‘পদ্য বাউল’ প্রোডাকশনটির প্রতিটি কবিতাই সবাইকে পড়তে হয়েছিল নিবিষ্ট মনে। রিহার্সেলের কল থাকতো সকাল ১০টায়। আমরা সকাল সাড়ে ন’টা পৌনে দশটায় পৌঁছতাম টিএসসিতে। শুরু হতো কবিতাপাঠ। কবিতাগুলো প্রথমে একটি একটি করে শুধু সাধারণ পাঠ হতো। কার ভয়েজে কোন কবিতাটি কতটা যায়, কোন কবিতা কার কতটা গভীরে প্রবেশ করেছে, এসব দেখা হতো। তারপর যার যার কবিতা সিলেক্ট করার পর শুরু হতো নির্মাণ। কবিতাটি প্রথম পড়ি আর প্রথম লাইনটি শোনার সঙ্গে সঙ্গে এতটাই মুগ্ধ হয়ে যাই যে, ২২ বছর ধরে সে আবেশ কাটিয়ে উঠতে পারিনি তার—‘আজ সেই ঘরে এলায়ে পড়েছে ছবি’।
এই একটি লাইন কতভাবে যে মনের ভেতর আলোড়ন তুলতো, তা কেবল আমিই জানি। কী অর্থ এর! কী আছে এই শব্দকতকের আড়ালে! যদি তার সঙ্গে কথা বলা যেতো! কাকে লিখেছেন কবি! কাকে এঁকেছেন! কী লিখেছেন! কী বলেছেন! কী অসাধারণ এক নতুন ভাষা! একই শব্দ, একই বর্ণ এ যাবত কাল যেভাবে পড়ে এসেছি, যা লিখে এসেছি, তা-ই এখানে লেখা আছে; অথচ কী যে অপরূপ দুর্ভেদ্য অন্যরকম এক র্যাপআপ! কী এক দুর্বোধ্য রহস্য কিন্তু ভীষণ আকর্ষণে কেবলেই গভীরে টানে। কেবলই ভেতর পোড়ায়। ছবি কেমন করে এলায়ে পড়ে! ক্লান্ত হয়ে পথিক শরীর এলিয়ে দেয় বটের ছায়ায়। কোনো রূপসীর একঢাল লম্বা ঘনকালো চুল এলিয়ে পড়ে ঘাড় বেয়ে আবেশে আলস্যে। এই তো জানি একজীবনে। বেদনার গভীরতা! যাতনার স্তব্ধতা! বিলাসের বিধুরতা! ক্ষতের যাতনা! ২২ বছরের এক মানবীর পক্ষে এই বিধুর বিচ্ছেদী আর অসামান্য বিরহের অসাধারণ ভিজ্যুয়ালাইজেশন করা কী আদৌ সম্ভব? তবু বুকে কোথায় যেন ছলছল করে কেঁদে ওঠে বেদনার নদী। ঢেউগুলো তার যেন ভেঙে ভেঙে পড়ে এসে আমারই মনের গহীনে। আর পড়তেই থাকে ভেঙে ভেঙে ভেঙে। খুব ভিজুয়ালাইজ করার চেষ্টা করি। ছবি কি ক্যামেরায় ফ্রেমে বাঁধানো ফটো? না কি মনের পর্দায় ছাপ ফেলে দেওয়া, এঁকে দেওয়া এক অপরূপ মনোহরণ! কেমন করে এলায়ে পড়ে ছবি? কেমন করে? এই রহস্যের জটাজালের আজও হয়নি কোনো ভেদ। কবিতাটি নিজের দখলে রেখেছিলেন প্রযোজনাটির পরিচালক আবৃত্তিকার মাসুদুজ্জামান। মনে পড়ে সেই পাগলামী সেই গভীর ভালোবাসা কবিতার জন্য। মনে পড়ে কবিতার জন্য সেই সুগভীর প্রেম আবৃত্তিকারের। মাসুদুজ্জামানকে আমি খুব কাছ থেকে চিনি। খুব গভীর আর নিগুঢ় তার বাঁধন কবিতার সঙ্গে। এই ধারাবাহিক লিখতে লিখতে বারবার নানাভাবে আসবে তার কথা। কারণ কবিতায় কবিতায় তার সঙ্গে আমার গড়ে উঠেছিল এক অপরূপ বাঁধন। আজও যা অমলিন। আমি তাকে বলি, জাত আবৃত্তিকার। তিনি হয়তো কবি হতে পারতেন। লিখতে পারতেন দারুণ কোনো রচনা। তার পড়া কবিতার সংখ্যা বিপুল। কবিতার সঙ্গে অন্তর্নিহিত এক মোহন বেদনা বিধুর কিংবা ক্ষীপ্র কিংবা দ্রোহ কিংবা লাস্য তার তৈরি হয় খুব সহজেই। এটা আমার বরাবর মনে হতো।
তখন সবে জণ্ডিস সেরে উঠেছেন। বাড়ি থেকে ফোটানো পানি নিয়ে এসে বসতেন সেই চিরকালের খুব গুরুত্ববহ আর ইঙ্গিতবহ আসন করে। সেটা না দেখলে বুঝিয়ে বলা ভীষণ কঠিন। বসতেন নিশাত আপা। বসতাম আমি, সোহেলী আপা, শারমিন, মাহফুজ, মাসুম, শিফা আপা, সোহেলভাই আর সোহাগভাই। তৈরি হতো সূক্ষ্ণ গভীর আর তুখোড় অথচ নিয়ন্ত্রিত এক আবেগের নৈবেদ্য। চিরে চিরে পড়তাম আমরা কবিকে। তার বেদনাকে। তার ভালোবাসাকে। পড়তাম তার ভাষাকে। তার উপমা-রূপক আর চিত্রকল্পকেও। মাসুদভাই পড়তেন তার নিজস্ব ভঙ্গিতে। আমরা যখন নতুন নতুন একটা ফর্ম ধরে পড়তে শিখছি মাত্র, তখন তাকে দেখেছি ফর্ম ভাঙছেন। পড়ছেন নিজস্ব এক ঢঙে।
যেখানে এলায়ে পড়েছে তার ছবি জানি না কে সে? তবু সর্বগ্রাসী হাহাকার দিগন্তে প্লাবন আনে। যে ঘর আজ শূন্য। যে ঘরে প্রেম নেই। শূন্য সে চরাচরে বটের মূলে রাখাল বসে না। একসময় রাখালের বাঁশির সুরে কেঁদে কেঁদে সারা হতো যে বটের মূল, আজ সেখানে প্রেম নেই। শূন্য গৃহাঙ্গনে কেবল এলায়ে পড়ে থাকে একটি মুখের ছবি। এই অবধি হারানোর, না পাওয়ার, না দেখার অথচ গভীরে অস্তিত্বশীল এক মানব কিংবা মানবীর ছায়া ছায়া মুখ ভাসে। অসম্ভব সুন্দর উপমা বিধৌত করে তুলে এনেছেন এক পরিশীলিত আবেগ আর তৈরি করেছেন এক অসাধারণ চিত্রকল্প—‘এখনো বরষা কোদালে মেঘের ফাঁকে/বিদ্যুৎ রেখা মেলে।’
তারপর শুরু হয় একটি দুর্দান্ত অভিমানের অবিস্মরণীয় এক ইনিংস। মাত্র আটটি লাইনে যেন উঠে আসে এক সুদূরগ্রাসী ব্যাপক বিধুর বিস্তর অভিমান। আর তার পরতে পরতে আঁকা রয়েছে অপরূপ সব চিত্রকল্প। মাসুদ ভাইয়ের খুব সাদামাটা কণ্ঠ। সাধারণ আবৃত্তিকারদের মতো ভরাট নয়। অথচ যখন পড়তে শুরু করেন, তখন অন্য এক মানুষ বের হয়ে আসেন ভেতর থেকে। এ যেন সত্যিকারের সেই লেখক। যার বুক চিরেই উঠে আসছে দীর্ঘশ্বাস। তার বেদনা চিরে চিরেই যেন জন্ম নিচ্ছে একেকটি শক্তিশালী অভিমান। তার শব্দ উচ্চারণের অলিতে গলিতে ছড়িয়ে পড়ছে যত যাতনার বিশেষ। এভাবে নির্মাণ করেছেন তিনি একেকটি কবিতার শব্দ থেকে বাক্য। বেদনা থেকে বিচ্ছেদ। প্রেম থেকে আনন্দ। আর বিশেষকে করে তুলেছেন সবিশেষ:
আজ সেই ঘরে এলায়ে পড়েছে ছবি
এমন ছিল না আষাঢ় শেষের বেলা
উদ্যানে ছিল বরষা পিড়ীত ফুল
আনন্দ ভৈরবী।আজ সেই গোঠে আসে না রাখাল ছেলে
কাঁদে না মোহন বাঁশিতে বটের মূলে
এখনো বরষা কোদালে মেঘের ফাঁকে
বিদ্যৎ রেখা মেলে।সে কি জানিত না এমনি দুঃসময়
লাফ মেরে ধরে মোরগের লাল ঝুঁটি
সে কি জানিত না হৃদয়ের অপচয়
কৃপণের বাম মুঠি।সেকি জানিত না যত বড় রাজধানী
তত বিখ্যাত নয় এ হৃদয়পুর
সে কি জানিত না আমি তারে যত জানি
আনখ সমুদ্দুর।আজ সেই ঘরে এলায়ে পড়েছে ছবি
এমন ছিল না আষাঢ় শেষের বেলা
উদ্যানে ছিল বরষা পিড়ীত ফুল
আনন্দ ভৈরবী।
(আনন্দ ভৈরবী: শক্তি চট্টোপাধ্যায়)
এখনো লিখতে বসে বোধের গভীরে ব্যবচ্ছেদ চলে অনবরত। একই রকম। কবি আর কবিতার। চোখে জল আনে সেই তো কবিতা। আর ব্যবচ্ছেদে ব্যবচ্ছেদে ভরে ওঠে শবাধার। বুকের আগল ভেঙে ভেসে যাই সে যাতনায়। আর অনিঃশেষ সম্পদে সমৃদ্ধ হযে উঠি ক্রমাগত। যতবার পাঠ করি ‘আনন্দ ভৈরবী’, তার চেয়েও বেশি বেজে ওঠে সেই অবিস্মরণীয় বিনির্মাণ।