পর্ব-দুই
মোহাম্মদ নূরুল হকের কবিতা: উপমার ক্যানভাসে বিমূর্ত কাব্যকলা
আধুনিক কবিতায় উপমার ভারে ভারাক্রান্ত—যারা এমন অভিযোগ করে আধুনিক কবিতাকে দূষিত করেন, তারা হয়তো ভেবে দেখেন না, কবিতার আদিকাল থেকেই উপমা বা প্রতীকের মাধ্যমে কবিতার অন্তর্নিহিত মাধুর্য খোদাই করা হয়েছে। প্রতীকাশ্রয়ী কবিতার মধ্যেই প্রকৃত কবিতার ব্যঞ্জনা নিহিত। কবির চেতনা অদ্ভুত রহস্যময়তার জালে আবদ্ধ। যেখানে কবি নিজেকে দাঁড় করান প্রতীকরূপে, নিজেকে উপস্থাপন করে সাধারণ মানুষের বাহক রূপে। কবির নিগূঢ় কল্পনার ইজেলে স্বপ্নময় কাব্যালোকের ছবি অঙ্কন করেন। বহুধাবিস্তৃত অঙ্গন ঘেঁটে কুড়িয়ে নেন শিল্পের প্রভাবক, কণা-অনুকণা। আর কাব্যভাষায় প্রতিফলিত হয় মননের সূক্ষ্ম রশ্মি, যা তার চেতনার অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ হয়। মোহাম্মদ নূরুল হকের কবিতায় জটিল চিন্তনের প্রভাবে উদ্ভাসিত যে রহস্য ভেদ করে, সেই কল্পচিত্র উদ্ধার করতে পাঠককে ভাবতে হয়। ঘোর আচ্ছন্নতায় কবিতার দ্যোতনা বিমূঢ় করে তোলে। ‘রোদের আঁচড়’ এমনই একটি কবিতা, যে কবিতায় কবি সমকালীন সমাজবাস্ততার মৃত্তিকায় হতাশাকে অঙ্কুরিত করেছেন। এই সমাজ যেন স্বপ্নহীন, তারার আলো নিভে গেলে গহিন তমিস্রায় কবিতাশ্রয়ী স্বপ্নেরা ঢেউ খেলে। নদীরা থেমে যায়, চেতনা থেমে যায়, থেমে যায় সব উর্বরচিন্তা। আর তখন কবিতাই পারে কেবল থেমে যাওয়া স্তব্ধতাকে গতিশীল করতে। চলমান জীবনের হতাশার স্ফুলিঙ্গ যেন কবিতা থেকে বিচ্ছুরিত হয়। মোহাম্মদ নূরুল হকের কবিতার শরীরজুড়ে থাকে উপমা ও বিমূর্তকলার দাপট।
এই নাও সান্ধ্যনদী; সূর্য মরে গেলে দিয়ো মাতাল চুমুক
আমার পকেটভর্তি তৃষাতুর চৈত্রের আকাশ
মগজে স্লোগান তুলে জেগে থাকে রাতগুলো আলোর কাঙ্ক্ষায়।চূড়ায় ওঠে না নদী-যে ওঠে সে পুড়ে মরে তুমুল ঘৃণায়।
‘স্রোতের নামতা’ কবিতায় কবি দেহজ ও কামজের আঁচড় টেনেছেন ইচ্ছেমতো। পুরাণ নির্ভর দীপ্তিমান প্রেমের আভায় ও নৈসর্গিক রূপে রূপায়ণের অভ্যন্তরে কবিতা উদ্ভাসিত হলেও কবিতার পরিণতিতে যৌনতার প্রাবল্য অবিচ্ছেদ্য রূপ নিয়েছে। কবিতার পরিণতিতে কবি প্রণয়ীর মৃন্ময়ী প্রেমকে জাগিয়ে তোলার প্রয়াসে আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, ‘তোমার গতরের নদী স্রোতের নামতা শেখে নাই?’ মনোজগতের অভ্যন্তরে কামনার রসে সিক্ত প্রণয়ীর দেহে প্রেমের উচ্ছ্বাস থাকলেও কবির প্রতি সাড়া না দেওয়ায় অন্তদর্হনের হতাশা আর আক্ষেপের সুর অনুরণিত হয়:
জানি তোর কোমরের কলসে প্রেমের বিষ নাচে
তোর চুলের বেণীতে ফণা তোলা সাপের নিশ্বাস
তোর চোখের তৃষ্ণায় পুড়ে খাক সহস্র সমুদ্র
চান্দের আন্ধারে নামে গেলাশ গেলাশ প্রিয়ঘুম
আমি ঘুম পান করি—রাত খাই কালান্ধসন্ধ্যায়
বয়স্করাতের দিঘি ঢেউ তোলে শরীরে আমার।
রবীন্দ্রনাথ ‘মানসী’ কবিতায় প্রেমাস্পদকে কাছে ডাকেননি। বরং তিনি প্রেমকে প্রাগঢ় অনুভূতি ও উপলব্ধির জন্য শুধু প্রেমকে দেহ থেকে মুক্ত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন:
হাসিটুকু কথাটুকু নয়নের দৃষ্টিটুকু
লও তার মধুর সৌরভ
চেয়ো না তাহারে।
কবির কাছে নারী আর নদী উপমাকল্পে যেন একে অন্যের প্রতিভু। স্রোত আর ভালোবাসার প্লাবন একে অন্যের সঙ্গে মিশে একাকার হয়ে যায়। ‘স্রোতের নামতা’ কবিতায় প্রেমের যে নিটোল চিত্র অঙ্কিত হয়েছে, তাকে আল মাহমুদের ‘সোনালী কাবিন’-এর সঙ্গে সাজুয্য স্থাপন করা যায়। ‘সোনালী কাবিন’ কবিতায় দেখা যায়:
রাতের নদীতে ভাসা পানিউড়ী পাখির ছতরে
শিষ্ট ঢেউয়ের পাল যে কিসিমে ভাঙে ছল ছল
আমার চুম্বন রাশি ক্রমাগত তোমার গতরে
ঢেলে দেবো চিরদিন মুক্ত করে লজ্জার আগল
এর ব্যতিক্রমে বানু এ-মস্তকে নামুক লানৎ
ভাষার শপথ আর প্রেমময় কাব্যের শপথ।
প্রেমের প্রকৃত গভীরতা উপলব্ধি করতে হলে দেহজ প্রেমকে বাদ দিয়ে প্রেমের আস্বাদন নিতে হবে। মিলনে সাময়িক পরিতৃপ্তি আর পরিতুষ্টি থাকলেও প্রেমের উপলব্ধি বুঝি শরৎচন্দ্রের ভাষায় বলতে হয়, ‘বড় প্রেম শুধু কাছেই ডাকে না, ইহা দূরেও ঠেলিয়া দেয়।’ ‘স্রোতের নামতা’য় কবি চেয়েছেন প্রেমিকার শরীর আর কামরস। আর সেই কামরসে সিক্ত হওয়ার বাসনা থেকেই কবি প্রেমিকাকে তিরস্কার করে বলেছেন, ‘তোর গতরের নদী ‘স্রোতের নামতা শেখে নাই?’ বাক্যবিন্যাস, শব্দ চয়ন ও উপমা বিধৃত কবিতাটি সহজেই পাঠককে আকৃষ্ট করে এবং সাবলীল ধারায় অবলীলায় কবিতার শরীর ছেনে টান টান দেহজ প্রেমের প্রোভোকেশনে দীপ্ত হয়।
‘এপ্রিলের রাত’ কবির আরও একটি শাশ্বত প্রেমের কবিতায় ব্যাপৃত হয়ে প্রিয়াকে না পাওয়ার কবির মনস্তাপের আক্ষেপের উত্তাপ। কবির মানসপ্রতিমাকে কাছে না পেয়ে কিংবা দৃষ্টির আঙিনায় দেখতে না পেয়ে তার ব্যবহার্য বস্ত্রজুড়ে যে মানসপ্রতিমার ছায়া প্রতিভাত হয়, সেই নীল আঁচলে কবি অনুভব করেন হৃদয়ের গহিনে প্রেমের হাহাকার। এপ্রিল মানে বাংলা বৈশাখের খর-রুক্ষতার প্রতীক, যেখানে কবি প্রেমের রসসিক্ত না হওয়ার ফলে বিরহ-বেদনাকে প্রকাশ করেছেন। মানসপ্রতিমার জন্য প্রেমিকপুরুষ প্রাপ্তির আকাঙ্ক্ষায় যোজন যোজন ধরে অপেক্ষা করতে দীর্ঘ আক্ষেপ নিয়ে।
…চোখজোড়া
স্বপ্ন নিয়ে জেগে থাকে মাইল-মাইল কালো রাত।
এই কবিতার প্রতিটি ছত্রেই বিভিন্ন উপমায় মানসপ্রতিমাকে কিংবা বিচ্ছেদের আত্মজ ও প্রতীকী অলঙ্কার তৈরি করা হয়েছে। ‘মেঘদূত কাব্যে’ কালিদাস শ্রাবণ মেঘের মাধ্যমে তার প্রেয়সীর কাছে বিরহের বার্তা পাঠিয়েছিলেন। এই উপমায় কবির এই কবিতাও এমন বিরহের ইঙ্গিত দিয়েছেন। কবির মানসপ্রতিমা যেন স্বপ্নের রাজকন্যা। আর সেই রাজকন্যাকে রূপার কাঠিতে জোছনাপ্লাবিত রাতে জাগিয়ে তোলার বাসনায় কবি জেগে থাকেন। জেগে থাকেন প্রিয়াকে প্রেমের নৈবদ্য দেওয়ার জন্য, তৃষ্ণার্থ চোখে একবার তাকে দেখার জন্য। কিন্তু তা আর হয় না। এই কবিতায় উপমার আধিক্য লক্ষণীয়। তবে সমস্ত কবিতাতেই একই সুর, একই বেদনা, একই আর্তনাদ বিধৃত হয়েছে—তা হলো প্রেয়সীকে একবার কাছে পাওয়া।
বাম চোখে চোখ রেখে পাড়ি দিলে কালরাত
অশোকের শিলালিপি থেকে যায় আজন্ম ধূসর;
তোমাকে পাই না কাছে; স্বপ্নে তবু ধরা দাও বুকে।
‘লাল মাছি’ কবিতাটিতেও কবির বিরহের অন্তর্দহনের আভাস পাওয়া যায়। এই কবিতায় যেসব উপমার আধিক্য লক্ষ করা যায়, সেগুলো কবির অন্য দুয়েকটি কবিতাতেও পরিদৃষ্ট হয়। যেমন, ‘নদী’ বা ‘স্রোতের নামতা’। ‘অন্ধনদী’ যে নদী পথ দেখে না, স্রোতহীন, পথহারা সেই নদীর ‘সতীন’ হয়ে একই পথের পথিক হয়ে কবিও যেন নিজের মর্মবেদনার কথা প্রিয়তমাকে জানিয়ে দিলেন। দীর্ঘ প্রহর ভালোবাসায় কাটিয়ে, স্বপ্নহারা কবির আত্মাভিমান ঝরে পড়ে কবিতার শেষ বাক্যে—‘কাউকে চাই না আজ সূর্যকান্ত রাতের শয্যায়!’
কাব্যসাহিত্য নির্মাণে কবির নিজস্বতা প্রতিভাত হয়ে যখন সামষ্টিক রূপ লাভ করতে পারে এবং সর্বজনবিদিত হয় তখন কাব্যসাহিত্য সার্থকতা পায়। কবির নিজস্বতা কবি নিজেই তৈরি করেন নিরলস সাধনায় সমাজবাস্তবতার উপাদান থেকে। নিজের অভিজ্ঞতার ছায়াও প্রতিফলিত হয় সাহিত্যের আভায়। অভিজ্ঞতা বলতে যা বোঝায়, তাহলো জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনা। এখানে কবির নিজেকে প্রেম করতে হবে এমন নয়; বরং প্রেমের কবিতা পাঠেও কবি অভিজ্ঞতাসমৃদ্ধ হন, যা নিজের লেখায় স্থান পায়। বয়সও শিল্প নির্মাণের বড় উপাদান। যৌবনে দেহজ প্রেমের ভাতি প্রোজ্জ্বল হলেও বয়সের ভারে ন্যুব্জমান হলে সেই প্রেমের কবিতাই পাঠকের কাছে স্পিরুচিয়াল মাপকাঠিতে বিচার্য হতে পারে। কবিতা পাঠে পাঠকও নিজ নিজ পারসেপশন থেকে বিচার করেন। একটি কবিতা যখন বিভিন্ন দৃষ্টি থেকে ব্যাখ্যা হয়ে দাঁড়ায়, পাঠকের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার আলোকে বিশ্লেষিত হতে থাকে, তখন একটি কবিতা সর্বজনীনতার সার্থকতা পায়।
প্রেম শাশ্বত, প্রেম চিরন্তন। প্রেমহীন মানবজীবন অর্থহীন। অন্যদিকে প্রেম ও বিরহ যেন মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। বিরহ ছাড়া প্রেমের আস্বাদন কোথায়? প্রেমের অনুভূতি প্রেমাস্পদকে কাছে না পাওয়ার বা উপভোগ না করার বেদনা থেকে যতটুকু অনুভব করা যায়, কাছে পাওয়ার পর ততটুকু অনুভব করা যায় না। কবিমানসে তাই বিচ্ছেদের হাহাকার থেকে উৎসারিত কবিতা হৃদয় ছুঁয়ে যায়, ভাবাবেগে মথিত করে। মোহাম্মদ নূরুল হকের ‘জংলি কুসুম’ এমনই একটি প্রেমের কবিতা, যে কবিতা পাঠে পাঠককে প্রেমের জোয়ারের স্বপ্ন দেখিয়েও পরিণতিতে মর্মবেদনার সুর বাজতে থাকে। প্রিয়ার মান ভাঙানোর জন্য প্রেমিক নিজেকে ‘জংলি ফুলের’ সঙ্গে তুলনা করেছেন। মনে হয় মান ভেঙে কবির কাছে ফিরে আসবে, কিন্তু না, পরিণামে কবিতার চিত্রকল্পে সেই সৌধ নির্মিত হয়নি। বরং ভাঙনের তীরে বহু শ্রম ও ঘামে আধা নির্মিত সেই সৌধ ভেঙে পড়ে। আর প্রেমিক মন শুধু প্রেয়সীকে ভালোবেসেই গেলো, প্রতীক্ষার প্রহর গুনলো। এই প্রহর যেন প্রেমিকের জন্য অনন্ত কালের। সেই মর্মবেদনার ধ্বনি শুনি:
মনে হয় এই ছুঁই এই ছুঁই
জানি তুমি পথের শেষে নেই, আছ পথের ওপারে।ফুটেছি বুনোফুল পুকুর ঘাটে, ক্ষেতে ও খামারে
পায়ে পায়ে চুমো খাই সকালে-বিকালে
যদি তুমি ভুল করে হাতে তুলে নাও,
. যদি ভালোবাসা পাই—তাই
ফুটেছি গোপনে ফুল, টবে নয় ছাদের কিনারে!
প্রেম ও দ্রোহেই পৃথিবীর অধিকাংশ কবিসত্তা। কোনো কবি সরাসরি বিদ্রোহের কথা বলেন, কেউ বলেন ডিপ্লোমেটিক সুগার কোটেড ভাষায়। এই ভাষাকে কাব্যসাহিত্যে বলা হয়ে থাকে উপমা-উৎপ্রেক্ষা জৌলসে বিমূর্ত ভাবনায়। কাব্যসাধনায় লাগসই উপমার ব্যবহার কবিধর্মও বটে। কবিতার মুন্সিয়ানা আর জৌলসও উপমার দ্যোতনাতে ছড়ায়। উপমাঋদ্ধ বিমূর্ত প্রকাশে কবিতা রচনায় মোহাম্মদ নূরুল হক সিদ্ধহস্ত।
‘এপ্রিল: ২০১২’ কবিতায় প্রেমাচ্ছন্ন কবির বিদ্রোহীর সুর বেজে ওঠে। বৈশাখকে উপেক্ষা করে বাংলার শেকড় ছিঁড়ে ইংরেজি মাসের নাম দিয়ে গ্রামীণ ও বাংলার লোকসংস্কৃতির বৃত্ত ভেঙে কবিতাটিতে দুঃসময়ের চিত্র ফুটে উঠেছে। একই শিরোনামে দুটি কবিতা রচিত: দুটিতেই নাগরিক জীবনে হতাশার শব্দছবি ফুটে উঠেছে। জীবনের সব প্রত্যাশার প্রতীকীরূপে যেখানে মানুষের জীবন হওয়া উচিত নাক্ষত্রিক আলোয় উদ্ভাসিত, সেখানে প্রত্যাশার উৎস সেইসব নক্ষত্রই আলোহীন, মৃত। প্রাণের উৎসই জল। আর সেই জলের ধারা বয়ে আনে শ্রাবণ। কিন্তু আমাদের সময় এমনই বিরূপ যে, স্বপ্নের পৃথিবীতে শ্রাবণের রাতও মৃত্যুকে ভালোবাসে, হয়ে যায় স্বপ্ন, হারিয়ে যায় প্রাণোচ্ছ্বলতা। দেশ, কাল, পাত্রপাত্রী—সব যেন একই তীরে দাঁড়িয়েছে, যে তীর শুধু ভেঙে পড়তে জানে, আশ্রয় দিতে জানে না।
আমাদের ভেসে যাওয়া স্বপ্নসাধ শ্রাবণের রাত
মুহূর্তের জন্য তবু মৃত্যু ভালোবাসে!
পুঁজিবাদী অর্থনীতি ও মুক্তবাজার অসুস্থ প্রতিযোগিতায় সম্পদ আর শোষণ মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। মুনাফাখোর, লুম্ফেন লুটেরা, মর্ডানাইজড মার্কেটিং সিস্টেম, দখলদার, নষ্ট রাজনীতিক ইত্যাদি প্রতিভূদের দোর্দণ্ড দাপটে মুষ্টিমেয় মানুষের হাতে একদিকে সম্পদের পাহাড়, অন্যদিকে শোষিত শ্রেণী সম্পদহীন হয়ে গতর খেটে শরীরকে বিলিয়ে দেয় তাদের সেবায়। মধ্যবিত্ত জীবনের স্বপ্ন ও বাস্তবতার টানাটানি তাদেরর হতাশার জলছাপ মুদ্রিত হয় শব্দের গভীরে। ওই লুটেরা শ্রেণীর মানুষেরা ভোগবিলাসে মত্ত, যাদের কাছে নেই কোনো শিল্পের কদর, নেই শিল্পের গুরুত্ব। পক্ষান্তরে কিছু সর্বহারা মানুষ শিল্পভাবনায় আচ্ছন্ন থাকে, যাদের স্বপ্ন দুবেলা দুমুঠো অন্নই যথেষ্ট। তারাই হয় ভোগবিলাসীর ভোগের শিকার। এই কবিতায় যেন এমন সমাজচিত্রই চিত্রিত হয়েছে। দেহজ তাড়না, কিংবা মানব চরিত্রের প্রাথমিক স্তরের জৈবিক তাড়নার ক্ষুধা মেটানোর জন্য কিছু মানুষ পরাজিত হয় বিত্তবৈভবের ভোগ বিলাসী মানুষের কাছে। সুকান্তের ‘পূর্ণিমার চাঁদ যেভাবে ঝলসানো রুটি’ শব্দছবির সাদৃস্য খুঁজে পাওয়া যায় মোহাম্মদ নূরুল হকের ‘রূপার থালার মতো থকথকে সূর্য’-এর উপমায়। একই হাহাকারের সুর যেন অনুরণিত হয় এই কবিতায়:
রূপার থালার মতো থকথকে সূর্য
অথবা ক্ষুধার্ত চোখজোড়া জ্বলে ওঠে আজ কারও—
কেন তবে গান করো প্রেমহীন পৃথিবীতে আর?
অভিব্যক্তি প্রকাশের নানা শিল্পরূপ উন্মোচন করে শিল্পী, অভিনব আঁক-আঁচড়ে নির্মাণ করেন মানুষের চিন্তার বিস্তৃত বলয়। যে শিল্পে চিন্তার সুযোগ নেই সে শিল্পের স্থায়ীত্ব নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। কবি কাব্যশিল্পের বা শব্দশিল্পের কারিগর। ভিন্নমাত্রায় চিন্তার বিস্তার ঘটিয়ে পাঠকের মনোজগতের ভাবনার জায়গাটি তৈরি করেন। অভিনব প্রকাশের মাধ্যমে অবশ্য নিজস্বতাও তৈরি হয়। গতানুগতিক ধারায় শিল্প তৈরি হলে সেই শিল্পের মৌলিকতা নিয়ে প্রশ্ন আসে। শিল্পের মৌলিকতা একটি বৈশিষ্ট্য, যা প্রথার বাইরে। মানুষ গ্রহণ করবে কি করবে না শিল্পীর ভাবনা হয়। জীবনানন্দা দাশ সেই রকম একজন কাব্যশিল্পী, যিনি নিজস্বতা তৈরি করেছেন এবং জীবদ্দশায় পাঠক তার কাব্যশিল্পকে গ্রহণ করেনি। মরণোত্তর তার কাব্যশিল্প হয়ে ওঠে বিশেষ মর্যাদার এবং তাকে বাংলাসাহিত্যের একজন শ্রেষ্ঠ কবি হিসেবে কাব্যবোদ্ধাগণ স্বীকৃতি দিতে থাকেন। শিল্পের মৌলিকত্ব বিজ্ঞানের নতুন কিছু আবিষ্কার করার মতোই জটিল। মোহাম্মদ নূরুল হকের কবিতায় কিছুটা নিজস্বতা তৈরি ইঙ্গিত পাওয়া যায়।
‘আমার হত্যাকারীর প্রতি’ কবির একটি কবিতায় প্রেমের বিষয়কে ভিন্ন আঙ্গিকে উপস্থাপন করেছেন। তিনি সরাসরি প্রেমের আহ্বান না জানিয়ে প্রেমিকাকে ডেকেছেন খুন করার জন্য। এই কবিতায় খুব বলতে কবির আত্মজ-সত্তা প্রেমকে বা নিজের চূড়ান্ত সমর্পণকে বুঝিয়েছেন। কবি প্রিয়ার কাছে নিজেকে এমনভাবেই সমর্পণ করতে চান, যেখানে সমস্ত অস্তিত্ব হারাবে। মৃত্যু মানে তো জীবনের সব লেনদেনের পরিসমাপ্তি। কবি প্রিয়ার কাছে সেই পরিসমাপ্তি ঘটাতে চান:
আমাকে হত্যার আগে ছুরিটায় শান দিয়ে নিয়ো
গোলাপের পাপড়ির ঘ্রাণে দেখে নিয়ো একবার
আমার হৃদপিণ্ডের ভেতর কেমন জেগে থাকে
আমার হত্যাকারীর প্রতি ভালোবাসা। বিকেলের
সব নদী নদী নয়, কিছু নদী নক্ষত্রের রাধা!
কবিতায় অন্য বাক্যে নিজের অপারগতা প্রকাশ করেছেন যে, স্বেচ্ছায় তিনি কাউকে বাধ্য করেন প্রিয়ার প্রেমসত্তাকে নিজের করে নিতে। এখানে দেহাতীত প্রেমের চেয়ে কামজ প্রেমের ইঙ্গিত স্পষ্ট হয় ধ্রুব তারার মতো। এই সমর্পণ যখন সবটুকু হয়ে যায়, তখন আর কিছুই থাকে না। মিলনেই বিলীন হয়ে যায় জীবনের সবটুকু, সমগ্র অস্তিত্ব।
এটি একটি দীর্ঘ কবিতা। কবির এমন দীর্ঘ কবিতা খুব কম চোখে পড়ে। তবে কবিতায় বিভিন্ন উপমার বীজে ফলিয়েছেন আচ্ছন্নতার ফসল। প্রিয়া কখন এলে প্রেমের গভীর আস্বদন পিয়ে পেতে পারেন, সেই সুযোগের বর্ণনাও অকুণ্ঠ ভাষায় বর্ণিত হয়েছে। ভাষার জাদুস্পর্শে হৃদয়ে ভাবাবেগ সঞ্চারণের বুঝি তাই হয়:
কালোরাতে পানকৌড়ি উড়ে গেলে ডানার হাওয়ায়
তুমি এসে খুন করে চলে যেও আমাকে তুমুল।
মানসীর প্রতি অনুযোগ-অনুরোধ; প্রেমের টোপে মন ভুলানোর মনোলোভা আহ্বান। এই আহ্বানে হৃদয়ের তাড়না জাগানিয়া মানসীর কোনো সাড়া নেই বলেই নিজের দুর্দশাকে বিজ্ঞাপন চিত্রের মতো দেখিয়ে তাকে কাতর করে তোলার আহ্বান শোনা যায়। শোনা যায় ম্যাটা-কমিউনিকেশনের ইঙ্গিতবহ প্রচ্ছন্ন ভাবাবেগের সুর। সেই সুরই প্রতিধ্বনিত হয়:
মাঠে-ঘাটে আর ক্ষেতে যারা শ্রম দেয়, তারা নাকি
নিজের মগজে জ্বালে স্বরচিত সূর্য; অতএব
আকাশকে সাক্ষী রেখে হেঁটে যাও মেঘের আগুনে।
কবির জীবন গ্রামঘেঁষা। তার সত্তায় রয়েছে এদেশের পলি বিধৌত মাটির গন্ধ, রয়েছে শ্যামল বাংলার নিসর্গের পূর্ণতা। নিসর্গের উপাদান মিশেছে কবিতায়। নিম্নবিত্ত মানুষের সংগ্রামী জীবনও কবিতার উপমায় এনেছেন।
আশা-নিরাশা, সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, পাপ-পুণ্যে ভরা মানুষের জীবন। জীবনের প্রতিটি স্তরেই এসবের বিপুল আয়োজন। কবিদের জীবন এসবের ঐশ্বর্যে ভরপুর। কবি যে পথে হাঁটেন, সে পথ কখনো মসৃণ নয়। কবি যে দিকে তাকান, সে দিক বসন্তের যৌবনপ্রাপ্ত পুষ্পে সজ্জিত নয়। কবি বৈষয়িক ঐশ্বর্য যতটুকু খোঁজেন, তার চেয়ে বেশি খোঁজেন শব্দময় ঐশ্বর্য। তিনি দৌলত খোঁজেন প্রেমে ও জীবনবোধে। ‘মৃত্যুর জন্য পার্থনা’ কবিতায় তার জীবনবোধের একটি চিত্র আঁকা হয়েছে। কবি যেচে কেন মৃত্যুকামনা করেন? কী দুঃখবোধ, কোন হতাশায় জর্জরিত? এই দীর্ঘ কবিতায় সমাজের নেতিবাচক প্রভাবে অতিষ্ঠ হয়ে, মানুষের ছলনা, দখলবাজি, দোর্দণ্ড প্রতাপে ন্যায়হীন সমাজে ব্যর্থতার গ্লানি নিয়ে হয়তো কবি জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটাতে চান। কবি যদি নিজের স্বপ্নের ভেতর দিয়ে মানুষকে স্বপ্ন দেখানোর কথা, কিন্তু এই কবিতায় আমরা পাই বিপরীত চিত্র। তবে হতাশাও কবির কবিতাকে গৌরবোজ্জ্বল করে তুলতে পারে। জীবনানন্দ দাশের অনেক কবিতায় হতাশা স্ফূরিত হয়েছে। সেসব কবিতা পাঠকের মনে বেশি দাগ কেটেছে এবং তিনিও মৃত্যু প্রার্থনা করতে গিয়েই দুঃখজনক মৃত্যুর মুখোমুখি হন।
‘মৃত্যুর জন্য প্রার্থনা’য় আরও একটি কল্পচিত্র লক্ষ করা যায়—স্মৃতিকাতরা। কবি স্মৃতিমন্থন করতে গিয়ে হৃদয় নিঙ্ড়ানো দুঃখবোধ ছেনে এনেছেন:
মনে তবু পড়ে-শ্রাবণে মাতাল নদী-অজানা সাঁতার!
অনঙ্গ রূপার চাঁদ দোল খায় টোলপড়া গালে
উঠোনের বামপাশে পুঁই আর লাউয়ের ঝাঁকে
জোনাকি না মেয়েটির হাসি!
মনে নেই? মনে কেন পড়ে না এখন?
ক্রমাগত মাথা দোলে, দ্রুত কাঁপে চোখের পাতা
মগজে কম্পন তুলে থেমে যায় অচেনা আলোক!
এই দৃশ্য স্বপ্নে নয়—জাগরণে আঁকা।
জীবনের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির সেতুবন্ধন রচনা করতে ব্যর্থ মানুষেরা মৃত্যু কামনা করে। এমন ব্যর্থতার গ্লানি কি কবিতায় স্থান দেওয়া হয়েছে? না হয় কেন কবি বলেন:
কামনার ভাষা তবু বোঝে না মরণ!
শরীরের ভেতরে শরীর
জেগে ওঠে যখন ক্ষুধায়—মৃত্যু তারে দেয় কোন সান্ত্বনার স্বাদ?
ব্যর্থতা কিসে? প্রেমের? না কি পার্থিব জীবনের? কবি এভাবেই কবিতা নির্মাণ করে প্রেম ও ক্ষুধার আপেক্ষিত মনস্তাপের বীজ বুনে দিয়েছেন এই কবিতায়।
মোহাম্মদ নূরুল হক পাঠককে আধুনিক কবিতায় ভাবের গভীর গিয়ে উপলব্ধি করার জন্য এক প্রকার মায়াজাল বোনেন, যে মায়াজাল থেকে বের হয়ে না এসে বরং কবিতার ভাবজগতে ঘুরপাক খেতে হয়।
চলবে…
আজকের কবিতা: স্বতন্ত্র স্বরের সন্ধানে-১॥ মোজাম্মেল হক নিয়োগী