নিয়ে কোনো একটি গাছ আমাদের কোলের মধ্যে বসে আছে। চারদিকে লোকসমাগম। তারা দেখতে চাইলে গাছের শেকড় কত দূর গিয়ে তন্দ্রা জমালো। আমরা স্থির। এক্কেবারে স্থির হয়ে আছি। আমাদের যেন কোনো হাত-পা নেই। আমাদের মুখোশের মধ্যে সাপের চিৎকার শুরু হয়ে গেছে। আমরা আর ঠিক করে বসতে পারি না। আমাদের মনে হয় দৌড়ে কোনো স্রোতের মধ্যে পালাতে পারলে বেঁচে যাবো।
ঠিক বাঁচাও নয়। জানালার ওই পাশে ক্ষুধার্ত কাকের কাছে যেতেও লজ্জা লাগে। তারা কতদিন ধরে আমাদের চিঠি লিখছে। দেশের মধ্যে অনটনের খবরাখবরে তাদের পেট বোঝাই। আমরা এক মুহূর্তও সেগুলো নিয়ে ভাবতে পারিনি। বরং নিরামিষ ভোজনে আমাদের কত আয়োজন—কতটা ক্ষয়ে যাচ্ছে পাতালের বিমার, সেই ভয়েই আমাদের পা বড় হচ্ছে না। নাড়াদের কানে মুখ নিয়ে শুয়ে পড়েছি; বিশ্বাস জোগাতে খুলে ফেলেছি নিজেদের দেহটাও। আর বাকি নেই কিছু! তারপরও দূরত্ববেষ্ঠিত করে রেখেছে। কলাই ক্ষেত থেকে কোনো ঘ্রাণ আমাদের জানালায় আসতে পারে না। তাদের হাতে-পায়ে শেকল বেঁধে দিয়েছে সন্ধ্যা।
ঘুমের কাছে ফিরে যাওয়া যেতে পারে। তার বালিশে মন রেখে নিঃসঙ্গ বাতাসের মতো ঘুরে ঘুরে দেখা যেতে পারে অথই ইচ্ছার ঘর-বাড়ি। কোমল সাজ থেকে খুলে খুলে ঘুমের কাছে নত হতে চাওয়া আর বেঁচে নেই। তারা নিজ ইচ্ছায় ছুটি হয়ে গেছে। আমাদের চাষাবাদ ছিল ওই সময়ে ঘুমের খামার থেকে বিদায়ের প্রাক্কালে আমাদেরও সেখানে কিছুটা রেখে এসেছি। আর সেই খামারে কিঞ্চিত আমরা বেড়ে উঠতে উঠতে যে একেকজন অবিকল আমরা হয়ে গেছি, সেই সংবাদ পেয়ে মোটেও তাজ্জব হই না। বরং মজা পেতে থাকি। অপেক্ষা করতে থাকি একটি নৈতিক যুদ্ধে। আমরা ও আমাদের মধ্যে যুদ্ধ হবে এবার! বিগত জন্মে আরও যেসব আমরা লুকিয়ে আছে লোকালয়ে কিংবা গাছে গাছে তাদেরও ডাকতে ইচ্ছে হলো। মনে হলো এবার একটা যুদ্ধের আয়োজন সত্যিই করা যেতে পারে। যে খেলায় আমরা আর আমরাই যোদ্ধা। আমরা ও আমরাই দর্শক। আবার আমরাই রেফারি।
প্রচণ্ড জ্বর নিয়ে ঘুম এলো। তার হাতে প্রাইমারির বুড়ো হেড মাস্টারের মতো লম্বা একটা বেত। আমরা তার চোখে তাকাতে পারছি না। তার শরীরের বিভিন্ন অংশ সকালের ঘুম—দুপুরের ঘুম—আবার অনিয়ম ঘুম—শিল্পসম্মত ঘুম। কিন্তু তার ঘুম! হয়তো আমাদের মতো তারও কোনো নিজস্ব ঘুম নেই। তাকে আমাদের প্রশ্ন করতে সাহস হয় না। আমরা কোনো প্রশ্নই করি না। আমরা আমাদের মধ্যে ডুবতে থাকি। ডুবে যেতেই থাকি। বেত মহোদয় চোখ বন্ধ করে ধ্যান করতে বসে যান। আমরা তার মাথায় উঠে যাচ্ছি। আমরা হাসি হাসি মুখ থেকে তাকেও খুলে নিয়ে যাচ্ছি। পালাচ্ছি। ঘুম থেকে পালাচ্ছি। সেখানে সকালে কিংবা বিকালের কোনো হিসাব নেই। সেখানে অস্থিরতার তুমুল চাষবাস হয়। অথবা সেখানে আমরা কিংবা ঘুম কেউ আর বেঁচে নেই। আমরা ভাগ হতে থাকি। আমি, তুমি ও সে ভাগ হয়ে তিনটি স্বপ্নে ছড়িয়ে যাই। ইচ্ছে করি যার যার ছবি আঁকবো অথবা তিনটি গল্প বানাবো। অথবা কোনো কিছুই না প্রত্যেকে আলাদা আলাদা অথচ এক হয়েই হাঁটবো-দৌড়াবো আবার চরিত্র হয়েও উঠবো।
প্রথম স্বপ্ন: জুলেখারা চার বোন
আমি ও জোলেখা। কেউ কারও জন্য তৈরি হইনি। জুলেখা তৈরি হয়েছে ক্রিং ক্রিং শব্দের জন্য। তার কান সবসময় ক্রিং ক্রিং শব্দের জন্য প্রস্তুত থাকে। তার মুখে বাতাসি ধরনের একটা প্রলেপ দেওয়া থাকে সবসময়। এই প্রলেপটা একদিন সন্ধ্যা শেষে আমি এঁকে দিয়েছিলাম। জুলেখা নিঃশব্দ বলেছিল—সেইসব ক্রিং ক্রিংয়ের কথা; যেগুলো ঠিকমতো বেজে ওঠে না। কিন্তু সেগুলো সে ঠিকই শুনতে পায়। আরও জানায় এরকম অনেক ক্রিং ক্রিং জমা হয়ে আছে তার আঁচলে। আমি উঁকি দিতে দেখলাম সেখানে কোনো ক্রিং ক্রিং নেই। সেই আঁচলের গুঁটিশুটি দিয়ে শুয়ে আছে জুলেখারা চার বোন। সবার মুখ একই রকম। আমি হাসপাতোলের মর্গে দেখা জুলেখার মুখটা খুঁজে বের করতে চাইলাম। মনে হলো কোনো মুখে বিন্দুমাত্র উষ্ণতা নেই। সব বরফে ঢাকা। বিশ্বাস হলো না আমার—এই বরফ বিক্রি করতে গিয়েই আমি একদিন আর ফিরে আসিনি। জোলেখার কাছে চলে গিয়েছিলাম। জুলেখা বলেছিল—তোমার জন্যই আমি প্রতিদিন অনেক বরফ বানাই। দেখো আমার বুকটা কেমন অ্যান্টারটিকা হয়ে গেছে।
আমি তার বুকে হাত রাখার সাহস পাই না। আমার বিদঘুটে ইচ্ছাগুলো তখনো যৌনতা ভুলে বরফ হতে শেখেনি। আমি বললাম, দেখো, আমি কিন্তু আজ আর কোনো বরফ কিনবো না। তুমি বরং আমাকে বরফ বানাতে পারো। তারপর যেকোনো লাশ গাড়িতে বিক্রি করে দিতে পারো। তুমি এবং তোমাদের চার বোনের সঙ্গে আমিও গ্রাম দেখতে দেখতে গলে যাবো।
২য় স্বপ্ন: নিঃসন্তান রাস্তারা
আমি জানতাম এই রাস্তায় আর কোনোদিন হাঁটা হবে না আমার। সে জন্য আমি প্রতিটি ঘাসের কানে বলে দিয়েছি সমুদ্রে ঢেউ ওঠার খবর। নিজের কানেও লিখি নিয়েছি সমুদ্র ফেরত তব্দা খাওয়া জলের ফোপাঁনা বিষ। রাস্তাগুলো আমাকে বিশ্বাস করলো না। আমিও তাদের বোঝাতে বোঝাতে শেষ পর্যন্ত ধৈর্যহারা হয়ে গেলাম। আমার মনে হলো, একটা মান্দার গাছ হয়ে আমিও এই রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকি। দাঁড়িয়ে থাকি এই ঘাসদের পরের জনম না আসা পর্যন্ত। আমার পা কিছুতেই মানলো না এই কথা। সে হাঁটতে চাইলো পাহাড়ে। যৌনতায়। আমি পায়ের পিছু পিছু হাঁটছি। হাঁটছি। আমার পিছু পিছ হাঁটছে ঘাসের চোখগুলো। তারা জানতে চায় আমার গন্তব্য। আমি সাহস জোগাতে থাকি। নিজের মনকে বোঝাতে থাকি। মনে মনে লিখতে থাকি ঘাস ছাড়া একটি উদ্যান গল্প। যে উদ্যানে আমারও কোনো অস্তিত্ব নেই। কেবল একটা মান্দার গাছ দাঁড়িয়ে আছে। আর তাড়া খাওয়া একটা বিড়াল দুনিয়া থেকে বাঁচার জন্য ঊর্ধ্বশ্বাসে তার মগডালে ওঠার জন্য তীব্র কসরত করছে। জলে জলে কানাকানি হচ্ছে শুনতে পেলাম। তাদেরও একই সন্দেহ, আমি গ্রাম ছেড়ে গেলে নাকি এই রাস্তাগুলো পোয়াতি হবে। নিজেকে ভয় পাওয়া ঢেউ মনে হতে লাগলো। আমি কোনোভাবেই এই গ্রামের পোয়াতি হওয়ার জন্য দায়ী নই। আমি কোনো নতুন রাস্তার জন্মদিতে চাইনি। আমি কেবল কিছু ধুলো কুড়াতে এসেছিলাম।
৩য় স্বপ্ন: জয়নবের মা
একদিন শেষ বিকেলে হালকা একটা ঘুমের সঙ্গে বিকিকিনি করছিলাম। রাতে যেন আর পাহারা বসাতে না হয়। কোথা থেকে যেন একদল জয়নবের মা এলো। তাদের ভিন্ন ভিন্ন কণ্ঠস্বর। কিন্তু সবার কথা একই রকম। একই সুর। অভিন্ন বাক্যে তারা কথা বলতে লাগলো। তারা উত্তপ্ত বাক্যে আমাকেও উত্তপ্ত করতে চাইলো। আমি চিৎকার শুরু করলাম। জয়নবের নাম ধরে ডাকলাম। একদল গ্রাম ছুটে এলো। প্রত্যেকের চোখেই শহর শহর ঘুম। মাথার মধ্যে মেগা সিটির উজ্বলতা। আমার নিজেকেই খুব বিকারগ্রস্ত মনে হলো। ভাবলাম জয়নবদের কাছে তাদের মায়েদের বুঝিয়ে দিয়ে আস্তে করে ভাটির দিকে নুয়ে যাবো। তাদের চোখের দিকে তাকালাম। তারা আমার হাত তোলা দেখে চুপ হয়ে গেলো। আমি ভয় পেলাম। মাঝে মধ্যেই নীরবতাকে যেমন ভয় পাই। ভয় পাওয়াটা যেন একটা গুণ। যদিও আমার এই গুণ কোনো জয়নবরাই জানে না। জয়নবরা ও তার মেয়েরা প্রত্যেকে প্রত্যেকের মুখোমুখি দাঁড়ালো। আমি স্থির দৃষ্টিতে তাদের দিতে তাকিয়ে থাকলাম।
জয়নবরা প্রশ্ন করলো, আমরা আমাদের পিতাকে দেখতে চাই। তোমরা মরে গিয়ে বেঁচে গেছে ভাবলে ভুল করবে। এই যে আমরা নরকেও তোমাদের কাছে বাবার চেহারা দেখতে চলে এসেছি।
আমার মনে হতে থাকলো আমার মধ্যে প্রচুর নরক তৈরি হচ্ছে। আমি দর্দম পুড়ে যাচ্ছি। সব জয়নবের মায়েরা আমার দিকে আঙুল তুললো। একমাঠ জয়নবরা সম্মিলিত কণ্ঠে আমাকে উদ্দেশ্য করে ‘বাবা’, ‘বাবা’ বলে চিৎকার করে উঠলো। আমার শরীর থেকে নেশার পোশাকগুলো খুলে যেতে লাগলো। আমি দেখলাম, আমার দুই পায়ের মাঝখানটা শিশ্নশূন্য। আর চারদিকে নিসপিস করছে হাসির স্রোত।
দেখা হলো আবার
হাজার হাজার পাখার মধ্যে মনে হলো কোনো একটি পাখা আমাদের জন্য বেশ আগ্রহ ভরে রেখেছে তার চোখে। আমরা দেখলাম তার কোনো চোখ নেই। পরক্ষণে মনে হলো আমাদেরও তো কোনো চোখ নেই! তাহলে আমরা দেখছি কেমনে? চোখহীন একটা দেশে আমরা নিজেদের আলাদা করার জন্য যত কূটকৌশল করেছি সেসব তালিকারা আমাদের মুখের মধ্যে গোল পাকাতে থাকলো। মাথার মধ্যে মিছিল শুরু হচ্ছিল তখন। আমরা থইথই চিন্তা থেকে ছড়িয়ে যেতে লাগলাম। মনে হলো জট পাকিয়ে আর কোনো লাভ নেই। আমাদের ক্ষত থেকে হেরে যাওয়ার ভাইরাস ছড়িয়ে যাচ্ছে পুরো দেশে—পুরো দুনিয়ায়! ভাঙা ভাঙা বাক্য থেকে লৌকিক কোনো ঘ্রাণ নিয়েও যদি স্থির হই তবু যে সেটা স্থায়ী হবে না। সেটা বারবার কানের কাছে বলে দিচ্ছে জড়ো হওয়া চোখেরা। আমরা ক্ষত ছেনে বের করতে থাকলাম বিগত দুনিয়ার প্রাণীদের। তাদের অদৃশ্য আমাদের কিছুটা স্বস্তি দিলো। আমরা মনে মনে হাত তুলে সেই শৈশবের মতোই ভাষণ দেওয়ার জন্য তৈরি হলাম। টপটপ করে সব জানালা বন্ধ হয়ে গেলো। আমাদের শাস নেওয়াও যেন বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। নিজেদের বারবার বোঝাচ্ছিলাম—আরে তোমরা এত ভয় পাও কেন? এটা তো তোমাদের দুনিয়া নয় যে অক্সিজেন না থাকলেই মরে যাবে। তোমরা তো হাজার বার মরার পরই এখানে এসেছ। তাদের হাতেও মরেছে হাজার দুনিয়া। আরও কত প্রাণী আর কত দুনিয়া মারা যাবে তার কোনো শেষ নেই। আর তোমরা যদি কিছু নাও করতে পারো, আমরা তোমাদের চোখ হত্যার অভিযোগে বাঁচিয়ে রাখবো। সব ধ্বংস দেখাই হবে তোমাদের শাস্তি।
হাতঘড়ি খুঁজতে থাকলাম। আমরা তো ইদানীং হাত ঘড়ি ব্যবহার করি। ঘড়ি পেলাম। ঘড়ির কাঁটা চলছে না। ঘণ্টার কাটায় জয়নব বসে আছে। এক জয়নবের মধ্যে চার জয়নব। আবার কখনো জুলেখা হা করে আকাশের চোখে চোখ রেখে বসে আছে আবার কখনো দেখেছি একটা সরু রাস্তা। একা একা হাঁটছে। যার শেষ প্রান্তে একটা মান্দার গাছ দাঁড়িয়ে ছয় হাতে আমাদের ডাকছে, ডেকেই যাচ্ছে।