[পর্ব-চার]
পদ্মার ঘোলা জলে নিজের লজ্জাবনত মুখের দিকে ঝুঁকে, আবির ছড়ানো সূর্য, মস্ত গোল আগুনের চাকতি হয়ে যেন তুলে আনতে চায় নিজের প্রতিবিম্বকেই, নদীর বুকে জাগা ঢেউয়ের চুলে বিলি কাটতে থাকে হাওয়া আর জলের ওপর মিহিন সোনালী কুয়াশা বিছিয়ে দেয় গোধূলি। ঝিকমিকিয়ে ওঠে পদ্মার ভরন্ত শরীর। সেদিকে তাকিয়ে আবিষ্ট, মোহাচ্ছন্ন হয়ে ওঠে তিতলি। অরুন্ধতী পাশে বসে বাদলের সঙ্গে বকবক করেই যাচ্ছে অবিরাম। মাথা ধরিয়ে দিচ্ছে একদম। এত বকতে পারে মেয়েটা! বাদল হুঁ হ্যাঁ করছে মাঝে-সাঝে। অন্যমনস্ক। তারও চোখ দূরে। অন্য কোথাও। অরুন্ধতীর সে নিয়ে মাথাব্যথা নেই তেমন। সে বকে যাচ্ছে। লতিফা বানুর সঙ্গে স্বভাবগত কিছু মিল আছে তার। জিনগত সাদৃশ্য! লতিফা বানু কারণে অকারণে বকতে ভালোবাসতেন খুব। মাঝে মাঝে খুব বিরক্ত হতো তিতলি। অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ে তার।
লতিফা বানুর শেষকৃত্য সেরে আজ ফিরছে তারা। শোক কেটে গেছে অনেকটাই। বাদল এখন অনেকটা স্বাভাবিক। তবে গম্ভীর। প্রয়োজন ছাড়া কথা তেমন বলছে না। অবশ্য, তিতলির সঙ্গে অপ্রয়োজনে কথা তার কমই হয়, বরাবরই। অরুন্ধতী কিছু একটা জানতে চাইছে, বুঝতেই তার দিকে মনোযোগ ফেরায় তিতলি। নদীর দিকে আঙুল তুলে কিছু একটা দেখিয়ে সে বলছে, বাবা! ওটা কী? ও বাবা! বলো না, কী ওটা?
তার নির্দেশিত দিকে চোখ রেখে দেখে তিতলি, শুশুক! একটু মাথা তুলেই ভুস করে ডুবে যাচ্ছে আবার। একটু পর আবার ভেসে উঠছে জলে।
বাদল বলে, ওটা শুশুক। একধরনের জলজ প্রাণি। তিমি দেখেছ না তুমি? ডলফিন, তারপর ধরো সিল মাছ, ওরকম আর কী!
অরুন্ধতীর কৌতূহল এত অল্পে মেটে না। কী খায় ওরা, কেমন করে খায়, কোথায় থাকে, ওদের নাম শুশুক কেন ইত্যাকার প্রশ্নে হাঁফ ধরিয়ে দেয় বাদলকে। শেষে তিতলির ধমকে সে ক্ষান্ত হয়।
কাল কি অফিস করতে হবে তোমাকে?
–প্রশ্নটা বাদলকে করে।
হ্যাঁ। অনেকদিন তো অফিস কামাই হলো পরপর।
—অন্যদিকে তাকিয়ে উত্তরটা দেয় বাদল। বাসের মধ্যে এমন আলাপ নিতান্তই খাপছাড়া, অপ্রয়োজনীয় লাগে তিতলির। তবু নীরবতার অস্বস্তি কাটাতেই মূলত কথা বলা। একটু সহজ হওয়া দরকার। অস্বস্তিকর পর্দাটা সরিয়ে দেওয়া প্রয়োজন খানিকটা। অরুন্ধতী এখন অনেকটাই কাটিয়ে উঠেছে লতিফা বানুর শোক। শিশু সে, তার মনে জল দাঁড়ায় না, গড়িয়ে যায়। কিন্তু বাদল হারিয়েছে তার মাকে। তার ক্ষতটা গভীর, অমোচনীয়। এ ক্ষত মোছে না, সময়ের একটু প্রলেপ পড়ে শুধু। সে চেষ্টাই করে তিতলি। এ ক্ষত অচেনা নয় তারও। সে জানে, কোথায় গিয়ে বেঁধে তীর! যে জননেন্দ্রীয় ফুঁড়ে আলো দেখে মানুষ, সে-ই জননী! তার প্রতি যে ভালোবাসা, পৃথিবীর আর কারও প্রতি কি তা জন্মে মানুষের? সম্ভবত, না! অভিজ্ঞতাটা নেই তিতলির। তাই সংশয়, সন্দেহ। সে শুধু বাবাকে জানতো। তার উন্মাদ, পাগল বাবা!
বাবার মুখটা মনে পড়তেই কেমন একটা কষ্ট বাষ্প হয়ে উঠে আসতে চায়। জমে যেতে চায় চোখে। সাবধানে চোখ ফিরিয়ে ফের জানালা দিয়ে দিগন্তরেখায় রাখে সে। বাবা নেই। ক’বছর হলো? নয়? না, আট। অরুন্ধতী এক বছরের যখন, তখন মারা গেছেন বাবা। অরু ন’য়ে পড়েছে।
—তুমিও কি অফিস করবে কাল?
—হ্যাঁ, তেমনই ভাবছি। বাদলের প্রশ্নের উত্তরে বলে তিতলি। তারপর বলে, অরুরও স্কুল কামাই গেল অনেকদিন। এমনিতেই পড়াশোনায় মন নেই। তারপর আবার গ্যাপ পড়ে গেলো। ক’দিন পরই পরীক্ষা।
অরুন্ধতী প্রতিবাদ করে সরবে।
—ইস! মা! তুমি না! আমার বুঝি পড়ায় মন নাই?
—নাই তো! তোর মিস তো এই সেদিনও এত্ত কমপ্লেইন করলো তোর নামে! শুধু মারামারি করিস ক্লাশে!
—আমাকে কেউ মারলে আমি তাকে ছাড়ব কেন? তোমাকে কেউ মারলে তুমি ছাড়বে তাকে?
—আমাকে কেউ কেন মারবে? আমি কি তোর মতো বাঁদরামি করে বেড়াই?
—বাবা! দেখোনা! মা আবার আমাকে বাঁদর বলছে! বাদলের দিকে তাকিয়ে আহ্লাদে যেন গ’লে যেতে চায় মেয়ে। বাবার দিকে সরে গিয়ে বলে, আমি বাঁদর হলে তুমি তো তবে বাঁদরের মা! বড় বাঁদর!
হো হো হেসে ওঠে বাদল। তিতলি কটমট করে তাকায় মেয়ের দিকে। অরুন্ধতী ভেঙচি কেটে বাবার দিকে সরে বসে আরেকটু। মেঘ কেটে যায় অনেকটা। বাদল মেয়েকে আদর করতে করতে বলে, অরুর পরীক্ষাটা শেষ হলে আমরা কোথাও থেকে ঘুরে আসব এবার। তুমি অফিসে বলে আগেই ম্যানেজ করে রেখো।
—কোথায় যাবে?
—সিলেট কিংবা কক্সবাজার। সময়টা আগে ম্যানেজ করি। জায়গা নিয়ে পরে ভাববো।
অরুন্ধতী হৈ হৈ করে ওঠে আনন্দে। পারলে এখনই বেরিয়ে পড়ে সে। তিতলি তাকে থামায়।
—যদি পরীক্ষাটা ঠিকঠাক মতো দাও, কোনো কমপ্লেইন যদি স্কুল থেকে না আসে আর তাহলেই যাব শুধু। নইলে যাওয়া ক্যানসেল, মনে রেখো!
—আমি একটুও দুষ্টুমি করব না, দেখো তুমি!
—আচ্ছা! দেখা যাবে!
কলকল করে কথা বলে যায় মেয়ে। বাবাও এবার তার সঙ্গে যোগ দেয়। মানুষ শোকের ভার বেশিক্ষণ বইতে পারে না। হালকা হতে চায়। বাদলও নিজের অজান্তেই চাইছে হয়তো। কিংবা সচেতনভাবেই। হোক। তিতলিও চায় সহজ, স্বাভাবিক হোক বাদল। মা’র সঙ্গে অন্য সন্তানদের তুলনায় একটু বেশি হৃদ্যতা ছিল তার। ছিল অন্যরকম টান। টের পেতো তিতলি। ভেতরে ভেতরে একটু ঈর্ষা আর অভিমানও ছিল তার। লতিফা বানু বাদলের মা, সে কি কেউ নয়! তার প্রতি একটুও কি টান থাকতে নেই বাদলের! নেই। তিতলি টের পায়। তার প্রতি বাদলের যেটুকু টান তা জৈবিক। অন্য যে কেউ যদি তার স্ত্রী হতো, এই টানটুকু সেই তার প্রতিও থাকতো বাদলের। কিন্তু, সে, তিতলি, আলাদা একজন মানুষ হিসেবে, আলাদা এক ব্যক্তিস্বত্তা হিসেবে একটু কি মনোযোগ পেতে পারে না বাদলের কাছে? পারে না কি একটুও ভালোবাসা পেতে! বাদল সে-সব বোঝে না। সে জানে, তিতলি তার স্ত্রী! শেকল পরানো পাখি! তাকে খাঁচার মধ্যে তিন বেলা জল আর আহার দিলেই চলে! হাওয়া নিষ্প্রয়োজন! আলোও! তার ডানা ছাঁটা! চাইলেও উড়তে পারবে না আর! কিন্তু তিতলি উড়তে চায়। সে জানে, তার আকাশ অসীম, উদার। সেখানে অন্যকারও অধিকার নেই। ইচ্ছেমাফিক ঘুড়ি সে ওড়াবে সেখানে। যেকোনো রঙা। এখানে কারও কোনো বাধা মানবে না সে, মানবে না কোনো প্রতিরোধ। তাকে যে অস্বীকার করে, তার স্বাতন্ত্র্যে যে আঘাত করে, তাকে সে ক্ষমা করে না, করবে না কিছুতেই। বাদলের প্রতিও তাই সীমাহীন ক্ষোভ তার মনে। না কি ঘৃণা? হবে কিছু একটা। অভিমান নয়, এটা নিশ্চিত। অভিমান সেখানে থাকে যেখানে ভালবাসা বাসা বাঁধে।
চলবে…
ঝিঁঝিলাগা দিনগুলো-৩॥ শিল্পী নাজনীন