এই খানকির পোয়া, চোখে ন দেহর? চোখ কি ঘরত রাই আসসোছ না? রীতিমতো হুঙ্কার ছাড়ে জয়নাল ভাই।
জয়নাল ভাই মানে কবি জয়নাল জিকু। বয়সে আমাদের ঢের বড়। আলাপে-আড্ডায় ভুলে যায় বয়সের ফারাক। এছাড়া যারা একই সময়ে সাহিত্যচর্চা করে, তাদের আবার ব্যবধান কিসের? কবিবরকে তাই জয়নাল ভাই বলেই ডাকি। তাতে তার অসম্মতি নেই বরং ফাঁকতালে যদি কবি জয়নাল জিকু নতুন কোনো কবি যশোপ্রার্থীর সঙ্গে পরিচিত হতে পারেন, তাতেই তিনি তৃপ্তি পান। পরিচয়পর্বে তিনি বলতে ভোলেন না, আমরা তার বয়সে বেশ ছোট, তবু মেশেন তার হৃদয় বড় বলেই। প্রতিবারের পরিচয়ের মতো এই শহরের নামকরা জনাপাঁচেক কবির নাম তিনি মুখে আনেন, স্মৃতিচারণের সঙ্গী করেন, লালদিঘির পাড়ে তাদের সঙ্গে ‘সাহিত্য সাহিত্য খেলা’র কথা সবিস্তারে বর্ণনা করেন। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ভেতরের বেদনাদের উগরে দিয়ে কপালে একচোট মৃদু থাপ্পড় খান জয়নাল ভাই নিজেই। দীর্ঘ প্রবাস তার জীবনে টাকা দিলেও কেড়ে নিয়েছে আড্ডার ধারাবাহিকতা, বন্ধুত্বের বন্ধন। তার সঙ্গে লিখতে আসা সেসব মহান বন্ধু এখন তাকে চেনে না, ফোন ধরে না, এড়িয়ে চলে ইত্যাদির ফিরিস্তি দিয়ে এক প্রকার টেনে নিয়ে যাবেন পাশের চায়ের দোকানে। কড়া লিকারে দুধ একটু বেশি হলে আর কী লাগে জয়নাল ভাইয়ের! তিনি হয়তো চায়ের নাম করে ভুলে যান তারই হাঁটুর বয়েসী ছোকরাদের সঙ্গে আড্ডায় বসার কথা। তার চিরায়ত বয়ান শুনে আমাদেরই কেউ কেউ একটু বেজার হয়—‘কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে’ আওড়ায় মনে মনে।
আজকের সময়টা একেবারে ভিন্ন, যাকে শিক্ষিতগোছের কেউ বলবেন, অপ্রত্যাশিত। রিকশাঅলার ওপর আড্ডাবাজ জয়নাল ভাই ওরফে কবি জয়নাল জিকুর এমন মেজাজে আমরাও খানিক তাজ্জব বনে যাই। যেনবা গোয়ালে থাকা শান্ত ষাঁড়টি হঠাৎই তেড়ে গেলো কাউকে ঢুঁশ মারতে। বুড়ো রিকশাঅলা, বেচারা জয়নাল ভাইয়ের লালচোখ দেখেই শেষ—বিশেষ করে আঞ্চলিক টোনে এমন গালি! রাস্তার একপাশে দাঁড়িয়ে আছে বুড়ো ক্ষমা প্রার্থনার ভঙ্গিতে। ওই রিকশার যাত্রী জয়নাল ভাইয়ের অধিক ঠ্যাডা বুড়োকে দিয়ে হেঁটে চলে যাচ্ছে তার গন্তব্যে।
চলে যান চাচা মিয়া, দেখেশুনে রিকশা চালাবেন—বলে আমি রিকশাঅলাকে ইঙ্গিত দেই রাস্তা মাপার। আমি, কায়সার, নন্দী এবার তৎপর হই জয়নাল ভাইয়ের আসলেই কিছু হয়েছে কি না, দেখতে। পাঞ্জাবির এক কোণা ছিঁড়ে গেছে একেবারে। এমন চমৎকার একটা পাঞ্জাবি ছিঁড়ে গেলে অহেতুক, কার মাথা ঠিক তাকে বলুন! অন্তত আমরা যারা, তার সাঙ্গ, তার সঙ্গে যাই হাটবাজারে, আড্ডায়, লাইব্রেরিতে, তারা জানি পাঞ্জাবিটার গল্প। আজ সকালে মাসিক নির্ধারিত সাহিত্যআড্ডায় তুলি আপাই তো বললো, জয়নাল ভাইরে পাঞ্জাবিটায় একেবারে ইয়াং লাগে, বয়স কমচে কম দশ-পনের বছর কমে গেছে জিকু ভাই! পাশেই ছিল নন্দী, তার দিকে চোখ যেতেই জয়নাল ভাইয়ের বেদিশা অবস্থা! জয়নাল ভাইয়ের মুখের কোণায় এমন হাসি নন্দী কেন আমরা কেউই দেখিনি এর আগে কখনো।
কোত্থেকে, একটা রিকশা প্রায় আমাদের গা বরাবর! ও পাশেই ছিলেন জয়নাল ভাই। ভাগ্যিস গায়ে লাগেনি কারও!
আড্ডায় কবিতা-পাঠ, আলোচনা শেষে চেরাগির দিকে খানিক ঘোরাঘুরি করা আমাদের পুরনো অভ্যেস। ভাতঘরে দুপুরের খাবার, মোড়ের মিষ্টি পান শেষে ডিসি হিলে বিকেলের সোনারোদে আরেকটু আড্ডা। ফাঁকে ফাঁকে জয়নাল ভাইয়ের বিভিন্ন পোজে কিছু ছবি নেওয়া—এমনই রুটিন আমাদের। ছবি নেওয়ার ত্রুটি তিনি সহ্য করেন না; বলেন, ছবিতে জিঁইয়ে থাকে মানুষের জীবন! এসব ফেসবুকে আপলোড দিয়ে কয়টা লাইক কমেন্ট তিনি পেলেন, তাও বলে দেন পরের দিন আড্ডায়। প্রায়ই দিনশেষে কতক আনন্দ নিয়ে বাসায় ফিরি আমরা। অথচ আজ, আনন্দের টিল্লাটি কে যেন উল্টে দেয় অদৃশ্য ইশারায়। শালার রিকশা, আর মানুষ দেখলি না গায়ে লাগার!
কায়সার আমাদের যৎসামান্য নীরবতাকে খুন করে বলে, আমি বলছিলাম, জামাল খান মোড়ে আরও কিছুটা সময় বসতে, সামনে পানির ফোয়ারা, ওদিকে খাস্তগীরের দেয়ালে বঙ্গবন্ধুসহ মুক্তিযোদ্ধাদের ম্যুরাল। যেখানে বসেছি, সামনে বনসাইঁয়ের সুদৃশ্য বনায়ন; কী লাগে আর মন জুড়াতে? আপনারা তো শুনলেন না কথা। গরিবের কথা বাসি হলেও ফলে, বুঝলেন! মুরব্বি ফলানো কায়সারকে আমিই বলি, যা কপালে আছে তা হবে, কে ঠেকাতে পারছে কবে? তখনো জয়নাল ভাই বিধ্বস্ত, পাঞ্জাবি ছেঁড়ার শোকে পাথর। চকবাজার থেকে রাহাত্তারপুল আসার রাস্তাটা হারামির হারামি। সারাক্ষণ ব্যস্ত। টমটম, রিকশা, সিএনজি অটোরিকশায় ভরপুর। তা না হয় মানা যায়, মাঝেমাঝে যে ট্রাক ঢুকে পড়ে? বড়লোকদের প্রাইভেট গাড়িগুলো খালি জ্যামই লাগায়। কত সুন্দর হেঁটে আসছিলাম আমি, নন্দী, কায়সার আর জয়নাল ভাই। বিকেলের শেষ বয়সে সন্ধ্যা আসি আসি করা সময়টা একটু হেঁটে উপভোগ করবো, তা আর হলো কই?
হাঁটছি, হাঁটছি আর কথার খই ফোটাচ্ছেন কবি জয়নাল জিকু। নানাপদের কথা। আজকের আড্ডার স্মরণীয় মুহূর্ত, লেখাপাঠ, আলোচনা, চেরাগি, জামাল খান—সবটাই ঘুরেফিরে আসছে তার কথায়। কোত্থেকে, একটা রিকশা প্রায় আমাদের গা বরাবর! ও পাশেই ছিলেন জয়নাল ভাই। ভাগ্যিস গায়ে লাগেনি কারও! তবে একটু শব্দ যেন শুনতে পাই। তা যে জয়নাল ভাইয়ের পাঞ্জাবি ছেঁড়ার হবে, তা আর জানে কে? অ্যা, এ পাঞ্জাবি পরেই জয়নাল ভাই-ঝিনু ভাবি এক হয়েছিল। দেশ-বিদেশের কত জামা জয়নাল ভাই গায়ে চড়ালেন, তবু এ পাঞ্জাবির প্রতি তার আলাদা মায়া, ভাবীই বলে, এটা পরলে তার বরকে অন্যরকম লাগে! অন্যরকম পাঞ্জাবির গায়ে আঁছড় মানে জয়নাল ভাই, ঝিনু ভাবীর কলিজায় দাগ লাগানো। এমন ব্যথায় জয়নাল ভাই মেজাজ হারাতে পারেন, তবু পথচলতি দুর্ঘটনা হিসেবে চালিয়ে নিতে আমরা তৎপর হয়ে উঠি, ঝামেলা এড়াতে, বাতচিৎ এড়াতে।
জয়নাল ভাই নীরবে হাঁটছেন, সঙ্গে আমরা তিন বেকার। আরে, আমি পাঞ্জাবির জন্য কাঁদি না!
কায়সার এতক্ষণ চুপ ছিল ভালো, এবার জেগে উঠে কী মনে করে। আচ্ছা জয়নাল ভাই, কত বছর হলো পাঞ্জাবিটা? নন্দী ওপাশ থেকে উত্তর করে, শালা কবি হতে চাস মাগার বুঝোছ না কচুটাও। মুরব্বিরা বলে না, প্রেমের মরা জলে ডোবে না! কত বছর সেটা বড় কথা না, কতদিন অক্ষত রাখতে পারলো, সেটাই বড়। ভালোবাসার নিদর্শন যতদিন সুস্থ রাখা যায়, ততদিন মঙ্গল—তুই কী বুঝবি বেকুব? আমাদের পা চলছে সামনের দিকে, গাড়ির হর্ন, জ্যাম—সবকিছুকে অতিক্রম করে আমরা চারজন অপার বেদনা বয়ে নিয়ে চলছি গন্তব্যের দিকে।
আচ্ছা, লাশ নিয়ে গেলে কেমন ভারী লাগে? আমার ভেতরে প্রশ্নটা উতালপাতাল করতে থাকে। জয়নাল ভাই নীরবে হাঁটছেন, সঙ্গে আমরা তিন বেকার। আরে, আমি পাঞ্জাবির জন্য কাঁদি না! তো? সমস্বরে আমাদের বিস্ময়মাখা ঘোর। কী বলেন কবি জয়নাল জিকু! কয়েকদিন ধরে তোমাদের ভাবীর সাথে আমার একটু গণ্ডগোল। সংসার তো করোনি তোমরা, বুঝবে না। বলেন জয়নাল ভাই—আমরা অনুরোধ করি তাকে। তিনি বলেন, আমি পাঞ্জাবির জন্য পেরেশান করি না পাগল, শ্বশুরের দেওয়া পাঞ্জাবিটার বাহানা ধরে তার কন্যে আজ কোন পেঁদানিটা আমাকে দেয়, সেটা ভেবেই…!
নন্দী, কায়সার, আমি পরস্পরের মুখ টিপে হাসি প্রায় সন্ধ্যার আবছা আঁধারেই!