[পর্ব-এক]
সারারাত কেটেছে নির্ঘুম। একটুও এক করতে পারেনি দুই চোখের পাতা। মাথাটা ভারী। যেন কয়েক মণ ওজন চাপানো। বিছানা ছাড়তে ইচ্ছে করে না। অবসাদ, ক্লান্তি। ঘড়ির দিকে তাকায় দীপন। সময় নেই, একদম সময় নেই। এবার উঠতে হবে। মিটিং শুরু হবে সাড়ে ন’টায়। এখন ন’টা বেজে সাত। প্রচণ্ড বিরক্তি আর হতাশা নিয়ে বিছানা ছাড়ে শেষমেষ। তাড়াহুড়োয় গরম ইস্ত্রি লেগে গেঞ্জির ফেব্রিক্স উঠে যায়। যাচ্চলে! দামি গেঞ্জিটা গেলো! তুলি গিফট করেছে গেলো বৈশাখে! শালা! কাজের চাপে রাতের ঘুম হারাম হয়ে গেছে ইদানীং। জীবনটাও এলোমেলো হতে শুরু করেছে।
মেজাজটা খিঁচড়ে আছে সকাল থেকেই। সারারাতের নির্ঘুমতার ক্লান্তি আর অবসাদে সবে একটু ঘুম ঘুম এসেছিল ভোরে, ঠিক তখনই সেলফোনটা মৃগীরোগীর কাঁপন নিয়ে জেগে যায়। অদ্ভুত নিরাসক্তি নিয়ে ফোনস্ক্রিনের দিকে তাকায় দীপন। না তাকিয়েও সে বলতে পারতো ফোনটা কার। মেয়েটা জ্বালিয়ে মারছে। অনেকদিন থেকে বিরক্ত করেই যাচ্ছে। মেজাজ ভালো থাকলে সে কথা বলে, মেয়েটাকে তখন ভালোও লাগে খুব। কিন্তু এখন, এই অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে সারারাত জেগে থাকার ক্লান্তি আর সেই সঙ্গে মাথায় চেপে থাকা অনেক চিন্তা—সব মিলিয়ে বড় অসহ্য লাগে মেয়েটাকে। ওপাশে তিতলি বোঝে না সে কথা। সে কথা বলতে চায়, ছটফট করে। কাঁদে। তার ফোঁপানি দীপনের কানে আসে। ফোন বন্ধ করে দেয় সে। মাথাটা দপদপ করে। অসহ্য। পৃথিবীটা ভারী অসহ্য!
দীপনের জন্য তার এই বোধ সহজ, স্বাভাবিক নয়। সবচেয়ে বড় কৌতুক, তার এই বোধটুকু দীপনের কাছে স্রেফ পাগলামি, মানসিক রোগ। দীপনের ভাষায়, তার চিকিৎসা দরকার
থাইল্যান্ডে আজই শেষ দিন তাদের। একটি আন্তর্জাতিক সেমিনারে এক সপ্তাহ হলো দীপন আর তার কলিগ মাহবুব ভাই এসেছেন। রাত দশটায় ফিরতি ফ্লাইট। তড়িঘড়ি গুছিয়ে নিতে হবে সব। শেষ দিনের মিটিংটায় দেরি করা চলবে না একদম। মাথায় মাত্রাহীন যন্ত্রণা নিয়ে তৈরি হতে থাকে দীপন। স্নানের পর বেশ একটু ভালো লাগে শরীর। মাথার মধ্যে তখনই চিন্তাটা ছোট্ট একটা ঢেউ তুলে হারিয়ে যায় আবার। সিলভি! মেয়েটার সঙ্গে শেষবারের মতো দেখা হলে বেশ হতো! হবে কি! দ্রুত পায়ে লাউঞ্জের দিকে এগোয়। মিটিং নির্ঘাত এতক্ষণে শুরু হয়ে গেছে।
ফিনিশিংটা ভালো হয়। বেশ ভালো। দিনশেষে টের পায় দীপন, সকালে শুরু হওয়া ক্লান্তিকর মাথাব্যথা আর একঘেয়েমির বিরক্তিটা একদম নেই। বেশ ফুরফুরে লাগে বরং। আটটায় এয়ারপোর্টে চেক ইন করতে হবে তাদের। এখন পাঁচটা। মাঝের তিনঘণ্টা বেশ আরাম করে কাটিয়ে দেওয়া যাবে। রুমে ফিরতে না ফিরতেই তিতলির ফোন। কথা বলে দীপন। মেয়েটা পাগল। এত অস্থিরতা, এত পাগলামি, দীপনের কণ্ঠ শুনলেই থেমে যায় সব। যেন জল পড়ে আগুনে। কেমন স্থির, শান্ত হয়ে সে তখন দীপনের কথা শোনে! অথচ তাকে দেখে কে বলবে, এই একটু আগেই কেমন অস্থির, অশান্ত হয়ে উঠেছিল সে!
মাঝে মাঝে ভারী বিরক্ত হয়ে ওঠে দীপন। দম বন্ধ লাগে। তিতলিকে সে বলে—এই শোনো! তুমি বরং কোনো মনোরোগ বিশেষজ্ঞ দেখাও!
তিতলি রাগ করে, কাঁদে, আবার মাঝে মাঝে সে নিজেও বলে তার সত্যিই কোনো মনোরোগ বিশেষজ্ঞের স্মরণাপন্ন হওয়া উচিত। দীপন তার কাছে একটা নেশা। ড্রাগ। নেশাসক্ত ব্যক্তির যেমন নির্দিষ্ট সময় পর পর নেশা না নিলে শরীরে জটিলতা তৈরি হয়, তার অবস্থাও তেমন। দীপনের সঙ্গে কথা না হলে, যোগাযোগ না হলে তার মধ্যেও অদ্ভুত জটিলতা তৈরি হয়। শরীরে, মনে। আক্ষরিক অর্থেই হয়। সে খেতে পারে না, ঘুমুতে পারে না। মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়। শরীরে অদ্ভুত রকম কাঁপুনি ওঠে। পৃথিবীটা দুর্বিষহ মনে হয় তখন। তখন টের পায়, সে সত্যিই জটিল কোনো মানসিক রোগে আক্রান্ত। নইলে এমন হওয়ার কথা নয় । সে বা দীপন, তাদের পথ ভিন্ন, গন্তব্য আলাদা। দীপনের জন্য তার এই বোধ সহজ, স্বাভাবিক নয়। সবচেয়ে বড় কৌতুক, তার এই বোধটুকু দীপনের কাছে স্রেফ পাগলামি, মানসিক রোগ। দীপনের ভাষায়, তার চিকিৎসা দরকার।
তিতলির সঙ্গে কথা শেষ করে তুলিকে ফোন দেয় দীপন। তুলি সংসার নিয়ে, রুমকিকে নিয়ে ব্যস্ত। দীপনকে সে সাবধানে থাকার পরামর্শ দেয়, তাড়াতাড়ি ফেরার তাগাদা দেয়। রুমকিটা অনর্গল কথা বলে। বাবা ফিরবে আজ। উত্তেজনায় টগবগ করে ফোটে মেয়েটা। আহা! বড় মায়া! জীবনটা ভারি উপভোগ্য মনে হয় এ বেলা।
সিলভি মেয়েটার সঙ্গে দেখা হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই আর। মেয়েটা শহরে ঢুকবে রাতে। ততক্ষণে দীপন প্লেনে। মেয়েটা বেশ। কলগার্ল! দীপনের সঙ্গে দেখা হয়েছিল হোটেল লাউঞ্জে। খুব ভদ্র আর স্মার্ট ভাষায় সে জানতে চেয়েছিল, দীপন তার সঙ্গে সেক্স করতে ইচ্ছুক কি না। মাহবুব ভাই গোল গোল চোখে একবার দীপন আর একবার সিলভির দিকে তাকাচ্ছিলেন। এত ভদ্র, স্মার্ট, সুন্দরী একটা মেয়ে এত সহজভাবে কাউকে সেক্সে আমন্ত্রণ জানাতে পারে, সেটা অবিশ্বাস্য তার কাছে। দীপন আড়চোখে মাহবুব ভাইকে একবার দেখে নিয়ে হাসি মুখে সিলভিকে না বলেছিল। তারপর চেষ্টা করেছিল সিলভির সঙ্গে খাতির জমানোর। কৌতূহল। সিলভি কথা বলতে রাজি হয়েছিল। আধাঘণ্টা হোটেলের সামনের খোলা লনে অন্ধকারে মুখোমুখি দুটি চেয়ারে বসে কথা বলেছিল তারা। সিলভি দরিদ্র কৃষক পরিবারের মেয়ে। ছাত্রী। মফস্বল শহরে থাকে। প্রতিদিন সন্ধ্যায় শহরে ঢোকে, সারারাত থাকে, সকালে ফিরে যায়। প্রস্টিটিউশনকে ব্যাংকক শহরটা শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছে এখন। সিলভির সঙ্গে কথা বলে সেটা বোঝা যায়।
সিলভির সঙ্গে কথা শেষে হোটেলে ঢুকে ভারী মুষড়ে পড়ে দীপন। মাহবুব ভাই আরও বেশি। বিরক্তও ভীষণ। লাগেজের চাবিটা দীপনের পকেটে ছিল। এখন নেই। দীপনের ক্ষীণ সন্দেহ, সিলভির সঙ্গে কথা বলার সময় অসাবধানতাবশত হোটেলের খোলা ওই লনে পড়েছে। সে লিফট বেয়ে গিয়ে খুঁজেও আসে জায়গাটা। নেই। না সিলভি, না চাবি। সিলভি কোনো খদ্দের পেয়ে চলে গেছে। কিন্তু চাবিটা? দীপন মিইয়ে যাওয়া কণ্ঠে বলে, মাহবুব ভাই, সিলভি চাবিটা যদি পেয়ে থাকে, তাহলে অবশ্যই ফেরত দেবে! আমার মন বলছে!
মাহবুব ভাই ধমকে ওঠেন—রাখো তোমার মন! বেশ্যার সঙ্গে আবার কথা কিসের তোমার? সে তোমার চাবি পেয়ে আবার ফেরত দিতে আসবে, তাই না? যত্তসব পাগলের সঙ্গে কাজ করি আমি!
মাহবুব ভাই গজগজ করতে থাকেন রাগে। পরদিন একই সময়ে হোটেল লাউঞ্জে বসে থাকে দীপন। মনে ক্ষীণ আশা, যদি সত্যিই চাবি পেয়ে থাকে সিলভি, ফেরত দিতে আসবে। দীপনের মুখে হাসি ফুটিয়ে এবং মাহবুব ভাইকে অবাক করে দিয়ে পরদিন হাসিমুখে উপস্থিত হয় সিলভি। হাতে চাবি। মাহবুব ভাইয়ের দিকে তার চ্যাপ্টা, গোলপানা মুখখানা ফিরিয়ে স্নিগ্ধ হাসি ঝরিয়ে বলে ওঠে—হাই!
মাহবুব ভাই ভীষণ অপ্রস্তুত হয়ে, বাতাস বের হওয়া বেলুনের মতো ফ্যাসফেসে গলায় বলেন—হ্যালো!
হো হো হেসে ওঠে দীপন। একহাত বাড়িয়ে চাবি নেয়। অন্যহাত সিলভির বাড়িয়ে দেওয়া হাতে মেলায়। সিলভির সঙ্গে বেশ বন্ধুত্ব হয়ে যায় তার। আজ যাওয়ার সময় সিলভির সঙ্গে দেখা হলে বেশ হতো। মনে মনে একটু আফসোস করে দীপন।
রাতের বাসটা ভীষণ গতিতে ছুটে চলে। জানালা খুলে আনমনে ছুটন্ত অন্ধকারের চোখে চোখ রেখে বসে থাকে তিতলি। অন্ধকারে দূরের ওই ঝোপজঙ্গল, গাছপালা, গ্রাম—সব কেমন ঝাপসা, রহস্যময় মনে হয়। বুকের মধ্যে কেমন শিরশির করে ওঠে। মনে হয় ওই যে ছুটে চলা অন্ধকার, ঝোপজঙ্গল, আগাছা, গ্রাম—ওই সবকিছু তার অতি চেনা, অতি আপনার। মনে হয় ওই সবকিছুর সঙ্গে, ওই সবকিছুর মধ্যে সে ছিল, আছে। বুকের মধ্যে কেমন টলটল করে ওঠে ভালোবাসা, অরুন্ধতীর জন্য, দীপনের জন্য, নিজের জন্য, বাদল আর তার মৃত মার জন্য, দূরের ওই অন্ধকারের জন্য, ফেলে আসা জীবনের জন্য, সমস্ত কিছুর জন্য। হঠাৎ দেশটার প্রতিও গভীর এক মমত্ব টের পায় তিতলি। মনে মনে বলে ওঠে—এই আমার দেশ, এই মাটি, এই প্রকৃতিতে আমি ছিলাম, আছি, থাকব!
বাদলের ঘুমন্ত ফর্সা, ফোলা মুখটাকে অন্ধকারে কেমন অদ্ভুত, অসুখী দেখায়। চলন্ত বাসেও সে নির্বিকার, সিটে হেলান দিয়ে ঘুমোয়। বাস ছুটে চলে
অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে তার দুই চোখে জল গড়ায় হঠাৎ। নিজেও টের পায় না হয়তো। তার মনের মধ্যে অচেনা এক বোধ বেনো জোছনার মতো আছড়ে পড়ে। আকাশের এককোণে ঝুলে থাকা উজ্জ্বল চাঁদের দিকে তাকিয়ে, দূরের অন্ধকারের দিকে চোখ রেখে তার হঠাৎ করে মনে পড়ে—একদিন সে-ও নাই হয়ে যাবে। সে-ও একদিন এই মাটি, হাওয়া, জল, প্রকৃতিতে মিশে যাবে। দীপন সেদিন নিজের অজান্তেই নিজের নিশ্বাসে টেনে নেবে তাকে, ছুড়ে দেবে প্রশ্বাসে! সেদিন কেমন লাগবে তার? খুব করে প্রতিশোধ কি নেওয়া হবে সেদিন দীপনের ওপর? তিতলিকে অবহেলার, অস্বীকারের আর কোনো পথই তো সেদিন খোলা থাকবে না দীপনের! ভাবতেই কী এক অচেনা সুখ কাঁটা দিয়ে ওঠে শরীরে, খামচে ধরে হৃৎপিণ্ডের ভিটে!
হাতের ওপর টুপ করে ঝরা উষ্ণতায় চমকে টের পায় তিতলি, কাঁদছে সে। সচেতন হয়ে ওঠে নিজের এতক্ষণের ভাবনায়। দীপন ঠিক বলে। সে পাগল। উন্মাদ। তার চিকিৎসা দরকার। যেমন চিকিৎসা দরকার ছিল তার বাবা হাবিবুর রহমান খানের। বাবা চিকিৎসা পাননি। বিনা চিকিৎসায় উন্মাদ উপাধি নিয়ে দিনের পর দিন শেকলবন্দি, অনাহারে থেকে মারা গেছেন। বাবাকে মুক্তিযোদ্ধা, না কাপুরুষ উপাধি দেওয়া উচিত? প্রশ্নটা তিতলিকে কুরে কুরে খায় প্রতিদিন। আহা! তার বোকা, উন্মাদ বাবা! মানুষকে ভালোবেসে পাগল হয়েছিলেন বলে, অত্যাচারী, অমানুষ এক মিলিটারি সেনার বাঁচার আকুতিতে নিজের হাতের চকচকে ছুরিটা সেদিন তার নিজের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল বলে, বাকি জীবন প্রায়শ্চিত্ত করেছেন। কাটিয়েছেন অমানবিক এক শেকলবন্দি জীবন।
বুকের কাছে মাথা রেখে নিশ্চিন্তে ঘুমন্ত মেয়েটার কচিমুখে চোখ ফেরায় তিতলি। চোখের জল মুছে তাকিয়ে থাকে অপলক। অরুন্ধতী। তার বাবার দেওয়া নাম। এই নাম দেওয়া নিয়ে বাদল আর তার মায়ের সঙ্গে কত যুদ্ধই না লড়তে হয়েছিল তাকে! বাদলের মা নিজের পছন্দে অরুন্ধতীর নাম রাখতে চেয়েছিলেন। বাদলেরও সায় ছিল তাতে। কিন্তু বাবার দেওয়া নামটাই খুব পছন্দ ছিল তিতলির। বাদলের মা’র ইচ্ছে ছিল কোনো ইসলামি নাম রাখবেন নাতনির। আয়েশা, ফাতেমা বা খাদিজা টাইপ। তাতে বেহেস্ত নিশ্চিত। মিনমিন করে বাদলও তিতলিকে তেমনই ছবক দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু বেহেস্তের লোভ তিতলিকে ততটা কাবু করতে পারেনি, যতটা করেছিল ‘দ্য গড অব স্মল থিংস’-এর লেখক অরুন্ধতী রায়, অথবা অরুন্ধতী নক্ষত্রের নামে তার মেয়ের নামকরণের বাসনা। ফলে তিতলির নরকবাস নিশ্চিত করেছিল বাদল আর তার মা, এপারেই। মৃত্যু পর্যন্ত অপেক্ষার ধৈর্য খুব একটা ছিল না তাদের। উঠতে-বসতে তিতলির শেকলবন্দি, উন্মাদ বাপের নামে শাপশাপান্ত, সেই সঙ্গে তিতলির অনৈসলামিক মনোভাব ঝেঁটিয়ে বিদায়ে তৎপর হয়েছিল তারা। লাভের লাভ, তিতলি আরও বেঁকে বসেছিল, মেয়ের নাম শেষ পর্যন্ত অরুন্ধতীই সাব্যস্ত হয়েছিল এবং মা-বাবা-দাদুর এই ত্রিমুখী যুদ্ধে অরুন্ধতী ক্রমশ অস্থির আর অবাধ্য হয়ে উঠছিল, উঠছে দিনে দিনে। আজও অরুন্ধতীর শ্রেণীশিক্ষক ফোন করে একগাদা অভিযোগ করেছেন, মেয়ে মারামারিতে ওস্তাদ, শিক্ষকের নির্দেশ মানে না, ক্লাসে অমনোযোগী ইত্যাদি ইত্যাদি। তিতলি শুনেছে, তারপর বলে দিয়েছে অরুন্ধতীকে ইচ্ছেমাফিক ধোলাই দিতে, এক্ষেত্রে কোনোরকম দয়া যেন না দেখানো হয় তাকে।
অরুন্ধতীর মুখে আলো ফেলেছে চাঁদ। জোছনা তার শ্যামল, কচি মুখটাতে ঢেউ তুলেছে স্নেহের। তিতলির বুকের মধ্যে উছলে পড়ে মায়া, উথলে ওঠে কান্না। সে ঘুমন্ত মেয়েকে বুকের মধ্যে টেনে নেয়, চুমু খায়। বুকের মধ্যে স্নেহের নদীতে জোয়ার ওঠে, বেদনার নদীতে জাগে ঢেউ। থ্রি সিটের কোণার দিকের সিটটাতে বসেছে বাদল। মাঝখানে অরুন্ধতী, জানালার পাশে তিতলি। বাদলের ঘুমন্ত ফর্সা, ফোলা মুখটাকে অন্ধকারে কেমন অদ্ভুত, অসুখী দেখায়। চলন্ত বাসেও সে নির্বিকার, সিটে হেলান দিয়ে ঘুমোয়। বাস ছুটে চলে। বাদলকে দেখে কে বলবে তার ভেতরে যন্ত্রণার সুনামি চলছে! কে বলবে সে যাচ্ছে তার মৃত মাকে অন্তিম বিদায় জানাতে! বরং মনে হচ্ছে ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত একজন মানুষ দারুণ নির্ভরতায় শান্তি খুঁজছে ঘুমের কাছে।
দেখতে দেখতে কমলারঙা বৃত্তটা হারিয়ে যায় ঘাড় উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা চাঁদ-সুরুজ মিনারটার আড়ালে। দিগন্তজোড়া আকাশে ছড়িয়ে দিয়ে যায় পাঁজা পাঁজা কমলার ছোপ। হঠাৎ তাকালে কেমন ধাঁধা লেগে যায় চোখে। কেমন ঘোরে আচ্ছন্ন হয়ে যায় মন। পৌষের শীত উপেক্ষা করে রতন জানালার কাঁচ সরিয়ে এই সন্ধ্যানামা ক্ষণটাতে তাকিয়ে থাকে পশ্চিমের ঘন হয়ে আসা কমলা রঙা সূর্যটার দিকে। একটু একটু করে নেমে যায় নিচে, হারিয়ে যায় আজকের মতো। রতনের বুকের মধ্যে কেমন একটা চাপাকান্না গুমরে উঠতে চায়। উথলে উঠতে চায় কোনো এক বলক ওঠা হাহাকার। প্রাণপণে নিজেকে সামলায় রতন। চোখ জ্বালা করে ওঠে। গলার কাছটায় কি একটা আটকে যাওয়ার অনুভূতি, চোয়ালে ব্যথার বোধ। সময় চলে যাচ্ছে রে রতন। ফুরিয়ে যাচ্ছে দিন। এইবেলা দেখে নে সব! এইবেলা ভোগ করে নে জীবন!
কে যেন ভেতর থেকে কড়া নেড়ে বলে যায় কথাগুলো। সতর্কঘণ্টা বাজিয়ে কে যেন সচকিত, সজাগ করে দিতে চায় তাকে। রতনের বুকের মধ্যে কে একজন সজোরে পাথর ভাঙে আজকাল। স্পষ্ট শোনে রতন। সময় ফুরিয়ে আসছে, জানে সে-ও। চিত্রার্পিতের মতো জানালায় দাঁড়িয়ে সে দেখে আঁধারের আলো গেলার দৃশ্য, দেখে রাতের বাহুলগ্ন হয়ে কী করে মিলিয়ে যায় দিন। অবিকল তার ভেতরে বাস করা দানবটার মতো। যে প্রতিদিন একটু একটু করে গ্রাস করছে রতনের জীবন, গিলে নিচ্ছে তার অফুরাণ প্রাণশক্তি। আবছা অন্ধকারে জেগে ওঠা ধ্রুবতারাটার দিকে পলকহীন তাকিয়ে থাকে রতন। মনে হয়, আহা! ওই ধ্রুবতারাটা অমনি অনন্তকাল জেগে থাকবে, শুধু সে-ই থাকবে না আর। কোথায় থাকবে রতন? কোন সীমাহীন অন্ধকারে? ভাবতে গিয়ে কেমন নিথর হয়ে আসে হাত-পা। কেমন দমবন্ধ লাগে তার। জানালা থেকে সরে দাঁড়ায়। পর্দাটা টেনে দেয়। বসে পড়ে খাটের এককোণে।
সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ কেড়ে নিলো সামান্য এক ঝিঁঝি। না কি মাধবী? মাথা চেপে ধরে চিৎকার করে ওঠে রতন
কতদিন যে বের হতে পারেনি সে চার দেয়ালের খোলস ছেড়ে! বন্ধ দরজার দিকে করুণ চোখে একবার তাকায় রতন। হতাশ মাথা নাড়ে। বাইরে উন্মুক্ত উদার পৃথিবী, অবাধ স্বাধীনতা। শুধু তারই পৃথিবী ডুবে গেছে সীমাহীন পরাধীনতায়, অন্তহীন অন্ধকারে। কিছুতেই দীপন বা তুলিকে সে বুঝাতে পারছে না যে পাগলামিটা এখন আর নেই তার। বেশ ভালো আছে সে এখন। মাঝে মাঝে, যখন মাথার মধ্যে মাতাল, বধির এক ঝিঁঝি তারস্বরে চিৎকার জুড়ে দেয়, তখন সে ঠিক রাখতে পারে না কাণ্ডজ্ঞান। কাউকে চিনতে পারে না তখন আর। সে সময়ের কোনো কথা পরে আর মনে থাকে না তার। এ অবস্থা চলে অনেকদিন। তারপর ধীরে ধীরে ক্লান্ত, অবসন্ন হয়ে মিইয়ে যায় ঝিঁঝিটা, ঘুমিয়ে পড়ে অজান্তেই। তখন একটু একটু করে আবার নিজেকে খুঁজে পায় রতন। আবার সে চোখ মেলে দেখতে পায় নিজের ভীষণ চেনা, ভীষণ পরিচিত পৃথিবী। গত তিন চারদিন হলো সে আবার চিনতে পারছে পৃথিবীটা। তারপর থেকেই সে তুলিকে বোঝানোর চেষ্টা করছে নিজের সুস্থতা। জানালার ফাঁক দিয়ে ভয়ে ভয়ে উঁকি দেওয়া রুমকির তুলতুলে, মিষ্টি মুখটা দেখে সে কতবার ডেকেছে তাকে, কতবার আদর করবে বলে হাত বাড়িয়েছে। রুমকি ভয়ে দৌড়ে পালিয়েছে। কষ্টে, যন্ত্রণায়, নিজের চুল নিজেই পটাপট ছিঁড়েছে রতন। জটপাকানো, নোংরা চুলগুলো দু হাতে চেপে কেঁদেছে হাউমাউ। লাভ হয়নি। দরজা খোলেনি কেউ। দিনের নির্দিষ্ট একটি সময়ে, যখন সে ঘুমোয়, তখন সাবধানে দরজা খুলে খাবার, জল রেখে যাওয়া হয় তার ঘরে। সে খুব করে চেষ্টা করে সে সময়টায় জেগে থাকার। পারে না। খাবারের মধ্যে নির্দিষ্ট মাত্রার ঘুমের ওষুধ দেওয়া হয় তাকে। ডাক্তারের নির্দেশে। সুস্থ থাকলে সে মাঝে মাঝে বিদ্রোহ করে, অভুক্ত থাকে। তাতে আবার অসুস্থতা বাড়ে দ্রুত। এছাড়া না খেয়ে বেশিক্ষণ সে থাকতেও পারে না আজকাল। বড্ড খিদে। গত ক’দিনে একটু একটু করে বোধ ফিরছে তার। দীপনকে সে দেখেনি এই ক’দিনে একবারও। দীপন সম্ভবত বাড়িতে নেই। থাকলে তার ঘরে একবার হলেও উঁকি দিতো। তার বোধ ফিরছে বুঝলে ঘরের দরজাও হয়তো খুলে দিতো। সে নেই বলেই তুলিও ভরসা পাচ্ছে না। পাগলকে বিশ্বাস নেই! ভেবেই হো হো হেসে ওঠে রতন। শালা! সে পাগল! বদ্ধ পাগল! অথচ মাধবী দিব্যি ভালো আছে, সুস্থ আছে!
কতই রঙ্গ জানো রে মওলা
কতই রঙ্গ জানো…
সুর করে গেয়ে ওঠে রতন। তার কণ্ঠে সুর ছিল। এখনো আছে কিছুটা। মাধবী বলতো ভালোবাসে। রতনের মধ্যে তেমন অনুভূতি জাগেনি কোনোদিন মাধবীর জন্য। মাধবী তারই প্রতিশোধ নিলো! এ কেমন ভালোবাসা মাধবীর? যাকে ভালবাসে, যার জন্য বুকের মধ্যে কাঁপন জাগে তার, কী করে তার শরীরে সে এভাবে বুনে দেয় মৃত্যুবীজ! রতনের মাথার মধ্যে সে ছেড়ে দিয়েছে এক মাতাল ঝিঁঝি! যে অনবরত তারস্বরে চিৎকারে জাগিয়ে রাখে রতনের অণু-পরমাণু। ধীরে ধীরে যে তার থাবা বড় করছে, একে একে দখল নিচ্ছে রতনের সমস্ত চৈতন্যে। সে বুঝতে পারছে, ঝিঁঝিটা আর সেই ছোট্ট ঝিঁঝিটা নেই এখন, ক্রমশ বড় হচ্ছে, লোভ বাড়ছে তার। ক্ষুদ্র, তুচ্ছ সে পোকাটি রূপ নিচ্ছে দানবে। ফুরিয়ে আসছে রতনের সময়। হায় মাধবী! হায় ভালোবাসা!
মাধবীকে তবু ক্ষমা করেছে রতন। ভালোও কি বাসেনি একটু! আহা! মাধবী! সে তো বোঝেনি! সে চেয়েছিল রতনের বুকের মধ্যে এক চিলতে জমিন। সে কি আর জানতো বুক নয়, রতনের মাথার মধ্যে ঝিঁঝি পোকা হয়ে যাবে তার খাওয়ানো সেই ধ্বন্বন্তরি কবিরাজি দাওয়াই! মাধবীর বুকের মধ্যে কতটা পুড়ছে এখন? নিজের ভুলের জন্য কতটা দহন তার মনে? বড় ইচ্ছে করে তার বুকের মধ্যে একবার সেঁধিয়ে যেতে! একবার যদি দেখা যেতো কতটা অপরাধবোধ জমেছে সেখানে! জীবন ফুরিয়ে গেলো। কিছুই হলো না। সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ কেড়ে নিলো সামান্য এক ঝিঁঝি। না কি মাধবী? মাথা চেপে ধরে চিৎকার করে ওঠে রতন। কাঁদে। না গড়তে পারলো নিজের ভবিষ্যৎ, না পূরণ করতে পারলো দীপনের স্বপ্ন। না ভালোবাসতে পারলো মাধবীকে। মাধবী শোধ নিলো! চরম প্রতিশোধ!
চলবে…