তুমি তো দেখছি মনডারে হাতে লইয়া আইছো আইজ। বলি, একটু বেশি মনযোগ দাও। শাড়িডা যেন্ সেই রকম হয়, আমার ইজ্জতের প্রশ্ন।
ধমকটা নুর হোসেনের বুকে একেবারে শেলের মতো বেঁধে। পাশাপাশি আরও দুই কারিগর খটাখট হাতেম টানছে। অপমানটা সে কারণেই একটু বেশি বাজছে। এছাড়া এ তল্লাটের কে না জানে নুর হোসেন মাকুর জুড়ি মেলাভার! দাদীর শিক্ষা, বাপের স্বপ্ন—সব বিসর্জন দিয়ে একদিন সে ঢুকে পড়েছিল বসাকদের পাড়ায়। নুর হোসেনের বাবা মোবারক হোসেন। দাদী বলতেন, তিনবেলা ভাত খাওয়ার সময়টুকু ছাড়া তার জমিতেই থাকতে বেশি ভালো লাগত। বলতে গিয়ে দাদীর বুকটা কেমন গর্বে ফুলে উঠতো। এরপর সে মৃত স্বামীর কথা বলতে থাকতো, তোর দাদাও ছিল সেই রকম। কুইড়ামি ছিল না কামে। হে কইতো, বেটা তো, বেটা ছাওয়াল হবে বেটা ছাওয়ালের নাহান। জমি জিরাত থাক্ না থাক, ধান ঘরে তোলাই হলো আসল পুরুষের ধর্ম। ধান হলো বীর্জের প্রতীক। পৌরুষের প্রতীক। যে পুরুষ ধান ফলাতে জানে না, তার বাঁচা-মরা সবই সমান। আমি চাই, ছাওয়াল আমার চাষি হোক, ঠিক আমার পূর্ব-পুরুষের মতো। তোর বাপ এক্কেরে সেই রকম হইছিল, দাদীর মুখে বিজয়ের হাসি। সেই হাসি নিয়েই তিনি পৃথিবী ছেড়েছেন। পেশা নিয়ে পরাজয়ের গল্পটা তাকে শুনতে হয়নি। সে কেবল নুর হোসেন জানে। দেশ স্বাধীন করতে গিয়ে নিজের ভিটে দখল হওয়ার ঘটনার চেয়ে তার বাপের জীবনে সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনা আর কী-ই বা আছে! মামার বাড়ি আশ্রিত হিসেবে থাকলেও মুক্তিযোদ্ধা বাপকে কিষাণ নিতেও অস্বীকৃতি জানিয়েছিল তোফাজ্জল, মতলেবদের মতো মানুষেরা। বাপের মুখে তবু অভিযোগ ছিল না! তার বিশ্বাস, শেখ সাব যখন রাজা হইছে, একদিন তার সুদিন আসবে। সেই সুদিন তার বাপের জীবনে আর অসেনি, নুর হোসেনের জীবনেও কি এসেছে! চারটা মাকু ম্যানেজ করতে গিয়ে নুর হোসেনের পায়ের গতি খানিকট শ্লথ হয়ে আসে। হলুদ-লাল আর সবুজ কম্বিনেশনের বিশেষ শাড়িটার নকশায় একসূতা ডিফেট খায়। অমনি পাশ থেকে চেচিঁয়ে ওঠেন অশোক বসাক—রাখো, রাখো, সরে যাও। ওঠো। কী বালের কাম করতে আইছো, কও দেখি? তুমি তো আমার সর্বনাশ করে ছাড়বা দেখছি! একরকম জোর করে উঠিয়ে ছিল সে নুর হোসেনকে। নুর হোসেন কোনো প্রতিবাদ করল না। বিস্মিত হয়ে সে বাপের বয়সী মানুষটার দিকে তাকিয়ে থাকে। কী একটা বলতে গিয়েও থেমে যায়।
অশোক বসাক পিটলুমে পা ঝুলিয়ে বসে। শাড়ির জমিনে দু-হাত বুলিয়ে স্বগতোক্তি করে। দীর্ঘ বিশবছর পর সে এইখানে বসলো। সবতেই হলো। কারণ এটা একটা বিশেষ শাড়ি। বিশেষ অর্ডারের কাজ। পেঁচায় জড়ানো একটা সূতা। এ সূতায় শাড়ি হওয়ার কথা ছয়টা কিন্তু শাড়ি হবে একটা। পুরো সুতার দাম পরিশোধ করে দিয়েছে ক্ষমতাসীন দলটির ইউনিয়ন পরিষদের এক সদস্য। চেয়ারম্যান সাহেবের একমাত্র মেয়ের বিয়ের শাড়ি এটি। এর নকশাও আর ব্যবহার করা যাবে না, এই শর্তেই শাড়ি বুনানোর কাজটি দেওয়া হয়েছে আশোক সবাককে। পৈত্রিকসূত্রেই আশোক বসাকরা তাঁতের কাজ করে। আশোকের তাঁতেই তৈরি হয় তল্লাটের সবচেয়ে ভালো শাড়ি। নুর হোসেন সেখানেই কাজ করে। নুর হোসেনকে সরিয়ে দিয়ে অশোক যখন হাতেমে ডান হাত আর যাইসালে বাম হাত রাখলো, তখন পাশ থেকে জাবেদ আলী-নুর হোসেন পরস্পর চোখ মেলালো। সেদিকে লক্ষ নেই অশোকের। হাতেমে টান দিতেই অশোকের মুখটা বিবর্ণ হয়ে উঠলো। চোখটা আচমকা ঝাপসা হয়ে উঠতে সে দেখতে পায় পেঁচার ওপর দিয়ে একটা মাথাবিহীন নারী সাদা শাড়ি পরে হেঁটে গেলো জানালার দিকে। এই সময় নুর হোসেন অশোকের কাঁধে হাত রাখে। তার অবসন্ন হাতে হাত রেখে নরম করে বলে, কাকু, আমার ওপর ভরসা রাখুন। উঠুন। অশোকের দুগাল বেয়ে অশ্রু ঝরতে থাকে। তিনি নুর হোসেনের হাতটা চেপে ধরেন এবং মাথা ঝাঁকান। নুর হোসেনের জায়গাটা দিতে উদ্যত হন। ক্রাচের বদলে তিনি নুর হোসের কাঁধে ভর রেখে পিটলুম থেকে উঠে আসেন। নুর হোসেন পিটলুমে পা ঝুলিয়ে বসে।
নুর হোসেনের বিবেক-পীড়িত হৃদয় ঠিকই অশোকের যন্ত্রণা কাতর হৃদয়কে স্পর্শ করলো। বললো, কাকু, আপনি এখানে বসে আমাকে শুধু বলেন, কী করতে হবে। আপনার মনমতো না হওয়া পর্যন্ত, এই আমি বসলাম, উঠবো না। আপনি চাপ নিয়েন না।
অশোকের তাতে কি সান্ত্বনা মেলে? নুর হোসেনকে নির্দেশনা দেওয়ারও কিছু নেই, জানে দুজনেই। নকশার কাগজ ঝোলানো আছে ওপরে। প্যাডেলে পায়ের ওঠানামা আর হাতেম টানার ওপরই নির্ভর করবে শাড়ির নকশা। অশোক কাঁধের গামছা নিয়ে মুখটা মুছলো। নুর হোসেন হাতেম টানতে শুরু করে।
হাতেম আর ফাইসাল টানার শব্দ একইভাবে বেজে চলছে; একই তালে। এই শব্দের তাল থেকে আলোয়া গ্রামকে যেন বিছিন্ন করা যায় না। অলোয়া গ্রামের পথে পথে, আকাশে-বাতাসে সর্বত্রই খটর খটর বাজছে একটি গান—‘কী বা রঙে বুনবো শাড়ি, ছবিখান দেখায়াদে…।’
দুই.
খটর-খটর হাতেম টানার শব্দে অশোকের বেদনাটা আরও ভারী হয়ে ওঠে। তার কেবলই মনে হয় জীবন যাওয়ার চেয়ে একটি পা হারানোর যন্ত্রণা অনেক বেশি ভারী। ১৯৭১-এর মুক্তযুদ্ধ যে কেবল অশোকের জীবনটা বদলে দিয়েছে, তা তো নয়! সেই যুদ্ধ একটু একটু করে বদলে দিয়েছে আলোয়া গ্রামের নিজস্ব ভবন। ভাবতেই ডান পায়ের ব্যথাটা তীব্রভাবে অনুভব করে অশোক। ব্যথাটা ক্রমশ ছড়িয়ে যায়। চোখের সামনে চলছে জমকালো নকশায় আঁচলের কাজ। চার চারটা মাকু সামাল দিচ্ছে নুর হোসেন। আঁচলটাকে মনে হয় আলোয়াগ্রাম, সারা বাংলাদেশ। ধ্যানী বুদ্ধের মতো সে নিবিষ্ট চিত্তে চেয়ে আছে শাড়ির আঁচল আর মাকুর দিকে। দেখতে পায় মাকুগুলো কেমন জীবন্ত হয়ে উঠছে। শাড়িখানা হয়ে উঠছে জীবন্ত এক পতাকা। সেই পতাকা উড়ছে বেনাপোলে। জব্বার মশিউর ধর্মদাস আর ভূপালদের সঙ্গে অশোক আছে কাগজ পুকুরিয়ায়। বৈশাখ মাস। দিগন্তহীন ফসলের মাঠ এখন ফাঁকা। ধূ-ধূ ধুসর মাঠ। পানির অভাবে বুক ফেটে চৌচির। তৃষ্ণার্ত এক মানুষের বুক বলে মনে হয়েছিল অশোকের। পানির জন্য সে ক্রদ্ধ। সেই রকম একটি মাঠের মদ্যদিয়ে হেঁটে আগাচ্ছিল অশোকরা। আজ অকলঙ্কিত রক্তে তাদের শত্রু হননের ইচ্ছা। চিরকালের শান্ত ও শান্তিপ্রিয় অশোক জব্বারেরা মায়ের স্নেহ আর ভায়ের প্রেমে, পিতার দরদে চিরকাল নিশ্চিন্ত এক জীবন পার করছে। আজ তারা নেমেছে রক্তের লড়াইয়ে। বুকজুড়ে তাদের খা খা তৃষ্ণা। মাঠের কোথাও কোনো প্রাণের স্পন্দন নেই। কোথাও কুঁচরিফুলের গাছও নেই, চেঁকাশাকের চিরল পাতার অস্তিত্বও নজরে আসে না। অশোকরা মানচিত্র অনুযায়ী হেঁটে আগায়। সামনেই কাগজ পুকুরিয়া গ্রাম। তারই পশ্চিম পাশে বেনাপোল। গ্রামে ঢোকার মুখে বিশাল এক মান্দার গাছ। ন্যাড়া গাছে লম্বা লম্বা ফল ধরে আছে। মাদার গাছের কাছে এসে জব্বার হাত তুলে ঘুরে দাঁড়ায়। প্লানটা আর একবার বুঝিয়ে দেয় সঙ্গীদের। সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গে বেনাপোলের পূর্বপাশ দিয়ে যে বড় রাস্তাটা উত্তর দক্ষিণে চলে গেছে, সেদিকে রওনা হয় তারা। ইতোমধ্যেই আর একটি দল পৌঁছে গেছে সেখানে। হঠাৎ অন্ধকার বিদীর্ণ করে গর্জে ওঠে মেশিন গান, আর মশিউরদের থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল থেকে থেকে গুলির শব্দ, শিশুদের ভয়ার্ত চিৎকার, আহত মানুষের আর্তনাদে কাগজ পুকুরিয়ার শান্ত চেহারাটা একেবারেই বদলে যায়। হঠাৎ মেশিনগানের একটা গুলি এসে লাগে আশোকের ডান উরুতে। মায়ের মুখখানা ভেসে উঠেই নিমিষে মিলিয়ে যায়। যখন অশোকের জ্ঞান ফেরে, দেখে সে ভারতে, হাসনাবাদ ক্যাম্পে। ডান পা’টা নাড়ানোর চেষ্টা করতেই নার্স ছুটে আসে—আহ্, করছেন কী?
ডাক্তার বলেন, ব্যস্ত হবেন না! ক’দিন বিশ্রাম করুন। ঠিকমতো ওষুধগুলো খেলে আপনি একেবারেই আগের মতোই সুস্থ হয়ে যাবেন। তারপর নার্সকে নির্দেশ দিলেন, ওনার ওষুধগুলো যেন ঠিক সময়মতো দেওয়া হয়, সেদিকে খেয়াল রাখবেন।
কদিন হঠাৎ মাঝরাতে চিৎকার করে উঠলো অশোক। অন্য ইউনিট থেকে ছুটে এসেছিল দু’জন নার্স।
কী হয়েছে?
অশোকের ফর্সা মুখের দিকে তাকিয়ে একজন সিস্টার ডাক্তারকে ডেকে আনলেন। ডাক্তার স্তম্ভিত হয়ে গেলেন, গ্যাঙগ্রিন! এমনটা তো হওয়ার কথা নয়?
কর্তব্যরত নার্সটিকে খুঁজে পাওয়া গেলো না সেখানে। ডাক্তারের নির্দেশে একজন সিস্টার ইনজেকশন পুশ করলেন। সেই ঘুম যখন ভাঙলো, ডাক ছেড়ে কেঁদে উঠলো সে। ভিজে উঠলো উপস্থিত নার্সের চোখও। ডাক্তার বললেন, আপনি যুদ্ধটা শিখেছেন বটে। কিন্তু আপনাকে বাস্তবতার জামাটাও গায়ে দিতে শিখতে হবে।
জামার প্রসঙ্গ আসতেই তার চোখের সামনে পৈত্রিক তাঁতযন্ত্রের ছবিটা ভেসে উঠলো। পিটলুমে পা রাখলে তবেই না চলবে তাঁতযন্ত্র। প্যাডেলে পা না পড়লে কেমন করে চলবে মাকু?
অশোকের কান্না থামে না। সদ্য কৈশরোত্তীর্ণ ২২ বছরের যুবক সে। ডাক্তার বললেন, মুক্তিযোদ্ধা আপনি। কেন ভঙে পড়ছেন? ভাবুন তো, সেই দিনের যুদ্ধে আপনার সহযোদ্ধারা সবাই কি বেঁচে আছে?
কিছুতেই সান্ত্বনা মেলে না অশোকের। কান্নাজড়িত কণ্ঠে সে বলে, ডাক্তার বাবু, আমাকে পা’টা ফেরত দিন, আমি যুদ্ধে যাবো। এখনো দেশ স্বাধীন হয় নাই। আমি যুদ্ধে যাবো ডাক্তার বাবু। আমার…আমার পা’টা ফেরত দিন। ডাক্তার বাবু মাথা নিচু করে চোখের জলটা সামলানোর চেষ্টা করেন।
তিন.
কিছুদিন পরে অশোক জেনেছিল, শরণার্থী শিবিরেও পঞ্চম বাহিনী কর্মতৎপর ছিল। তাদের ষড়যন্ত্রের কারণেই পা’টা হারিয়ে ছিল অশোক। তার দায়িত্বে থাকা নার্সটি তাকে ঘুমের ইনজিকশন ছাড়া কোনো এন্টিবায়টিকই দেয়নি। যার ফলে গ্যাংগ্রিন হয় অশোকের পয়ে। পা’টা বাদ দেওয়া ছাড়া তাকে বাচাঁনোই কঠিন। এই নার্সকে নিয়ে ঝামেলা হলে চক্রটি ধরা পড়েছিল পাকা রাস্তার কাছে মুক্তযোদ্ধাদের হাতে। কিন্তু কী লাভ হলো অশোকের! যুদ্ধ শেষ হলে সে যখন ফেরে, ভীষণ অপরিচিত লাগে আলেয়াগ্রামকে। যুদ্ধে দীপেন-হিতেনরা দেশ ছেড়েছে। ওদের বাড়িটা এখন মোয়াজ্জেমদের বাড়ি। আলেয়া তাড়িনির মুসলীম লীগের অসগর আলী-খাঁর বড় ছেলে মোয়াজ্জেমের দাবি, বাড়িটা সে কিনে নিয়েছে। কিন্তু এলাকার সবাই জানে দীপেনের বৌ-বাচ্চাদের সর্বনাশের হুমকি দিয়ে কিভাবে সে দখল করেছে এই বাড়িটা। স্বপন দারা বাড়ি ছেড়ে গেছে দেশ স্বাধীনের অনেক পরে। বাড়িটায় কোনো স্মৃতিচিহ্ন আর নেই। যাওয়ার আগের দিন স্বপনদা এসেছিল অশোকের বাবার কাছে। বৈশাখের সন্ধ্যাক্রুদ্ধ আকাশের মতো ছিল স্বপনদার মুখ। থমথমে গম্ভীর। সেই মুখে কোনো প্রতিবাদের ঝড় ছিল না। দাওয়ায় বসে অশোক কেবল মুড়ি চিবুচ্ছিল। স্বপনদাদের বাড়িতে বৈদ্যুতিক তাত কল বসেছে এখন। শ’খানেক কর্মচারী খাটে সেখানে। তাদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অশোকবসাক দৌড়াতে পারবে কেন? তবু সুনামের জোরে যতটুকু যাওয়া যায়, তাতেই সে সন্তুষ্ট। বসাকদের একটা বড় অংশ যুদ্ধের পর কলকাতায় চলে গেছে। এখন ওখানে গড়ে উঠেছে ফুলিয়া কলোনি। বাংলাদেশের তাঁতের শাড়ির রমরমা ব্যবসা। অশোকের দাদারা বরাবর বলেছে। কিন্তু রাজি হয়নি অশোক। যদিও জীবনটা এখানে কাচের বাসনের মতো ভেঙে টুকরো টুকরো হতে থাকে প্রতিনিয়ত, তবু বাদ দেওয়া পায়ের প্রান্তদেশ ছুঁয়ে নিজের মতো করেই গুছিয়ে নেয় সে জীবনের সাঙ্গটা। তাই চেয়ারম্যানের মেয়ের বিয়ের বিশেষ শাড়িটা যখন পায়, তখন চড়ুই পাখির মতো ছিটিয়ে ছিটিয়ে সারা শরীরে সে সুখের জল মেখেছিল গায়ে। বিষয়টা যতটা না অর্থনৈতিক তার চেয়েও বেশি যে সম্মানের। নুর হোসেনের হাতের টানা শেষ হয়। কাচি নিয়ে সে দক্ষ হাতে বাড়তি সুতো কাটতে থাকে।
কাকু!
সম্বিৎ ফিরে পায় অশোক। নুর হোসেনের মুখের দিকে তাকায়। তারপর শাড়ির জমিনে হাত রেখে উৎফুল্ল হয়ে ওঠে। পেঁচা আর নরদে টান টান শাড়ি দেখলে প্রাণের কোথাও টান লাগে। শাড়ির নিজের কোনো উচ্ছ্বাস প্রকাশের ভাষা নেই। কিন্তু অশোকের আছে। সে শাড়ির পরতে পরতে হাত বুলায়। মাঝে মাঝে তারিফ করে নুরুর। অশোক দেখতে পায় একটা শাড়িপরা নগ্ন পা হেঁটে যাচ্ছে। লাল আলতায় ভেজানো পা ডুবে যাচ্ছে সবুজ ঘাসের ভেতর। এমন একটা শাড়ি সে কোনোদিন বুনতে পারবে না। ভিজে ওঠে চোখটা। নরদ থেকে শাড়িটা খুলে নিতে হবে। এ সময় ঢেউটিনের দরজা ঠেলে ভেতরে এসে দাঁড়ালো তিন চার জন। যে অর্ডার দিয়েছিল, সে এগিয়ে এসে বললো, আইজ ডেভিভারির ডেট আছিল। হইছে শাড়ি খান! অশোক কিছুটা সময়ের জন্য ছন্দ হারায়। চেয়ারম্যান সাব পাঠাইছে।
হঠাৎ বিদ্যুৎ খেলে যায় অশোকের রক্তে। এতক্ষণ যে পেশাদারী মানুষ হয়েছিল, এখন তার ঘোর কাটে। এবার তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে আজগর আলীর ভাস্তের মুখ। রাজাকারের জন্য সে শাড়ি তৈরি করছে। সে দেখতে পায় শাড়িখানা পরে চেয়ারম্যানের মেয়ে নয়, স্বয়ং চেয়ারম্যান হেঁটে বেড়াচ্ছে অন্ধকারের বুকে। নিরীহ মানুষের পেছনে-পেছনে। অদৃশ্য সব দানবের সঙ্গে সে হেঁটে বেড়াচ্ছে, শাড়ির সমগ্র আঁচলে আছে—গোলাম আজম আর তার অনুসারীদের চোখ।
অশোকের শিল্পী সত্তায় টান লাগে। চোয়ালটা শক্ত হয়ে ওঠে। সংযত হয়ে বলে—বাছারা, এখনো শাড়িখানা তৈরি হয়ে উঠে নাই। আর একটা দিন সময় লাগবে। ওরা চলে যায়। নুর হোসেন তাকিয়ে থাকে অশোকের দিকে। বলে—খুলবো শাড়ি খান? হাত দিয়ে ইশারা করতেই নুর হোসেন শাড়িখানা খুলে নেয় নরদ থেকে। তারপর দক্ষহাতে ভাঁজ করে বলে—কাকু, এই ধরেন। অশোক বাম হাত দিয়ে শাড়ি খানা নিয়ে ক্রাচে ভরকরে উঠানে নেমে যায। বগলতলায় ক্রাচ রেখে দুই হাতে মেলে ধরে শাড়ি। নুর হোসেনকে ডাকে—নুরু।
—কাকু।
—ম্যাচটা নিয়ে আয়।
নুর হোসেন থতমতো খায়। অশোক কখনো বিড়ি-সিগারেট খায় না জানে নুর হোসেন। সুধায়, ম্যাচ ক্যারে কাকু?
—তুই আন।
নুরু ম্যাচটা এগিয়ে দেয় অশোকের দিকে। শালার রাজাকারের বাচ্চারে দিমু না শাড়ি—শক্ত হয়ে ওঠে অশোকের চোয়াল। নুরু চমকে ওঠে—কও কী কাকু! ওরা কি আস্ত রাখবে আমাগো?
—যে বাল ফেলায় ফেলাক।
নুরু উঠানে বসে পড়ে। শাড়ির আঁচলখানা ধরে। বিষণ্ন হয়ে ওঠে তার মুখমণ্ডল। একটা জখমি জানোয়ারের মতো শাড়িটাকে হাতে জড়িয়ে নেয় অশোক। নুরুর হাত থেকে হড়কে যায় আঁচল। অশোক ক্রাচ পাশে রেখে বসে পড়ে উঠানে। অশোকের বউ এসে হায় তোলা সাপের মতো মুহূর্তে হিসহিস করে ওঠে আগুন। একটা কথাও না বলে ক্রাচে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ায় অশোক।