উপনিবেশ
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক যুগেই প্রথম বাংলা ব্যাকরণ রচিত হয় বলে তাতে ঔপনেবেশিক প্রভাব থেকে যায়। বাংলা ব্যাকরণের ধ্বনিতত্ত্ব ম্যাক্সমুলার-মার্কা সংস্কৃতভক্ত প্রাচ্যতত্ত্ববিদদের প্রভাবে সংস্কৃত ভাবাপন্ন ছিল। রূপতত্ত্বও সংস্কৃত প্রভাবিত ছিল। বাক্যতত্ত্ব ছিল ঔপনিবেশিক প্রভুদের ভাষা ইংরেজির অবিকল। শুধু পদক্রমে অতি সামান্য পার্থক্য ছিল। ইংরেজি বাক্যের পদক্রম SVO, যা ছিল কর্তা + ক্রিয়া + কর্ম। আর বাংলা বাক্যের পদক্রম SOVঅর্থাৎ কর্তা + কর্ম + ক্রিয়া। এছাড়া বাক্যের সংজ্ঞা, প্রকারভেদ সবই ইংরেজির মতোই।
গঠন, অর্থ ও ভাব অনুসারে বাংলা বাক্যের প্রকারভেদ ইংরেজির অবিকল। বড় দুঃখের বিষয় বাংলা ভাষায় কোনো বাংলা ব্যাকরণ রচিত হয়নি। এ নিয়ে ভাষাবিজ্ঞানী ড. হুমায়ুন আজাদের আফসোস ছিল। একবার বাংলা ব্যাকরণ লিখে দিতে বলায় তিনি কোটি টাকা বরাদ্দের কথা বলেছিলেন বলে বাংলা একাডেমি সে প্রকল্প থেকে সরে আসে। এর অনেক বছর পরে বাংলা একাডেমি ‘প্রমিত বাংলা ব্যাকরণ’ প্রণয়ন করে। উত্তর ঔপনিবেশিক যুগে প্রণীত নতুন এই ব্যাকরণে দেখা যায়, রূপতত্ত্বও ঔপনিবেশিক প্রভুদের ভাষার দখলে চলে গেছে। কয়েক শতক ধরে চলমান পদপ্রকরণ অধ্যায়টিতে কিছুটা দেশজ গন্ধ ছিল। পদ ছিল পাঁচ প্রকার। বিশেষ্য, বিশেষণ, সর্বনাম, অব্যয় ও ক্রিয়া। নতুন এই ব্যাকরণে পদ বলে কিছু নেই। আছে শব্দ। আছে ব্যাকরণিক শব্দশ্রেণী। যা ইংরেজি পার্টস অব স্পিচের মতোই। ইংরেজি ব্যাকরণের পার্টস অব স্পিচের বাংলা ভার্সনই এখন বাংলা ব্যাকরণের শব্দশ্রেণী। যা ইংরেজির মতোই আট প্রকার। নাউনের স্থলে বিশেষ্য, প্রনাউনের স্থলে সর্বনাম, ভার্বের স্থলে ক্রিয়া, এডভার্বের স্থলে ক্রিয়া বিশেষণ, কনজাংকশনের স্থলে যোজক শব্দ, ইন্টারজেকশনের স্থলে আবেগ শব্দ ও প্রি-পজিশনের স্থলে অনুসর্গ। শেষের এই বিষয়টিতে সামান্য পার্থক্য আছে শুধু। প্রি-পজিশন কোনো শব্দের আগে বসে আর অনুসর্গ শেষে বসে।
বিলুপ্ত হয়ে গেছে অব্যয় পদ। বিলুপ্ত হয়ে গেছে এতকাল ধরে জেনে আসা শব্দ আর পদের সংজ্ঞা ও পার্থক্য। এখন আর কোনো পদ নেই। সবই শব্দ। আগে যারা পড়েছেন বাক্যে ব্যবহৃত বিভক্তিযুক্ত শব্দকে পদ বলা হয় বা এ ধরনের কিছু, তারা এখন ভুল জেনেছেন বলে গণ্য হবে।
এছাড়া শব্দগঠনের অন্যতম প্রক্রিয়া উপসর্গ ও প্রত্যয়কে ইংরেজি সাফিক্স ও প্রিফিক্সের অনুকরণে আদ্যপ্রত্যয় ও অন্তপ্রত্যয় বলে আলোচনা করা হয়েছে। এখানেও ইংরেজির ভূত।
প্রমিত
নতুন বাংলা ব্যাকরণের নাম ‘প্রমিত বাংলা ব্যাকরণ’। তবে কি আগের ব্যাকরণ অপ্রমিত ছিল? তাহলে প্রমিত জিনিসটা আসলে কী? বাংলা একাডেমির ব্যবহারিক বাংলা অভিধানে প্রমিত শব্দের অর্থে লেখা হয়েছে ১ বিণ. নিশ্চিত, নির্ধারিত। ২ বিণ. জ্ঞাত, প্রমাণিত। ৩ বিণ. পরিমিত, পরিমাণযুক্ত। প্র উপসর্গ যুক্ত মিত। এদিক থেকে মনে হয় শব্দটির অর্থ পরিমিত। মানিত শব্দের দ্বিতীয় নাসিক্যধ্বনির বিলুপ্তিতে হয়ে থাকলে প্রমিত মানে প্রমাণিত। পরিমিত ধরা হলে ভাষার সম্প্রসারণ, সংকোচন, বৈচিত্র্য ইত্যাদি নানা গুণ বা বৈশিষ্ট্যের অসীমতা থেকে পরিমিত করা হয়েছে। আর প্রমাণিত ধরা হলে প্রশ্ন জাগে, কে বা কারা কেমন করে সঠিক শব্দরূপটি প্রমাণ করলেন, কিসের ভিত্তিতে করেছেন?
আসলে প্রমিত ব্যাকরণের শক্তি ও ক্ষমতা দেখে মনে হয় ১ নম্বর অর্থের ওপর জোর দিয়েই নব্য ব্যাকরণ প্রণেতারা প্রমিত শব্দটি ব্যবহার করেছেন। নিশ্চিত ও নির্ধারিত। এখানেও প্রশ্ন ওঠে, শব্দের বা ভাষার এই রূপটিই যে নিশ্চিত, তা কার কথায়, কেন, কিভাবে হলো? আসলে নির্ধারিত অর্থেই প্রমিত শব্দটির ব্যবহার অধিকতর যৌক্তিক বলে মনে হয়। ব্যাকরণ প্রণেতারা নির্ধারিত করে দিয়েছেন।
এবার দেখা যাক ‘বাংলা একাডেমি প্রমিত বাংলা ব্যাকরণ’ বইয়ে প্রমিত বলতে কী বোঝানো হয়েছে?
“অনেক রকমের বাংলা আছে, কারণ বাংলা একটা অবিমিশ্র সংহত ভাষা নয়, তা অনেকগুলি ‘বাংলা’র সমষ্টি। সব বড়ো এবং ব্যাপ্ত ভাষাই এই রকম। একাধিক ভাষাবৈচিত্র্যের সমষ্টি বা গুচ্ছ। এই বিচিত্র ভাষারূপগুলির কোনোটি স্থানীয় বা আঞ্চলিক ভাষা বা ‘উপভাষা’, কোনোটি সমাজের গোষ্ঠী বা শ্রেণির ভাষা। এগুলি মুখের ভাষা। আবার সকলে না হোক, অধিকাংশ বক্তা বলে বা শোনে এমন একটা মুখের ভাষা আছে, যা স্থানবিশেষে আবদ্ধ নয়, এবং সমাজের শ্রেণি বা গোষ্ঠীতেও আবদ্ধ নয়। তারই নাম প্রমিত ভাষা।” [পৃষ্ঠা: ৩-৪]
প্রমিত ভাষা সম্পর্কে হুমায়ুন আজাদের সংজ্ঞা—‘কোনো জাতি বা রাষ্ট্রের সমস্ত ভাষিক দায়িত্ব পালনে সমর্থ যে ভাষা, তাকে চিহ্নিত করা যায় মান (বা প্রমিত) ভাষারূপে।’ [হুমায়ুন আজাদ: শিল্পকলার বিমানবিকীকরণ ও অন্যান্য: পৃষ্ঠা: ১২৬]
হুমায়ুন আজাদ পাশ্চাত্যের দুই জন ভাষাবিজ্ঞানী—পল গারভিন ও মেডেলিন ম্যাথিঅটের সংজ্ঞা উদ্ধৃতি দিয়েছেন, ‘যে বিধিবদ্ধ ভাষিক রূপ, বৃহৎ কোনো ভাষাসমাজ কর্তৃক গৃহীত, ও আদর্শ কাঠামোরূপে ব্যবহৃত, তাই মান ভাষা।’ [হুমায়ুন আজাদ: ঐ: পৃষ্ঠা: ১২৬]
ওপরের সংজ্ঞা দুটির প্রথমটিতে হুমায়ুন আজাদের মতে ভাষার সঙ্গে জাতি ও রাষ্ট্রের সম্পর্ক এবং পরেরটিতে পল গারভিন ও মেডেলিন ম্যাথিঅটের মতে, সমাজের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়টি দেখতে পাচ্ছি। আদর্শের কথাও বলেছেন গারভিন ও ম্যাথিঅট। তারা সমাজে গৃহীত হওয়ার কথাও বলেছেন।
বর্তমান প্রমিত বাংলা ভাষায় শব্দের এমন রূপ আছে, এমন ধ্বনি আছে যা বাংলাদেশের অধিকাংশ কেন, ষোলো কোটি জনগণের মধ্যে মাত্র কয়েক লাখ লোক উচ্চারণ করে বা ব্যবহার করে, বা তারচেয়েও কম। এগুলোকেও প্রমিত বলা হয়েছে। কেন? প্রমিত বাংলা ব্যাকরণের সঙ্গে প্রমিত বাংলা বানান ও প্রমিত বাংলা উচ্চারণের প্রসঙ্গও এখানে চলে আসে। যদি কোনো জাতিতে, রাষ্ট্রে বা সমাজে গৃহীত না হয়ে থাকে সে ভাষারূপ, বানান বা উচ্চারণকে প্রমিত বলার কারণ কী? ধরা যাক ‘ইতিমধ্যে’ বা ‘ইতিপূর্বে’ শব্দ দুটি। এদেশের শতকরা নিরানব্বই দশমিক নিরানব্বই জন লোকের কাছে এভাবে গৃহীত হয়েছে, তারা এভাবেই লেখে ও উচ্চারণ করে। তারপরও কেন বলা হচ্ছে শব্দ দুটি ভুল?
ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ নাকি ‘ইতিপূর্ব’ শব্দটিকে বাংলা বলে গ্রহণ করার প্রস্তাব করেছিলেন। ড. আনিসুজ্জামানও এ শব্দটির ব্যাপারে অনুরূপ সুপারিশ করেছেন গত পঁচিশে মে (২০১৮) তারিখের দৈনিক প্রথম আলোয়।
প্রমথ চৌধুরী ঢাকা ও কলকাতার উপভাষাকে
সম্পূর্ণ অস্বীকার করেছেন
শব্দ দুটিকে ভুল বলা হয় সন্ধি বিচ্ছেদ করার মাধ্যমে। ইতঃ+পূর্বে= ইতঃপূর্বে। ইতঃ+ মধ্যে= ইতোমধ্যে। এভাবে দেখানোর কোনো যুক্তি নাই। কারণ বাংলা একাডেমির প্রমিত ব্যাকরণ বইয়েই লেখা হয়েছে সন্ধি মূলত সংস্কৃত ব্যাকরণের বিষয়। বিশেষ করে বিসর্গ সন্ধি তো অবশ্যই সংস্কৃত ব্যাকরণের আলোচ্য বিষয়। বাংলা ব্যাকরণে বিসর্গ সন্ধি নেই। তাহলে বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত শব্দ সংস্কৃত ব্যাকরণ দিয়ে বিশ্লেষণ করে দেখিয়ে জাতি কর্তৃক গৃহীত এবঙ সমাজ কর্তৃক বরণীয় শব্দরূপকে ভুল বলে অভিহিত করার কারণ কী? সংস্কৃত ব্যাকরণ দিয়ে বাংলা শব্দ বিচার বিশ্লেষণ করা হলে অনেক ক্ষেত্রেই সর্বনাশ ঘটে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। যেমন, ‘পিতৃঋণ’ অর্থ পিতার ঋণ, ‘পিতৃহীন’ অর্থ পিতা নাই যার। একই ধরনের শব্দ কিন্তু অর্থে ভিন্নতা আছে। তেমন, ‘পিতৃমাতৃহীন’ এই শব্দটির বাংলা অর্থ হয় যার পিতা ও মাতা নাই। কিন্তু সংস্কৃতে অর্থ হয় যে পিতার মাতা নাই। অর্থাৎ বাবা জীবিত আছেন কিন্তু দাদি মারা গেছেন। কাজেই বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত শব্দ সংস্কৃত ব্যাকরণে বিচার করাটাই বড় ভুল।
প্রমিতকরণের ভেতরে থাকে আধিপত্য বিস্তারের ক্ষমতা। ধরা যাক, ‘নিয়ে নিই’ এই শব্দবন্ধটি এভাবে এদেশের কতজন লোক উচ্চারণ করে? ‘নিয়া’কে নিয়ে উচ্চারণ করে কারা? ‘নেই’কে ‘নিই’ উচ্চারণ করা হয় কোথায়? এটি পশ্চিমবঙ্গীয় উচ্চারণ। পশ্চিমবঙ্গের বাংলা ভাষার প্রধান বৈশিষ্ট্য স্বরসঙ্গতি আর অভিশ্রুতি। আর পূর্ব বাংলা বা বাংলাদেশের বাংলাভাষার প্রধান বৈশিষ্ট্য অপিনিহিতি। ‘নিয়া’র অন্ত্য স্বরধ্বনিটি বাঁকা করে ‘নিয়ে’ করা হয়েছে। এটি প্রগত স্বরসঙ্গতি। প্রথম ধ্বনির প্রভাবে পরিবির্তিত হয়েছে পরের ধ্বনি। আর ‘নেই’ শব্দের পরের ই-ধ্বনির প্রভাবে প্রথম ধ্বনিটি পরিবর্তন করা হয়েছে। এটি পরাগত স্বরসঙ্গতি। ‘নেই’ মানে নিয়ে যাই—এ শব্দটি বিলুপ্ত করা হয়েছে কারণ ‘নাই’ শব্দটিকে বাঁকিয়ে ‘নেই’ বানানো হয়েছে বলে। দুটি ‘নেই’ তো আর চলতে পারে না!
এমন অনেক শব্দ যা বাংলাদেশে অপ্রচলিত হওয়া সত্ত্বেও প্রমিত ভাষায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। প্রমিতের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, ‘সকলে না হোক, অধিকাংশ বক্তা বলে’—অথচ দেখা যাচ্ছে ষোলো কোটি মানুষের মধ্যে দুই-চার লাখ লোকও উচ্চারণ করে না এমন শব্দকে প্রমিত বলে ‘নির্ধারিত’ করে দেওয়া হয়েছে। ‘স্থানবিশেষে আবদ্ধ নয় এবং সমাজের শ্রেণি বা গোষ্ঠীতেও আবদ্ধ নয়’ প্রমিতের শর্ত হওয়া সত্ত্বেও অনেক শব্দ যা শুধু পশ্চিমবাংলার কোনো স্থানে বা বাংলাদেশের যশোর অথবা কুষ্টিয়া জেলার কোথাও আবদ্ধ শব্দকেও প্রমিত বলে র্নিধারিত করে দেওয়া হয়েছে।
প্রমথ চৌধুরী
বাংলা চলিত গদ্যকে লেখ্য ভাষা করে তোলার জন্য যারা সবচেয়ে বেশি শ্রম দিয়েছেন, দিক নির্দেশনা দিয়েছেন তাদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর প্রমথ চৌধুরীর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। প্রমথ চৌধুরী মনে করতেন, ‘যতদূর পারা যায়, যে ভাষায় কথা কথা কই সেই ভাষায় লিখতে পারলে ভাষা প্রাণ পায়।’ কলকাতার চলিত (রবীন্দ্রনাথ লিখতেন ‘চলতি’) বাংলা যখন দানা বেঁধে ওঠে, সাহিত্যের ভাষা হয়ে ওঠে, তখন তা নদীয়া ও শান্তিপুর অঞ্চলের উপভাষা দিয়ে গঠিত হয়। কেন এই অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষাকে কেন্দ্র করে কলকাতার বুদ্ধিজীবীমহল প্রমিত বা চলিত গদ্য বা স্ট্যান্ডার্ড বলে গ্রহণ করলেন, তা প্রমথ চৌধুরী একাধিক প্রবন্ধে লিখেছেন। তিনি ‘দক্ষিণ দেশি ভাষা’ বলে নির্দেশ করে নদীয়া, শান্তিপুর, ভাগীরথীর উভয় কূল এবং বর্তমান বর্ধমান, বীরভূম জেলার পূর্ব ও দক্ষিণাংশের উপভাষাকে কথ্য প্রমিত ভাষারূপ বলে গ্রহণ করেছেন।
প্রমথ চৌধুরী ঢাকা ও কলকাতার উপভাষাকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করেছেন। তিনি এ দুটি উপভাষারূপকে অবজ্ঞা করে লিখেছেন, ‘ঢাকাই কথা এবং খাস-কলকাত্তাই কথা, অর্থাৎ সুতানুটির গ্রাম্যভাষা দুয়েরই উচ্চারণ অনেকটা বিকৃত; সুতরাং ঢাকাই কিংবা খাস-কলকাত্তাই কথা পূর্বেও সাহিত্যে নিজেদের আধিপত্য স্থাপন করতে পারে নি এবং ভবিষ্যতেও পারবে না।’ [হুমায়ুন আজাদ:ঐ: পৃষ্ঠা-১৩৫]
প্রমথ চৌধুরী ভাষাবিজ্ঞানী ছিলেন না। ছিলেন ভাষা ব্যবহারকারী লেখক ও পত্রিকা সম্পাদক। তাই তার রচনার দিকে প্রশ্ন নিক্ষেপ করে লাভ নেই যে, তিনি কোন গবেষণা ও তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে আলোচ্য দুটি অঞ্চলের উপভাষাকে বিকৃত বলে গণ্য করে গেছেন এবং নদীয়া-শান্তিপুরের উপভাষাকে প্রকৃত ভেবে নিয়েছেন। ড. হুমায়ুন আজাদ জানিয়েছেন, ‘বাংলা মান কথ্য ভাষা ঠিক কোন অঞ্চলের উপভাষাভিত্তিক, তা ভাষাতাত্ত্বিকভাবে নির্ণীত হয় নি।’
তবে বাংলা চলিত রীতির অন্যতম প্রবর্তক এবং প্রচলক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এ দিক দিয়ে ছিলেন প্রমথ চৌধুরীর প্রায় বিপরীত। তিনি কলকাতার সন্তান তাই কলকাতার উপভাষার প্রতি তার টান ছিল। হুমায়ুন আজাদের মতে, ‘রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাসী ছিলেন রাজধানীতত্ত্বে;—রাজধানীর উপভাষাই সারা দেশের ভাষা হয়ে ওঠে এমন বিশ্বাস ছিল তাঁর।’
তাই রবীন্দ্রনাথ চলতি ভাষার জন্য কলকাতার উপভাষাকে ভিত্তি বলে মনে করতেন। ‘বাঙলা উচ্চারণ’ প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন, ‘কলিকাতা অঞ্চলের উচ্চারণকেই আদর্শ ধরিয়া লইতে হইবে। কারণ, কলিকাতা রাজধানী। কলিকাতা সমস্ত বঙ্গভূমির সংক্ষিপ্তসার।’ তিনি ‘বাংলা কৃৎ ও তদ্ধিত’ প্রবন্ধে শক্তভাবে বলেছেন, ‘বর্তমানকালে কলিকাতা ছাড়া বাংলাদেশের অপরাপর উচ্চারণকে প্রাদেশিক বলিয়া গণ্য করাই সংগত।’ রবীন্দ্রনাথ ১৯৩৮ সালের দিকে প্রমথ চৌধুরীর মত মেনে নিয়েছেন বলে দেখা যায় ‘বাংলা ভাষা পরিচয়’ প্রবন্ধে। তবে তখনো কলকাতার ভাষার প্রতি টান ছিল। লিখেছেন, ‘বিশেষ কারণে টসকানি প্রদেশের উপভাষা সমস্ত ইটালির এক ভাষা বলে গণ্য হয়েছে। তেমনি কলকাতা শহরের নিকটবর্তী চারদিকের ভাষা স্বভাবতই বাংলাদেশের সকল দেশী ভাষা ব’লে গণ্য হয়েছে।’ পরে লিখেছেন, ‘যে দক্ষিণী বাংলা লোকমুখে এবং সাহিত্যে চলে যাচ্ছে তাকেই আমরা বাংলা ভাষা বলে গণ্য করব।’ এখানেই তাকে প্রমথ চৌধুরীর কাছে পরাজিত মনে হচ্ছে।
রবীন্দ্রনাথ কলাকাতার উপভাষার পক্ষে অন্য প্রবন্ধেও মত দিয়েছেন। আবার তাঁর সঙ্গে দূরত্ব বজায় রেখে মত দিয়েছেন শরচ্চন্দ্র শাস্ত্রী। তিনি বলেছেন, ‘শৈশব হইতে শুনিয়া আসিতেছি, নবদ্বীপ ও তৎসন্নিহিত স্থানের প্রচলিত ভাষাই বিশুদ্ধ বাঙলা ভাষা। কলিকাতা রাজধানী হইলেও এখানে কোনো ভাষা নির্দিষ্ট নাই।’
প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ ‘চলতি বাংলার বানান’ প্রবন্ধে নিজের মত প্রকাশ করে জানান, কলিকাতা ও কলিকাতার কাছাকাছি নবদ্বীপ, ভাটপাড়া, কৃষ্ণনগর প্রভৃতি স্থানের মিক্ষিত লোকদের উচ্চারণকেই আধুনিক বাঙলার প্রামাণিক উচ্চারণ বলে করতে হবে।
পশ্চিমবঙ্গের প্রমিত বা চলিত গদ্য বাংলাদেশের জন্যও প্রমিত কি না, এটি একটি বড় প্রশ্ন। বাংলাদেশের একটি প্রতিবেশী দেশের একটি প্রাদেশিক ভাষার একটি আঞ্চলিক উপভাষাকে আমরা আমাদের স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশের জন্য অবশ্যমান্য ভাষা হিসেবে গ্রহণ করব কি না, করলে কেন করব, এই বিষয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। এটি বিস্তারিত আলোচনার দাবি রাখে।
ভাষাবিজ্ঞানী ড. হুমায়ুন আজাদ ‘শিল্পকলার বিমানবিকীকরণ ও অন্যান্য’ বইয়ে ‘মান ভাষা বাংলা: একটি না একাধিক’ প্রবন্ধে প্রশ্ন রেখেছিলেন, বাংলা মান ভাষারূপ কয়টি হবে? একটি না একাধিক?
ভাষায় কোনো ধরনের আধিপত্যকে
মেনে নিতে রাজি না
ব্রিটিশ ইংরেজি ও আমেরিকান ইংরেজির কিন্তু দুটি প্রমিত বা মান রূপ আমাদের চোখের সামনে আছে। এর বাইরে ইন্ডিয়ান ইংলিশও একটি নতুন ইংরেজি চালু হয়ে গেছে। যা আমেরিকান ও ব্রিটিশ ইংরেজি থেকে এমনকি কানাডা-অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডের ইংরেজি থেকেও পৃথক। কাস্তিলিয়ান স্প্যানিশ ও আমেরিকান স্প্যানিশ নামে দুটি প্রমিত ভাষারূপ চালু আছে একই ভাষার। চোস্ত ফারসি ও হিন্দুস্তানি ফারসি নামে ফারসি ভাষার দুটি প্রমিত রূপ আছে। ফ্রান্সের ফরাসি ও আফ্রিকান ফরাসিও ভিন্ন। রাশিয়ার রুশ ও বেলারুশের রুশ ভিন্ন। তেমনি উল্লেখযোগ্য রকমের পৃথক মানরূপ নিয়ে আছে মান্দারিন চাইনিজ ও ক্যান্টনিজ চাইনিজ। সউদি আরবের আরবি, মিসরের আরবি ও কুয়েতের আরবিও ভিন্ন। বর্ণমালায়ও ভিন্নতা আছে।
এখন যদি কেউ বলেন, উচ্চারণে পার্থক্য থাকলেও লেখ্য ভাষায় তো যথেষ্ট মিল আছে। সুতরাং কলকাতার ও ঢাকার প্রমিত ভাষা এক হতেই পারে। বাংলা একাডেমির প্রমিত বাংলা ব্যাকরণে’র ৩ নম্বর পৃষ্ঠায় লেখা হয়েছে, ‘আধুনিক ভাষাবিজ্ঞান মুখের ভাষা ছাড়া অন্য কোনোরকম ভাষাকে, যেমন লেখার ভাষা, ইঙ্গিতের ভাষা ইত্যাদি, মূল বা কেন্দ্রীয় বিচারের বিষয় মনে করে না।’
এখানে আমরা মুখের ভাষার শক্তিতে আস্থা রাখতে পারি। কিন্তু উক্ত বইয়ের ৫ নম্বর পৃষ্ঠায় আবার যা বলা হয়েছে বা লেখা হয়েছে তা বিভ্রান্তিকর। ‘প্রমিত বাংলা বেশিরভাগ বাঙালির মুখের জন্মগত ভাষা বা ঘরের ভাষা নয়।’ এর আগে যা বলা হয়েছে, তার ঠিক উল্টা কথা দেখতে পাচ্ছি।
তাহলে এই প্রমিতের ভিত্তি কী? কার বিবেচনায় প্রমিত বলে গণ্য হচ্ছে? কোন বিবেচনায়? এই কৃত্রিম ভাষার তো সাধুভাষার মতো বিলুপ্তির দিকে যেতে দেরি হবে না। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, সাধুভাষার স্থান হবে ঐতিহাসিক কবরস্থানে। জনগণের ওপর চাপিয়ে দেওয়া প্রমিত ভাষার স্থানও সেখানেই হবে।
সাম্রাজ্যবাদ
ইংরেজি, ফরাসি, জার্মান, স্প্যানিশ, ইতালিয়ান, পর্তুগিজ ইত্যাদি ইউরোপীয় প্রধান ভাষার প্রমিত রূপের উদাহরণ টেনে অনেকেই বলেন, এইসব ভাষায় একটি স্ট্যান্ডার্ড বা প্রমিত রূপ আছে বাংলায়ও থাকতে হবে। কেউ কেউ মনে করেন, আইন করে প্রমিত বাংলা ভাষার শুদ্ধতা রক্ষা করতে হবে ইউরোপীয় ভাষাগুলোর মতো।
ইউরোপের ভাষার উদাহরণ যতোই দেওয়া হোক, একটি প্রশ্ন এখানে মাথা তুলে দাঁড়াবেই। ইউরোপের এইসব ভাষা সাম্রাজ্যবাদীদের ভাষা। ঔপনিবেশিক শাসকশ্রেণীর ভাষা। বাংলা ভাষা কি সাম্রাজ্যবাদী ভাষা? না কি তা হয়ে উঠতে চায়? আমাদের রাষ্ট্রীয় মূলনীতিতে কী আছে? আমাদের পররাষ্ট্র নীতি কী? ইউরোপের এসব ভাষাভাষী জাতি বিভিন্ন দেশ অবৈধভাবে দখল করেছে, অন্যায়ভাবে স্থানীয়দের হত্যা করেছে, নিষ্ঠুরভাবে অধীন জাতির সংস্কৃতি বিনাশ করেছে। দেশজ ভাষা লুপ্ত করেছে, স্বধর্ম প্রচার করে ভিন্ন ধর্ম বিনষ্ট করেছে। সম্পদ লুট করেছে। এসব কর্মকাণ্ডের পেছনে তাদের ভাষা আগ্নেয়াস্ত্রের চেয়ে কম ভয়ঙ্কর ভূমিকা পালন করেনি। এসব জাতির ভাষার বর্ণমালা নরহত্যার অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে রক্তে রঞ্জিত হয়ে আছে। শাসন, শোষণ, লুণ্ঠন, অপহরণ ও খুন-ধর্ষণের জন্য ভাষাগত ঐক্য অন্য অনেক রকম ঐক্যের সঙ্গে কাজ করেছে। আর আমাদের দুঃখিনী বর্ণমালা অত্যাচারের চাবুকের আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে যন্ত্রণায় কাঁতরাচ্ছে। এখন তার স্বস্তির ও সুস্থ হওয়ার সময়।
পাকিস্তানি আমলে উর্দু ভাষাকে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা। তারপর চাপে পড়ে বাংলা ভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দিলেও উর্দু হরফ ব্যবহারের প্রস্তাব করা। এরও পরে ভাষা ও বর্ণমালা মেনে নিলেও শব্দ ভাণ্ডারে উর্দু শব্দ অনুপ্রবেশ করানোর হীনচেষ্টা আমাদের ভুলে গেলে চলবে না। এই সবই কিন্তু হয়েছে ভাষাগত ঐক্য, সংহতি ও প্রমিতকরণের নামে। হয়তো তখন ‘প্রমিত’ শব্দটির ব্যবহার করেনি পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী।
সবশেষে দেখি ভাষাবিজ্ঞানী ড. হুমায়ুন আজাদ বাংলা ভাষার কয়টি প্রমিত রূপ আশা করেছেন। তিনি সাধু-চলিত (তিনিও রবীন্দ্রনাথের মতো ‘চলতি’ লিখেছেন) রীতির মধ্যে শুধু চলতি রীতিকেই প্রমিত বলে গ্রহণ করতে চেয়েছেন। আর রাজনৈতিকভাবে দুটি দেশের মধ্যে একটি অভিন্ন প্রমিত ভাষার কথা বলেছেন। তবে তার মধ্যে থাকবে বৈচিত্র্য। দুটি অঞ্চলের মধ্যে মিল থাকবে ভাষার একটি শক্ত কাঠামোতে। সে কাঠামো গড়ে উঠবে ক্রিয়ারূপ, সর্বনামরূপ এবং বহুবচনরূপরাশি। [হুমায়ুন আজাদ: ঐ: পৃষ্ঠা-১৪৪]
‘বাঙলা ভাষার চারটি স্তর হচ্ছে ধ্বনি, রূপ (বা শব্দ), বাক্য ও অর্থের স্তর, এবং এ-চারটি স্তরেই যে অবিকল অভিন্ন হবে মান বাঙলা ভাষা, তা নয়।‘ [হুমায়ুন আজাদ: ঐ: পৃষ্ঠা-১৪৫]। তিনি আরও লিখেছেন, ‘বাঙলা ভাষার উভয় অঞ্চলে বাঙলা ধ্বনিমূলরাশি সংখ্যায় ও প্রকৃতিতে নিশ্চয়ই অভিন্ন, কিন্তু তাদের বাস্তবায়নে অর্থাৎ উচ্চারণে অবশ্যই কিছুটা ভিন্নতা ঘটবে। এতো বড়ো একটা ভাষা-অঞ্চলে উচ্চারণ-অভিন্নতা আশা করা যেতে পারে না; এবং তার দরকার নেই।’ তিনি আরও জানান, ‘উচ্চারণ কখনো অবিকল এক হবে না। মান ভাষার জন্য তা জরুরি নয়। শব্দসম্ভার ও বাকভঙ্গিতেও ভিন্নতা থাকবে কিছুটা দু-অঞ্চলে; এবং এ-ভিন্নতা বিকাশ ঘটাবে মান বাঙলা ভাষার। … নতুন শব্দ তৈরি হবে, আঞ্চলিক শব্দ নেওয়া হবে, বিভাষা থেকে ঋণ নেওয়া হবে।… বাক্যিক কাঠামোতেও ভিন্নতা থাকবে, আর তা হবে ব্যক্তিক—কে কখন একটি অভিনব বাক্যসংগঠন সৃষ্টি করবে, তা আগে থেকে ব’লে দেওয়া যায় না।’
হুমায়ুন আজাদের প্রমিত বা মান বাংলা ভাষাচিন্তায় কোনো আধিপত্য বিস্তারের সুযোগ নেই। স্বাধীন ও স্বতন্ত্রভাবেই একটি প্রমিত বাংলা ভাষা, ব্যাকরণ, বানান ও উচ্চারণরীতি প্রণয়ন করা সম্ভব। আর একজন ভাষা ব্যবহারকারী হিসাবে আমিও তাই আশা করি। ভাষায় কোনো ধরনের আধিপত্যকে মেনে নিতে রাজি না।