সেমাদুল হকার প্রতি রবিবার ফিল্ডের হাট আর বুধবার বারঘরিয়া হাটে তার সবুজ ব্যাগ থেকে ডুগডুগি বের করে ডুগডুগি বাজাতে শুরু করে বিকেল পাঁচটা সাড়ে পাঁচটার দিকে। অন্তত, আমাদের বয়স যাদের তিরিশ বা তার চেয়ে একটু বেশি, তারা দেখে আসছি। এর কামাই নাই।
হাটের নির্দিষ্ট স্থানে এসে জিনিসপত্র গুছিয়ে বসে। তারপর নিজে একটা বিড়ি ধরায় আর একটা বিড়ি ধরিয়ে দেয় বানরটাকে। বানর যখন বিড়ি টানে, তখনই লোকজন এসে জমা হতে থাকে। সে তার ডুগডুগিটা বাজায় ডুগ ডুগ ডুগ। বহুদূর চলে যায় তার ডুগডুগির ডুগ…ডুগ…ডুগ…। বাজারে বসে থাকা বেকার আর সুবিধামতো সর্বপ্রকার লোক হাজির হতে থাকে।
এ অঞ্চলের হাট-বাজারগুলোতে এ ডুগডুগ শব্দ যুগ যুগ ধরে বাজছে তার হাতে। কয়েক পুরুষ ঘুরে এ ডুগডুগি তার হাতে এসে ডুগ ডুগ করে বাজছে আর ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে। চারদিক এসে হাজির হয় তার দিকে। সে বিড়ি টানে। কারও কোনো বিকার নাই। বানর বিড়ি টানে। মানুষ হাসে।
বানরের বিড়ি শেষ হলে ফেলে দিয়ে পা চাপা দিতে যায়। পায়ে বিড়ির আগুনের আঁচ লাগে বা লাগার ভান করে। মুখ চোখের ভঙ্গিমা পরিবর্তন করে ফেলে, ভাবটা এমন, উফ্ পা পুড়ে গেলো। মানুষ বানরের মুখভঙ্গি দেখে হাসে। বানর সেমাদুলের স্যান্ডেল জোড়া হাতে পরে হেঁটে এসে বিড়ির আগুন চাপা দেয়। মানুষ বানরের বুদ্ধি দেখে বিস্মিত হয়ে স্মিত হাসে।
সেমাদুল বানরের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘ওরে চেতন, মুসলমানেরা কিভাবে নামাজ পড়ে, দেখিয়ে দাও তো বাবা দর্শক ভায়াদের।’ সে তার বানরের নাম দিয়েছে চেতন। বানর সেমাদুলের বুকপকেট থেকে টুপি বের করে নিয়ে মাথায় পরে। নামাজ পড়ার মতো করে সেজদা দেয়। বানরের নামাজ পড়া দেখে মানুষ মজা পায়, হাসে, বাহবা দেয়। ‘আচ্ছা বানর বাবা. দেখাও দেখি দর্শক বাবা-ভাইদের, হিন্দুরা তাদের দেবীমার সামনে কিভাবে দাঁড়িয়ে থাকে।’ বানরটা চোখ বন্ধ করে জোড়হাতে দাঁড়িয়ে থাকে ভক্তিভাব মুখে তোলে। লোকজন আনন্দ পেয়ে হাতহালি দেয়। ‘আচ্ছা বাবা চেতন, দেখাও দেখি চোর কিভাবে চুরি করার জন্য গৃহস্থের ঘরে ঢুকে।’ বানর চোরেদের মত এদিক ওদিক তাকিয়ে, লাফিয়ে সেমাদুলের হাতে থাকা বাঁশের রিং পার হয়ে চলে যায়। সেমাদুলের আগে থেকেই ফেলে রাখা রুমাল তুলে নিয়ে লাফ দিয়ে আবার রিং পার হয়ে চলে আসে। মানুষ অবাক-বিস্ময় নিয়ে বানরের খেলা দেখে। একটা করে খেলা শেষ হয় আর সেমাদুলের ডুগডুগি বেজে ওঠে ডুগডুগ করে।
মাঝে মাঝে সেমাদুল মজার মজার কথা বলে একটা করে আর ডুগডুগি বেজে ওঠে। আবার বানর খেলে। চার আনা, আট আনা, একটাকা পড়ে বানরের পায়ের কাছে। বানর টাকা আয় করে। বানরের আয়ে সেমাদুলের সংসার চলে। বাড়িতে তার বউ আছে, একটা মেয়ে আছে। সেমাদুল বানরটাকে ছেলের মতোই দেখে। লোকে যদি জিজ্ঞাসা করে, ‘বাড়িতে মুখের কটা?’ সেমাদুল বলে, ‘চারজন।’
সেমাদুলের কথা বলার ভঙ্গি, শব্দচয়ন আর অঙ্গভঙ্গি সবই মানুষজনকে আনন্দ দেয় নিখাদ। মাঝে মাঝে সে ছোট ছোট রূপকথা, ঐতিহাসিক, কোরানিক, পুরানিক গল্প বলে। মানুষ চুপ করে শোনে। তার চুম্বককথা আঁটকে রাখে মানুষকে।
সে গল্প বলে, ‘ভাইসকল, মন দিয়ে শুনুন, সব মানুষ মানুষ নয় কিন্তু সব বানর বানরই। শুদ্ধ একেবারে।’
ডুগডুগিতে তাল তুলে আবার বলে, ‘শুনেন ভাইয়েরা, বহু বহুদিন আগে দুনিয়াতে শুক্রবারে সবকাজ করা বন্ধ ছিল। কারণ শুক্রবার হলো পবিত্রবার। এদিন সারা দুনিয়া সৃষ্টি করার পর আল্লা-তায়ালা আরশে আজিমে বিশ্রাম নেবার জন্য আসীন হন। সেদিন সমগ্র সৃষ্টি তাকে সেজদা করে। তাই সেদিনটাকে আল্লাহ বিশেষ মর্যাদা দিয়ে বিশ্রামবার হিসেবে ঘোষণা করে আর সকল কর্ম নিষেধ করে। শুধু ধর্মকর্ম করার দিন সেটা। কিন্তু কিছু লোক নিষেধ অমান্য করে নদীতে মাছ ধরছিল। নদীর ধার দিয়ে যারা নামাজ পড়ার জন্য মসজিদে যাচ্ছিল, তখন ঐসকল নিষেধ অমান্যকারীদের বলে, এই বান্দরেরা আজ শুক্রবার জানিস না, পবিত্র দিন। আজ দুনিয়াবি কাজ বন্ধ।তাদের বানর বলার সাথে সাথে মাছ ধরা মানুষগুলো বানর হয়ে যায়।’
তার গল্প মানুষজন মোহিত হয়ে শোনে। বানরটা পিটপিট করে তাকায় সেমাদুলের দিকে। সব মানুষ বানরের দিকে তাকায়। বানরের চোখ দেখে, মুখ দেখে বোঝা যায় না, সে এ গল্প বিশ্বাস করেছে কি না।
আবার ডুগডুগি বেজে ওঠে। আবার কথা বলে ওঠে সেমাদুল, ‘কিন্তু ভাই, বানরকে আমি বানর বলি না। বানুষ বলি। বানর আমার কাছে মানুষের মতোই লাগে। শুধু কথা বলতে পারে না। আর এ বানর মানুষকে সালাম করতে পারে, মানুষকে নমস্কার করতে পারে।’ সেমাদুল বানরের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘বানুষ, মুসলমান ভাইদের সালাম কর দেখি।’ বানরটা হাত তুলে কপালে ঠেকিয়ে সালাম করে। কারও কারও সঙ্গে হ্যান্ডশেকও করে। সেমাদুল বানরকে আবার বলে, ‘বানুষ, এবার হিন্দু দাদাদের নমস্কার করো দেখি।’ বানর নমস্কার করে।
সেমাদুল আবার বলতে শুরু করে, ‘ভাই সকল, সকল মানুষকে আমি মানুষও বলি না। অনেকেই আছে দেখতে মানুষ কিন্তু আসলে মানুষ নয়। তাদের আমি মানর বলি।’ সে একটা দুটা করে বাক্য বলে আর ডুগডুগি বাজায়। এতে তার বক্তব্য আরও ঘন, গাঢ় আর বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠে। সে বলতে থাকে, ‘ঐ গল্প শুধু গল্প নয় ভাই। শিক্ষা আছে। এর মানে বানরের ভেতর মানুষ আছে আর মানুষের ভেতর বানর তো ছিলই। যারা বানর হয়েছিল তারা বানরই থেকে গেছে আর বেশি শয়তান হবার সুযোগ পায়নি। কিন্তু মানুষ অনেক সময় পেয়েছে আরও বেশি শয়তান হবার। এমনকি মানুষ শয়তানের থেকেও বেশি শয়তান হতে পেরেছে।’ তার ডুগডুগি ডুগডুগ করে তার বক্তব্য সমর্থন করে, বক্তব্যকে আরও সমর্থ করে তোলে।
এরপর থেকে বেলাল প্রায় সেমাদুলের কাছ থেকে নিশিলীলা নেয় । সেমাদুল কোনো প্রশ্ন করে না।
সে আবার গল্প শুরু করে, ‘মানুষ যে কত শয়তান তার একটা গল্প শুনুন ভাইয়েরা। একবার একটা মাঠ দিয়ে যাচ্ছিল শয়তান। সেখানে কয়েকজন রাখাল বালক খেলা করছিল। শয়তান ভাবল, এদের নিয়ে একটু মজা করে নিই, তাদের দিয়ে কিছু খারাপ কাজ করিয়ে নেয়া যায় কি না দেখি। শয়তান একটা ঘোড়ার রূপ ধরে শান্তভাবে তাদের পাশে ঘুরতে থাকে। রাখাল বালকেরা দেখল, খুব শান্ত একটা ঘোড়া তাদের পাশাপাশিই হাঁটাহাঁটি করছে। একজন সাহস করে গিয়ে ঘোড়ার পিঠে উঠে বসে। ঘোড়ারূপী শয়তান শান্ত থাকে। তারা দেখল, ঘোড়া কিছুই বলছে না। কয়েকজন ঘোড়ার পিঠে চাপাচাপি করে উঠে বসে। তখনো কয়েকজন চাপতে পারেনি ঘোড়ার পিঠে। যারা ঘোড়ার পিঠে চড়তে পারেনি তারা বলল, আমরাও উঠতে চাই। যারা আগে উঠেছিল তারা বলে, বসার মতো জায়গা নেই ঘোড়ার পিঠে। তাদের মধ্যে ঝগড়া লাগার উপক্রম। ঘোড়া মিটি মিটি হাসে। তাদের মধ্যে মারামারিও শুরু হয়। ঘোড়া মনে মনে হাসে। কিছুটা রক্তপাত হয়। ঘোড়া ভেতর ভেতর বেদম খুশি। কিন্তু একজন বলল, ঝগড়া করিস না। একটা বুদ্ধি বের করেছি। ঘোড়ার পাছায় একটা বাঁশ ঢুকিয়ে দিলে জায়গা সবার হবে। সাথে সাথে তারা একটা বাঁশ নিয়ে এসে ঘোড়ার মলদ্বারে ঢুকিয়ে দেয়। যারা ঘোড়ার পিঠে চড়তে পারল না তারা মলদ্বারে প্রবেশ করানো বাঁশে চড়ে বসে আর ঘোড়াকে দাবড়াতে থাকে। ঘোড়ারূপী শয়তানের তখন ত্রাহি মধুসূদন অবস্থা। সে হঠাৎ মরার ভান করে পড়ে যায়। রাখাল বালকেরা মরা ঘোড়া রেখে চলে আসে। ঘোড়ার রূপ পরিবর্তন করে শয়তান স্বগতোক্তি করে, ‘শয়তানি করার জন্য আমার এ জগতে থাকার দরকার নাই। মানুষই আমার চেয়ে বড় শয়তান হয়ে আছে।’
সেমাদুল হকার শুধু বানর খেলা আর গল্প শোনায় না, এসবের ফাঁকে ফাঁকে বিভিন্ন রোগের ওষুধও বিক্রি করে। আমবাত, জামবাত, গেঁটেবাত, কটিবাতসহ ছত্রিশ প্রকার বাতের ওষুধ পাওয়া যায় তার কাছে। তার কাছে পাওয়া যায় ‘নিশিলীলা’ নামের কামের বিশেষ ওষুধ। এ ওষুধ খেলে রাতের নারী চুল দিয়ে পুরুষের পা মুছে দেবে। পুরুষকে বলবে, দেবতা। বলবে, প্রভু। লোকজন তার ওষুধ কিনে নিয়ে যায়। নিশিলীলা ওষুধ বিক্রি হয় সবচেয়ে বেশি। লোকজন খেলা দেখে, গল্প শুনে, ওষুধ নিয়ে টাকা পয়সা ফেলে দেয় মাটিতে, কেউ কেউ বানরের হাতে ধরিয়ে দেয়। পয়সা কুড়িয়ে এনে বানর সেমাদুলের হাতে তুলে দেয়। সেমাদুল টাকা পয়সা ছোট একটা থলিতে ঢুকিয়ে থলির মুখ বেঁধে কোমরে গুজে বাড়ির দিকে হাঁটা দেয়।
তার বাড়ি ঢোকার আগে একটা মোড়। মোড়ে চা মিষ্টির দোকান। এখানে এসে বানরকে বিস্কুট কিনে দেয়। বানর কুট কুট করে বিস্কুট খায়। ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে বিস্কুটের গুঁড়ো। দোকানদার ক্যাশবাক্সের কাছে বসে থাকে। বানরের দিকে তাকায়। এ দোকানে দুগ্রাম দূরের বাইশ তেইশ বয়সের একটা ছেলে কাজ করে। সেমাদুল ছেলেটার দিকে তাকিয়ে বলে, ‘বাবা বেলাল একটা লাল চা দে দেখি।’ বেলাল টুং টাং শব্দ তুলে লাল চা তৈরি করে। চা এনে দেয়, ‘এই নেন চাচা, চা খান।’ সেমাদুল চায়ে চুমুক দেয়। বানর সেমাদুলের চা খাওয়া দেখে পিটপিট করে। কখনো বেলাল বানরের সাথে দুষ্টুমি করে একটু একটু, ‘কী রে বান্দর চা খাবি না কি!’ বানর কখনো কখনো দাঁত খিঁচিয়ে তাকায় তার দিকে, কখনো তাকিয়েও দেখে না।
বাড়িতে ঢুকার পর বানরকে বারান্দায় বেঁধে রাখে লোহার শেকলে। রাতের খাবার দেয়। নিজে রাতের খাবার খায়। তারপর আবার একটা চা সিগারেট খেতে ইচ্ছে করে সেমাদুলের। মেয়েটাকে বলে, ‘শেফালি মা, মোড় থেকে একটা চা নিয়ে আয় না।’ মেয়েটা ছোট পেন্সিল ব্যাটারির লাইট নিয়ে বাবার জন্য চা আনতে যায়। ব্যাপারটা এত বেশি নিয়মিত যে কোনো কোনোদিন বেলালই চা নিয়ে চলে আসে পলিথিনে করে, ‘এদিক দিয়েই তো যাচ্ছিলাম বাড়ি। ভাবলাম, চাচার চাটা দিয়েই যায়।’ সে কিছুক্ষণ গল্প করে। কিছুক্ষণ বানরের সঙ্গে ফাজলামি করে। বানর রেগে গিয়ে বেলালকে মারতে, আঁচড়াতে আসে। বেলাল সরে যায়, বানর বাধা পায় শেকলে। শেকল ঝন ঝন করে ওঠে। শেফালি লণ্ঠনের মৃদু আলোর ভেতর খিল খিল করে হেসে ওঠে। বেলাল তার হাসিতে মজা পেয়ে আরও মজা করে বানরের সঙ্গে। বানর দাঁত খিঁচায়।
একদিন খেলা দেখিয়ে আসছে সেমাদুল। মোড়ের চায়ের দোকানে চা খাবার জন্য ঢুকে। বেলাল লাল চা দিয়ে যায়। চা খেয়ে, টাকা দিয়ে বের হয়ে কিছুটা হেঁটেছে এমন সময় মনে হয়, তার পিছে পিছে কেউ আসছে। সেমাদুল পেছন দিকে তাকায়। অন্ধকারের মধ্যে চিনতে পারে, বেলাল। সেমাদুল থামে। বেলাল, ‘ফিস ফিস করে বলে, চাচা নিশিলীলা ওষুধ লাগবে।’ সেমাদুল বলে, ‘তুমি কি বিয়ে করেছ, তুমি এ ওষুধ কী করবে?’ বেলাল বলে, ‘না, চাচা আমার জন্য নয়, আমাদের গ্রামের লোকের জন্য। আমার চেয়ে বড় কিন্তু আমার সাথে বন্ধুর মতই চলাফেরা। সেই আনতে বলেছে।’ সেমাদুল তার ব্যাগ থেকে এক প্যাকেট নিশিলীলা বের করে দেয়। টাকা নিয়ে নেয়। এরপর থেকে বেলাল প্রায় সেমাদুলের কাছ থেকে নিশিলীলা নেয় । সেমাদুল কোনো প্রশ্ন করে না।
বাবার জন্য প্রায়ই চা কিনতে যায় সেমাদুলের মেয়ে, ‘বেলাল ভাই লাল চা দাও।’ বেলাল লাল চা দেয় শেফালির হাতে, ‘এই নে শেফালি চা। একটা মিষ্টি খাবি নাকি?’ শেফালি না করলে, বেলাল একটু জোর করেই বলে, ‘আরে নে, খা, মালিক নেই, একটা মিষ্টি খেলে কিছু হবে না। আর থাকলেই বা কী, আমি কি তোকে একটা মিষ্টি খাওয়াতে পারি না?’ শেফালি মিষ্টি খেয়ে চা নিয়ে বাড়ি ফিরে। কোনো কোনো দিন শেফালি ইয়ারকি করে তার সঙ্গে, ‘তোমার নাম বেলাল, তবে তুমি লাল চা কর কী করে?’ ইয়ারকি করে শেফালি ফিচফিচ করে হাসে। বেলাল উত্তর করে, ‘আমার নাম বেলাল হোক, কিন্তু আমি লাল চা দুধ চা দুটোই সমানভাবে করতে পারি।’ শেফালি ‘দুধ চা-ও বানাতে পারি’ শুনে লজ্জা পায়।
সেমাদুল চা খায়। চা খেয়ে সেমাদুল ঘুমাতে যায় বিছানায়। শেফালি তার ঘরে ঘুমুতে যায়। শেফালির মা বাড়ির কাজ শেষ করে সেমাদুলের পাশে শোয়। বানরটা বসে বসে ঢুলে। মাঝে মাঝে শুয়ে পড়ে। কখনো কখনো পিটপিট করে অন্ধকার বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকে। ছুচো, ইঁদুরের চলা ফেরা দেখে। রাতে মাঝে মাঝে ছায়াদের হাঁটা চলা দেখে। আবার ঘুমায়। ভোর নেমে আসে বানরের চোখে, বানুষের চোখে।
দিন শুরু হয়। প্রস্তুতি চলে সেমাদুলের নতুন কোনো হাটে খেলা দেখানোর পরিকল্পনা করে। বিকেলে বের হয় সেমাদুল আর বানর, আয় করার জন্য। সংসার চালানোর জন্য। প্রতিদিন দুপুরের আগে পর্যন্ত বানরটাকে নতুন নতুন খেলা শেখানোর চেষ্টা করে। বানরটা নতুন নতুনভাবে মানুষকে নকল করার চেষ্টা করতে থাকে। একটা খেলা শিখতে অনেক সময় লেগে যায়।
২
[এ গল্পের জন্ম সেমাদুলের জন্য নয়। সেমাদুল কোনো গল্প তৈরি করতে পারে না। সে গল্প হয়ে, বানরওয়ালা হয়ে, গল্পি হয়ে, হকার হয়ে মানুষের মুখে মুখে ঘুরে বেড়ায়। এ গল্পের জন্ম অন্য কারণে। এ গল্পের জন্ম জন্মের জন্য।]
বানরটা প্রচণ্ড জোরে একটা চড় খেলো। বানরটা এর আগে সেমাদুলের হাতে মার খায়নি এমন নয়। খেলা শেখানোর সময় অন্যকিছু করে বসলে, অমনোযোগী হয়ে গেলে গালি খেয়েছে, ছোটখাটো মার খেয়েছে সেমাদুলের হাতে। কিন্তু এবারের চড়টা অন্য যতগুলো চড়-থাপড় খেয়েছে, তার চেয়ে ওজনে অনেক ভারী, কারণ অনেক আলাদা। এ চড় খাবার ব্যাপারটা ঘটল বিচারের পর সন্ধ্যার ঠিক আগেখানে।
শেফালি আর থামতে পারে না তোতলাতে থাকে, ‘বে… বে… বে… বেনর… বানর… বানরটা… এ বাচ্চা বানরের।’
সেমাদুলের কুমারি মেয়ে শেফালি একটা বাচ্চার জন্ম দিয়েছে পৃথিবীতে। এ বাচ্চা জন্মের জন্যে গ্রামের বড় পুকুরের পাশে ফাঁকা জায়গাটাতে বিচারটা বসে যায়। কুমারি শেফালি মা হয়েছে শুক্রবারের দিন। আজ রবিবার বিচার সভা। কী থেকে কী হয়েছে, সেসব বিত্তান্ত বিচারে জানা হবে। পরশু বাচ্চা হয়েছে, কালকে প্রচার হয়েছে, আজকে বিচার। তার শরীরের অবস্থা ভালো না, মেয়েটাকে তারপরেও আসতে হলো বিচারের পুকুরে, পুকুর পাড়ে।
লোকজন প্রথমেই জানতে চাইল, ‘বাচ্চাটির বাবা কে?’ শেফালি চুপচাপ। সেমাদুল আর তার বউও তার গর্ভের কথা জানতে পারার পর বহুবার জানতে চেয়েছে কিন্তু বলেনি। বাচ্চাটা নষ্ট করতে বলেছে কিন্তু করেনি। চুপচাপ সরে গেছে, চুপচাপ থেকেছে। এখনো চুপচাপ। আবার একই প্রশ্ন করা হলো, ‘আরে কথা বলছিস না কেন বজ্জাত মেয়ে, বাচ্চাটার বাবা কে?’ সে আবারও চুপচাপ। বিচারের লোকেরা রেগে মেগে একাকার। গালিগালাজ কোনো কিছুতেই কিছু হয় না। কিন্তু এতগুলো মানুষের চাপ থামাতে সে কতক্ষণ পারবে। মানুষের কথার ঝড় চলে তার ওপর দিয়ে। কথাঝড়ের তোড়ের ভেতর সে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। মানুষের কথার বন্যা আর কথাজলের বন্য ঢেউ চলে তার ওপর, সে হাবুডুবু খায়, শ্বাস নিতে পারে না। বাজখাই গলায় মাতবর আবার চিৎকার দিয়ে ওঠে, ‘আর সহ্য করব না, এবার পিটুনি শুরু করব, বলে দে, বাচ্চাটার বাবা কে?’ শেফালি আর থামতে পারে না তোতলাতে থাকে, ‘বে… বে… বে… বেনর… বানর… বানরটা… এ বাচ্চা বানরের।’ লোকজন স্তম্ভিত হয়ে থাকে। কথা বলেই, শেফালি পালাতে থাকে। পালাতে পালাতে বাড়ি চলে আসে। লোকজন স্তম্ভিত। ভীত, সন্ত্রস্ত্র, রাগে শেফালির বাবা শেফালির পিছু পিছু বাড়ি চলে আসে। বাচ্চাটা কাঁদছিল, কুমারি ঘরে ঢুকে, স্তন গুঁজে দেয় অনভ্যস্তভাবে, আনাড়িভাবে। বাচ্চাটার কান্না থামে। চুপচাপ কুমারির স্তন চুষে শান্ত হয়ে।
সেমাদুল বাড়িতে ঢুকে বানরের কাছে গিয়ে বানরকে কষে চড় মারে। বানরটা বিস্মিত হয়ে যায়। কিছু বুঝে উঠতে পারে না। সেমাদুল বানরের দিকে অগ্নিদৃষ্টি হেনে বলে, ‘তুই একাজ করতে পারলি!’ এবার বানরটা তার বিস্ময় কাটিয়ে ওঠে। তার চোখ দিয়ে ঝর ঝর করে জল পড়ছে। তার জল দেখে কেউ বুঝতে পারছিল না, কেন বানরটা কাঁদছে। হতে পারে সে কাঁদছে অনুতাপে। হতে পারে সে কাঁদছে তার মালিক তাকে অবিশ্বাস করেছে বলে। হতে পারে সে কাঁদছে চড়টাতে অনেক ব্যথা পাবার কারণে।
সেমাদুল রাগে ক্ষোভে বের হয়ে যায় বাসা থেকে। যেদিকে দুচোখ যায় চলে যাবে। আর ফিরবে না। কোনো মানরে বা কোনো বানুষে তার বিশ্বাস নাই। মানুষ বলে কিছু নাই জগতে। সবেই বিশ্বাসঘাতক, পাতক, সুবিধা চাতক।
বানরটার শেকল আলগা ছিল না। সেমাদুলকে চলে যেতে দেখে শেকল ছেঁড়ার জন্য জোর শুরু করে। বেলালের দুষ্টুমিতে তাকে শায়েস্তা করার জন্য বহুবার সে এমনভাবে শেকল ছেঁড়ার চেষ্টা করেছে, পারেনি, শেকলে ব্যথা পেয়েছে শুধু। কিন্তু আজকে শেকলটা দ্রুতই খুলে গেলো। সে ছাড়া পেয়ে সেমাদুল যে দিকে হেঁটে গেছে সেদিকে দৌড়াতে থাকে। চেতন নামের বানর সেমাদুলের পায়ের ছাপ ঠিক চিনতে পেরে গেছে। সেমাদুল ডুগডুগিটাও নেয়নি। বানরটা ডুগডুগি নিয়েই তার পিছু পিছু ছুটছে। বানরের দৌড়ে হাতের ডুগডুগি এলোপাতাড়ি বাজছে। ডুগডুগির শব্দে পেছন ফিরে তাকায় সে, দাঁড়ায় সে।