[পর্ব-৩৬]
রিকশার হুড খুলে দিয়ে বিশ্ব চরাচর মুখর করে তুমুল বৃষ্টিতে ভিজি দু’জন। তখন আমাদের কানে-কানে বৃষ্টির গান ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। কাছে কাছে গায়ে গায়ে স্পর্শ করে থাকা ছাড়া আর কোনো অনুভব নেই। ভেজা শরীরে, ভেজা আকাশে যেন ক্রমশ আগুন-আগুন নেশা ধরে যায়। সেই থেকে বৃষ্টির সঙ্গে তুমুল এক সখ্য গড়ে ওঠে আমাদের। বৃষ্টি এলেই নেমে পড়ি দু’জন পথে। ভেজা গায়ে ভেজা গন্ধে মাতাল সেদিনের গল্প এসে শেষ হয় সন্ধ্যার গাঢ় হয়ে আসা অন্ধকারে। এখানে-সেখানে ঘুরে-ঘুরে ফিরি সারাদিন। ভেজা কাপড় গায়েই শুকিয়ে সন্ধ্যায় হলের গেটে ফিরে আসি দু’জন। যেন ছেড়ে দিতে, ছেড়ে যেতে চাই না কেউ কাউকে। তবু গেটের ভেতর দিকে পা বাড়াই। সে চলে যেতে যেতে আমি আবার পেছন ফিরে আসি।
—আগামী কাল আসবেন?
—এখনো আপনি?
আমি হাসি। সেও হাসে। হাসতে হাসতে চলে যায়। ছেলে মানুষের মুখে অমন মিষ্টি হাসি আমি খুব কমই দেখেছি। কবিতা তার অতটা ধারালো নয়। তবু খঞ্জনপুরে আমাকে যে দুটো বই নিজের হাতে লিখে সাইন করে দিয়েছিল, সে দুটোর একটাতে লেখা ছিল—‘এসো, আমরা দু’জনে উচ্চারণ করি, আমৃত্যু শত্রু আমাদের রাজাকার।’
তাতেই বুঝতে পেরেছিলাম সে স্বাধীনতার পক্ষের লোক। দেশ ও স্বাজাত্যবোধের জায়গাটায় মিল পেলাম তখনই। সে আমার চেয়ে বয়সে প্রায় ১০ বছরের বড়। বয়স তখন তার ৩৩ চলছে। ইতালিতে বেশ কয়েক বছর থাকার পরও মনের মতো করে কাজ করতে পারছে না বলে খুব ডি-স্যাটিসফ্যাকশনে রয়েছে, এটুকু আমি জানি। তবু বিয়ের খুব চাপ বাড়ি থেকে। আমার সঙ্গে আসার পর থেকে সে দেশে ব্যাক করার কথাও ভাবতে থাকে। তখন তেমন মোবাইল ফোনের ব্যাপক প্রচলন নেই। তার বাড়িতে টিঅ্যান্ডটির ফোনে যে কথা হতো না তা নয়। বাড়ির বড় ছেলে হওয়ার কারণে অন্য ভাইবোনেরা আমাদের বিষয়ে তেমন কিছু তাকে বলতে সাহস না করলেও খুব নজরদারির ভেতর রাখতো। বিশেষ করে মামুন আর লিপি আপা। মা ছিলেন খঞ্জনপুরের ডাকসাইটে মানুষ। শুনেছি এরশাদের রাজনৈতিক মতানুসারী তিনি। কঠিন হাতে সংসার ধরে রেখেছেন। বাবাকে যতটা দেখেছি, সব সয়ে যাওয়া, শুনে যাওয়া, মেনে নেওয়া মানুষ মনে হয়েছে তাকে। তাই ফোনটা বেশির ভাগ দিনই ধরতেন তার মা। খঞ্জনপুর চলে গেলে তার সঙ্গে কথা হতো কবিতায় কবিতায়। চিঠি লিখে। বই দুটো পাওয়ার মাসখানেক পর আমি তার ওই কবিতাটির শেষ দু’টি লাইন ধরে রেখে প্রতি উত্তর লিখে চিঠিটা ডাকে ফেলেছিলাম।
তুমি ছিলে দাঁড়ায়ে অতন্দ্র প্রহরী
আমি নির্ভীক যোদ্ধা
তুমি দিলে প্রাণ বীরদর্পে
আমি খুলে শাড়ি সজ্জা
এসো উচ্চারণ করি আমরা দু’জনে
আমৃত্যু শত্রু আমাদের রাজাকার
সন্ধ্যার আলো আঁধারিকে অন্ধকারে ঢেকে দিয়ে সে চলে যায়। আপনিকে তুমিতে বসিয়ে সে জেগে থাকে। ভালোবাসার স্বর্গভূমিতে আমাকে দেবী সাজিয়ে পূজার ফুল সাজায়। আমার নীল আকাশে সাদা মেঘের ক্যানভাসে সে নতুন রঙিন স্বপ্ন আঁকে। এই যৌথ পথ চলায় আমরা জাগতিক প্রাত্যহিক ভাবনা ভাবিনি কখনো। আমরা ঘর বাঁধার গল্প করিনি তখনো। আমরা ভবিষ্যতের নিশ্চিন্ত আশ্বাসের ভাবনায় দুরন্ত দুর্বার সময়কে বাঁধিনি কখনো। তবু আগে আগে ভবিষ্যৎ সামলাতে চায় কেউ কেউ। তাড়া করে ফেরে আমাদের পিছু পিছু। লিপি আপা ঢাকায় এলে আবাহনী ক্লাবে আমার হলের বান্ধবী আর হকি প্লেয়ার বন্ধুদের মিটিংও বসে যখন তখন, সবই আমাদের কানে আসে। আঁটতে থাকে জটিল গেরো, গোপনে। তবু আমরা আমাদের কথা ভাবি। আমরা আমাদের মতো ভাসি। আমাদের মতো ভালোবাসি। বিগত দিনের ঝগড়া-আক্রমণ-অপমান-নিপীড়ন-শোষণ-সংকট-স্নায়বিক চাপের বীভৎস স্মৃতিগুলো ক্রমে অপসৃয়মান। সবকিছু আলাদা, সব অন্যরকম এখানে। একহারা গড়নের, পাঁচ ফুট দশ ইঞ্চি উচ্চতার গাঢ় কৃষ্ণ বর্ণে উজ্জ্বল তার চোখের তারায় আমি আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা পড়ে যেতে থাকি। ভীষণ গভীর সে চোখের নেশা। সম্মোহনী সে চোখের দ্যুতি। অথচ সে উল্টে আমাকে বলে:
তোমার চোখ সুন্দর।
আমি হেসে প্রশ্ন করি:
আমার চোখ সুন্দর?
সে বলে:
তোমার শরীর সুন্দর।
আমি হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ি তার শরীরে। সে আমাকে আলতো অনুভবে জড়িয়ে ধরে বলে:
তোমার ঠোঁট সুন্দর।
আমি চুমু খাই তার ঠোঁটে। হেসে উঠে বলি:
আর একবার হাসো তো দেখি।
হাসতে হাসতে আমার হাত ধরে কাছে টানে। আমি টাল সামলাতে না পেরে গিয়ে পড়ি একেবারে তার বুকের ওপর। হাত ধরে টানতে টানতে কোথায় না কোথায় নিয়ে চলে। আমার পথ ছেড়ে দেই তার হাতে। বাঙালি, সুন্দর বলতে যে দুধে-আলতা রঙ বোঝায়, তার ধারে কাছে নই আমি। একহারা গড়নের শ্যামলা বাঙালি মেয়ে। সাদাসিদে চোখে গাঢ় জীবন। গভীর চোখের ঘনকালো আইল্যাশের প্রেমে পড়েছে অনেকেই। সেটা আমি অস্বীকার করতে পারি না। এছাড়া আর কিসে যে অত সুন্দর পেলো, সে নিজেই জানে। হলে আমার বন্ধুরা যখন দামি গাড়ি নিয়ে আসা টাকাওয়ালা বন্ধুর হাজার টাকার উপহার পায়, সুগন্ধী পারফিউমে বাতাসে তরঙ্গ তুলে হেঁটে যায়, দামি জুতো পরে বেড়াতে চলে, তখন আমার আটপৌরে সাজ। যখন বন্ধুরা বিউটি পার্লারে ফেসিয়াল করতে যায়, তখন হলের জনশূন্য রুমে আমি একলা বসে কবিতা পড়ি। যখন বিলাসিতায় জীবন উপভোগ করে আমার বন্ধুরা, আমি তখন আব্বার ওপর দারুণ অভিমানে কাঁদতে থাকি। নির্বাক শব্দে ভাইজানের হাত থেকে যেন টাকা নিতে না হয়, সেজন্য আল্লাহকে ডাকি। আমার সুন্দর হওয়ার কোনোই কারণ নেই। তার চোখে কোথায়, কী কারণ আমার সুন্দরের, আমি জানি না। তার কথা বিশ্বাসও করি না। তবু হেসে যাই। তবে এটুকু বুঝেছিলাম, রূপের ঝলক তাকে টানেনি আমার দিকে। তবে? আর কী আছে? সে চিন্তা অবশ্য কখনো ঢোকেনি মাথায়। সে দিনে দিনে আমাকে বুঝতে শুরু করে। আমি বুঝি কি না বুঝি, সেটা তখনো উপলব্ধি করতে পারি না ঠিকমতো। তবে দারুণ এক আকর্ষণ তার প্রতিও আমার, সেটা অস্বীকার করতে পারি না। সে চোখে কাজল টানা পছন্দ করে। আমি চোখে কাজল আঁকি। সে জয়ললিতা টিপ পছন্দ করে। খুব চেষ্টা করেও আমি কপালে জয়ললিতা টিপ আঁকতে পারি না ঠিকঠাক করে। তার প্রিয় রঙ নীল। আমি আলমারি খুলে নীল শাড়ি খুঁজে মরি। সে আমার পায়ে সোনার মল পরাতে চায়। আমি পা টেনে নেই। তবু রোজ বিকেলে আমরা বেড়াতে যাই। দূর হতে দূরান্তে চলি। হলের মাঠে বসবো না বলে, বন্ধুর লাগানো গোয়েন্দা আর বান্ধবীদের অসহ্য ঠেকলে আমরা ভেসে চলি হলের মাঠের কচি সবুজ ঘাসের পরশ ছেড়ে বহু দূরের হাওয়ায়। আকাশে আকাশে তখন কত না আনন্দ গান গেয়ে ওঠে, কবিতায় কবিতায় লেখা হয় কত না কত আদর। বাইকের পিঠে চড়ে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরি তাকে। তার গায়ের ঘ্রাণ, বুঝি কোনো দেবতা নেমে এসেছেন পৃথিবীতে। স্বর্গ স্বর্গ ঘ্রাণে হাওয়ায় হাওয়ায় আমাকে উড়িয়ে নিয়ে চলেছে। আমি প্রথমবারের মতো ভালোবাসার পরশ পেতে শুরু করি। এতটা শ্রদ্ধা সম্মান আর আবেগের সমন্বয় থাকে প্রেমে, প্রথম বারের মতো বুঝতে শুরু করি। আমার ভালোলাগা তীব্র হতে শুরু করে। তার গায়ের কালো রঙ, তার ঠোঁটের লুকোনো হাসি, তার কথা, তার উদ্ভ্রান্ত জীবনে তখন আমারও গভীর সমর্পণ। কখনো চলে যাই সোজা কাকলী-বনানী ছাড়িয়ে এয়ার পোর্ট পার হয়ে আরও দূরে, উত্তরা জোয়ার সাহারা ছেড়েও বহুদূর। টঙ্গী চৌরাস্তা। অতটা পথ বাইকে একটানা ভেসে ভেসে চলি। আবার ফিরেও চলে আসি।
সেদিন ছিল খর রোদ। দুপুরের রোদে নম্রতা মোড়ানো সোনারঙ তখনো ধরে আসেনি মোটেই। নেমে আসি নিচে। সঙ্গে বাইক নেই দেখে ভাবি, বসবো এবার ঘাসের মাঠে।
—এখানে নয়। ওদিকে চলো।
হাঁটি তার সঙ্গে সঙ্গে। বাংলাদেশ কুয়েত মৈত্রী হলের গেট থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলসীমা পার হতে বেশ লম্বা, প্রায় দুই তিন মিনিটের রাস্তা হাঁটতে হয়। এরপর মেইন গেট। গেটের বাইরে এলে সোজা আজিমপুর গোরস্তানের সীমানা প্রাচীর। হাতের ডান পাশে বিডিআর তিন নম্বর গেট। বামদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের ছাত্রদের জন্য নির্দিষ্ট করা শাহনেওয়াজ হল। শাহনেওয়াজ হল পার হয়ে সোজা রাস্তা চলে গেছে নিউমার্কেট। সে অবধি আমরা হাঁটি। প্রখর রোদ্রে যখন ম্লান হয়ে আসে গাছের পাতার রঙ, আমাদের মনে তখন শীতল পরশ। একটা বেবিটেক্সি ডেকে উঠে পড়ি দু’জনে। তারপর জানতে পারি যাচ্ছি সোনার গাঁ, পানাম নগর। ছুটে চলেছে বেবিট্যাক্সি। দিনের তীব্র আলো ক্রমে সহনীয় হয়ে এলে, বিকেলের কোলে গড়িয়ে পড়ে গেলে সূর্যের আদুরে ওম, আমরা তখন মাঝখানের দূরত্বটুকু মুছে দিয়ে খুব কাছে আসি। ঘন হয়ে বসি দু’জনে।
চলবে…
নারী: অ্যা হান্ড্রেড ফেসেস অব উইমেন-৩৫॥ শাপলা সপর্যিতা