‘সবাই আমরা ল্যাঙরা হাবা/ দুইটা ট্যাকা দ্যান গো বাবা/ আমার আল্লা নবীজির নাম/ তোমরাও একদিন গোরে যাবা/ দুইটা ট্যাকা দ্যান গো বাবা/ আমার আল্লা রাসুলের নাম/ খাইতে শুইতে কিছুই পাই না/ দুইটা ট্যাকা দ্যান গো বাবা/ আমার আল্লা নবীজির নাম/ জমি জিরাত কিছুই চাই না/ দুইটা ট্যাকা দ্যান গো বাবা/ আমার আল্লা রাসুলের নাম।’
পাঁচ জনের একটা দল—দুই জন নারী, একজন উঠতি যুবক, একজন শিশু। দুই নারীর একজনের ডান পায়ের গোড়ালির নিচের অংশ অনুপস্থিত থাকায় কোনোমতে শরীরের ভারসাম্য বজায় রাখতে হচ্ছে তাকে। বাম হাতটিকে কোমরের ভাঁজে বিশেষ কায়দায় রেখে ঝুঁকে ঝুঁকে হাঁটছে সে, সম্ভবত ডান পায়ের জন্মগত অক্ষমতাকে সহযোগিতা করার উদ্দেশ্যে এই কায়দাটা রপ্ত করেছে, তার হাঁটার ভঙ্গিটা খুবই বিচিত্র। অন্য জন, যার বয়স ঠাহর করা অসম্ভব—সে বাকশক্তিহীন। উঠতি যুবকটির মাথায় নোংরা একটা পাগড়ি, পরনের পাঞ্জাবিটার রঙ সাদা না হলদে, তা স্পষ্ট নয়। মুখভর্তি এলোমেলো দাড়ি, সেই দাড়ির যত্ন নেওয়ার সুযোগ তার হয় না, এটা নিশ্চিত। শারীরিকভাবে সে খুবই শক্তপোক্ত। দলের পাঁচ-ছয় বছরের শিশুটি, সেই যুবকের বাম হাত ধরে তাকে দলটির সঙ্গে যুক্ত রাখার কাজটি সুনিপুণভাবে করছে। যুবকটির চোখের ওপরের পাতা লেপটে আছে নিচের পাতার সঙ্গে, সে অন্ধ, জন্মান্ধ। ছোট এই দলটি সদা ব্যস্ত-সন্ত্রস্ত মানুষের যাত্রাপথে কোনো প্রতিবন্ধকতা তৈরি না করেই এগিয়ে চলছে। গুলিস্তানের গোলাপশাহর মাজারের ফুটপাতঘেঁষা রাস্তা দিয়ে এগিয়ে যেতে যেতে জিরো পয়েন্ট এসে পৌঁছেছে দলটি। বৃত্তাকার দলটির ডান দিকে তাকালেই জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররম, বাম পাশেই বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সচিবালয়। ইতস্তত দলটি, অবশেষে সচিবালয়ের রাস্তা ধরে সামনে এগোয়। ইতোমধ্যে নিয়ন আলো জ্বলে গেছে, যদিও মাগরিবের আজান এখনো শোনা যাচ্ছে না। সন্ধ্যা নামার আগেই নিয়ন আলো জ্বলে ওঠা এই শহরের নিয়ম, চারিদিকে এত আলো থাকা সত্ত্বেও বিবিধ অন্ধকারে সাঁতার কাটছে এ শহর।
তারপর তার সঙ্গে আছে তার চিরশত্রু, তার রূপ—যদিও সে খুবই সাবধানে সবার থেকে আড়াল করে রাখে সবসময় তার সঙ্গে থাকা এই চিরশত্রুকে। কিন্তু শত্রু তো শত্রুই, সঙ্গেই থাক আর আড়ালে থাক।
দলে আরও একজন আছেন, সম্ভবত তিনিই দলনেতা। তার শরীর বলতে তেলের ব্যারেলের মতো একটি দেহ, দেহের সঙ্গে অদ্ভুতভাবে লেগে আছে প্রায় চুলশূন্য একটি মাথা। বাস বা ট্রাকের টায়ারের টিউব কেটে গোলাকার দেহটির জন্য পোশাকের মতো কিছু একটা একটা বানানো হয়েছে। সেই বিশেষ পোশাকের ভেতর নিজেকে সঁপে দিয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে নেতৃত্ব দিচ্ছেন দলটিকে, তার পোশাকে লেগে আছে ধুলো-বালি-কফ-থুথু-দুঃখ-ব্যথা-বেদনা। আর লেগে আছে এই শহরের দলাদলা দীর্ঘশ্বাস। দলনেতা সুর তুললে বাকিরা সেই সুরে যতটা সম্ভব করুণ-রস জুড়ে দেওয়ায় অন্তর্ভেদী, দুঃখ জাগানিয়া একটা ঢেউ আছড়ে পড়ছে আশপাশের ব্যস্ততায়। রিকশা, টেম্পো, বাসের হর্ন, বিবিধ কোলাহল—সবকিছুকে ছাপিয়ে এই সুর সাধারণ পথচারীর হৃদয়ে ভালোমতোই ধাক্কা দিতে পারছে, তা নিশ্চিত। নিশ্চিত যে, তা বোঝা যায়—দলের বাকশক্তিহীন নারী সদস্যের হাতে থাকা ছোট প্লাস্টিকের বাটিটা দেখলে; দশ-পাঁচ-দুই টাকার নোটের আড়ালে বিশ, পঞ্চাশ এমনকি দুই-একটা একশো টাকার নোট মাথা উঁচু করে তাদের উপস্থিতির জানান দিচ্ছে। তবে একশো টাকার নোট বেশিক্ষণ পরিবেশ আলো করার সুযোগ পাচ্ছে না। দলের বাকশক্তিহীন যে নারী, সে সন্তর্পণে একশো টাকার নোট তুলে কোমরে বেঁধে রাখা ছোট একটা কাপড়ের ব্যাগে ঢুকিয়ে ফেলছে। সঙ্গে সঙ্গে সুরের সঙ্গে তাল মেলানোর চেষ্টা করছে—আমার আল্লা নবীজির নাম/ আ-হু আ-হু আল্লা রাসূলের.. .।
জীবনে প্রথম জোমেলা পা রেখেছে এই শহরে। কিছুই চেনে না সে। চিনবে কিভাবে? বাস এসে দাঁড়ালে কন্ডাকটর সবাইকে নামতে বলে। সে-ও নেমে পড়ে বাস থেকে, নেমেই দেখে চারিদিকে মানুষ আর মানুষ, গিজগিজ করছে—দৌড়াচ্ছে, শুধু দৌড়াচ্ছে, কে যে কার পেছনে কেন দৌড়চ্ছে, তা কেউ জানে না। তবু দৌড়াচ্ছে, তাদের এই দৌড় কবে কখন কোথায় শেষ হবে, তা জানার চেষ্টাও করে না, এরা শুধু দৌড়ায়। এদিক-ওদিক তাকাতেই চোখে পড়ে দলটিকে, পিছু নেয় সে। তবে কাউকে বুঝতে দেয় না যে, সে এই দলটিকে অনুসরণ করছে। ঠিক কী কারণে অনুসরণ করছে, তা নিজেও জানে না। এমন নয় যে, এই শহরে দেখার আর কিছু নেই! আশপাশে উঁচু উঁচু বিল্ডিং, মানুষের মাথার ওপর দাঁড়িয়ে থাকা ব্রিজ। এই ব্রিজগুলো দেখে কিছুটা আশ্চর্য হয় সে, ‘নদী-টদী কুনু কিছু নাই, তাও ফের ব্রিজ?’ অবশ্য এগুলোর কিছুই ভালো লাগে না তার। ‘লুকিয়ে থাকার জন্য নাকি এই শহর সবচাইতে নিরাপদ।’ কথাগুলো তাকে বলেছিল, আকল আলী। তার সহযোগিতায় না পেলে হয়তো সে এই শহরে আসার সাহসই পেতো না। এজন্য অবশ্য আকল আলীর পাওনা কড়ায়গণ্ডায় চুকিয়ে দিতে হয়েছে তাকে। সে চায় না, কারও কাছে ঋণী থাকুক সে। কিন্তু পাওনা হিসেবে আকল আলী যা নিয়েছে, তা একটু বেশিই। যদিও সে মুহূর্তে কিছুই করার ছিল না তার।
সাভার পার হয়ে হেমায়েতপুরের কাছাকাছি পৌঁছুলে, হানিফ পরিবহণের বাসটা একটা পাম্পে এসে দাঁড়ায়। আকল আলীর পায়খানা চাপে, পাম্পের পেছনের দিকের টয়লেটে যায় সে। সেখানে ছোটখাটো একটা লাইন পড়ে গেছে ইতোমধ্যে। আকল আলী সেই লাইনের শেষে এসে দাঁড়ায়। বাসের তেল নেওয়া শেষ হলে প্রায় সবাই বাসে উঠে বসে, কিন্তু তখন পর্যন্ত আকল আলী আসেনি। কন্ডাকটর এসে জোমেলাকে আকল আলীর কথা জিজ্ঞেস করলে নির্লিপ্ত জোমেলা জানায়, আকল আলী আগের স্টপেজে নেমে গেছে। বাস কন্ডাক্টরের তাড়াহুড়ো ছিলো, তাকে আবার গাবতলী থেকে ফিরতি ট্রিপ নিয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জ যেতে হবে। বাস চলা আরম্ভ করলে জোমেলা নিজের কাছে থাকা বারশো টাকার মোবাইলটা খুলে আকলের কিনে দেওয়া সিমটা বের করে চলন্ত বাসের জানালা দিয়ে বাইরে ছুড়ে মারে, সে চায় না এ শহরের একজন মানুষ, এমনকি কোনো কাকপক্ষীও তাকে চিনুক। আকল আলীকে ছেড়ে এসে কিছুক্ষণ খুব অস্বস্তি অনুভব করে জোমেলা, ভয়ও পায়, কিন্তু ভয়টা মুহূর্তেই কেটে যায়। ভয় মুহূর্তেই ঘৃণায় পরিণত হয়, যখন তার মনে পড়ে আকল আলীর পাওনা আদায় করার কথা।
যে জায়গায় সবাই বাস থেকে নেমে গেছে, জোমেলাকেও সেখানেই নেমে যেতে হয়েছে। জোমেলার সামনে দিয়ে এক এক করে অনেক বাস যাচ্ছে, একেকটা বাস একেক জায়গার নাম করে যাত্রীদের ডাকছে। নামগুলোর একটাও পরিচিত না হলেও ‘গুলিস্তান’ নামটি জোমেলার কাছে পরিচিত ঠেকে। আকলের কাছে সে এই নামটি আগেও শুনেছে। বাসে উঠে পড়ে সে। নিজেকে ভাসিয়ে দিয়েছে সে, অজানার স্রোতে ভেসে গিয়ে বাঁচতে চেয়েছে, যদিও বাঁচা বা মরা নিয়ে এতটুকুও ভাবে না সে, কিন্তু গ্রাম থেকে পালিয়ে চলে না এসে তার আর কী-ই বা করার ছিল, ‘কী করতুং? কুনু উপায় ছিল? উপায় যে ছিল না, সেট্যাই বা কী কোইর্যা কোহি? কিন্তুক কহব কী কোইর্যা ? গলাতে যে কথা কাঁটার মতন আটকিয়া থাকে, হামার কী সাধ্য সে কথাকে গলা থ্যাক্যা বাহির কইর্যা আনার, কিন্তু বাহির না কইর্যা ও তো উপায় নাই, সে কথা গলায় আটকিয়্যা থাকলে হামার শাস বন হইয়া মইরা য্যাতুং হামি। মরতেও তো চ্যাহাছিনু, একবারই চ্যাহ্যাছিনু, বিষ খ্যায়্যা লিয়াছিনু, ইন্দুর মারার বিষও, সেও হার সঁতে বেঈমানি কইর্যা ছে। মরার মরা হামাকে ল্যায়নি, কেহু যখন হামাকে একবার ফিরিয়্যা দ্যায় হামি তার কাছে আর কখনুই যাই না। হামি মরিনি কিন্তু বাপু মর্যান গেছে। বাপুকে হামি নিজ হাতে বিষ খাউয়িয়্যা থুয়্যা অ্যাসসি।’ নিজের সঙ্গে নিজেই কথা বলে জোমেলা।
যে মেয়ের মা নাই, তার জন্য পুরো পৃথিবীই পর হয়ে যায়। কিন্তু তারপরও, সুউদ্দি’র কথা মনে আসলে ঘৃণায় ভরে ওঠে জোমেলার মন। তার বাপ যে অন্যায় কাজ করছে, তার শাস্তি মরণ। ‘আর এই শোরের বাচ্চা মাকে একটুকুনও শান্তিতে থাকতে দ্যায়নি। শান্তি তো দূরের কথা দু ব্যালা প্যাটের ভাতই দ্যায়নি। মাকে রোজ র্যা তেই মারতোক সুউদ্দি, যাক, মা মর্যা য্যায়ায় শান্তি প্যায়াছে, ত্যাহিলে কি মরণেই সুখ?’ জোমেলা ভাবে, ‘তাহিলে হামি কি জীবনকে ভালব্যাস্যা ফেল্যাছি?’ জীবনে খুব বেশি শত্রুর মুখোমুখি হয়নি জোমেলা—না তার বাপ না, আকলও না, গরিবের ঘরে জোন্মাছে সেট্যাও লয়, তার শত্রু সে নিজেই।’ জোমেলা ইচ্ছা করেই নিজেকে আড়ালে রাখতে চায়, নোংরা জামাকাপড়, আউলা ঝাউলা চুল, চেহারার একটুকুও যত্নআত্তি নেয় না। দাদায় কইতো, ‘বেটি ছ্যাল্যার শরীলের রূপ হোল্যো তার সবচাহিতে বড় শত্রু।’
এইসব এলোমেলো কথা ভাবতে ভাবতে দলটা থেকে কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখেই হঠাৎ একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে পড়ে জোমেলা। দলের সুরটা কেটে গেছে বলে হয়তো জোমেলাও থমকে গেছে। সুর কেটে গেলে সবকিছুই কেটে যায়, সেটা ভিক্ষা করার জন্য গাওয়া গান হোক আর জীবন। অবশ্য এখনো কেউই বোঝেনি যে, সে দলটাকে অনুসরণ করছে। বায়তুল মোকাররম মসজিদের মাইকে ঝমঝম করে বেজে ওঠে আজান। হয়তো আজানের জন্যই বিরতি নিয়েছে দলটি। ‘এরাও খুব ভালো কর্যারই জানে ধর্মকে কামে ল্যাগ্যাইতে পারলেই কেল্লাফতে।’ এই কথাগুলো জোমেলার না, আকলের। মাঝে মাঝে গুরুত্বপূর্ণ কথা বলে ফেলতো আকল। পড়াশোনা বেশিদূর করে নাই, কিন্তু খুব তাড়াতাড়ি শিখে নিতে পারতো। মনে মনে সে জোমেলাকে পছন্দ করতো। কিন্তু সব পুরুষের একই সমস্যা, সবকিছুতে বড্ড তাড়াহুড়া করে ফেলে তারা, এবং, এর ফলে বিশ্বাস হারায়। ওই যে, পাওনাটা আদায়ে যদি সে তাড়াহুড়া না করতো, তাহলে কি তাকে আজ ফেলে রেখে চলে আসতে পারতো জোমেলা?
মাগরিবের আজান শেষ হওয়ামাত্রই দলটা পুনরায় নড়েচড়ে বসে। হাইকোর্টের গেট থেকে দোয়েল চত্বরের দিকে এগোয় দলটি। মোড় নেয় জোমেলাও। হাইকোর্ট বা দোয়েল চত্বর চেনে না জোমেলা, আসলে সে এই শহরের কাউকে চেনে না, সে নিজেও চায় না এই শহরের কেউ তাকে চিনুক। না-চেনা, না-জানা একটা শহরে তার কোথাও যাওয়ার জায়গাও নেই, নিজেকে বৈশাখের খড়কুটোর মতোই ছেড়ে দিয়েছে সে। ঘূর্ণি বাতাসের কুণ্ডলী তাকে যেখানে নিয়ে যাবে, সেখানেই যাবে সে। দোয়েল চত্বর থেকে ডানে মোড় নিয়ে দলটি এসে দাঁড়ায় তিন নেতার মাজারের সামনের রাস্তার ফুটপাতে। নির্দিষ্ট দূরত্বে, রাস্তার বিপরীতে দাঁড়ায় জোমেলা। অবাক হয় সে। দলের নেতা এবার মাজারের বাউন্ডারিতে ঠেস দিয়ে বসে পড়ে, সে-তো একা বসতে পারে না, বসার এই কাজটা করে দেয় বাকশক্তিহীন নারীটি, ল্যাংড়া মেয়েছেলেটি, তাদের সঙ্গে হাত লাগায় পাঁচ ছয় বছরের শিশুটি। ব্যারেলের মতো শরীর বিশিষ্ট মানুষটি এবার লম্বা শ্বাস নিয়ে মেয়েটিকে ইশারায় কী যেন বলে। ইশারা করা মাত্রই, মেয়েটি তার কোমরে গুঁজে রাখা ছোট্ট ব্যাগটি থেকে একটি ম্যাচবাক্স আর একটি বেনসন সিগারেটের মোচড়ানো প্যাকেট বের করে। প্যাকেট থেকে একটি সিগারেট বের করে ঠোঁটে লাগায় নারীটি, ম্যাচে কাঠি ঘষলে ফস করে জ্বলে ওঠে কাঠি, সিগারেট জ্বালিয়ে দুইটা টান দেয়। এই দৃশ্যটা ভালো লাগে জোমেলার। সে উৎসুক হয়ে পরের ঘটনা দেখার চেষ্টা করে, সঙ্গে সঙ্গে এই ব্যাপারটাও লক্ষ রাখে, কেউ যেন বুঝতে না পারে, সে এই দলটাকে এতক্ষণ অনুসরণ করেছে এবং এখনও করছে। জোমেলা লক্ষ করে, দুইটা টান দেওয়ার পর সিগারেটটা দলনেতার ঠোঁটে গুঁজে দেয় দলের বাকশক্তিহীন নারীটি, যেহেতু দলনেতার হাত-পা কিছুই নেই, প্রায় সব কাজেই কারও না কারও সাহায্য নিতে হয় তাকে, শুধু সে যখন রাস্তা দিয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে এগিয়ে চলে, তখন তার কারও সাহায্য লাগে না। সিগারেটটা ঠোঁটে নিয়ে লম্বা কয়েকটা টান দেয় সে, সিগারেটটা ঠোঁটে রেখেই বিশেষ কায়দায় ধোঁয়া ছাড়ে, এবং; নতুন করে টান দেয় সিগারেটে। দ্রুত শেষ হয়ে আসে সিগারেট। ঠোঁট দিয়েই ফুরিয়ে আসা সিগারেটের ফিল্টার ছুড়ে মারে রাস্তায়, তারপর নিজেদের মধ্যে কী সব কথাবলা আরম্ভ করে। বিপরীত প্রান্তের ফুটপাতে একাই জোমেলা, ঘটনাগুলো দেখছে, খেয়ালই করেনি, তার পাশেই এসে দাঁড়িয়েছে একজন মানুষ। জোমেলাকে ইশারা করে সে। ভয় পেলেও জোমেলা ভেঙে পড়ে না। চেহারার ভেতর আরোপিত কাঠিন্য ধরে রাখার চেষ্টা করে। এ ইশারা কিসের ইশারা তা বুঝতে এতটুকুও দেরি হয় না জোমেলার। জোমেলা ভাবে, ‘এইসব ইশারা বুঝার ক্ষমতা না দিয়্যা বেটিছ্যালাকে দুনিয়ায় পাঠাইলে অন্যায় করত আল্লা।’ আশাহত হয় মানুষটি, ফিরে যায়, জোমেলার চোখের মধ্যে কী যেন একটা আছে, যা দেখে পুরুষ ভয় পায়, অবশ্য সবসময় জোমেলা এই ক্ষমতা ব্যবহার করে না।
‘আব্বায় তুমারে ডাকে।’
‘আব্বা?’ জোমেলা মেয়েটিকে চিনে ফেলে, এই মেয়ে তো ওই দলের সেই ছোট্ট মেয়েটি।
‘চলো কইলাম, আব্বা ডাকসে, চলো।’বলেই হাত দিয়ে রাস্তার ওপার জমে থাকা একটা অন্ধকারের দলার দিকে আঙুল তুলে দেখায়, ‘ওই যে ওইটা আমার আব্বা, চলো, না গেলে কিন্তু আব্বায় রাগ করবো।’
কী করবে বুঝে উঠতে পারে না জোমেলা, হ্যাঁ, এটা ঠিক যে প্রায় আধাঘণ্টা ধরে দলটিকে অনুসরণ করছে, কেন করছে সে নিজেও জানে না। অচেনা এই শহর, দুধের সরের মতো ঘন মানুষ, কিন্তু মনে হয় নয়া এরা কেউ কাউকে চিনে। শুধু বিশেষ কোনো পরিস্থিতির সৃষ্টি না হলে এখানে কেউ কাউকে চিনতে চায় না। এই যেমন কিছুক্ষণ আগেই একজন মানুষ ইশারায় তাকে ডাকছিল, সেই ইশারায় সাড়া দিলে হয়তো জোমেলার সঙ্গে পরিচয় হতো নতুন একজন মানুষে। হয়তো তার গন্তব্য পাল্টে যেতো। সিদ্ধান্ত নিতে কিছুক্ষণ সময় নেয় জোমেলা। উনিশ বছর বয়সী একজন মেয়েকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা দেয়নি এই সমাজ, আর সে তো মা-ছাড়া, গ্রাম-ছাড়া, বাপ-ছাড়া, আকল আলী ছাড়া, ধনদৌলত-জমিজিরাত ছাড়া সহায়সম্বলহীন সামান্য একজন মেয়ে মানুষ, তারপর তার সঙ্গে আছে তার চিরশত্রু, তার রূপ—যদিও সে খুবই সাবধানে সবার থেকে আড়াল করে রাখে সবসময় তার সঙ্গে থাকা এই চিরশত্রুকে। কিন্তু শত্রু তো শত্রুই, সঙ্গেই থাক আর আড়ালে থাক।
যাবে কী যাবে না, এই ভেবে অবশেষে বাচ্চাটির সঙ্গে রাস্তার ওপারে আসে জোমেলা। এসেই দলটির পাশে দাঁড়ায়। অবশ্য সে যে এসে দাঁড়িয়েছে তা কেউই খেয়াল করে না বা এই মুহূর্তে তাদের হয়তো খেয়াল করার সময়ও নেই। দলের যে মেয়েটির কাছে ছোট ব্যাগটি থাকে, সে তার ব্যাগ থেকে টাকাগুলো বের করে, বাটিতে থাকা ছোট নোটগুলো এবং খুচরো পয়সা—সবই ফুটপাতের নিয়ন আলোর ছোঁয়া পেয়ে জ্বলে ওঠে মিথেনের মতো। তিনজনের তিন দায়িত্ব। মেয়েটির হাতে বারোটি একশো টাকার নোট—নোটগুলোকে সে বারবার গুনে দেখে। যে মেয়েটির ডান গোড়ালি নেই, সে খুবই মনোযোগী হয়ে খুচরো নোটগুলোকে সাজাচ্ছে, সাজানো শেষ হলে শত অনিচ্ছা সত্ত্বেও টাকাগুলো দলের বাকশক্তিহীণ নারীটির দিকে বাড়িয়ে দিচ্ছে। সে পরম যত্নে টাকা গুনছে। একশো টাকার ছয়টা নোটসহ মোট দুই হাজার সাতশো সাতাত্তর টাকা হয়েছে, বাকি আছে কয়েন—কয়েন মিলিয়ে মোট টাকার পরিমাণ দাঁড়ায় দুই হাজার আটশো তিরানব্বুই টাকা।
টাকার চেয়ে জরুরি কিছু এই জীবনে কিছু নাই, তা শমশের হাওলাদার ছাড়া আর কে ভালো বোঝে। খুব অল্প বয়সেই একটা অ্যাক্সিডেন্ট কেড়ে নিয়েছে তার জীবন—জীবনই তো। এভাবে বেঁচে থাকার কোনো মানে আছে? তবু বেঁচে আছে, থাকতে হয়েছে। শমসের মরে গেলে কী এমন হতো? মরেনি। টানা তিন মাস হাসপাতালের থেকে সে দেখেছে কিভাবে সরকারি হাসপাতাল নিজেকে বিক্রি করে দিয়েছে প্রাইভেট ক্লিনিকের কাছে। সরকারি হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে প্রাইভেট ক্লিনিকে যাওয়া সম্ভব হয়নি তার, সম্ভব হলে হয়তো একটা হাত বাঁচানো যেতো, অবশ্য একটা হাত থাকা না থাকায় খুব বেশি কিছু যায় আসে না। শমসের কখনো রাগ করে না, রাগ করা ছেড়ে দিয়েছে অ্যাক্সিডেন্টে স্ত্রী-সন্তান এবং তার নিজের হাত-পা হারানোর পর থেকেই। তখন শমসের হাওলাদারের বয়স আর কতই হবে, ছাব্বিশ? হ্যাঁ ছাব্বিশ।
আজ চল্লিশ বছর বয়সে দাঁড়িয়ে কত কথা মনে পড়ে যায় শমসেরের—হাসপাতাল থেকে ছুটি পাওয়ার দিন কেউ ছিল না তাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। আর কোথায়ই বা নিয়ে যাবে? কে নিয়ে যাবে? খোঁজখবর রাখার মতো কেউ ছিলও না। কর্তৃপক্ষ এক প্রকার জোর করেই তাকে হাসপাতাল থেকে বের করে দেয়, আর তারাই বা কতদিন রাখবে? যে রোগীকে মাসের পর মাস কেউ দেখতে আসে না, কোনো খবর রাখে না, তাকে কতদিন পোষা যায়? ততদিনে সেলাই শুকিয়ে গেছে ঠিকই কিন্তু ভেতরের দগদগে ঘা আজীবনও শুকাবে না—একথা শমসের ভালো করেই জানতো। জীবন তাকে সুযোগ দিয়েছে, যদিও এ সুযোগ আনন্দিত হওয়ার মতো নয় মোটেও। অবশ্য অ্যাক্সিডেন্টে একটা জিনিস খুব ভালোভাবেই তার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেছে, জীবন-মৃত্যুর মালিক আসলে এ দুনিয়ার কেউ নয়, হ্যাঁ কেউ একজন আছেন যে আড়াল থেকে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছেন, না হলে কি আর শমসের বাঁচে?
‘ওই ছেমড়ি, রিকশায় ওড, কাইল সকালে তোর মুন যেদিকে চায়, সেদিকে চইলা যাবি, ওড।’
হাসপাতাল থেকে ছুটি দেওয়ার পর প্রথম তিনদিন সে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ গেটে এক প্রকার পড়েই ছিল, তবু হাত পাতেনি কারও কাছে। তার হাতই নেই তো হাত পাতবে কিভাবে? মানুষ তাকে ভিক্ষুক মনে করে দয়াপরবশ হয়ে তার সামনে কিছু খুচরা পয়সা দিয়ে গেছে। এই পয়সায় অবশ্য কেউ হাত দেয়নি। টাকা ছাড়া হাত-পা ওয়ালা মানুষই পঙ্গু, আর সে তো! কিন্তু পেট তো কোনো কথা শোনে না। পাশের চায়ের দোকানদারকে ডেকে একটা পাউরুটি আর একটা কলা দিতে বলেছিল সে, দোকানদার প্রথম দিন সমাদর করে তাকে খাইয়েও দিয়েছিল, বিনিময়ে তার সামনে পড়ে থাকা পয়সা থেকে রুটি আর কলার দাম নিয়েছিল। চতুর্থ দিন তার পাশের ভিক্ষুক, বোবা—হামেরা কাছে ঘেঁষার চেষ্টা করেছিল। দোকানদারের কাজটা সে-ই করে দিয়েছে। সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত আসে এটাই নিয়ম, কিন্তু শমসের কী করবে? প্রায় তিনদিন সে পড়ে ছিল হাসপাতালের গেইটে। পাশেই ভিক্ষার বাটি হাতে দাঁড়িয়ে থাকত হামেরা। শেষে সে-ই শমশেরকে তার সঙ্গে নিয়ে যেতে চাইলে শমসের না করেনি। কিছুদিনের মধ্যেই তারা একটা দলও গড়ে তোলে, এই দলে অনেকে আসে, কিছুদিন থাকে তারপর নতুন দল তৈরি করে চলেও যায়। কিন্তু হামেরা আর শমশের কেউ কাউকে ছেড়ে যায় না, তাদের এই জোট বাঁধার বয়স তাও প্রায় তের চৌদ্দ বছর হয়ে গেলো।
এই মাইয়া, পেছন পেছন কী করতে আসছোশ?’
অবাক হয়ে শমসের হাওলাদারের দিকে তাকিয়ে থাকে জোমেলা, চমকে ওঠে, ভয় হয় তার। এ লোক কিভাবে বুঝল, সে তো রাস্তা দিয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে এগিয়ে এসেছে, তাহলে সে দেখল কখন? অবাক জোমেলা সকল জড়তাকে গিলে নিয়ে শক্ত থাকার চেষ্টা করে বলে, ‘কুণ্ঠে… কুণ্ঠে.. হামি ফের কুণ্ঠে?? না… হামি… হামি তো রাস্তাঘাট, না না চিনহি তো… এ এদিকে য্যাছিনু…।’
‘শোন মাইয়া, গত এক যুগ এই শহরের রাস্তায় গড়াইয়া গড়াইয়া চলত্যাছি, এই শহরের নাড়ী নক্ষত্র সব আমার চেনা, আমারে মিছা কথা কস ক্যান?’
‘মিছা কথা কোহোবো কেনে?’ ইতস্তত জোমেলা, এদিক-ওদিক তাকায়।
‘শোন বেডি, ল, আমগো লগে ল…’ ডান পায়ের গোড়ালি না থাকা সুকমন বলে ওঠে।
‘কী কোহিছেন, আপনারঘে শোঁতে যাবো কেনে?’ জোমেলা বুঝে উঠতে পারে না, কী করবে সে? এরা তাকে নিয়ে যেতেই বা চাইছে ক্যানো?
‘উ- উ, উ-উ’ জোমেলার দিকে একটা বিস্কুটের প্যাকেট এগিয়ে দেয় বোবা হামেরা।
জোমেলা হাত বাড়িয়ে দিয়েও গুটিয়ে নেয়। হ্যাঁ এটা ঠিক, খুব ক্ষুধা পেয়েছে তার, খুব পিপাসাও পেয়েছে।
‘খাও, খাইয়া লও…’ ছয় সাত বছরের বাচ্চা মেয়েটা, এতক্ষণে জানা গেলো, তার নাম কুসুম, সে বলে কথাগুলো, বলেই অর্ধেক পানিসহ ছোট বোতলটা এগিয়ে দেয় তার দিকে।
‘এই বেডি ল, খা… আমগো লগে ল…’
‘কী কোহিছেন, আপনারঘে শোঁতে যাবো কেনে?’ বিস্কুটের প্যাকেট আর পানির বোতলটা হাতে নেয় জোমেলা।
‘যাওন লাগবো না তোর। জা ভাগ এহান থে, মাগি আবার গরম দেহায়, ওই কুসুম রিকশা ডাক।’ শমসের হাওলাদারের অভিজ্ঞতা বলে, এ শহরে এই মেয়ের যাওয়ার কোনো জায়গা নেই।
অন্ধ ছেলেটা কিছু দেখতে না পেয়েও সব কিছু দেখছে, তার মুখভঙ্গি তেমনই বলে। মরতে চেয়েও মরা হয়নি জোমেলার। সে এখন বাঁচতে চায়, দেখে নিতে চায়, জীবন তাকে কতদূর নিয়ে যেতে পারে। তবু বুঝে উঠতে পারে না, তার কী করা উচিত। কিছুক্ষণ আগেই পুলিশের বদ ইঙ্গিতে কিছুটা ঘাবড়ে গেছে জোমেলা। এদিকে রাত বড় হচ্ছে, আলো ঝলমল করলেও অন্ধকার বাড়ছে। এই শহরে রাত বড় হতে থাকা মানে নাকি নিজের কাছে নিজেই অচেনা হয়ে যাওয়া, আকল আলী বলেছিল।
‘লও গেলমান বাই, ওডো।’চঞ্চলমতি কুসুম হাত ধরে তাকে রিকশায় ওঠায়।
‘গেলমান?’ জোমেলার জানা হলো এই অন্ধের নাম। কী অদ্ভুত নাম, ‘গেলমান।’ জোমেলার খুব জানার ইচ্ছে হয়, পাম্পের বাথরুম থেকে ফিরে এসে তাকে না পেয়ে আকলের কি অবস্থা হয়েছিল? হয়তো কিছুক্ষণ এদিক-ওদিক খুঁজেছে, একে-ওকে জিজ্ঞেস করেছে, হয়তো বা এসবের কিছুই করেনি, হয়তো সে গ্রামে ফিরে যাবে বলে ঠিক করেছে, আবার এমনও হতে পারে তাকে খোঁজার জন্য সে শহরে এসেছে। ‘ধুররও, যা ইচ্ছা তাই করুক গা আকল।’কিন্তু কী সিদ্ধান্ত নেবে জোমেলা? সে কি শমসের হাওলাদারের কথামতো তাদের সঙ্গেই যাবে? বুঝতে পারে না, ঠিক সেদিনের মতো, যেদিন ছয় বছর বয়সের জোমেলাকে ফাঁকি দিয়ে তার মা শান্তি খুঁজতে চোখ বুজেছিল।
রিকশায় ওঠানো হয় শমসের হাওলাদারকে। রিকশাওয়ালা, ডান পায়ের গোড়ালি না থাকা সুকমন আর বোবা হামেরা, এই তিনজনে ধরে এমনভাবে তাকে রিকশায় তুললো। দেখে মনে হলো তিনজন মানুষ ধরাধরি করে একটা আটার বস্তা তুললো রিকশায়। শমসের হাওলাদারের পাশে গিয়ে বসলো হামেরা। এই পর্যন্ত দেখে যা মনে হলো, এই দলে শমশেরের পরেই হামেরার কর্তৃত্ব।
আরেক রিকশায় গিয়ে উঠলো ল্যাংড়া সুকমন। জোমেলা তখনো ফুটপাতেই। হঠাৎ শমসের হাওলাদার গম্ভীর গলায় বলে উঠলো, ‘ওই ছেমড়ি, রিকশায় ওড, কাইল সকালে তোর মুন যেদিকে চায়, সেদিকে চইলা যাবি, ওড।’
ঢাকা শহরের আলো-আঁধারীর ধোঁকা কাটিয়ে এগিয়ে চলছে তিনটা রিকশা, গন্তব্য কোথায়—জানে না জোমেলা।
রিকশার সিটে জড়সড়ো হয়ে বসে আছে জোমেলা। তার পাশেই বসে আছে ল্যাংড়া সুকমন। জোমেলা সাহস পাচ্ছে না তাকে কিছু জিজ্ঞেস করার। ‘কী রে বেডি, এমুন বেক্কলের লাহান বইসা আছো ক্যান? সুন্দর কইরা বয়।’ নীরবতা ভেঙে বলে ওঠে সুকমন।
‘তোমারে একটা কথা পুছ করব?’ চলন্ত রিকশা থেকে নড়বড়ে শহরটাকে দেখতে দেখতে বলে জোমেলা।
‘কী জিগাইবি, জিগা দেহি।’
‘তুমি কি ঐ ল্যাংড়ার বহু?’
একথা শোনামাত্রই খিক খিক করে হেঁচকির তোলার মতো করে হেসে ওঠে সুকমন, হাসি থামতেই চায় না। হাসতে হাসতেই বলে সুকমন, ‘কী কইলি? ব-উ?’
‘উ তাহিলে তোমার কে হয়?’ একদিনও হয়নি জোমেলা এ শহরে এসেছে। শীত সন্ধ্যায় ধরাতে না পারা চুলা থেকে কুণ্ডলী পাকিয়ে ওঠা ধোঁয়ার মতোই মনে হচ্ছে শহরটাকে।
‘কে? হ, কে? কে? তাইতো! কে?’
নিয়নের লালচে আলোয় এই শহরের চেহারা কেমন যেন হয়ে যায়, মনে হয় পুরো শহরটা জণ্ডিসে আক্রান্ত। সুকমন অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে থাকায় তার মুখের ভাষাটাও দেখতে পায় না জোমেলা। ‘শোন, এহানে কেউ কারও কিছু হয় না, মানে সম্পর্কের দিক দিয়া। আর আমগো এহানকার নিয়ম, কারও সম্পর্কে জিগান যাইতো না, বুজছস?’ কথাগুলো বলতে বলতে কোমরে গুঁজে রাখা পলিথিনের প্যাকেট থেকে একটা পানের খিলি বের করে মুখে পুরে নেয় সুকমন।
‘মানে? এট্যাঁ কি কহিলা জি বু?’
‘কী কইলি? বু? তোরে না কইলাম, এইহানে আমরা কেউ কারও না?’ একথা বলেই জোমেলার দিকে মুখ ফিরিয়ে কিছুটা ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে সুকমন, জোমেলার কুনইয়ের ভাঁজ দিয়ে নিজের হাতটা ঢুকিয়ে দেয় সুকমন, ‘জোমেলা? তুই তো একডা আগুন রে বেডি!’ বুঝে উঠতে পারে না জোমেলা, ‘আগুন?’ এই প্রথম জোমেলার নাম ধরে ডাকে সুকমন।
‘হ, আগুনই তো।’
‘আগুন মানে কী জি? হামার কি জ্বর কইর্যাছে নাকি জি বুবু?’ সুকমনকে খুব আপন মনে হয় জোমেলার। কত সহজেই অচেনা অজানা মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক তৈরি হয়, আবার খুব সহজেই চিরস্থায়ী সম্পর্কগুলো হ্যারিকেনের চিমনির মতো হুট করে ভেঙেও যায়। বাপের কথা মনে পড়ে যায় জোমেলার, মনে পড়ে যায় আকল আলীর কথা, সবচেয়ে মনে পড়ে তার মা-র কথা।
‘হ জ্বরই তো’—বলেই আবার খিক খিক করে হেসে ওঠে সুকমন। ‘শোন জোমেলা, তোর শরীর রূপের আগুনে জ্বলতেছে। সাবধানে থাহিস।’
এতক্ষণে সবকিছু পরিষ্কার হয় জোমেলার কাছে, ‘বু, হামার মোধে কী আছে, হামি জানি না, সেট্যাকে রূপ কহো আর যা কহো, কিন্তু এট্যা জানি, এটাই হামার বড় শত্রু। তুমিই কহো, শত্রুর সোঁতে কতখন বাস করা যায়।’
‘হ, মাইয়া মাইনসের বড় শত্রু হইলো শইল, তার মধ্যে রূপের বারুদ ঢুকাই দিলে সেইটা তো বোমের মতোন, বুঝছস?’ পানের পিক ফেলার জন্য মুখ বাড়িয়ে রাখা অবস্থায় কথাগুলো বলে সুকমন
‘বুবু, হামি এর ল্যাগ্যাই পালিয়্যা অ্যাস্যাছি।’ সংশয় গাঢ় কুয়াশার মতো ঘিরে ধরছে জোমেলাকে।
‘তুই তো কাইলকাই যাবি গা, ঠিক কইছি?’ সুকমন এবার সরাসরি জোমেলার খয়েরি চোখের দিকে তাকায়। মনে মনে আল্লাহকে দোষারোপ করতে থাকে, ‘আল্লাহ ক্যান গরিবের ঘরে এমুন সুন্দর মাইয়ার জন্ম দিলা? তুমি মাঝে মাঝে এমুন সব কাম করো না!’
‘চোল্যা যাবো।’
‘কই যাবি?’
‘জানি ন্যা কুণ্ঠে যাব।’ অনিশ্চিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে জোমেলা। সুকমন আরেকটু গভীর আলীঙ্গনে জড়িয়ে ধরে তাকে।
চানখারপুলের জীর্ণ পুরাতন একটা দোতলা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায় রিকশা। দোতলা মানে, নিচ তলায় দুই রুম, ওপরে একটা। গলা সমান ইটের বাউন্ডারি ঘিরে রেখেছে বাড়িটিকে। সবাই এক এক করে রিকশা থেকে নামে। তারপর ধরাধরি করে শমসের হাওলাদারকে নামিয়ে গেটের ভেতর নিয়ে যায়। বাড়ির সামনে আঙিনাসমান ছোট্ট একটা জায়গা। সেখানে একটা টিউবওয়েল। শমসের হাওলাদারকে নিয়ে টিউবওয়েলের পাড়ে একটা বিশেষ ধরনের চেয়ারে বসানো হয়। সেখানে আগে থেকেই বালতি ভরা হালকা গরম পানি, ডেটল সাবান, ক্লিয়ার শ্যাম্পু নিয়ে প্রস্তুত থাকে। সুকমন, হামেরা, গেলমান নিচতলার ঘরে প্রবেশ করে। কুসুম দাঁড়িয়ে আছে, সে শমসের হাওলাদারের গোসলের তদারকি করছে। দুই জন মধ্যবয়স্ক নারী খুব যত্নের সঙ্গে শমসের হাওলাদারকে গোসল করাতে থাকে। সন্ধ্যা ইতোমধ্যে গড়িয়ে পড়েছে রাতের দিকে। জোমেলা অবাক হয়, সে ভাবতেই পারেনি এরা এমনভাবে, এমন বাড়িতে থাকে।
ময়লার ভাগাড় থেকে বাচ্চাটিকে তুলে আনতে ইশারা করে শমসের। হাত-পা ছুড়ে একটু প্রতিবাদ করবে সে সক্ষমতাটুকুও ছিল না শিশুটির।
‘অই কুসুম, ওরে ভিত্রে নিয়া যা।’ অস্বস্তির মধ্যে পড়ে জোমেলা। ‘তুমি এহনও এহানে দাঁড়ায় আছো? চলো, চলো। ঘরের ভিত্রে চলো।’ গোসল শেষ হলে আবার ধরাধরি করে শমসেরকে নিচ তলার ঘরে আনা হয়, সবাই একসঙ্গে খাওয়া দাওয়া করে। খাওয়া শেষ হলে দোতলায় তোলার জন্য একটা বড় লোহার গামলায় বসানো হয় শমসেরকে, গামলার চারদিকে চারটি ফুটো করা, সেই ফুটোতে শক্ত দড়ি বাঁধা। দেখে অনেকটা দাঁড়িপাল্লার মতো মনে হয়। নিচ তলার ঘরের ছাদের একটা অংশ গোল করে কাটা, সেখানে দিয়ে দড়ি বাঁধা গামলাটা দোতলার ছাদে ঝোলানো একটা রিং-এর সঙ্গে আটকানো। কুয়া থেকে বালতি দিয়ে যেভাবে পানি তোলা হয় ঠিক সেভাবেই দোতলার ঘরে তোলা হয় শমসেরকে। বাইরের দিকে আলাদা একটা এক পায়া সিঁড়িও আছে। দোতলার ঘরে যাওয়ার অনুমতি আছে শুধু হামেরা আর কুসুমের।
পরের দিন সকালে শমসের হাওলাদার জোমেলাকে জিজ্ঞেস করে, এ শহরে তার চেনাজানা কেউ আছে কি না। উত্তর জানে শমসের, তবু শুনে নিতে চায় জোমেলার মুখ থেকে। কোথাও যাওয়া হয় না জোমেলার। তিন দিন ধরে সে এখানে, এই বাড়িতেই। সকাল এগারোটার দিকে শমশের হাওলাদার তার দল নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। একেক দিন একে সময়ে ফেরে, তবে বেশিরভাগ সময়ে সন্ধ্যার আগেই ফিরে আসে। এর মধ্যে অবশ্য একদিনও সঙ্গে নেয়নি জোমেলাকে। জোমেলা জানে, একদিন না একদিন তাকেও বেরুতে হবে শমসের হাওলাদারের সঙ্গে। ভেতরে ভেতরে নিজেকে প্রস্তুত করে সে, শমসের নিশ্চয় বসিয়ে বসিয়ে খাওয়াবে না তাকে।
খুব বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয় না। একদিন রাতে খাওয়া দাওয়া শেষ হলে সবাইকে দোতলায় ঘরে আসতে বলে হাওলাদার। সুকমনের কাছে জোমেলা শুনেছে, মাঝেমাঝে মিটিং করে হাওলাদার। জোমেলা এ-ও শুনেছে, হাওলাদার মানুষ হিসেবে খুব একটা খারাপ না, গালিগালাজ করে, তবে প্রত্যেকের মজুরি বুঝিয়ে দেয়—এক টাকার হিসাবও এদিক ওদিক করে না, এমনকি সেই টাকা কে কোথায় কিভাবে খরচ করছে, বা কেউ বাড়িতে পাঠাচ্ছে কি না, তার খবরও রাখে না হাওলাদার। কারও অসুখ-বিসুখ অথবা অন্য যেকোনো সমস্যা, হাওলাদার এতটুকুও অবহেলা করে না, নিজে হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করে, খরচাপাতি যা, সবকিছুই সে-ই দেয়। সুকমন বলেছে, হাওলাদার ভালোই টাকা পয়সা জমায়, সব কুসুমের নামে জমায়।
সকলেই মেঝেতে বসে আছে। জোমেলাও তাদের সঙ্গেই বসেছে। সবার মুখের দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে কথা আরম্ভ করে শমসের হাওলাদার। সুকমন বা হামেরা কেউই কিছু বুঝতে পারে না দোতলার ঘরে মিটিং করার কারণ। অবশ্য কোনোদিনই হাওলাদারের আচার আচরণের কোনোটাই ধরতে পারেনি তারা। সুকমন বা গেলমান সবার দিকেই সে কোনো না কোনোভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে, উদ্ধার করেছে তাদের। হাত না থাকলেও যে হাত বাড়িয়ে দেওয়া যায়, তা শমশেরের সঙ্গে না চললে বোঝা যাবে না।
আর কুসুম! একদিন খুব সকালে বুয়েটের খেলার মাঠ আর ঢাকা মেডিক্যালের মাঝখানের রাস্তা দিয়ে একটা রিকশা করে হাসপাতালে ভর্তি সুকমনকে দেখতে যাচ্ছিল শমশের আর হামেরা। হঠাৎ রিকশাওয়ালাকে দাঁড়াতে বলে সে। হামেরা বুঝতে পারেনি, কী জন্য রিকশা দাঁড় করালো শমসের। রিকশা থামিয়ে, রাস্তার পাশের ময়লা ফেলার জায়গাটার দিকে যেতে বলে হামেরাকে। হামেরা এগিয়ে গেলে অবাক হয়ে দেখে একটা সদ্যজাত শিশু। কাঁদছে, কিন্তু তার কান্নার স্বর এত ক্ষীণ, পৃথিবী তা শুনতে অক্ষম। ময়লার ভাগাড় থেকে বাচ্চাটিকে তুলে আনতে ইশারা করে শমসের। হাত-পা ছুড়ে একটু প্রতিবাদ করবে সে সক্ষমতাটুকুও ছিল না শিশুটির। মায়ের পেট ছিঁড়ে বেরিয়ে আসা শিশুটি তখনো নাভির বর্ধিত অংশটি বয়ে বেড়াচ্ছে এবং সেই ছেঁড়া অংশ থেকে ফোঁটায় ফোঁটায় রক্ত বেরুচ্ছে, যেন সে খুব করে চাইছে তার শরীর থেকে বিষাক্ত শেষ রক্তবিন্দুটিও যেন ঝরে পড়ে। শমসের বাচ্চাটিকে নিয়ে রিকশায় বসতে ইশারা করে হামেরাকে। হয়তো কোনো কুমারী মা নিজের সতীত্ব টিকিয়ে রাখতে বলি দিয়েছে শিশুটিকে। শিশুটিকে নিয়ে ঢাকা মেডিক্যালের ইমার্জেন্সিতে যায় শমসের এবং তাকে নিজের বাচ্চা বলে পরিচয় দেয়, তার নাম রাখে ‘কুসুম’।
‘আমার কুসুমরে স্কুলে ভর্তি করামু। স্কুলের হস্টেলে থাকব অই, মাঝেমইধ্যে বাড়িত আসবো।’ কথাগুলো বলে অবিশ্বাসী দৃষ্টিতে সবার মুখের দিকে তাকায় শমসের, তার কথাই যে শেষ কথা, একথাও সে ভালোভাবেই জানে। হামেরাকে হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে বুঝিয়ে বলে শমসের। প্রায় দশ বছর একসঙ্গে থাকতে থাকতে হামেরার সব কথা বোঝে শমসের, আবার হামেরাও খুব ভালো মতোই বোঝে শমশেরের ইশারা।
‘আমি স্কুলে যামু! হহ আমি পড়মু, পইড়া হাসিনা ম্যাডামের মতোন হমু, আব্বা। আব্বা বাড়িত থাইকা পড়ন যায় না?’ কিছুটা দ্বিধান্বিত কুসুম, যদিও তার চোখমুখ জ্বলজ্বল করে ওঠে। কুসুমকে কদাচিৎ দলের সঙ্গে নিয়ে যেত শমসের, হয়তো মাসে একদিন। সিদ্ধান্ত হলো কুসুমকে এ মাসেই একটি আবাসিক স্কুলে ভর্তি করানো হবে।
হামেরাকে ইশারায় বসতে বলে বাকিদের নিচ তলায় নেমে যেতে বলে শমসের। সবাই উঠে দাঁড়ায়। গেলমানের হাত ধরে কুসুম। সুকমন খোঁড়াতে খোঁড়াতে এগোতে থাকে সিঁড়ির দিকে। জোমেলা উঠে দাঁড়ালে তাকেও বসতে বলে শমসের। জোমেলা অবাক হয়।
‘জোমেলা, আমাকে বিয়ে করতে তোর আপত্তি আছে?’ শমসের ইশারায় কথাগুলো হামেরাকেও বোঝায়। জোমেলা কিছুই বুঝে উঠতে পারে না। উজ্জ্বল হয়ে ওঠে হামেরার মুখ।
‘সময় নিয়ে ভেবে উত্তর জানাবি। রাজি না হলেও সমস্যা নেই, তোর এখানে থাকা নিয়ে কোনো সমস্যা হবে না। এমনকি তোকে অন্যদের মতো আমার দলের সদস্য হয়ে ভিক্ষাও করতে হবে না। যাদের শরীরে কোনো অপুর্ণতা নাই তাদের ভিক্ষা করা ঠিক না।’শমশেরের মুখ থেকে শুদ্ধ উচ্চারণের কথা শুনতে কেমন জানি লাগে জোমেলার।
দু’জনেই নেমে আসে নিচ তলায়। ‘সে কেন শমসেরকে বিয়ে করতে যাবে? কিন্তু’ ভাবনার ঘুড়ি উড়তে উড়তে গোত্তা মেরে নিচে পড়ে যায়, কুল খুঁজে পায় না।
আমি তোগোরে ওপর থাইকা দেহুম, তোগোরে মেলামেশা করা অবস্থায় দেখলেও আমার মনের স্বাদ পূরণ হইবো বউ, আমিও তহন নিজেরে গেলমান ভাবুম
দিন পাঁচেক পর জোমেলার বিয়ে। সবচেয়ে খুশি হয় কুসুম। বিয়ের পর মা পাবে, এই আনন্দে উড়ে বেড়াচ্ছে সে। অবশ্য বিয়ের তিন দিন পরেই সানরাইজ স্কুল অ্যান্ড কলেজের হোস্টেলে চলে যেতে হবে তাকে। প্রতি সপ্তাহে কুসুমকে একবার করে দেখে আসবে জোমেলা, আর মাসে দুই দিনের জন্য বাড়ি আসতে পারবে সে।
বিয়ে হওয়া চার দিন হয়ে গেলো শমশের ও জোমেলার। এক অদ্ভুত কুয়াশাঘেরা সম্পর্ক তাদের। এর মধ্যেই জোমেলাকে একটা সোনার চেইন কিনে দিয়েছে শমশের। নতুন শাড়ি, জামাকাপড়, কসমেটিক্স—এগুলোও দিয়েছে।
হামেরা বছরে একবার করে গ্রামের বাড়ি যায়। কুসুমকে হোস্টেলে রেখে আসা হয়েছে। শমসেরকে দেখাশোনার জন্য তো জোমেলা থাকলোই। এখনই বাড়ি যাওয়ার জন্য ভালো সময়, সুকমনেরও ইচ্ছা হয় বাড়ি থেকে ঘুরে আসার। তাদের গ্রামের বাড়ি কাছাকাছি।
বাড়িতে একজন কাজের বুয়াও আসে। সন্ধ্যার আগে কাজ শেষ করে চলে যায় সে। যাওয়ার আগে সবাই মিলে শমসেরকে দোতলার ঘরে তুলে দেয়। শমসের আজ জোমেলাকে সাজতে বলে, যদিও কোনো প্রসাধন ছাড়াই জোমেলাকে হুরের মতো লাগে দেখতে।
আয়নায় দাঁড়িয়ে নিজের চেহারা দেখে অবাক হয় জোমেলা। সত্যি সে এত সুন্দর! শমশেরের বিছানায় এসে বসে জোমেলা। অবাক বিস্ময়ে জোমেলাকে দেখতে থাকে শমশের।
‘আল্লাহ তোরে এত রূপ দিয়া ক্যান পাঠাইছে রে?’
‘ঢঙ করিয়েন না হাওলাদার সাহেব’—এ কথা বলেই স্বামীর বুকে নিজের সরু আঙুলগুলোকে মুক্ত করে দেয় সে, খেলুক ওরা, ইচ্ছেমতো খেলুক শমশেরের বুকের অনুভূতিতে।
‘বউ, তুই আইজ নিচের ঘরে গিয়া থাক। আমি ছাদের পাটাতন খুইলা রাখুম, ভয় পাইস না, যা, যা বউ।’
‘কেনে নিচের ঘরে য্যায়া শুতবো কেনে?’ ঝটকা মেরে নিজেকে সরিয়ে নেয় জোমেলা, রাগে থরথর করে কাঁপতে থাকে। মা মারা যাওয়ার সময় তার বয়স ছিল কুসুমের সমান, দিনে দিনে একটু একটু করে বড় হইছে সে। এরমধ্যেই বাড়িতে সৎ মা এসেছে, জোমেলার বাপ তাকে নিয়েই ব্যস্ত থেকেছে। সদ্য যৌবনপ্রাপ্ত জোমেলার দিকে যখন চোখ পড়েছে, তখন নিজের মেয়ের দিকেও হাত বাড়াতেও দ্বিধা করেনি সেই পশুরুপী মানুষ। ঘৃণায় জোমেলার মন বিষিয়ে উঠেছিল, বাড়ি ছাড়ার আগে সে নিজের বাপকে বিষ খাইয়ে রেখে এসেছিল।
‘বউরে, এক্সিডেন্ট আমার বউ বাচ্চার লগে লগে আমার শরীর থাইকা আরও অনেককিছু কাইড়া নিয়া গ্যাছে, দ্যাখ, দ্যাখ। কিন্তু আমার মনডা তো জীবিত আছে রে, হে-য়ে তো অনেক কিছুই চায়।’
নিজেকে ধরে রাখতে পারে না জোমেলা। চিকন সুরে কাঁদতে আরম্ভ করে। এই দুনিয়ায় নিজেকে কেমন অবাঞ্ছিত মনে হয়।
‘দ্যাক বউ, গেলমান আন্ধা মানুষ, ওই তোর এই রূপের কিছুই দেখবো না। ওর লগে যহন মেলামেশা করবি তহন ওর জায়গায় আমারে ভাইবা নিস। যা আইজ গেলমানের লগে…, যা বউ, তোর জোয়ান শরীর, তুই উপোষ থাকবি ক্যান? জোয়ান শরীররে উপোষে রাখলে শরীর খারাপ করে। আমি তোগোরে ওপর থাইকা দেহুম, তোগোরে মেলামেশা করা অবস্থায় দেখলেও আমার মনের স্বাদ পূরণ হইবো বউ, আমিও তহন নিজেরে গেলমান ভাবুম, যা বউ যা…নিচের ঘরে যা।’