॥পর্ব-চার॥
ইমদাদুল হক মিলনের সবচেয়ে আলোচিত উপন্যাস নূরজাহান।
কোনো সমাজে যখন মৌলবাদ আস্কারা পায় তখন অশিক্ষিত ধর্মান্ধরা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। ধীরে ধীরে রাষ্ট্রব্যবস্থাকে নাজুক করতে থাকে। একসময় আইনও তাদের কাছে তোয়াক্কাহীন হয়ে যায়। ঠিক তখনই ধরাকে সরা জ্ঞান করা শুরু করে তারা। পঁচাত্তরের পরে যখন এই মৌলবাদ আস্কারা পেতে থাকে। তখন থেকেই এগুলো শুরু হয়ে যায়। তাই আজ প্রায় সারাদেশেই প্রচলিত আইনকে তোয়াক্কাহীন হতে দেখি। এই যে সচরাচর দেখা এক জীবন, জীবনের বিভিন্ন পিঠ অবলোকন—আর এই অবলোকন যখন জন-আত্মার ভেতরে সৃষ্টির ও প্রতিবাদের বীজ বপন করে তখন? তখন আমাদের কাছে দুটো রাস্তা খুলে যায়। এক. প্রতিবাদের মাধ্যম হিসেবে নিজে কিছু সৃষ্টি করা। দুই. কোনা সৃষ্টির মাঝে সেই প্রতিবাদ খোঁজা।
নূরজাহান আমাদেরকে সেই প্রতিবাদ খোঁজার ঠাঁই দিয়েছে। দিয়েছে নিজেদের সৃষ্টির অক্ষমতা আড়াল করার সান্তনা। দিয়েছে ন্যায় বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদতে না-দেওয়ার সাহস।
নূরজাহান লেখার পটভূমি কিংবা কাহিনীও আজ সর্বজনবিদিত। একটি সত্য ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিস্তৃত হয় এর ডালপালা। ইমদাদুল হক মিলন ঘটনা আর প্রেক্ষাপটকে একাত্ম করার জন্য, আরও বেশি জীবন্ত আর রক্ত-মাংসীয় করার জন্য একটি নির্দিষ্ট এলাকার একটি নির্দিষ্ট ঘটনাকে নিয়ে এলেন তার আজীবন দেখা পরিবেশ-প্রতিবেশ আর জনমানুষে। ফলে নূরজাহান হয়ে উঠলো প্রকৃত অর্থেই জীবন্ত। প্রকৃত ঘটনা সিলেটের। কিন্তু প্রকৃতার্থে তা সারাদেশের এক ভয়াবহ সমস্যা বললে অত্যুক্তি হয় না। তাই নূরজাহানের ঘটনা বলতে গিয়েই একে একে এলো দবিরগাছি, হামিদা, মরনী, আলি আমজাদ, মাকুন্দা কাশেম। এবং মাওলানা মান্নান। আর এভাবেই ধীরে ধীরে সূচিত হতে থাকলো এই জনপদের একটি আখ্যান। কিন্তু এই একটি আখ্যানের মাঝে নিহিত শত শত আখ্যান। বিভিন্ন রকম তাদের ব্যঞ্জনা। ঘটে যাচ্ছে ঘটনার পর ঘটনা। বাস্তবের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে অধিকতর বাস্তব। শুদ্ধবাক্যের ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে আঞ্চলিক অভিব্যক্তি। ফুটে উঠছে জীবন যাপন আর সমাজ সংগ্রামের ছবি। ফুটে উঠছে বেঁচে থাকার স্বপ্ন আর প্রতিবাদের স্পৃহা।
ব্যক্তি নূরজাহানের কাহিনীতে যদি একইসঙ্গে উঠে আসে দবির গাছির কথা, উঠে আসে হামিদার কথা, মরণীর কথা, উঠে আসে মাওলানা মান্নানের কথা। তখন এসব চরিত্র বা কুশীলবের নিজ নিজ ভূমিকার ভেতরেই চিত্রিত হয় এই সমাজের ভণ্ডামি, চিত্রিত হয় মমতা, চিত্রিত হয় শোষণ-শাসনের খড়গ, চিত্রিত হয় নিজের ভোগ আর লালসাকে চরিতার্থ করার জন্য পবিত্র ধর্মকে ব্যবহারের কথা। আর এসবের সম্মিলিত মিথষ্ক্রিয়ায় যা রচিত হয় তা হয়ে ওঠে প্রকৃতই মহাকাব্যিক।
এই ভার্চুয়াল যুগে মহাকব্যিক ব্যঞ্জনা নিয়ে যদি কিছু নির্মিত হয় তা প্রিয় ও কালজয়ী না হয়ে পারে কিভাবে। আমি জানি না। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তার আরেকটি কর্ম নয়মাস। রচনাটিতে ভিন্নার্থিক প্রক্ষেপণে আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে তুলে আনা হয়েছে।
কীভাবে?
তা বুঝতে হলে যেতে হবে নয়মাসের গভীরে।
প্রকৃত ইতিহাস চাপা দেওয়া এবং বিকৃতির মহোৎসবে সম্ভবত সবচেয়ে এগিয়ে পাকিস্তান। পাকিস্তানের পাঠ্যপুস্তক ঘেঁটে দেখা যায় একাত্তর নিয়ে একটিমাত্র বাক্য দিয়েই পুরো ইতিহাস লেখা সম্পন্ন করেছে। বলা হয়েছে, ‘একাত্তর সালে পূর্ব পাকিস্তান পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়’। দ্বাদশ শ্রেণী পর্যায়ের ইতিহাসে সামান্য কয়েকটি শব্দ যোগ করা হয়েছে মাত্র। আগের বাক্যটির সঙ্গে যোগ করা হয়েছে, ‘ভারতীয় হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠীর সহযোগিতায় পূর্ব পাকিস্তান একাত্তর সালে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।’ পাঠ্যপুস্তকে ইতিহাসের এ হেন অবস্থায় সেখানকার বর্তমান প্রজন্মের কাছে অজানা থেকে যায় একাত্তরের প্রকৃত ঘটনা। তাদের অজানা থেকে যায় তৎকালীন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কুকর্মের কথা।
সেই অশ্রুত ইতিহাস পাকিস্তানের বর্তমান প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার কাহিনী বিধৃত হয়েছে নয়মাস নামক আখ্যানে। পাকিস্তানি কিশোরী মেয়ে ময়মুনা হায়দার খানের বাবা বাংলাদেশের একটা টেক্সটাইল মিলে কাজ করে। বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় তাদের বসবাস। এখানে বসবাস করে আরও কয়েকটি পাকিস্তানি পরিবার। এখানকার স্থানীয় ছেলে মেয়েদের সঙ্গে পাকিস্তানি ছেলেমেয়েদের বন্ধুত্ব হয়ে যায়। প্রতি বিকেলবেলা এক সঙ্গে খেলাধুলা করে তারা। ক্রিকেট বাস্কেটবল ইত্যাদি। বাংলাদেশ বনাম পাকিস্তান ক্রিকেট ম্যাচের সূত্র ধরে বাংলাদেশি ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে পাকিস্তানি কয়েকটি পরিবারের ছেলে মেয়েদের সামান্য বিরোধ জন্মে। খেলায় পাকিস্তান হেরেও যায়। বাংলাদেশি ছেলে মেয়েরা বলে মার্চ মাসে আমরা হারব না। ম্যাচটির পর শুধু বাংলাদেশি বন্ধুরা নয়, অন্যান্য বাংলাদেশিদের মুখেও শোনা যায় মার্চ মাসের কথা।
কিশোরী ময়মুনার মনে প্রশ্ন জাগে বাংলাদেশিরা কেন বারবার মার্চ মাসের কথা বলে? আবাসিক এলাকার মাঠে ক্রিকেট খেলার সূত্র ধরে পরিচয় হয় এক লেখক-সম্পাদকের সঙ্গে। লেখক-সম্পাদকের কাছে ময়মুনা জানতে চায় মার্চ মাসের কথা। সে-সূত্র ধরে লেখক সম্পাদক বলে একাত্তরে ঘটে যাওয়া প্রকৃত ঘটনা। বলে তাদের পূর্ব পুরুষের কৃতকর্মের কথা।
এভাবে এক অজ্ঞাত অধ্যায় খুলে যায় কিশোরী ময়মুনার চোখের সামনে। খুলে যায় পাকিস্তানিদের প্রকৃত চরিত্র। তীব্র ঘৃণা জন্মে যায় তার মনে। অপরাধবোধ এমন পর্যায়ে চলে যায় যে, সে সিদ্ধান্ত নেয় কোনো বাঙালিকে সে মুখ দেখাবে না। ভাবে, যে দেশের মাটি তার দেশের মানুষ নিরীহ বাঙালির রক্তে ভাসিয়েছে সেখানে থাকার কোনো অধিকার নেই। মেয়েটি তার পরিবারকে বাধ্য করে পাকিস্তানে ফিরে যেতে। যাওয়ার আগে লেখক-সম্পাদকের কাছে গিয়ে ক্ষমা চায়।
ইমদাদুল হক মিলন এই আখ্যানের মাধ্যমে কয়েকটি কাজ করেছেন। বিষয়ের দিক থেকে বিবেচনা করলে দেখা যায় এরকম বিষয় নিয়ে ইতোপূর্বে কোনো গল্প-উপন্যাস লেখা হয়নি। এমনকি জানার চেষ্টাও করা হয়নি একাত্তর নিয়ে পাকিস্তানের বর্তমান প্রজন্মের ধারণা কী। কিংবা তাদের ধারণা পাল্টে দেওয়ার জন্য প্রকৃত ইতিহাস তাদের সামনে তুলে ধরা যায় কি না। প্রতীকী অর্থে হলেও ইমদাদুল হক মিলন প্রথম এ কাজটি করলেন। লেখক তেরো বছরের এক কিশোরীর জবানিতে পুরো আখ্যান বিধৃত করেছেন। তাতে তার মনস্তত্ব যেমন ধরা পড়েছে তেমনি ধরা পড়েছে তার বিবেকবোধের আওতায় একাত্তরের প্রকৃত ঘটনা। তার ক্ষমা চাওয়ার বিষয়টিও প্রতীকী। পাকিস্তান সরকার, সেনাবাহিনী কিংবা তাদের জনগণ এখন পর্যন্ত একাত্তরের নৃশংষ ঘটনার জন্য ক্ষমা চায়নি। এ প্রজন্মের একজন কিশোরীর ক্ষমা চাওয়ার মাধ্যমে সে-বিষয়টির দিকে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে। দ্বিতীয়ত, কিশোরীকে একাত্তরের ঘটনা বলতে গিয়ে লেখক আরেকবার একাত্তরের প্রকৃত ঘটনা তুলে ধরেছেন। তাতে পাঠক আরেকবার গল্প-উপনাসের মোড়কে প্রকৃত ইতিহাস পাঠের সুযোগ পান। জানার সুযোগ পান আরো কতিপয় মর্মন্তদ ঘটনার।
আর আঙ্গিক ও আয়তনের দিক বিবেচনা করলে নয়মাস আখ্যানটিকে ঠিক গল্প বলা হবে না কি উপন্যাস বলা হবে তা ঠিক করা বেশ মুশকিল। প্রচলিত গল্পের আয়তন থেকে নয়মাস বেশ বড় কিন্তু উপন্যাসের চেয়ে ছোট। লেখক এই প্রয়াসের মাধ্যমে ভেঙে ফেলতে চেয়েছেন প্রচলিত ফিকশনের কাঠামো। তিনি আসলে গল্প বলতে চেয়েছেন। এখানে ‘গল্প’ বলতে পাঠকরা গল্প-উপন্যাসে যা খুঁজেন। সেই ‘গল্প’ বলতে গিযে ইমদাদুল হক মিলন প্রচলিত কাঠামো ও আঙ্গিককে ভেঙে ফেলেছেন। আসলে তিনি যা বলতে চেয়েছেন এবং যেভাবে বলতে চেয়েছেন তার জন্য এ কাঠামোটিই যেন যুৎসই। আরোপিত কোনোকিছু লেখক এখানে চাপিয়ে দিতে চাননি।
আখ্যানে যে লেখক-সম্পাদকের উপস্থিতি পাওয়া যায় তিনি যে ইমদাদুল হক মিলন নিজেই তাও ধরতে পাঠকের সমস্যা হয় না। আখ্যানে এভাবে লেখকের উপস্থিতিও ভিন্ন মাত্রার। যা আমাদের প্রচলিত আখ্যানে নেই বললেই চলে। এ ধরনের প্রয়াসের ফলে ‘গল্পের’ বিশ্বস্ততা আরও বেড়ে যায়।
‘ঘা’ নামের অন্য আখ্যানটিও মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক। উত্তম পুরুষের কথকও একজন লেখক। তার বন্ধু বহুদিন পর জার্মানি থেকে দেশে ফিরে আসে। বাংলাদেশ নিয়ে সে বরাবর নিম্ন ধারণা পোষণ করতে থাকে। লেখক যুক্তি এবং উদাহরণের মাধ্যমে বুঝিয়ে দেন বাংলাদেশের উন্নতির কথা, স্বাধীনতার প্রাপ্তির কথা। জার্মানিতে গিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানের পেছনেও রয়েছে আমাদের স্বাধীনতার ছোঁয়া। লেখক সে-কথাও বলেন। এ আখ্যানটিতে বিশেষভাবে এসেছে বীরাঙ্গনাদের কথা। লেখক মুক্তিযুদ্ধের কথা বলেন। কয়েকজন বীরাঙ্গনার কাহিনী বলেন। এভাবে আরেক বীরাঙ্গনার সন্ধান পান। প্রবাসী বন্ধু সে অসহায় বীরাঙ্গনার সব দায় দায়িত্ব নিয়ে নেন।
এ আখ্যানটির মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের আরো কয়েকটি অজানা অধ্যায় জানা হয়ে যায়।
নয়মাস ও ঘা আখ্যানিটিতে লেখক এভাবে বিষয়ে, আঙ্গিকে, আয়তনে, উপস্থাপনে এক ভিন্ন মাত্রায় একাত্তরকে তুলে ধরেছেন। গল্প-উপন্যাসের প্রচলিত কাঠামো ভেঙে ফেলারও প্রয়াসী হয়েছেন। যা বাংলা সাহিত্যে নিঃসন্দেহে নতুন।
এবার আসা যাক তার সাম্প্রতিক দুটি উপন্যাস নিয়ে। সমকালে বসে দূরকালের হিসেব করা যায় না ঠিকই্। কিন্তু কিছু কিছু সাহিত্য কর্ম রচিত হয় যা সমকালে বসেও এর দূরলক্ষী প্রভাব ও প্রাবাল্য টের পাওয়া যায়। ইমদাদুল হক মিলনের জিন্দাবাহার এবং মায়ানগর উপন্যাস দুটি সম্পর্কে এ কথা খুব শক্ত করেই বলা যায়। বলা বাহুল্য উপন্যাস দুটি লেখকের আত্মজৈবনিক।
চলবে…
ইমদাদুল হক মিলনের কথাসাহিত্য-৩॥ এমরান কবির
ইমদাদুল হক মিলনের কথাসাহিত্য-২॥ এমরান কবির
ইমদাদুল হক মিলনের কথাসাহিত্য-১॥ এমরান কবির