॥পর্ব-১॥
বন্ধুর সঙ্গে বাজি ধরে এক তরুণ লিখে ফেললো একটি গল্প। বাজির অংশ হিসেবে সেটা পাঠানোও হলো তখনকার দিনের একটি বিখ্যাত পত্রিকায়। গল্পটা ছাপা হয়ে গেলো। বাজিতে জিতে গেলেন সেই তরুণ লেখক। এই তথ্যটি সবার জানা। বলার অপেক্ষা রাখে না যে তখনকার ওই তরুণ লেখকের নাম মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। কী অপূর্ব কাকতাল। ওই ঘটনার কয়েক দশক পর আরেক তরুণ বন্ধুদের সঙ্গে বাজি ধরলো। তার লেখক বন্ধুর তখন মোটামুটি নাম। অনামি অলেখক বন্ধুটি লেখক বন্ধুর সঙ্গে বাজি ধরে ১৯৭৩ সালে বন্ধু শিরোনামেরই একটি গল্প লিখে পাঠালেন দৈনিক পূর্বদেশ পত্রিকার ছোটদের পাতা চাঁদের হাটে। জেদ ও বাজি ধরে লেখা ওই গল্পটি ছাপা হলো সেখানে। বলার অপেক্ষা রাখে না, দ্বিতীয় লেখক হলেন দুই বাংলার জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলন। মজার বিষয় হলো এই অপূর্ব কাকতালের ঘটনা তিনি জেনেছিলেন অনেক পরে।
সেই থেকে শুরু। আজ অব্দি চলমান তার সোনার কলমের ঝরনাধারা। লিখে চলেছেন একের পর এক উপন্যাস, ছোটগল্প, বড়গল্প, শিশুসাহিত্য, টিভি নাটক, সিনেমার চিত্রনাট্য ইত্যাদি। দায়িত্ব পালন করছেন একটি দৈনিকের সম্পাদক হিসেবেও।
আমাদের প্রকাশনা শিল্পকে একটি শক্ত অবস্থানে দাঁড় করার পেছনে ইমদাদুল হক মিলনের রয়েছে বিশেষ ভূমিকা। কিন্তু এই ভূমিকা পালন করতে গিয়ে এবং নিজের জীবিকার তাগিদে তিনি লিখে ফেলেছেন কিছু হালকা চালের রচনা। যা লেখককে এখন বিদ্ধ করে। লেখক অনুশোচনায় দগ্ধ হন। বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে তিনি তা সখেদে প্রকাশও করেন। এও বলেন, এ ছাড়া তার উপায়ও ছিল না ওই সময়। নিয়তি হয়তো বা এটাই চেয়েছিল। কিন্তু গৌরবের কথা হলো তার হাত দিয়েই বের হয়ে এসেছে ‘পরাধীনতা’র মতো উপন্যাস, বের হয়েছে ‘ভূমিপুত্র’। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লিখেছেন কালোঘোড়া যা গভীর প্রতীকী ব্যঞ্জনায় উজ্জ্বল। লিখেছেন সাড়ে তিন হাত ভূমি’র মতো উপন্যাস যেখানে রয়েছে এমন এক চরিত্র, যাকে বলা যেতে পারে মুক্তিযোদ্ধার যথার্থ প্রতিনিধি। লিখেছেন নিজের জীবনের ছায়া অবলম্বনে কেমন আছ, ‘সবুজপাতা’, ‘জিন্দাবাহার’, ‘মায়ানগর’। আর ‘নূরজাহান’-এর কথা তো বলাই বাহুল্য। বাংলা সহিত্যের বৃহত্তম উপন্যাস হিসেবে খ্যাত এই মহাকাব্যিক রচনাটির একটি বাক্যও বাহুল্য নয়। সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম একটি লেখায় বলেছেন, ‘এই উপন্যাস থেকে একটি শব্দও বাদ দেওয়া যাবে না। এর গঠনটি এমন যে, এই রচনার কোনো বাক্য থেকে যদি একটি শব্দ বাদ দেওয়া হয়, তবে সেটা হবে এর অঙ্গহানি।’ বিশাল কলেবর হওয়ায় কোনো কোনো মহল ধারণা পোষণ করেন এর ব্যাপ্তিক প্রসার নিয়ে। কিন্তু সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম তা খারিজ করে দেন। দেশ পত্রিকায় বাংলাদেশের যে দুই-একজনকে বিশেষ মূল্যায়ন করা হয়েছে বিভিন্ন সময়ে, ইমদাদুল হক মিলন তাদের অন্যতম। বলা বাহুল্য বর্তমান সাহিত্য রচনায় দুই বাংলায় এমন বহুপ্রজ কিন্তু শিল্পমানে উত্তীর্ণ সাহিত্যিক আর একজনও নেই।
ইমদাদুল হক মিলন এত লিখেছেন, ভালো-মন্দ মিলিয়ে—তা নিয়ে আলোচনা করতে গেলে লক্ষ লক্ষ শব্দ ব্যবহার করতে হবে। যা সাহিত্য পাতার কলেবরের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে না। এমনকি তার প্রধানতম কর্ম-অবদান—ছোটগল্প নিয়ে আলোচনা করতে গেলেও এই কথা প্রযোজ্য। আমরা এখানে মোটাদাগে কয়েক দশক আগে প্রকাশিত উপন্যাস ও সাম্প্রতিক কিছু উপন্যাস নিয়ে সংক্ষিপ্ত কথা বলতে চাই।
আগেই বলা হয়েছে, স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তার কালোত্তীর্ণ উপন্যাস ‘কালোঘোড়া’র কথা। কয়েক দশক আগে লেখা এই উপন্যাসটি তার একটি উল্লেখযোগ্য রচনা। ‘কালোঘোড়া’ স্বাধীনতার বহুমাত্রিক প্রতীকী উপন্যাস হিসেবে বিবেচ্য।
একটি নিবিড় গ্রাম যুদ্ধের দামামায় কী রূপ পরিগ্রহ করে, বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষ কিভাবে এটাকে গ্রহণ-বর্জন করে, বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির মানুষের ভূমিকা কেমন হয়: স্বাধীনতা সংগ্রাম কিভাবে মানুষকে আত্মত্যাগী করে তোলে, পাশাপাশি স্বার্থপর ও কৌশলী করে তোলে, তারই এক মর্মন্তুদ কাহিনী ‘কালোঘোড়া’।
উপন্যাসের শুরু ‘বৃষ্টিটা আছেই’—এই ছোট্ট একটি বাক্য দিয়ে। ছোট্ট এ বাক্যটিই যেন এক বিশাল প্রতীক এই উপন্যাসের। আমরা জানি বৃষ্টি এমন এক নিয়ামক, যা সব কিছুকেই জড়িত করে ফেলে। ভিজিয়ে দেয়। বিভ্রান্ত করে। আমরা এও জানি, মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় এই বৃষ্টি আমাদের জন্য যেমন আশীর্বাদ স্বরূপ ছিল, তেমনি পাকিস্তানিদের জন্য ছিল বিভীষিকা। লেখক যেন এই প্রতীকী বাক্যের মাধ্যমে প্রথমেই জানিয়ে দিলেন অনেক কথা।
এরকম অনেক কথাই তিনি জানান তার এই উপন্যাসের মাধ্যমে। হাড়কিপটে রতনলালের কথা দিয়েই শুরু। তার দোকানের বেচা-কেনা, কর্মচারীদের কথা, গঞ্জের লোকজন, গ্রাহক সব কিছু উঠে এসেছে। আর নিবিড়ভাবে উঠে এসেছে রতনলালের মা-মরা একমাত্র বোবা মেয়ে কালীর কথা। রতনলালের সব আকাঙ্ক্ষা, সব স্বপ্ন, সব পরিকল্পনা ওই কালীকে ঘিরে।
কিন্তু রতনলালের আকাঙ্ক্ষা-স্বপ্ন-পরিকল্পনা সববিছু ধ্বংস হয়ে যায়। স্বাধীনতাবিরোধী চক্রের এক হোতা স্থানীয় চেয়ারম্যান বৃষ্টিবহুল এক দুপুরে কালীর ঘরে ঢুকে তাকে ধর্ষণ করে। অনেকক্ষণ পর কালির জ্ঞান ফিরলে সে বিবস্ত্র হয়ে স্থানীয় পুকুরে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। রাতে রতনলাল ঘরে ফিরে মেয়েকে না পেয়ে প্রায় পাগল হয়ে যায়। তার হাহাকার ভরা ডাক আর অন্ধকারে বৃষ্টির ভেতরে ছুটে চলা এক মর্মন্তদ দৃশ্যের জন্ম দেয়।
এরপর থেকে রতনলাল আর রতনলাল থাকে না। সে অন্য মানুষ হয়ে যায়।
রতনলালের দোকানের কর্মচারী বালক নয়নার আকাঙক্ষা-স্বপ্ন-পরিকল্পনাও ধ্বংস হয়ে যায়। আরেক কর্মচারী বারেকের দ্বারা সে বারবার নিগৃহীত হয়। একটা পুরো বিড়ি খাওয়ার আকাঙক্ষা তার সারাজীবনের। কিন্তু বারেকের জন্য সেটা সম্ভব হয় না। এদিকে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। চেয়ারম্যানের গোমস্তা বারেকের কাছে খবর পাঠিয়েছে দেখা করতে। বারেক প্রথমে দ্বিধাগ্রস্ত। দোদুল্যমান। তারপর স্থির। যে-দিন দেখা করতে যাবে তার আগের রাতে নয়নাকে সব খুলে বলে। বলে, চেয়ারম্যানের সঙ্গে মিলিটারিদের খুব ভালো সম্পর্ক। প্রতি সপ্তাহে চেয়ারম্যান সাব ক্যাম্পে দেখা করতে যায়। চেয়ারম্যানের সঙ্গে থাকলে আমার তোর কারও কোনো ক্ষতি হবে না।
বারেক এভাবে নয়নাকে নির্ভয় দিয়ে তাকে ভোগ করে। পরের দিন চলে যায় চেয়ারম্যানের কাছে।
এভাবেই চলছিল। এক রাতে দোকানের দরজায় টুকটুক শব্দ। অনেক দ্বিধা, ভয়, শঙ্কা আর সতর্কতার মধ্যেই সে হঠাৎ জিজ্ঞেস করে, কেডা? বাইরের অন্ধকার, বৃষ্টি আর হাওয়া সরিয়ে ফিসফিসে গলায় তখন ভেসে আসে একটি কণ্ঠ—‘আমি খোকা।’
জয় বাংলা শুরু হয়ে যাওয়ার পর থেকেই এই খোকাসহ অনেকেই কইলকাত্তা চলে গেছে। মানুষে বলে ওরা মুক্তিবাহিনী হয়ে গেছে। খোকাসহ আরও তিনজন হুড়মুড় করে দোকানে ঢুকে পড়ে।
এভাবে মুক্তিযুদ্ধে অবদানের ভেতরে ঢুকে পড়ে রতনলালের এক সাধারণ কর্মচারী নয়না। রতনলালের দোকানের মিষ্টির হাড়ি থেকে খুব সাবধানে একটা একটা করে মিষ্টি এনে মুক্তিযোদ্ধাদের খাওয়ায়। থাকার জায়গা দেয় গোপনে। এলাকার তথ্য দেয়।
একদিন সকালে বারেক এসে নয়নাকে নিয়ে যায় চেয়ারম্যানের কাছে। নয়নার বুক শুকিয়ে কাঠ। কী হতে চলেছে! বারেক তাকে আশ্বস্থ করে তোর কিছু হবে না। কারণ আমি আছি। এই একটিই ভরসা। চেয়ারম্যানের বাসায় ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই তাকে বেঁধে ফেলে চেয়ারম্যানের গোমস্তা। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে, রাতে তোর ডেরায় কে কে আসে?
আজীবন দূর্বল ব্যক্তিত্বের নয়না মুহূর্তেই স্থির হয়ে যায়। স্পষ্ট করে জানিয়ে দেয়, সে জানে না। তারপর তাকে কঠিন এবং নির্মমভাবে পেটানো হয়। তবু সে স্বীকার করে না মুক্তিযোদ্ধাদের কথা। এক পর্যায়ে যে মারা যায়।
খোকার নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধার এই ক্ষুদ্র দল তাদের পরিকল্পনা আঁকে। চেয়ারম্যানের ছোট বউও তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করে।
পরিকল্পনা অনুযায়ী খুব সফলভাবে মুক্তিযোদ্ধারা স্বাধীনতাবিরোধী চেয়ারম্যানকে দুই সহযোগীসহ ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা করে। চেয়ারম্যানের রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে তারা গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে—‘জয় বংলা’, ‘জয় বাংলা’।
একাত্তরে জেগে ওঠার সেই সব দিনের কথা, একটি শান্ত-শিষ্ট গ্রামের পরিবর্তিত চেহারা, মুক্তিযুদ্ধের প্রভাবে বদলে যাওয়া মানুষের চরিত্র, এক সাধারণ বালকের কাছে মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় প্রাপ্তি, বোবা যুবতীর প্রাণ বিসর্জন, মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে স্বাধীনতাবিরোধীদের হোতা চেয়ারম্যানের দুই সহযোগীসহ মৃত্যু, মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়দাতা বালকের নিজের অজান্তেই মুক্তিযোদ্ধা হয়ে ওঠার কথা—এগুলো বয়ান করেন কথাশিল্পী ইমদাদুল হক মিলন।
চলবে…