ইশ্ বেয়াদবি হয়ে গেছে! হুজুরের সঙ্গে এরকম বেয়াদবি আর করা যাবে না। এটা আমার জন্য উচিত হয় নি। আমার উচিত ছিল নিজেকে হুজুরের হাতে সঁপে দেওয়া, যত বেত্রাঘাত করতে পারেন। কিন্তু না, আমি কিচ্ছু করলাম না। চুপচাপ হুজুরের পবিত্র হাতে মার খেয়ে চললাম। টুঁ শব্দটিও করলাম না। একটু নড়লাম না, চড়লামও না।
আহা! কী ভালো হুজুরটা! তার সঙ্গে আমার এমন করা উচিত হয়নি। গুরু তো! ওস্তাদ। পিতৃপ্রতিম। বেচতে পারবেন, কিনতেও পারবেন। অথচ তিনি মারলেন আর আমি সঙ্গে সঙ্গে চুপ মেরে গেলাম। মেরেছেন, ঠিক করেছেন। কোরানই পড়া দরকার। চল্লিশ মিনিট কেন চল্লিশ বছর লাগাতার পড়তে বললেও সেটাই করা আমার উচিত। কেননা আমি ছাত্র। ক্রীতদাস। তার চে’ অধম। মানুষ হওয়ার যোগ্য না। মানুষ হওয়ার জন্যই মা-বাবা মাদ্রাসায় পাঠিয়েছেন। বলেছেন, যেভাবেই হোক মানুষ বানাবেন। আমার শুধু হাড্ডিগুলো হলেই চলবে। মানুষ হতে এসে চতুষ্পদের মএতা মার না খেলে কি আর মানুষ হওয়া যায়! মাইর খাও, মাইর খাও। কেন আমি মাত্র বিশ মিনিট কোরান পড়ব? আমার তো চল্লিশ মিনিটই পড়া উচিত। কেননা হুজুর বলেছেন। তার কথা তো আল্লাহ, আল্লার নবীর পরেই। তোমার বাকি সব বিষয় পড়া হয়নি তো, তাতে কী হয়েছে! হোক সেটা কোরান-হাদিসেরই ব্যাখ্যা, সমাধান। ওসব পড়া কি আমার উচিত ছিল?
আমার উচিত ছিল কোরান পড়া। শুধুই কোরান। কোরানময় পৃথিবী। কোরানের আলোয় আলোকিত দেশ। সমাজ। পরিবার। ব্যক্তি। আহা! কী আনন্দ হবে তখন। শুধু আলো আর আলো। নূর আর নূর। একজন বেশ্যাও সে আলোয় উদ্ভাসিত হবে। আমাদের হুজুররা তাদের বিয়ে করবে। মূলত আলোকিত করবে। তাদের শরীরে আলো ঢালবে। হুজুরের শরীর থেকে যা বের হবে, সেটাই দ্যুতি। সেটাই সুবাসিত সুগন্ধিযুক্ত। কারণ, হুজুররা তো নবীর ওয়ারিশ। তার উত্তরাধিকারী। নবীর মলমূত্র সুবাসিত হলে, ভক্ষণ করলে জাহান্নাম হারাম হবে। তাহলে আমাদের ছোট ছোট নবী, যাদের আমরা হুজুর বলে চিনি, তারা তো নবীই, নবীরই ওয়ারিশ; তাদের থেকে যা বের হবে, সেটাও তো নবীর মতোই হওয়া উচিত।
আহা! তার সঙ্গে বেয়াদবি! নিজেকে আমার পশুর চেয়েও নিকৃষ্ট মনে হচ্ছে। কুত্তা। একটা বেওয়ারিশ কুত্তা। আহা! হুজুর! তিনি আগেও দু‘তিনবার মেরেছিলেন। আমি বোধহয় হুজুরের সঙ্গে মানানসই কোনো শব্দ লাগাতে পারছি না। নাদান না, বেয়াদব; মাহরুম গাশত আজ ফজলে রব। আমি কি রবের ফজল আর করম থেকে মাহরুম হচ্ছি? হুজুর যদি মনে কষ্ট পেয়ে থাকেন! হায় হায়! তাহলে আমার কী হবে?!
তিনি দু’বার মেরেছিলেন কোনো কারণ ছাড়া। না, তাতে আমার কোনো অভিযোগ নেই। হুজুর না, উস্তাদ তো। তিনি যেখানে মারবেন, সেখানটা তো জাহান্নামের আগুন স্পর্শ করতে পারবে না। আমার উচিত সমস্ত শরীরে হুজুরের বেতের দাগ বহন করে চলা। হোক না তা পাছা কিংবা লিঙ্গ। না হলে যে জাহান্নামের সত্তর গুণ বেশি উত্তপ্ত আগুনে পুড়বে। গত বছর কোরান তর্জমা করাতেন যে হুজুর, তিনি যে একজনের সঙ্গে…লা হাওলা ওলাকুওয়াতা ইল্লাবিল্লা; লাওয়াতত (সমকাম) করে ধরা পড়েছিলেন, আর তারপর যে তাকে শাস্তি দেওয়ার বদলে বড় বড় হুজুর তার বিরুদ্ধে যারা প্রতিবাদ তুলেছিল, তাদের বহিষ্কার করে; তার মানে কি এই নয়, কে জানে, হুজুর হয়তো চেয়েছিলেন তাকে জাহান্নাম থেকে বাচাঁতে। কিন্তু তারা তা বোঝেনি; এর ভেতর উস্তাদের বিশেষ বরকত আছে; আলাদা হেকমত আছে। কিংবা শৈশবে মক্তবে যে হুজুরের কাছে পড়েছিলাম, তিনি যে বড় ছাত্রদের ডেকে নিয়ে নিজের খাহেশ বা পাছার জ্বালানি কমাতেন, তা তো ছাত্রদের মঙ্গলের জন্যই। কিন্তু লোকেরা তো বোঝে না। সব বেয়াকুব। মূর্খ। নাদান। কমবখত। হুজুরদের ইচ্ছা তারা বোঝে না। পবিত্র অনুভূতি তারা সমঝে না। মঙ্গলের চিন্তা তারা জানে না।
হুজুর হয়তো আমাকে মারার বা মানুষ বানানোর চিন্তা সেদিন থেকে করছেন, যেদিন আমি একটা পড়া না বুঝলে হুজুরকে সেটা বুঝিয়ে দিতে বলেছিলাম। না, তখন আমি বা-আদব জিজ্ঞাসা করেছিলাম। কিন্তু কেন জানি না, হুজুর থমকে গেলেন। সবাই বলে, তিনি পড়া মুখস্থ করে এসে ছাত্রদের সামনে শুধু ছেড়ে দেন। এর বাইরে কেউ কোনো প্রশ্ন করলে চেতে (রেগে) যান। এটা তার শানের খেলাপ। তিনি এটা পছন্দ করেন না। এরপর অবশ্য হুজুর আমার প্রশ্নের উত্তর দিতে চেষ্টা করেছিলেন। গোঁজামিল দিয়ে, জোড়াতালি দিয়ে। আমার মন তাতে ভরেনি। কিন্তু হায়, অতৃপ্ত মন তুমি সেটা কী করেছিলে!
হুজুর সবসময় অন্ধদের পথ দেখান। কানার হাটবাজারে ঘুরেঘুরে কানাদের আলোতে আনেন। হুজুর কানার হাটবাজারের লোক
তিনি তার ভাদাইম্যার মতো চেহারা দিয়ে বান্দরের মতো মুখ বাঁকিয়ে চুরিয়ে অনেক কষ্টে ম্যাজিক দেখানোর মতো করে টক টক হাসিতে বোঝাতে চেষ্টা করেছিলেন, বা আমাকে ভর্ৎসনা করছিলেন, উম্ম্। ভালো ছাত্র হয়ে গেছে। এশকাল করে। বাবা, সাংঘাতিক, ব্যাঙ্গাতিক, ম্যাঙ্গাতিক। ভালো ছাত্র হয়ে গেছে! বলছিলেন আর বান্দরের মতো একে হাঁটুতে গুঁতাচ্ছিলেন, এর গালে ঘা দিচ্ছিলেন, তো ওর পেটে খোঁচা মারছিলেন, যে হাসছিল তার মুখ ভ্যাংচাচ্ছিলেন। আমার নাদান মনটা তখন ছটফট করছিল। একজন হুজুরের চেহারা আর আচরণ এত হাস্যকর আর নিকৃষ্ট হতে পারে, আমার অনুর্বর মগজটা তা কল্পনাও করতে পারেনি। কিন্তু হুজুরের এমন আচরণও না জানি কোন হেকমতের ইশারা। না জানি কোন কেরামতির খেলা। আমার অবুঝ মনটা তা বোঝেনি।
জাফর কিংবা আরো অনেকে দাবি করে ভাদাইম্যার সঙ্গে হুজুরের কোনো জেনেটিক সম্পর্ক আছে। নিশ্চিত। তিনি ভাদাইম্যার আপন কেউ। তা নাহলে এত মিল এত মিল, কী চেহারাসুরতে কী আচরণে কথা বলার ঢংয়ে, হায় হায় সাক্ষাৎ ভাদাইম্যা। বাড়ি একই জেলায়। কে জানে এক থানায় কি না, এক ইউনিয়নে কি না, এক গ্রামে কি না, এক পরিবারের কি না, এক মায়ের পেটের কি না।
কিন্তু আমি তাতে দোষ দেখি না। কত অসৎ ছেলেও তো মাদ্রাসায় পড়তে আসে ভালো হতে চায়। বরং সে হিসেবে মাদ্রাসাই নিরাপদ। কত চোর বদমাইশের ছেলে আল্লার ওলি হতে আসে। তাহলে এক জোকারের ভাই কিংবা স্বয়ং জোকার যদি নবীর লেবাস সুরত নিজের করে নিতে চায় তো সমস্যা কী! এছাড়া জোকারি তো খারাপ না। মানুষকে আনন্দ দেওয়া নবীজিও পছন্দ করতেন।
আমি হয়তো সঠিক শব্দ ব্যবহার করতে পারছি না। নাদান তো, মূর্খ, মূর্খের আবার লেখালেখি। কিন্তু হুজুরদের শান শওকত কীর্তিকলাপ আমরা ছাত্ররা যদি প্রচার না করি তো আর কথা কী ছিল।
আমাদের হুজুরের নাম মোবারক মাওলানা আজমতুল্লাহ। দোয়া করা উচিত, তার ছায়া দীর্ঘ হোক ( দামাত বারকাতুহুম)।
তার কষ্টও অনেক। চার্লি চ্যাপলিনও নাকি অনেক দুঃখী মানুষ ছিলেন। তাই নিজের দুঃখ ভুলে থাকতে সবাইকে হাসাহাসিতে মাতিয়ে রাখতেন। তিনি তারই অনুসারী কি না, কে জানে। সবাই কষ্ট পেলেই যে অন্যকে হাসানোর দায়িত্ব নেবে, এমন তো নয়। আমাদের হুজুর তো মানুষ বানানোর দায়িত্ব নিয়েছেন। যদিও তিনি ভাদাইম্যার অনুকরণে ছাত্রদের মজা দেন; সেটা তার অনুষঙ্গ।
তার চারটা আল্লার মাল, মানে একটা র্যাব বাহিনী, মানে বোরকাঅলা মাইয়্যা পোলাপান। বেতনও নাকি বেশি না। ৬৫০০। ২০১৭ সালে একজনের বেতন ৬৫০০। কল্পনা করা যায়! তাও আবার এতগুলা বিপরীত লিঙ্গের র্যাব বাহিনীর প্রধান হয়ে। এই জন্য নাকি তিনি আমাদের সরকার দলীয় প্রিন্সিপালের ওপর খ্যাপা। প্রিন্সিপাল সাহেব আরেক কামেল মানুষ। আল্লাহু আকবার! এতিমখানার প্রিন্সিপাল হয়ে গুলশানে কয়েক কোটি টাকা দিয়ে ফ্ল্যাট কিনেছেন। হাতে আই ফোন। এটা কারও সহ্য হয় না। কে জানে তিনি এত টাকা কোথায় পেলেন। সবাই বলে, মানে ইশারা করে, মাদ্রাসার ফান্ডের দিকে। কিন্তু আমার তা মনে হয় না। আল্লার রাস্তায় চললে আল্লাই খাওয়াবেন আল্লাই পরাবেন। গুলশানে ফ্ল্যাট তিনিই কিনে দেবেন। লোকদের কেন এত বাজে! এটা ঠিক না। আল্লাহ মেহেরবান, আল্লাহ মেহেরবান।
আচ্ছা এত কথা বলি কেন? খালি বেহুদা প্যাঁচাল হয়ে যাচ্ছে। এসব বেফজুল কথাবার্তা বলার কোনো মানে হয়? হুজুরদের এমন কীর্তিকলাপ শুনে আমাদের থ হওয়ার কী আছে!
আমরা তো নাদান। বেবুঝ। বেআক্কেল। আমরা অন্ধ। কানা। কানাই তো। আমরা কি আর এতসব কারিশমা দেখার মতো চোখ রাখি? আমাদের অন্তরের চোখ মরে গেছে। পানি শুকিয়ে গেছে। দুঃখিত। এতক্ষণ আমি আপনাদেরও শামিল করে নিয়েছিলাম। এটা ঠিক হয়নি। ভুল তো আমার। আমি কেন হুজুরের হাতে নিজেকে তুলে দিয়ে বললাম না, আমাকে আরও মারেন, আরও মারেন। আমি নাদান, আমি বুঝি না।
অন্যরা ফজরের নামাজ না পড়ে ঘুমাচ্ছিল। হুজুর তাদের কিছু বললেন না। একজন টুলের ওপর মাথা দিয়ে ঘুমাচ্ছিল, সে অবশ্য হুজুরের মসজিদে নামাজ পড়িয়ে দেয়। তাই তাকেও মারলেন না। তিন চারজন কোরান পড়ছিল। হুজুর তাদের কাউকে মারলেন না। হুজুরের কী সুন্দর চোখ। না, দৃষ্টি। তিনি ঘুমন্তদের মারেন না। কী ইনসাফ! হুজুর নিজের লোকদের মারেন না! কী ভালোবাসা! হুজুর মারেন যে চল্লিশ মিনিট কোরান না পড়ে বিশ মিনিট পড়ে। হুজুর মারেন যে কোরান না পড়ে হাদিস পড়ে, ফতোয়া পড়ে। হুজুর কানাদের মারেন। হুজুর সবসময় অন্ধদের পথ দেখান। কানার হাটবাজারে ঘুরেঘুরে কানাদের আলোতে আনেন। হুজুর কানার হাটবাজারের লোক। কিন্তু আমাদের কমবুদ্ধির আত্মা তা বোঝে না। আমাদের নাদান দিল তা জানে না।