এমন কিশোর হয়তো পাওয়া যাবে না, যে ফুটবলে লাথি দেয়নি। তাদের মধ্য থেকে কেউ কেউ জলকাদায় মাখামাখি করে পাড়ায়, স্কুলে ও আন্তঃস্কুল প্রতিযোগিতা টুর্নামেন্টের এবড়ো-খেবড়ো মাঠে খেলোয়াড়ের সমস্ত শক্তি-শৈলী দিয়ে খেলতে খেলতে ভাবনা ও শক্তির অপরিসীম সাধনা ও ধৈর্যের জাঁতায় পেশীশৈলীর কীর্তিতে জাতীয়ও আন্তর্জাতিক সবুজ ঘাসের মসৃণ কার্পেটের মতো মনলোভা মাঠকে আন্দোলিত করে। অবিশ্রাম অনুশীলন, রক্তমজ্জায় নেশার তাড়নায় জাগতিক সবকিছুকে যখন একটি ফুটবলের পিণ্ডে কোনো সাধক বন্দি করেন, তখনই তিনি পেশীশৈলীর দুর্দণ্ড প্রতাপে মাঠ কাঁপিয়ে মানুষকে ভালো লাগার আবেশে সম্মোহিত করতে পারেন। কবিদের বেলায় কি এমন হওয়া অপরিহার্য?
কিশোর বয়সে ভালো লাগার কবিতা কিংবা গানের কলি কোন মানুষ আওড়ায় না? কেউ কেউ ভালো লাগার মানুষকে ভেবে কিছু বিষয়কে আশ্রয় করে লিখেও ফেলে কবিতার দু্ই-চার পঙ্ক্তি। কেউ কেউ অভ্যাসবশত কবিতার সুরকে বাঁধেন জীবনের আরাধনায়। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ড্রয়িংয়ের খাতায় ছবির আঁক দেয়নি এমন স্কুল পড়ুয়া কি খুঁজে পাওয়া যাবে? কিন্তু তাদের মধ্য থেকে তারাই শিল্পের রূপ-রস-মাধুর্যে অভিবাসিত যারা শিল্পকে বাঁধেন রক্ত-মজ্জায়-চিন্তা-চেতনায়। এভাবেই জগতের মানুষ দেখে মনন ও শিল্পের অভিকর্ষিত রূপ। সাধারণের মধ্য থেকে বের হয়ে আসে অসাধারণ প্রতিভা; সাধারণ থেকে উন্মেষ ঘটে অসাধারণের এবং তারাই জগতের অনেক কিছুকে রূপ-রস-মাধুরী দিয়ে সৃষ্টি করেন শিল্প, যা যুগের পর যুগ মানুষকে ভালো লাগার প্রেরণা জোগায়।
সাহিত্য হলো শব্দে আঁকা অদৃশ্য বস্তুকে দৃশ্যায়নের কঠিন শিল্প। কবিতা সাহিত্যেরই অংশ, যা স্বল্প পরিসরে বিমূর্ত ভাবনায় শব্দের কল্পরূপ দিয়ে কবি চিত্রিত করেন সময়ের, মানুষের, প্রকৃতি ইত্যাদির ছবি। ফুটবল দিয়ে যখন শুরু করেছিলাম, সেখান থেকেই বলা যায়, পেলের কিংবা ম্যারাডোনার শিল্পিত খেলা যেমন চোখে লেগে থাকে, রেখা দেখলেই যেমন চেনা যায় ভিঞ্চির, গগের বা এসএম সুলতানের আঁকা, ঠিক তেমনি শিল্পিত কবিতার ভাব ও ভাবের গাঁথুনি দেখে চেনা যায় কবিকে। মানুষের মনে খোদিত হয় ভালো লাগার চিত্র। সুখের আবেশে সম্মোহিত হয় কবিতার লাইনে, শিল্পিত মেজাজে, চেতনার, জাগরণের, সুন্দরের ও আনন্দের অবগাহনে। আজকে অর্থাৎ এই একুশ শতকে যারা বাংলা কবিতা চর্চায় আত্মনিয়োগ করেছেন, তাদের মধ্যে সবাইকে যে আলাদা করে চেনা যায়, তা নয়। তবে তাদের মধ্যে কাউকে কাউকে চেনা যায়, কবিতার শব্দ-চিত্রকল্প-উপমা-রূপক-প্রতীক-আঙ্গিকের স্বাতন্ত্র্যের কারণে। তেমন কয়েকজনকে নিয়ে আজকের এই প্রবন্ধের অবতারণা।
কাজী নাসির মামুনের কবিতা: লোকসংস্কৃতির ব্যঞ্জনায় প্রেম ও ক্ষোভ
কবিতার সৃষ্টি সহজাত হলেও অনুশীলন, চর্চা, রক্ত-মজ্জা-চেতনা-জীবনে কবিতায় গেঁথে যারা এগুতে চান, তারাই শিল্পের মোহনময়তায় আবদ্ধ করেন পাঠককে। শিল্পকে পাশ কেটে যাওয়ার উপায় নেই। যদি পাশ কেটেই যেতে হয়, তাহলে কৈশোরের মাঠের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ফুটবলে লাথি দেওয়ার মতোই হবে কবিতা, পেলে কিংবা ম্যারাডোনার মতো হৃদয়ে আসন গেড়ে বসার কোনো সম্ভাবনা থাকবে না তাতে।
কবিতার মূলসূত্র বা প্রধান রীতি হলো ছন্দ, যাকে উপেক্ষা করে কবিতাচর্চা মাঠের পাশে দাঁড়িয়ে কিশোরের ফুটবলে লাথি দেওয়ার মতোই খেয়াল ছাড়া কিছু নয়। মাঠে নামতে হলে প্রধান রীতিনীতি মেনেই শিল্পচর্চায় এগিয়ে যেতে হবে। কবি কাজী নাসির মামুনের কবিতা যেন আত্মার গহিনে নাড়িয়ে দিয়ে রূপমাধুর্য দিয়ে ভরিয়ে দেওয়া। কবিতার প্রতিপাদ্য ভালোবাসা আর বাংলার লোক-ঐতিহ্য শাশ্বত প্রেমের লয়হীন-ক্ষয়হীন প্রেমের যে ধোপদুরস্ত শিল্পরূপ খচিত হয়ে বেহুলা-লখিন্দরের আখ্যানে রচিত, তারই অনুরণন শুনতে পাওয়া যায় নাসির মামুনের কবিতার মৃদুমন্দ সুরে, মাদলশার আড়ম্বর আয়োজনে।
বোধিরা মরেছে আজ, কেউটে ছোবল খাচ্ছি বর
সাঁই তুমি কথা কও, জলে ভাসি এই লখিন্দর।
নীলকণ্ঠ হয়েছি দেখো, উদোম শরীর দেখো লাশ
আমাকে করেছ পর? কেন শুধু এই পরিহাস?
এদিকে সেদিকে খুঁজি, চারপাশে তোমার আকাল
সব ঘাটে হাস খেল, মূলত এ আমিই মাকাল।
সাঁই তুমি বেহুলা যে, প্রেমের করুণা সঞ্জীবনী।
একবার বীণ ধরো, সাপ এসে ফেলে যাক মণি।
‘লখিন্দরের গান’ কবিতাগুচ্ছে কবি এমন করেই নাড়ি ধরে টান দেওয়ার মতো কাব্যরসে পাঠককে নিয়ে যান গভীর ভাবনার জগতে। ‘লখিন্দরের গান’ কবিতাগুচ্ছের দশটি কবিতার মধ্যে তিনি চারটি কবিতা লিখেছেন ‘সনেটের’ নিখুঁত বৈশিষ্ট্যে। ছন্দ ও মাত্রায় বিশুদ্ধ রূপ আজকাল কবিতায় খুব কমই চোখে পড়ে। প্রতিটি কবিতায় প্রেমের শাশ্বত রূপের রেখাচিত্রে তিনি সমাজের অপাঙ্ক্তেয় অপশক্তিরও ইঙ্গিত দিয়ে অঙ্কন করেছেন, যেগুলো পাঠককে কবিতামন্ত্রে আচ্ছন্ন করবে। এই কবিতাগুচ্ছে ছন্দ-মাত্রার সঙ্গে বিমূর্ত শিল্প সৃষ্টি করেছেন উপমার ছায়ায়। নিচের কবিতাংশটি লক্ষ করুন।
আত্মজ জলের মায়া ভাঙনে গিয়েছে ডুবোযান।
মরত্বে অমর থাকে প্রাণপণ পূজার দু’কূল
ছাপানো দেহের শশী। অল্প কালো নিন্দার বহুল
সিঁড়িতে পায়ের ছাপ সাঁতরে গিয়েছে দুঃখ, বান।
জেগেছে প্রান্তরে দেশ, রূপান্তরে অন্য লখিন্দর
বেহুলা আকালে বউ; বলে গেছে সময় অপর।
লোকসংস্কৃতির বাতাবরণে কবির আবেগ-প্রভাব-প্রাবল্য সমকালীন সমাজ বাস্তবতার উপলব্ধি ও প্রকাশ বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। প্রতীক বা উপমার ব্যঞ্জনায় কবির মনোজগতের ক্ষোভ ও যন্ত্রণার আভাস দিয়েছেন। রাষ্ট্রের প্রশাসনযন্ত্রের মস্তকে বসে যারা ভোগবিলাসে মত্ত তাদের প্রতি কটাক্ষ করেছেন ভিন্ন আঙ্গিকে যা কবিতাকে করেছে ঋদ্ধ ও সময়োপযোগী।
বেহুলা হারানো গেলে উৎপাদনে মৃগয়া সম্ভব?
জীবন ঠেকানো চরে আমলার বেপরোয়া হাত,
ক্ষৌরকর্মে জল ছাড়া বিশ্বাসে না মিলে বস্ত জাত।
তর্কে তর্কাতীত লাভে যার হাতে জীবন বাস্তব,
সৌধের যৌনতাঘর, ছিটকিনি, তার কাছে সব।
বেহুলার জাত গেল। মান পনে চার ভিক্ষার জাকাত।
আমিত্বে সাঁড়াশি টানে। মরে গেলে জাত কি বেজাত।
সাহিত্যের কোনো সীমা-পরিসীমা নেই—এ কথা সত্য। সাহিত্যকে দাবার ছকের মতো ছকে বন্দি করারও কোনো যুক্তি নেই, যার প্রমাণ মিলে আরব্য রজনীর গল্প, কিংবা গ্রিক পুরাণ বিশ্বসাহিত্যের উজ্জ্বলতায়। শব্দবন্দি বা ছকবন্দি সাহিত্যের ক্ষেত্রে আমার যেমন রয়েছে নিরাসক্তি, তেমনি রয়েছে অকাট্য অপক্ষপাতিত্ব। কবির কবিতায় ছন্দের কঠিন বিধানের যূথবদ্ধ কাঠামো থেকে মুক্ত হয়ে তিনি আধুনিক ছন্দের ছাঁচে আবার নির্মাণ করেছেন লালিত্যে ভরা শব্দে মায়াজাল। এই মায়াজল পাঠককে মোহাচ্ছন্ন করে নিগূঢ় প্রেমের গহিনে মদিরভাবালুতায় আক্রান্ত করে। একই কবিতায় তিনি উপমার অপরূপ সৌকর্য ও উৎকর্ষে সৃষ্টি করেন এক আবেগসঞ্জাত চিত্রকল্প। কাব্যরসে কবিতায় গ্রিক পুরাণ, খ্রিস্ট ও ইসলাম ধর্মের সুরে লহরি তুলেছেন অপূর্ব ঐকতানে, যেখানে বাংলার সংস্কৃতিকে বুটিক শিল্পের কারুকাজে প্রাঞ্জলতা দিয়ে আক্রোশ ও প্রতিবাদের ভাষা তৈরি করেছেন।
গুহার বাতাসে ইডিপাস বিদ্ধ-শাপে
কোন পথে চামর দোলায়?
কার পাপে আদিম যিশুর মতো শূলবিদ্ধ মাটি?
ও পাখি, ও বৃক্ষ,
ও আমার লাটিম ঘুরানো মাঠ,
আমি কি জেগে উঠবো ঘাসে
দিঘির পানিতে জিন? ভূধরে নিতম্ব রেখে
. দেখাবো সাহস?ক্রন্দসী বেহুলা ঘুমে,
সোনার রেকাবে তার এসেছি নোলক।
মাছে-ভাতে স্বপ্নমোড়া গুপ্ত পুলসেরাত;
আমাকে দাঁড়াতে হবে।
কেরামান-কাতেবিন, দ্রাবিড় কিতাবে লিখ প্রত্ন-ইতিহাস।
অ-হল্য জীবনচরে এইখানে দাঁড়ালাম ধৃষ্ট লাঠিয়াল:
আমার দখল নেবে কে আছে এমন?
‘ছবির হাট’ কবিতাটিতে কবি বর্তমান রুষ্ট সময়ের আক্ষেপ, ব্যর্থতা, গ্লানি, কষ্ট ও আড়ষ্টতার ফলক নির্মাণ করেছেন। ছোট্ট অথচ গূঢ় চিন্তায় এই কবিতাটি বিন্দুর মধ্যে সিন্ধুর গভীরতার আভাস দিয়ে যায়। শূন্যতার ভেতরে মনন ও শিল্পের সঙ্গে সংগ্রামী জীবনের হাহাকার ফুটে ওঠে। ‘আমরা তো সেইসব পিপীলিকা ডানার সংগ্রামে সমবেত হই’ শিল্পের অবহেলা, বঞ্চনার রোধন অনুরণিত হয়। কবি কাজী নাসির মামুনের কবিতাগুলো সুখপাঠ্য এবং বর্তমান-ভবিষ্যৎ পাঠকের জন্য মূল্যবান কাব্যসাহিত্য হিসেবে বিবেচিত হবে বলে বিশ্বাস।
চলবে…