বাংলামোটরের মোড়ে আপাত স্থবির যন্ত্রযানের সারির দিকে অনেকক্ষণ অর্থহীন, বোবাচোখে তাকিয়ে ছিল মৃদুল। জ্যামে আটকে পড়া গাড়িগুলোর হর্নের শব্দ, মানুষের অকারণ চিৎকার, কোনো কিছুই স্পর্শ করছিল না তাকে। নির্বোধ, জড়বস্তুর মতো ফ্যালফেলে চোখ মেলে দেখছিল নগরীর এই থমকে যাওয়া চিত্র। যেন উদ্দাম ছুটে চলা স্রোত প্রবল বাধায় থেমে গেছে হঠাৎ। স্রোত নেই, কিন্তু গর্জনটুকু আছে। আছড়ে পড়ছে নগরীর দেয়ালে দেয়ালে, প্রতিধ্বনি তুলে ফের ফিরে আসছে মানুষের কানে, হাওয়ায়, তীব্র গতিতে। আরও কতক্ষণ অমন আত্মভোলা দাঁড়িয়ে থাকতো মৃদুল, সে হিসাব মেলার আগেই সম্বিত ফিরলো তার, কনুইয়ের কাছে নরম, কোমল একটা স্পর্শ। সঙ্গে এক নারীকণ্ঠের অচেনা আমন্ত্রণ। চমকে চোখ ফেরালো মৃদুল। ভীষণ অপ্রস্তুত, থতমত হয়ে সরে দাঁড়ালো একটু।
বছর বাইশ-তেইশের তরুণী। আগ-পাশ-তলা দেখলো মৃদুল। জরিপ করলো। কপালে মস্ত কালো টিপ। পরনে সস্তা বাটিকের শাড়ি। পায়ে স্লিপার। বয়স কম হওয়ায় আলগা একটা লাবণ্য আছে মুখে, সুন্দরী বলা যায় না। সেই ঘাটতিটুকু ঢাকার আপ্রাণ চেষ্টা আছে সস্তা রঙের প্রলেপে, তাতে চেষ্টাটুকুই প্রকট হয়েছে কেবল, ঘাটতিটুকু নির্লজ্জ বেহায়ার মতো দাঁত মেলেছে আরও। সবচেয়ে বড় কথা, মেয়েটার সারা শরীরে ফুটে আছে স্পষ্ট দৈন্য। খারাপ লাগলো মৃদুলের। ততক্ষণে জ্যাম ছেড়েছে। চলতে শুরু করেছে গাড়ি। ব্যস্ত নগরী আবার ঝাঁপিয়ে পড়েছে গতির স্রোতে। মৃদুল দাঁড়িয়েছিল ওভারব্রিজের নিচে। জীবনের ঝুলিতে আরও একটা হতাশার গল্প যোগ হওয়ার তীব্রতর গ্লানি নিয়ে সে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে নগরীর নাট্যমঞ্চে নিত্যদিন মঞ্চায়িত হওয়া তামাশার চিত্র দেখছিল অনভ্যস্ত চোখে। ঠিক দেখাও নয়, তাকিয়ে থাকা। তখনই মেয়েটির আহ্বান।
কুঁকড়ে গেলো মৃদুল। তার ঘুণে ধরা মফস্বলী জীবনে এ আহ্বান খুবই অচেনা, অশোভন। কী করবে ভেবে পেলো না। তরুণী ততক্ষণে আরও কাছে ঘেঁষেছে। কোমল পাহাড়চূড়া ছুঁয়ে দিয়েছে মৃদুলের কনুইয়ের আশপাশ। নিবিড় হওয়ার চেষ্টায় মৃদুলের মুখের দিকে মোহন দৃষ্টি তুলে মৃদু, নিচুস্বরে বলছে, চলেন, দুই শ দিলেই চলবো!
ভেতরে ভেতরে ভীষণ কেঁপে উঠলো মৃদুল। ভয়ে ভয়ে তাকালো আশেপাশে। না। কারও সময় নেই এসব খেয়াল করার। যার যার ধান্দায় ছুটছে সবাই। দম দেওয়া পুতুলের জীবন নিয়ে সবাই ঘুরছে যার যার কক্ষপথে। তার চৌত্রিশ বছরের প্রায় বেকার জীবনে এ এক নতুন অভিজ্ঞতা। অস্বস্তিকর, তীব্র অস্বস্তিকর, তবু বেশ একটু রোমাঞ্চকরও। কিন্তু! তার রক্ষণশীল মফস্বলী মন কুঁকড়ে উঠলো ঘৃণায়! বেশ্যা! ছিঃ!
তারপরই কৌতুক ঝিকিয়ে উঠলো চোখে। মেয়েটা কি জানে তার পকেটে মোটে পাঁচ শ টাকার একটা নোট আর সামান্য কয়েকটা খুচরো টাকা আছে? জানলে কেমন হবে তার মুখ?
চোখ থেকে হাসি মুছে মেয়েটার মুখ থেকে চোখ সরিয়ে নিলো মৃদুল। নিচুস্বরে বললো, আমার কাছে টাকা নেই।
মেয়েটা নাছোড়বান্দা। মরিয়া হয়ে বললো, আচ্ছা, এক শ দিয়েন। চলেন।
আমারে পঞ্চাশ দিলেই হবে। যাবেন?
মেয়েটা প্রথমে বুঝলো না। চোখে চোখে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। তারপর বিশ্রী একটা খিস্তি দিয়ে চলে গেলো অন্যদিকে। মেয়েটার জন্য মায়া হলো তার। না জানি কতটা টাকার দরকার মেয়েটার! আহারে!
সঙ্গে সঙ্গে গলা ছেড়ে হাসলো। বহুদিন আগে ঠিক এমনই একটা গল্প কোথায় যেন পড়েছিল সে। মেয়েটা একশো চাইছিল, ছেলেটা বলেছিল তার এক শ লাগবে না, পঞ্চাশ দিলেই সে মেয়েটার সঙ্গে যেতে প্রস্তুত। আজ নিজের জীবনেই ঘটনাটা ঘটায় আমোদ পেলো মৃদুল। হাসির শব্দে চমকে তাকালো কেউ কেউ। কাছেই দাঁড়িয়ে থাকা বাদামওয়ালার থেকে দশ টাকার বাদাম কিনলো মৃদুল। ওভারব্রিজে উঠে একপাশে পা ছড়িয়ে বসলো অতপর। নিয়ন আলোর ঘোর লাগা হলুদ আলোয় ডুবে থাকা শহর দেখতে দেখতে বাদামের খোসা ছড়িয়ে ফুঁ দিলো আয়েশ করে। পারলে জীবনের সব অতৃপ্তি আর অপ্রাপ্তিতেও এমনি করে ফুঁ দিতো সে। উড়িয়ে দিতো হাওয়ার স্রোতে। দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো মৃদুল। গ্লানিময় বিকেলটা আবার উড়ে এলো মনের ভেতর। তীব্র অপমান আর ক্ষোভে জ্বলে গেলো বুকটা। এই নিয়ে কতবার যে হলো! একটা চাকরি যে এত দুর্মূল্য, কে জানতো। তবু আজ অনেক আশা নিয়ে এসেছিল, জোর আশ্বাস দিয়েছিলেন ভদ্রলোক। তনিমা নিজে গিয়ে তদ্বির করে এসেছিল। বারবার বলেছিল, এবার ঠিক হয়ে যাবে, দেখো।
দেখছিল মৃদুল। ইন্টারভিউ বোর্ডে ডাক পাওয়ার আগেই দেখেছিল। দামি শাড়ি পরা, ছবির মতো কয়েকজন সুন্দরী মেয়ে, প্রতিমার মতো বসেছিল ইন্টারভিউয়ের জন্য। দেখেই তাদের প্রেমে পড়তে ইচ্ছে হচ্ছিল মৃদুলের, ইচ্ছে করছিল দেবীজ্ঞানে বসে পড়ে তাদের পায়ের কাছে, প্রণাম করে বলে, বর দাও মা! যেন মরার আগে অন্তত একটা চাকরি-বাকরি হয়! তার মতো গোবরগণেশ আরও যারা ছিল, হা করে তারাও গিলছিল দেবীরূপ। মলিন পোশাক পরা সাদামাটা কয়েকটা মেয়েও বসেছিল শুকনো, ম্লান মুখে। কেতাদুরস্ত দুই-চারজন আগবাড়িয়ে সুন্দরীদের সঙ্গে আলাপ জমানোর চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে মুখ হাঁড়ি করে অপেক্ষা করছিল ডাক আসার।
ইন্টারভিউ বোর্ডে মুশকো মার্কা লোকগুলো গা-ছাড়াভাবে কয়েকটা প্রশ্ন করেছিল মৃদুলকে। সে বুঝেই গেছিল, এবারও চাকরিটা হচ্ছে না তার। মুখ অন্ধকার করে আরও অনেকের মতোই ইন্টারভিউ বোর্ড থেকে বের হয়ে এসেছিল। মফস্বলের নন-এমপিও কলেজে বেগার খাটা মৃদুল বিধবা মায়ের কাছে বহু অনুনয় করে তিনমণ ধান বিক্রি করে ঢাকায় এসেছিল এবার, অন্যসব বারের মতোই, যদি একটা চাকরি হয় তার, যদি হয় সুস্থভাবে বাঁচার একটা পথ। কলেজ এমপিও অর্ডার না পাওয়া পর্যন্ত বিকল্প একটা জীবিকা দরকার তার। তনিমা প্রেমিকা ছিল। সে এখন সরকারি চাকুরের সুখী স্ত্রী। দুই সন্তানের মা। তবু এই যে তার চাকরির জন্য এখনো বরকে দিয়ে তদ্বির করায় তনিমা, এ দুর্দিনে এটুকুই বা কম কী!
ফুটপাথঘেঁষা দোকান থেকে পাঁচ টাকার বাসি পাউরুটি কিনে ছুড়ে দেয় কুকুরটাকে। কুকুরটা কুঁইকুঁই শব্দ করে আনন্দে। কৃতজ্ঞ চোখে তাকায়। মুদুল হাঁটতে থাকে। আর বেশি দূর নেই। গতি দ্রুত করে। শওকত দেরি করে ঘুমোয় যদিও, তবু বেশি রাত করা ঠিক হবে না। কুকুরটাও পথ চলে সঙ্গে।
ফোনটা বন্ধ রেখেছিল ইন্টারভিউ বোর্ডে ঢোকার সময়। অন করেনি আর। থাক বন্ধ। যা বোঝার বুঝে যাবে তনিমা। বুঝুক। মৃদুলের চাকরি হওয়া বা না হওয়ায় তার আসবে যাবে না কিছুই। মা-ও বুঝবে। চিন্তা করবে, কষ্ট পাবে। সেসব নতুন কিছু নয়। দশটাকার বাদাম চিবুতে চিবুতে ঢাকা শহরের ঘোলাটে আলোয় বসে অগুনতি গাড়ি আর মানুষের স্রোত দেখে মৃদুল। বয়ে যাওয়া জীবন দেখে। হঠাৎই তার মধ্যে অন্য এক চিন্তার উদয় হয়। গাড়িগুলো চলছে, যন্ত্র। চালিয়ে নিচ্ছে মানুষ। মানুষগুলোও চলছে, কে চালাচ্ছে তাদের? হঠাৎ গাড়িগুলো বিকল হয়ে যায় যদি, জোড়াতালি দিয়ে চালানো যাবে আবার, নতুবা ফেলে দেওয়া হবে, আমদানি করা হবে নতুন গাড়ির। কিন্তু মানুষ? মানুষ বিকল হলে কী হয়? ফেলে দেওয়া হয়, তার জায়গাও দখল করে নতুন কেউ। তাহলে মানুষও আসলে এক যন্ত্রেরই নাম। গাড়ি। আদম গাড়ি। কী যেন একটা গান আছে না এই আদম গাড়ি নিয়ে? মনে করার চেষ্টা করলো মৃদুল। মনেও পড়তো হয়তো। তার আগেই কাঁধে একটা হাত পড়লো তার। নিয়ন বাতির ঘোলাটে হলুদ আলোয় তার কাঁধে হাত দেওয়া ছেলেটার মুখটা কেমন ফ্যাকাসে আর ভৌতিক দেখালো। মৃদুল খেয়াল করলো তার দুই পাশে দুই জন বসে পড়েছে, তারই মতো লেপটে। অদূরে দাঁড়িয়ে আছে দুই জন। এদিকেই চোখ। একই দলের। বোঝা যায়। কাঁধে হাতটা রেখে হাসি হাসি মুখে তার দিকে তাকিয়ে চাপা হুমকির স্বরে একজন বললো, ভাইজান, পকেটে যা আছে, ঝটপট দিয়া দেন। কোনো ঝামেলা কইরেন না।
পাশের জন পেছন দিক থেকে জড়িয়ে ধরে আছে তাকে। অনুভবে বোঝা যায় তার হাতের মুঠিতে পিস্তল জাতীয় কিছু একটা আছে। ওভারব্রিজ দিয়ে মানুষ নির্বিকার উঠছে, নামছে। হঠাৎ তাদের দিকে চোখ পড়লে মনে হবে তিনবন্ধু গল্প করছে জমিয়ে। মানুষগুলো নির্বিকার চলে যাচ্ছে যে যার মতো। কত ভুল দৃশ্যই যে প্রতিদিন মঞ্চায়িত হয় মানুষের চোখে, সেসব সত্যি ভেবে ভুল করে চোখ, ভেবে বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো মৃদুল। একবার ইচ্ছে হলো চিৎকার করে, লোক ডাকে। কী আর হবে! মেরে ফেলবে তাকে? গুলি করে পালিয়ে যাবে? তাতে কী এসে যায়। মা কষ্ট পাবে। আর বিশেষ কিছু ক্ষতি হবে না কারও। পরক্ষণেই মত পাল্টালো। থাক। কী-ই বা তার কাছে আছে এমন! পাঁচ সাড়ে পাঁচশো টাকা আর সস্তার একটা মোবাইল সেট। কী এমন হবে যদি নিয়ে যায় ছেলেগুলো। নিক। হয়তো তারচেও ঢের বেশি কষ্টে আছে ছেলেগুলো। হয়তো আরও বেশি অন্ধকার ছাওয়া জীবন তাদের।
ছেলেটার মুখের দিকে তাকিয়ে ম্লান হাসলো মৃদুল। মানিব্যাগ হাতড়ে বের করে দিলো টাকা। পাঁচ শ টাকার একটা নোট, দুটো বিশ টাকার ময়লা ছেঁড়া নোট আরেকটা দুই টাকার নোট, চকচকে। দোয়েলটা দাঁড়িয়ে আছে লেজ তুলে। যেন শিষ দিয়ে উঠবে যখন-তখন। অন্য পকেট থেকে সস্তার অ্যান্ড্রোয়েড সেটটাও বের করে দিলো মৃদুল। তনিমার দেওয়া। যাক। তনিমাই যখন নেই, তখন তার দেওয়া ফোন দিয়ে কী হবে!
আর কিছু নাই ভাই—মৃদু, লজ্জিত কণ্ঠে বললো মৃদুল।
মশকরা করেন মিয়া? জলদি করেন কইলাম। টাইম নাই। বাইর করেন সব, নইলে হান্দায়া দিমু—ধমকে উঠলো ছেলেটা। পিঠে এবার হালকা চাপ টের পেলো মৃদুল। পিস্তল নয়, ছুরি!
সত্যিই নাই ভাই! চেক করে দেখেন বিশ্বাস না হলে।—অসহায়, হালছাড়া কণ্ঠে বললো মৃদুল।
ছেলেদুটো চোখে চোখে তাকালো। অদূরে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেদুটোর সঙ্গে ইশারায় কী একটা বললো। তারপর—হুশ! শালা ফকিরনির পোলা—বলে ছোঁ দিয়ে পাঁচ শ টাকার নোটটা তুলে নিয়ে ম্যানিব্যাগটা মৃদুলের মুখের ওপর ছুড়ে দিলো। যেন ভীষণ অশুচি কিছু ধরছে এমন ভঙ্গিতে ফোনটা হাতে নিয়ে একটানে সিম খুলে মৃদুলের হাতে দিয়ে লাফ দিয়ে উঠে পড়লো দু’জনই। মিলিয়ে গেলো হাওয়ায়। ভোজবাজির মতো অদূরে দাঁড়ানো ছেলেদুটোও নাই হয়ে গেলো তখন তখনই। আর তখনই, ঠিক সিনেমায় দেখা দৃশ্যের মতো কোত্থেকে উঠে এলো খাকি পোশাকের এক টহল পুলিশ, সোজা দাঁড়ালো এসে মৃদুলের সামনে। ভারী, কর্তৃত্বের গলায় বললো, এত রাতে এইহানে করেন কী? এইডা জায়গা ভালা না, বাসায় যানগা।
অগত্যা উঠে পড়লো মৃদুল। নিয়নের হলুদাভ আলো মেখে ওভারব্রিজ বেয়ে নামতে থাকলো ধীরে। প্রায় সাত বছরের কলেজ শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা তার। যুক্তিবিদ্যা পড়ায় ক্লাসে। পনেরো বছরের কলেজটা প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি পেলেও এমপিওভুক্ত হয়নি আজও। নগদ চার লাখ টাকা দিয়ে ঢুকেছে চাকরিতে, স্থানীয় এমপিকে সে ও কলেজের বাকি শিক্ষকেরা জনপ্রতি দিয়েছে দেড়লাখ, এমপিওভুক্তির সুপারিশের জন্য ঘুষবাবদ। এমপি সাহেব টাকা হজম করে ফেলেছেন বহুদিন আগে, কিন্তু কলেজ এমপিওভুক্ত হয়নি আজও। ছাত্রদের যুক্তিবিদ্যা পড়িয়ে বহু যুক্তিই আয়ত্ত করেছে মৃদুল, কিন্তু কলেজ এমপিওভুক্ত না হওয়ার পেছনে সে কোনো যুক্তিই দাঁড় করাতে পারেনি। ক্লাসে বরাবর প্রথম হতো সে, তবু সরকারি কোনো চাকরি জোটাতে পারেনি শেষমেষ। কলেজেও তাকে ঢুকতে হয়েছিল টাকা দিয়ে।
টাকাগুলোই জলে গেলো! বিড়বিড় করতে করতে মৃদুল ফুটপাথ ধরে হাঁটতে থাকে শ্লথ পায়ে। ক্লাসের সবচেয়ে অগা ছাত্র ছিল শওকত। বাপের টাকায় ঢাকায় গার্মেন্টস ব্যবসা এখন তার। সুন্দরী বউ, দামি গাড়ি। আপাতত শওকতের বাসার দিকেই হাঁটতে থাকে মৃদুল। তার কাছ থেকে কিছু টাকা নিয়ে সকালে বাড়ির পথ ধরবে, ভাবে মনে মনে। এই রাতে তাকে দেখে কতটা বিরক্ত হবে শওকত আর তার বউ, ফোন না দিয়ে যাওয়া অনাহুত অতিথিকে কতটা অনাদরে বরণ করবে তারা, ভেবে নিজের মনেই কুঁকড়ে ওঠে মৃদুল। শঙ্কায় ভরে ওঠে মন। চৌত্রিশ বছরের এই প্রায় বেকার জীবনের একেকটা ইন্টারভিউ মানেই অপমানের ফিরিস্তি, কুঁকড়ে ওঠার গ্লানি। ক্লান্ত পায়ে এগোয় মৃদুল। একটা কুকুর তাকে সঙ্গ দেয়, পেছন পেছন এগোয়। ফিরে দেখে মৃদুল। ফুটপাথঘেঁষা দোকান থেকে পাঁচ টাকার বাসি পাউরুটি কিনে ছুড়ে দেয় কুকুরটাকে। কুকুরটা কুঁইকুঁই শব্দ করে আনন্দে। কৃতজ্ঞ চোখে তাকায়। মুদুল হাঁটতে থাকে। আর বেশি দূর নেই। গতি দ্রুত করে। শওকত দেরি করে ঘুমোয় যদিও, তবু বেশি রাত করা ঠিক হবে না। কুকুরটাও পথ চলে সঙ্গে। পকেটে যা টাকা আছে কিছু কিনে খাওয়া যায়, অন্তত কলা-পাউরুটি। ইচ্ছে করে না। জীবনটাই বিশাল এক ইন্টারভিউ মনে হয় তার। চলছে তো চলছেই। শেষ কবে হবে কে জানে। হঠাৎ থমকে দাঁড়ায় মৃদুল। কী একটু ভাবে। তারপর ঢুকে পড়ে দ্বিধাহীন। পার্কের বেঞ্চিতে শুয়ে পড়ে টান হয়ে। শওকত আর তার বউয়ের বিরক্ত মুখের চেয়ে এই ভালো। কাত হয়ে শুয়ে মাথার নিচে পুরনো রঙচটা ব্যাগটা রেখে ঘুমোনোর চেষ্টা করে সে। কুকুরটা অদূরে কুণ্ডলি পাকিয়ে শুয়ে পড়ে। একটুকরো বাসি পাউরুটির কৃতজ্ঞতায় মৃদুলের মাথার দিকে সতর্ক প্রহরীর ভূমিকায় ঝিমোয়।