বাংলা উপন্যাসের পরিণত পর্বের প্রায় এক শতাব্দী পরে রশীদ করীম (১৯২৫)-এর প্রথম উপন্যাস ‘উত্তম পুরুষ’ (১৯৬১) প্রকাশিত হওয়ার আগপর্যন্ত বাঙালি মুসলমানের আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠা ও নাগরিক জীবননির্ভর শিল্পসফল উপন্যাস-প্রয়াস দুর্লক্ষ্য। নৈয়ায়িক শৃঙ্খলা বিবেচনায় রেখেও বলা যায়, কলকাতাকেন্দ্রিক বাঙালি মুসলমানের বাস্তব জীবনবোধের প্রেক্ষাপট আর কোনো উপন্যাসে এত ব্যাপকভাবে ধরা পড়েনি। তবে সৌভাগ্য, ততদিনে এদেশের লেখকগণ কথাসাহিত্যে সর্বব্যাপী অবস্থান তৈরি করতে না পারলেও যে ক’খানি উপন্যাস রচনা করেছিলেন, শিল্পগুণ বিচারে তা ছিল অতুলনীয়। রশীদ করীম বয়স বিবেচনায় আবু ইসহাক, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্, আবুল কালাম শামসুদ্দিনের প্রায় সমসাময়িক হলেও এই বিরলপ্রজ লেখকগণ অনগ্রসর বাঙালি মুসলমান জীবনের যে রূপদান করেছিলেন, তা হয়ে উঠেছে সমগ্র বাংলা কথাসাহিত্যের স্মারক। কিন্তু তাদের উপন্যাসের সংখ্যা ছিল কম; ব্যক্তি ও জাতীয় জীবনের ঘটনাপ্রবাহের তুলনায় নগণ্য।
তবে রশীদ করীমের সমকালীন কিংবা তার অগ্রজ শিল্প-সফল ঔপন্যাসিকগণ অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রতীক ও রূপকের আশ্রয়ে, গ্রামীণ ও মধ্যবিত্ত জীবনের পটভূমিতে, গ্রাম ও নগর জীবনের দ্বন্দ্ব-সংক্ষুব্ধ পরিবর্তমান চেতনাকে ধরতে চেষ্টা করেছেন। সে সব রচনায় বাংলাদেশের, এমনকী বাঙালি মুসলমানের কোনো একটি দিক গভীর স্পষ্টতায় ধরা দিলেও, বৃহত্তর পটভূমিতে বাঙালি মুসলমানের আত্মনির্মাণ, আধুনিকতা ও রাজনৈতিক সংকট তত গভীরভাবে ধরা পড়েনি। তাঁর পূর্ববর্তী কথাসাহিত্য সমাজের অচর্চিত এমন অনেক দিক আলোকিত করলেও বিষয়ের সঙ্গে ঔপন্যাসিকের গভীর সম্পৃক্ততা ধরা পড়ে না। কিছুটা পল্লবগ্রহীতার আশ্রয়ও তাতে চোখে পড়ে। অতীত অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধির পুনঃপাঠে রশীদ করীমের উপন্যাস বাংলা সাহিত্যের এক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।
বিশ শতকের আধুনিকতাকে সম্বল করে এ দেশে রশীদ করীমই আত্মজৈবনিক রচনার সততা রক্ষা করে অগ্রসর হয়েছেন। প্রিয়-অপ্রিয় নানা অনুষঙ্গ জীবনসত্যের মতো প্রকাশিত হয়েছে, যার দায়ভার তিনি এড়াতে পারেননি। যা সত্য, স্বতঃস্ফূর্ত যার প্রকাশ, তার অনিবার্যতা তিনি অস্বীকার করেননি। জীবনের কাম-ক্রোধ, রাগ-রিরংসা, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, সাম্প্রদায়িক ও মনস্তাত্ত্বিক সংঘাত এত ব্যাপকভাবে তার আগে উপন্যাসে ধরা পড়েনি।
‘উত্তম পুরুষ’ গ্রন্থ আকারে প্রকাশের আগে সিকান্দার আবু জাফর সম্পাদিত সমকালে ধারাবাহিকভাবে বের হতে থাকে। কিন্তু মাত্র কয়েক কিস্তি প্রকাশের পরে কম্যুনালিটির দায়ে সম্পাদক এর প্রকাশ বন্ধ করে দেন। উপন্যাসটিতে সত্যিই এ ধরনের দোষ আছে কি না, সে প্রশ্নের মীমাংসার আগে উপন্যাসশিল্প নিয়ে দুই-একটি কথা বলে নেওয়া ভালো। কারণ, এক বাচনিক ভাষ্যের প্রতি আমাদের যে আস্থা গড়ে উঠেছে, তাকে মানদণ্ড ধরে নিয়ে এ উপন্যাস বিচার করা সম্ভব নয়।
উপন্যাসের শিল্পগুণ বিচারে যে বিষয়গুলো বিবেচনায় রাখা প্রয়োজন, সেগুলো হলো—একজন ঔপন্যাসিক কোন পদ্ধতিতে জীবন ও জগতের অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছেন, জীবন অভিজ্ঞতাকে তিনি কিভাবে অনুধাবন করেন, তিনি উপন্যাস রচনার ক্ষেত্রে কী কী পরিহার করেছেন, কোন ধরনের সমস্যা উপন্যাসে ধারণ করেছেন, এ ধরনের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি কী ধরনের নৈতিকমূল্য প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন। এই বিষয়গুলো বিবেচনায় রেখেই আমরা রশীদ করীমের উপন্যাস বিচারে প্রবৃত্ত হবো।
আজ থেকে ৫০ বছর আগে উপন্যাসটি যখন প্রথম প্রকাশিত হয়, তখনকার প্রেক্ষাপট উপেক্ষা করলে এ উপন্যাসের প্রতি সুবিবেচনা করা হয় না। এ উপন্যাসে ও তৎকালীন সমাজে বিভাজন কেবল ধর্ম সম্প্রদায়ের মধ্যে নয়, অর্থনৈতিক শ্রেণী ও বর্ণ বৈষম্যের মধ্যেও প্রকট। রশীদ করীমের আগের প্রায় একশ বছরে বাংলা কথাসাহিত্য যে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে চলেছিল, সেখানে বাঙালি মুসলমানের আলাদা কোনো পরিচয় ছিল না। বিষয় বিবেচনার দিক দিয়েও এর নতুনত্ব অস্বীকার করা যায় না। এছাড়া উপন্যাস পাঠে এদেশের পাঠকদের চোখ ভরলেও মন ভরছিল না শুরু থেকেই। বরং আধুনিক উপন্যাস-সাহিত্যের সংস্পর্শে নব্যশিক্ষিত বাঙালি মুসলমান পাঠকদের উপন্যাস পাঠের আকাঙ্ক্ষা বেড়ে গিয়েছিল বহুগুণ। বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ, তিন বন্দ্যোপাধ্যায়সহ বাংলা উপন্যাসের মহান স্রষ্টারা বেশ কিছু কালোত্তীর্ণ উপন্যাস রচনা করলেও মীর মশাররফ হোসেনের, নজীবর রহমান ও সেইসঙ্গে কিছু অসফল শিল্প প্রচেষ্টাও দীর্ঘদিন ধরে এ দেশের পাঠকের ক্ষুধা মিটিয়ে আসছিল।
উপন্যাসকে আমরা অলিখিত কালের ইতিহাস হিসেবে বিবেচনা করতে পারি। সালওয়ারি ঘটনপঞ্জীর ওপর নির্ভর না করে, সমকালীন লিখিত ইতিহাস আশ্রয় না করে, রাজ-রাজড়া ও রাজনৈতিক কাহিনীকে পাশ কাটিয়ে যে চলমান জীবনধারা এবং সেই জীবনের সামষ্টিক ও ব্যষ্টিক বিকাশ ও প্রকাশ যেভাবে লিখিত হয়, তা-ই তো উপন্যাস। উপন্যাসে যে সব সত্য উঠে আসে, তা মূলত সেই সব মানুষের ইতিহাস ও সমাজচিত্র যা রাজনৈতিক ইতিহাসে খুব একটা প্রশ্রয় পায় না।
সে বিবেচনায়, রশীদ করীম ‘উত্তম পুরুষ’ লিখতে গিয়ে সমকালীন ইতিহাসের প্রতি আস্থাশীল ছিলেন, রাজনৈতিক ইতিহাসেও তার প্রমাণ মেলে। শরৎচন্দ্র বিধবা সমস্যা, কুলিন প্রথা, জাতপাত, বর্ণপ্রথা ও গোষ্ঠীগত সমস্যাকে তার উপন্যাসে চাগিয়ে দিয়েছিলেন। একটি পর্বের হিন্দু মুসলমানের সাংস্কৃতিক পার্থক্য, ছোঁয়াছুঁয়ির বাচ-বিচার কেবল দুটি ধর্মগোষ্ঠীর মধ্যেই সত্য নয়। উচ্চবিত্তের হিন্দু কী নিম্নবর্ণের হিন্দুর ছায়া মাড়ায়, এক পিঁড়িতে আহার করে, বিয়ে-শাদি আসন-ব্যাসন কস্মিনকালেও তাদের একসঙ্গে হয় না। এ সব বিষয় বাংলা ভাষার নমস্য কথাসাহিত্যিকগণ তুলে ধরেছেন। রশীদ করীম একটু এগিয়ে গিয়ে সমক্ষেত্রে হিন্দু মুসলমানও যে আলাদা নয়, তা দেখিয়ে দিয়েছেন।
চরিত্রের প্রয়োজনেই ঘটনাপ্রবাহ চলে এসেছে,
চরিত্র কখনো ঘটনার দাস হয়ে থাকেনি
এ উপন্যাসের প্রকাশকাল ১৯৬১ সাল হলেও ১৯৪০ সালের কলকাতাকেন্দ্রিক জীবনধারা এতে বিধৃত হয়েছে। ১৯২৫ সালে রশীদ করীমের জন্ম কলকাতায়। উপন্যাসটির পটভূমি নির্মিত হচ্ছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে ব্রিটিশ ভারতের শেষপাদে কলকাতাকেন্দ্রিক বাঙালি (হিন্দু ও মুসলমান) জীবনের সংকট ও সম্ভাবনা নিয়ে। উপন্যাসটির রচনাকাল আর উপন্যাসের কাল এক নয়—এই সত্য উপন্যাস পাঠকের ভুলে গেলে চলবে না। লেখক এই উপন্যাসে তার শৈশবের পুনর্নির্মাণ করতে চেয়েছেন মাত্র। বলা হয়ে থাকে, শৈশব পুনর্নির্মাণ করার ক্ষমতা যার যত বেশি, তিনি তত প্রতিভাবান লেখক। প্রকৃতপক্ষে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে একজন ঔপন্যাসিক কী লেখেন? তিনি কি কেবল তার পল্লবগ্রাহী মনের আশ্রয় নিয়ে কল্পনার জাল বোনেন? না, আমাদের অভিজ্ঞতা, মূলত একজন ঔপন্যাসিক তার নির্জ্ঞানলোকে যেসব বাস্তব ঘটনাপ্রবাহ সুপ্ত থাকে, তারই প্রতিফলন ঘটান। রশীদ করীম কি সত্যিই সার্থকভাবে তার শৈশবকে উপন্যাসে পুনর্নির্মাণ করতে পেরেছেন। সে সত্য জানার জন্য আজ আমাদের ভারত উপমহাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক ইতিহাসের কাছে ফিরে যেতে হবে। যে সব ঘটনা ও অনিবার্যতার মধ্য দিয়ে আজকের বাংলাদেশ তার অতীতও তো একটা ছিল। অতীতের প্রতি আমাদের মোহময়তা ও স্মৃতিবিধুরতা ক্রিয়া করা সত্ত্বেও আমরা কি সেখানে ফিরে যেতে পারি? মানববাদী বিশেষ করে নারী দরদি শরৎচন্দ্র সামাজিক সমস্যাবলি তার উপন্যাস-কথাসাহিত্যে বিধৃত করেছেন, বিশেষ করে কুলীন (এই সমস্যাটি এখন আর হিন্দু সমাজে তেমন প্রকট নয়)। অবশ্য বিধবা বিবাহের আইনগত সত্যতা প্রতিষ্ঠা হলেও বাস্তবে তেমন সম্ভব না। যে যাই হোক, সামাজিক সংকট নিরসন হলে লেখকের দায় এবং সম্ভাবনা ফুরিয়ে যায় না। ইতিহাসের বাইরের ঘটনাপ্রবাহ ছাড়াও লেখক অনেক ক্ষেত্রে দূর অতীতের জীবনপ্রবাহ উপন্যাসের উপজীব্য করে তোলেন। যেমন বিভূতিভূষণের অমর উপন্যাস ‘ইছামতী’ ব্রিটিশ শাসন, নীলকর বিদ্রোহ ও জার্মানির কৃত্রিম নীলের সুবাদেই নীলের অবসান, ভবানীবাড়ুয্যের তিন বোনের একসঙ্গে পাণি গ্রহণ—সে সব অতীত বিষয় হলেও একটি সমাজ-সত্য পাঠের আনন্দ থেকে আমাদের বঞ্চিত করে না। আজ ব্রিটিশ নেই, পাকিস্তানের অবসান হয়েছে, হিন্দুঅধ্যুষিত ও মুসলিমঅধ্যুষিত বাংলা এক থাকতে পারেনি—এর পশ্চাৎভূমি কী ছিল, সে সব ইতিহাসের বিষয়। কিন্তু উত্তম পুরুষে তৎকালীন মুসলিম মধ্যবিত্ত সমাজের যে সংকট ও সম্ভাবনা ধরা পড়েছে, ইতিহাস নির্মাণের ক্ষেত্রে তার মূল্য অপরিসীম। তবে তাই বলে উপন্যাসকে যেন আমরা ইতিহাস মনে না করি। রশীদ করীমের নিজের বয়ানে- ‘সেই সময় কলকাতার পরিবেশ যেমন ছিল, আমি ঠিক সেইভাবেই পরিবেশের কাছে বিশ্বস্ত থেকেই উপন্যাসটি রচনা করেছি। আমি কোনো বাস্তবকে আদর্শায়িত করিনি অথবা কোনো আদর্শকে বাস্তবায়িত করিনি। কলকাতার পরিবেশ যেমন ছিল, ঠিক যথাযথ তাই চিত্রিত করেছি।’
এ উপন্যাসে ঔপন্যাসিকের বিশেষ দিক হলো অফিসিয়াল বয়ানের বিরোধিতা করা। শুধু লিপি না থাকার কারণে, ইংরেজি জ্ঞানের অভাবে, অর্থিকভাবে হীনবল বলে এবং পরাজিত রাজার সঙ্গে ধর্মসূত্রে এক হওয়ার অপরাধে যাদের ডিসকোর্সগুলো হারাতে বসেছিল, রশীদ করীম তারই বাণী আরোপ করেছেন। এক বাচনিকতার বিরুদ্ধে এ ক্ষেত্রে তাঁকে রবীন্দ্রনাথ বলি আর শরৎচন্দ্র বলি, কারও থেকে আলাদা করা যায় না।
‘উত্তম পুরুষ’-এর কেন্দ্রীয় চরিত্র শাকের—মধ্যবিত্ত চাকুরে পরিবারের সন্তান, তার বাবা সাব-ডিভিশনলাল কর্মকর্তা হলেও বেশ আর্থিক দৈন্যের মধ্যে তাকে বেড়ে উঠতে হয়েছে। এই আর্থিক দীনতা অবশ্য তাদের একার নয়। তৎকালীন আর্থ-সামাজিক কাঠামোর মধ্যে সেই সত্য নিহিত। জমিদার শ্রেণী, ব্রিটিশের খেতাবপ্রাপ্ত খানবাহাদুর-রায়বাহাদুর কিংবা হালে গজিয়ে ওঠা কিছু বৈশ্য-সাহা পরিবার ছাড়া পরাধীন ব্রিটিশ ভারতে আর্থিক দুরবস্থা কমবেশি প্রায় সবারই। শাকের ফুটবল খেলোয়াড়, ভালো ছাত্র এবং মুসলিম লীগের সমর্থক। ধারণা করা যায়, মুসলিম লীগের প্রতি শাকেরের ঝুঁকে পড়ার অন্যতম কারণ হীনম্মন্যতা বোধ। আর্থিক দীনতা, উচ্চবিত্ত সেলিনার রূপ ও উন্নত সংস্কৃতির অহঙ্কার এবং মুসলমান বলে সহপাঠী বন্ধুদের নিরন্তর অবজ্ঞা তাকে পরিচয়ের সমস্যায় নিপতিত করেছিল। এমনকী উচ্চবিত্ত মুশতাক ও সেলিনার ‘বাড়ির সুন্দর সচ্ছল পরিবেশের বিরুদ্ধে আমার সেই অপরিণত মন হঠাৎ বিদ্রোহ ঘোষণা করে বসল।’ প্রকৃতপক্ষে আত্মপরিচয়ের সংকটে নিপতিত শাকের আত্মপ্রতিষ্ঠার তাগিদে কিছু একটা করতে চায়। এ উপন্যাসে রশীদ করীমের বিষয় বাস্তবতা মূলত উঠে এসেছে তার সময়জ্ঞান, সমাজজ্ঞান, ইতিহাস জ্ঞান ও ব্যক্তিমানসের জ্ঞানের সারাৎসার থেকে। যে কারণে একরৈখিক জীবনপাতের প্রতি পক্ষপাতিত্ব রশীদ করীমের উদ্দিষ্ট ছিল না। আর সমাজের কেবল বিদ্যমান বাস্তবতা অনবরত তুলে ধরে ঔপন্যাসিকের রসিক মনটিও ব্যাহত করেননি তিনি। তার উপন্যাসের চরিত্রগুলো সজীব ও সঞ্চারমান। চরিত্রের প্রয়োজনেই ঘটনাপ্রবাহ চলে এসেছে, চরিত্র কখনো ঘটনার দাস হয়ে থাকেনি।
হিন্দু মুসলমান পরষ্পরকে যেভাবে পীড়ন করছে, তেমনি ধনী-আশরাফ মুসলমানের কাছে তার স্বজাতি যথার্থ মর্যাদা পায়নি (এমনকি নিজের মামার কাছেও অবজ্ঞা ছাড়া সহযোগিতা নয়)। আবার হিন্দু ধর্মের সনাতন জাতপাত, আর্থিক শ্রেণীবিন্যাস ও ছোঁয়াছুঁয়ির হাত থেকে নিম্ন ও দরিদ্র হিন্দুরা রক্ষা পায়নি। রশীদ করীম হিন্দু মুসলমানের পারস্পরিক বিরোধের একটি ঐতিহাসিক দ্বন্দ্ব যেমন এ উপন্যাসে তুলে এনেছেন; তেমন স্বজাতির মধ্যে বিরোধও অস্বীকার করেননি। তাছাড়া ব্যক্তি মানুষ যে ধর্ম বা জাতিরই হোক তার মহত্তম বিকাশ যে সম্ভব তাও তিনি দক্ষতার সঙ্গে তুলে ধরেছেন। মুসলমান বলেই শাকেরের আর্থিক অসচ্ছলতার কারণ নয়; ক্লাসের সবচেয়ে ভালো ছাত্র যে শেখর সেও পরীক্ষার ফি’র অভাবে ফরম ফিলাপ করতে পারছে না, অথচ সহপাঠী সলিল দত্ত দুই হাতে টাকা খরচ করলেও দুটো টাকা দিয়ে তাকে সাহায্য করেনি। সহপাঠী হিসেবে শাকেরই সেদিন সেলিনার দেওয়া দামি কলমটি মাত্র ১৫ টাকায় সলিলের কাছে বিক্রি করে শেখরের পরীক্ষার ফিস মিটিয়েছিল। মাত্র কয়েক বছর পর সেই সলিলই শেখরের বোন চন্দ্রার লোভে সলিলদের কপট সাহায্য করার ছলে তাদের পরিবারটিকে তছনছ করে দিয়েছে। অথচ মুসলমান বলে শেখরের পরিবারের কাছে যোগ্য মর্যাদা এমনকী তাদের গ্লাসে পানি খাওয়ার অধিকারটুকু পাচ্ছে না শাকের। অন্যদিকে লম্পট হওয়া সত্ত্বেও স্বজাতি বলে সলিলের সবকিছুকেই তারা প্রশ্রয় দিয়েছে সানন্দে। এমনকী শেখরের মায়ের প্রতি লোলুপ কালিপদ বাবুর জন্যও তাদের যে সহৃদয়তা ছিল, তাও শাকেরের প্রতি জোটেনি। এই অবজ্ঞা কিন্তু পারিবারিক বা ব্যক্তির ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর নির্ভরশীল নয়, শত শত বছর ধরে সমাজ এই আচরণ নির্ধারণ করে দিয়েছে। ব্যক্তি বাইরে আসতে চাইলে সমাজ তাকে অপদস্থ ও নির্যাতন করেছে। শেখর, শেখরের মা ও চন্দ্রার শাকেরের প্রতি ভালোবাসার কোনো কমতি ছিল না। কিন্তু সমাজ সে ভালোবাসার স্বীকৃতি দেয় না। এ ভালোবাসা জানাজানি হলে তাদের সমাজ থেকে পতিত হতে হবে। এই কষ্ট অর্থনৈতিক কষ্টের চেয়েও বেশি। সলিল একদিন শাকেরকে তাদের বাড়িতে নেওয়ার প্রস্তাব দিয়ে বলেছিল, ‘বলব তুই হিন্দু। তোর নাম অম্বিকা। মা খুব গোড়া কিনা। নইলে একসঙ্গে খেতে দেবে না। তুই তো দেখতেও হিন্দুর মতো। কে বলবে বাঙালি নোস।—আমি বাঙালি নই কি রে!— বাঃ তুই তো মুসলমান।… মা যদি জানতে পারে তো বেচারীকে গোবর খেয়ে প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে।.. তুই কাপড় পরিস না কেন রে? কাপড় পরি না! আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকি।-ধুর গাধা কোথাকার, কাপড় কাকে বলে তাও জানিস না!.. ধুতিকেই কাপড় বলে।’ (সময়ের পরিবর্তন হয়েছে। এখন আর কোনো হিন্দু সন্তানকেও তেমন ধুতি পড়তে দেখা যায় না। ধুতির সঙ্গে সঙ্গে হয়তো জাতপাত ছোঁয়াছঁয়ির বিষয়টিও দূরীভূত হয়েছে অনেকখানি। কিন্তু সেদিনের বাস্তবতা তো শেষ হয়ে যায়নি।) অন্যদিকে পণ্ডিত মশাইয়ের মতো মানুষ, যিনি স্কুলের সবাইকে নিজের সন্তানের মতো গ্রহণ করেছিলেন, শাকেরও তার স্নেহ থেকে বঞ্চিত হয়নি।
এই উপন্যাসের চরিতপাতের মধ্যে সূক্ষ্মভাবে যে বিরোধ ঘনীভূত হয়ে উঠেছে তাকে আমরা হিন্দু-মুসলমানের দ্বন্দ্ব হিসেবে দেখলে ভুল করব। কেন্দ্রীয় চরিত্র শাকের সংস্কৃতিতে বেশি নম্বর পায় বলে, পানিকে জল, আব্বা-আম্মাকে বাবা-মা, ভাইকে দাদা, সালামের পরিবর্তে আদাব বলার কারণে যেমন ফার্সি মৌলবির হাত থেকে রেহাই পায়নি, আবার মুসলিম লীগের সমর্থক বলে হিন্দু বন্ধুদের অবজ্ঞার শিকার হয়েছে। (তবে একটি কথা বলে নেওয়া ভালো, সেই চল্লিশ সালে কংগ্রেস বা মুসলিম লীগ ছাড়া অন্য কোনো লীগের সমর্থক হওয়ার উপায় ছিল না। বাংলা উপন্যাসের অনেক নায়কই কংগ্রেস, স্বদেশি কিংবা বাম রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। আজ সেই পাকিস্তানও নেই; সেই মুসলিম লীগও নেই। আজ পাকিস্তান পন্থা অবলম্বন করা যেমন অবাস্তব তেমনি ইতিহাসের সেদিনের বাস্তবতা অস্বীকার করে আমরা যেন এই গ্রন্থের নায়ককে ভুল না বুঝি।) একটি ঐতিহাসিক দ্বন্দ্বকেই লেখক এ উপন্যাসে তুলে আনতে চেষ্টা করেছেন।
এ উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্রের পরেই সেলিনার কথা উল্লেখ করতে হয়। সেলিনা কি এই উপন্যাসের নায়িকা? সেলিনাকে এ উপন্যাসের নায়িকা বলা যায় না। কারণ সেলিনাকে কেন্দ্র করে উপন্যাসের কাহিনী বা নায়ক আবর্তিত হয়নি। রশীদ করীম একক কোনো ব্যক্তি কিংবা চরিত্রকে এ উপন্যাসের চালিকাশক্তি করেননি। এক পক্ষপাতহীন দ্রষ্টার ভূমিকায় তিনি প্রতিটি চরিত্রকে গড়ে তুলেছেন। পরোক্ষভাবে তিনি সময়কেই নায়ক হিসেবে বেছে নিয়েছেন। এই সময়টি হলো ব্রিটিশ ভারতের শেষপাদে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে শাকের নামক চরিত্রের কিশোরকান্ত যৌবনের ঘটনাপ্রবাহ। লেখক নিজেও যাকে আত্মজৈবনিক বলতে চেয়েছেন। তবে সেলিনা কিংবা নিহার ভাবীর সঙ্গে তার যে প্রেম ও লিবিডোকেন্দ্রিক অনুভব পর্ব, তার সততা উপন্যাসকে উৎকর্ষে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে। নিহার ভাবীর ক্ষেত্রে একটি অতি নাটকীয়তা থাকলেও বাঙালি মুসলমান মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মধ্যে এ চরিত্র বিরল নয়। মায়ের সঙ্গে হাফেজ শাকেরের সম্পর্ক কথাবার্তা, মা-বাবার সম্পর্ক বর্ণনায় কেবলই দ্রষ্টার ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়া এদেশের উপন্যাসের ক্ষেত্রে ছিল একটি বিরল ঘটনা। লেখকের পক্ষপাতহীন বর্ণনা ও দৃষ্টিভঙ্গি বাংলাদেশের পরবর্তীকালের উপন্যাসের পথ খুলে দিতে সহায়ক হয়েছে।
এ উপন্যাসের সাম্প্রদায়িকতা প্রসঙ্গে সমরেশ বসুর একটি মন্তব্য দিয়ে ইতি টানব—‘নানা কারণেই বইটি আমার ভালো লেগেছে। তথাপি বইটি একপেশে দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে লেখা এবং সাম্প্রদায়িকও বটে, যদিও তার মধ্যে অনেক যুক্তিযুক্ত কারণ রয়েছে। নায়কের মন যেসব অভিজ্ঞতায় হিন্দুদের প্রতি বিরূপ হয়ে উঠেছিল, বিশেষ করে যে দুই শতকের কথা বলা হয়েছে, তা অনেকখানি সত্য। সেই সময়ে হিন্দু হিসেবে আমার নিজের অভিজ্ঞতাও তাই।’ আমাদেরও মনে হয় সত্যের প্রতি বিশ্বস্ত থাকতে গিয়ে লেখক এই অপবাদের ভাগীদার হয়েছেন। কিন্তু একজন সৎ ঔপন্যাসিকের এছাড়া গত্যন্তরই বা কী! সমরেশ বসুকেও কাহিনীর প্রতি বিশ্বস্ত থাকতে গিয়ে ঝক্কি কম পোহাতে হয়নি। সমরেশ বসু তার সমাজ বাস্তবতা নিয়ে যে কাজ করেছিলেন, রশীদ করীমও তার পরিচিত জগৎ নিয়ে একই কাজ করেছেন। ৭০ দশকে স্বাধীন বাংলাদেশের নতুন কথাসাহিত্যের দিকদ্রষ্টা তিনি।
বাংলা উপন্যাসে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ যদি সাত্রেঁ, তাহলে
রশীদ করীম আলবেয়ার ক্যামু কিংবা কাফকা
এ উপন্যাস নিয়ে একটা কথা বলা হয়নি, আপাত দৃষ্টিতে হিন্দু মুসলমানের সাংস্কৃতিক পার্থক্য দেখা গেলেও দুটি ধর্ম সম্প্রদায় যে একই সঙ্গে সমমর্যাদায় বাস করেছিল বিভাগ-উত্তরকালে এ উপন্যাসটি তার সাহিত্যিক দলিল। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যখন সাংস্কৃতিক আদান-প্রদান বন্ধ; দুই দেশের মধ্যে বিরোধ টিকিয়ে রাখা যখন দেশরক্ষার উপায় হয়ে দাঁড়িয়েছিল, তখন এই উপন্যাসটি কলকাতাকেন্দ্রিক হিন্দু-মুসলিম জীবনের বাস্তবতা তুলে ধরে এ দেশের পাঠককে, বিশেষ করে যারা এদেশে স্থায়ীভাবে চলে এসেছিলেন, তাদের স্মৃতিবিধুরতা জাগিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিল। সুতরাং, এ উপন্যাসের বহির্দৃশ্যে যত না বিরোধ, অন্তঃপ্রবাহে তারচেয়ে বেশি ঐক্য বিদ্যমান।
রচনার সংখ্যাধিক্যতার বিবেচনায় তেমন কিছু বেশি না হলেও পরবর্তীকালে তিনি আরও ১১টি উপন্যাস রচনা করেছেন। প্রসন্নপাষাণ (১৯৬৩), আমার যত গ্লানি (১৯৭৩), প্রেম একটি লাল গোলাপ (১৯৭৮), সাধারণ লোকের কাহিনী (১৯৮১), এ কালের রূপ কথা (১৯৮১), শ্যামা (১৯৮৪), বড়ই নিঃসঙ্গ (১৯৮৫), মায়ের কাছে যাচ্ছি (১৯৮৯), চিনি না (১৯৯), পদতলে রক্ত (১৯৯০), লাঞ্চ বক্স (১৯৯৩)।
রশীদ করীম মূলত তার প্রথম উপন্যাস থেকে পরবর্তী উপন্যাসগুলোতে কহিনীর অনুপুক্সক্ষ বর্ণনায়, মানব মনের জটিল ও কুটিল রহস্য বর্ণনায়, নারী-পুরুষের লিবিডোর কেন্দ্রিক চেতনা বর্ণনায় অনেক বেশি তীক্ষ্ণ ও স্থিতধী হয়ে উঠেছেন। একযুগে তিনটি উপন্যাস লিখেছেন তিনি এবং পরবর্তী ২৪ বছরে ৯টি। তাঁর কাছে উপন্যাসের ভাষা এবং প্লট স্বচ্ছন্দে ধরা দিলেও, প্রথম উপন্যাস লিখেই খ্যাতি ও পুরস্কার অর্জন করার পরও উপন্যাসের সংখ্যাধিক্যের প্রতি তার প্রবণতা দেখা যায়নি। প্রথম উপন্যাস লেখার ১২ বছর পর ১৯৭৩ সালে তার তৃতীয় উপন্যাস ‘আমার যত গ্লানি’ প্রকাশিত হয়। অথচ আদমজী পুরস্কারের খ্যাতি কাজে লাগিয়ে পাঠকের পকেট থেকে পয়সা বের করার ফিকির তিনি করেননি। তার উপন্যাস কেবল পাঠকের মনোরঞ্জনের জন্য নয়। সমাজের বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে যে জীবন ঘনীভূত হয়ে উঠেছে তিনি পাঠককে তারই অংশীদার করে তুলেছেন। একটি উপন্যাসের ঘটনা অন্য উপন্যাসে চালান করেননি। তবু সব উপন্যাস মিলিয়ে একটি জীবনবৃত্ত তৈরি করেছেন তিনি। উত্তম পুরুষের পরবর্তী রচনাগুলোতে রশীদ করীম আরো বেশি তীক্ষ্ণ ও উজ্জ্বল। তার ভাষা হয়ে উঠেছে আরো বেশি বেগবান ও অনুসন্ধানী। প্রথম তিনটি উপন্যাসে তিনি যে আত্মজৈবনিকতা ব্যবহার করছেন ধীরে ধীরে সেই শৈলীকে তিনি পরিহার করেছেন। বাংলা উপন্যাসে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ যদি সাত্রেঁ, তাহলে রশীদ করীম আলবেয়ার ক্যামু কিংবা কাফকা।
দ্বিতীয় উপন্যাস ‘প্রসন্ন পাষাণ’-এর চালিকাশক্তি একটি নারীচরিত্রকে উত্তম পুরুষের জায়গায় স্থাপন করে তিনি কথাসাহিত্যে শক্তিমানতার জানান দিয়েছেন। একজন প্রকৃত লেখক যে স্রষ্টা পক্ষপাতহীন ‘প্রসন্ন পাষাণ’ তার পরিচায়ক। রবীন্দ্রনাথ যেমন কুমুকে, শরৎচন্দ্র যেমন ভ্রমরকে অঙ্কন করতে যেয়ে পুরুষরুপী লেখকসত্তাকে অতিক্রম করে যান, তেমনি রশীদ করীমও তিশনাকে আঁকতে গিয়ে তার আত্মজৈবনিকতা চরিত্রের মধ্যে বিলীন হয়ে যান। এ যেন আত্মা বদলের কাহিনী। গুস্তাফ ইয়ুং-এর পুরুষের অন্তর্নিহিত নারী অ্যানিমা এবং নারীর অন্তর্নিহিত পুরুষ অ্যানিমাস—এই দুই সত্তার সমান উপস্থিতি একজন শক্তিমান লেখকের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। উত্তম পুরুষ লিখতে তিনি যেমন তার আমি সত্তাকে জানান দিয়েছেন, ঠিক একইভাবে প্রসন্ন পাষাণেও তার নারীসত্তা প্রবল ও বাস্তবসম্মত হয়ে উঠেছে। আর পাঠককে বোকা বানিয়ে দিয়ে যেন বলছেন, এই যে বলছি না, উত্তম পুরুষ আত্মজৈবনিক—ওসবের দরকার নেই; আসল হলো লেখকের সৃজন ক্ষমতা। তিশনার মুখ দিয়ে উত্তম পুরুষের মতো তিনি ওই একই কথা বলে নিয়েছেন, ‘আমার উদ্দেশ্য আত্মকাহিনী রচনা; অবশ্য যদি সম্ভব হয় ঔপন্যাসিক রসের রসায়নে জারিয়ে নিয়েই এই কর্মটি করতে চাই।’ শাকের আর তিশনা—দুই উপন্যাসের দুই কেন্দ্রীয় চরিত্র- উত্তম পুরুষ ও উত্তম (নারী)! বঙ্কিমচন্দ্র ‘রজনী’ উপন্যাসে এই ক্ষমতার পরীক্ষা করেছিলেন। নগরকেন্দ্রিক মধ্যবিত্ত মুসলিম বাঙালি জীবনের প্রতিভু হিসেবে উপন্যাসে শাকের যে ভূমিকা পালন করেছে; প্রসন্ন পাষাণে তিশনা সেই একই ভূমিকা পালন করেছে। এ উপন্যাসে একজন মুসলিম কন্যা তার শরীর ও মনের জেগে ওঠার কাহিনী বর্ণনা করেছেন পরম নিস্পৃহতায়।
এ পর্বের উপন্যাসত্রয়ীর মধ্যে ‘আমার যত গ্লানি’তে এক অদ্ভূত শিল্পকৌশল প্রয়োগ করা হয়েছে। উপন্যাসের কাহিনী হিসেবে বাংলাদেশ জন্মের প্রসবকালটি ব্যবহার করেছেন তিনি। আইয়ুবি শাসনের অবসান; জেনারেল ইয়াহিয়ার সামরিক শাসন জারি। এক অস্থির বাংলাদেশের পটভূমিকায় অস্থির যুবক ইরফান। এখানেও উত্তম পুরুষ। প্রথম উপন্যাস সম্বন্ধে লেখকের ভাষ্য ছিল তিনি কোনো বাস্তবকে আদর্শায়িত করেননি কিংবা আদর্শকে বাস্তবায়িত। তার এই ভাষ্য ‘আমার যত গ্লানি’তে আরও বেশি সত্য হয়ে উঠেছে। উপন্যাসের শুরুটাই এ রকম—‘আমি লোকটা একটা খচ্চর, যদিও আমার বাপ লোকটা মোটের ওপর ভালোই ছিলেন।’ এ উপন্যাসের নায়কের সঙ্গে ‘আউটসাইডার’ কিংবা ‘প্রজাপতি’র একটি দূরসম্পর্ক মনে হলেও বিষয় ও পরিণতি স্বতন্ত্র ও সৃজনশীল। সামরিক শাসনের গুমোট পরিবেশে বাংলাদেশে নারীর শরীর আর পানপাত্র ছাড়া কোনো সৃজনশীলতার সঙ্গেই নিজেকে জড়াতে পারছে না উপন্যাসের নায়ক ইরফান। ইরফানকে যে বাংলা উপন্যাসের নায়ক করা যায় এ দুঃসাহস রশীদ করীম দেখিয়েছেন। একটি নষ্টভ্রষ্ট সময়ের মানুষ ইরফান। এ নায়কের প্রতি পাঠকের সহানুভূতি কিংবা ঘৃণা জাগ্রত করার কোনো চেষ্টা করেননি। এমন নিরাসক্ত নির্মেদ বর্ণনা বাংলা উপন্যাসে বিরল। রশীদ করীমের চরিত্রগুলো বিশেষ করে ইরফান চরিত্র আপাতদৃষ্টে রাজনীতিবিমুখ নিরাসক্ত অন্তর্মুখী মনে হলেও, এক অদ্ভুত কুশলতায় তিনি তাকে সময়ের কেন্দ্রবিন্দুতে প্রতিষ্ঠা করেছেন। আমরা যুদ্ধের উপন্যাস বলতে যা বুঝি, রাজনীতি কিংবা সমাজমনস্কতা—এর কোনোটাই এই উপন্যাসে নেই। এমনকী মুক্তিযুদ্ধও না। তবু মনে হয় যুদ্ধপূর্ব এবং যুদ্ধপরবর্তী সময় এমন নিখুঁতভাবে বাংলা উপন্যাসে খুব একটা ধরা পড়েনি। ইরফানের জগৎ মূলত আয়েশা এবং কোহিনূরের প্রেম পরকীয়ার মধ্যে নিহিত। তবু গভীর সূক্ষ্মতায় সমকালীন রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্য এ উপন্যাসে ধরা পড়েছে। প্রকৃতপক্ষে এ উপন্যাসের বহিঃস্রোতে কোনো রাজনীতি নেই। রাজনীতির প্রভাবে ব্যক্তির মনোজাগতিক নির্মিতি তার উপন্যাসে ধরা পড়েছে। আপাত দৃষ্টে রশীদ করীমের উপন্যাস নারী-পুরুষের জটিল সম্পর্ক, ব্যক্তিমানুষের আত্মিক সংঘাত মনে হলেও ব্রিটিশ ও পাকিস্তান পর্বের সংক্ষুব্ধ সময় নিখুঁতভাবে ধরা পড়েছে।
তিনি এমন একটা সময়ে জন্মগ্রহণ ও জীবন যাপন করেছেন, যা এই উপমহাদেশের সবচেয়ে ঘটনাবহুল কাল। ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান, ভারত বিভাগ, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয়। এর কোনো পরিবর্তনই স্বাভাবিকভাবে হয়নি। তুমুল আন্দোলন ও বিক্ষুব্ধতার মাঝে সামষ্টিক ও ব্যষ্টিক জীবনের নিরর্থতার মাঝে তার নায়করা বেড়ে উঠছে।