এক.
নিজাম তিনটি হাঁচি দিয়ে থামলো। থামার লক্ষণ দেখে পাশে বন্ধুরা বসে থাকলে কান থেকে হাত নামাতো। তার হাঁচি আশেপাশে এক কিলোমিটার দূর থেকেও শোনা যায় বলে তারা দাবি করে। এজন্য তাদের নিজেদের কান রক্ষার্থে হাত দিয়ে রাখতে হয়। হাঁচির পর হয়তো বন্ধুদের কেউ বলতো, দোস্ত, কতদিন পর মাত্র তিনটাতেই থাইম্যা গেলি, ক তো? নিজাম হাহা করে হাসতো। বন্ধুদের প্রশ্নের উত্তর দিতে পারতো না সে। তার হাঁচির সর্বনিম্ন সংখ্যা আট থেকে দশ। তবে হাঁচি যদি দশটা পেরিয়ে যায়, তাহলে টেকসই ঠাণ্ডা লাগবে। জ্বর সর্দি কাশি আর মাথাব্যথা সপরিবারে তার ঘাড়ে আস্তানা গেড়ে বসবে। সাধারণ ওষুধে কাজ হবে না, খেতে হবে হায়ার এন্টিবায়োটিক।
আজ বন্ধুরা নেই পাশে। কাছের সব বন্ধুদের বিয়ে হয়ে গেছে। বান্ধবীরা বাচ্চাকাচ্চা আর সংসার নিয়ে দিন কাটাচ্ছে। বন্ধুরা হয় অফিসে ব্যস্ত কিংবা ব্যবসা সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে। আর শুধু সেই বসে বসে হাঁচি গুনে বন্ধুরা কী বলতো, সেটা ভাবছে।
নিজামের হাঁচি কোনো সমস্যা নয়, এই জোরে হাঁচি দেওয়া সে ক্লাস এইটে থাকার সময় রপ্ত করেছে। ইংরেজি শিক্ষক রেজাউল ইসলাম হাঁচি দিলে বিশাল মাঠের পরে রাস্তা, সেই রাস্তা থেকে শোনা যেতো। নিজাম রেজাউল স্যারের কোনো গুণই নিজের মধ্যে ধারণ করতে পারেনি কিন্তু হাঁচিটা সে শিখে ফেলেছে। কলেজের পড়ার সময়ে সবাই তাকে চিনতো, হয়তোবা নাম জানতো না। কিন্তু তার সম্পর্কে আলাপের সময় কেউ না চিনলে বলতো, ওই যে কান-মাথা ফাটিয়ে হাঁচি দেয়, ওই ছেলেটা।
হাঁচির সংখ্যা পঞ্চাশটি পেরিয়ে গেলে তার মাথায় কোনো কাজ করে না। এটা কি কোনো অসুখ, সে বলতে পারে না। ঘড়িসারে একটি বেসরকারি হাসপাতাল আছে। সেখানকার ডাক্তাররা বলতে পারেনি। তারা ঢাকায় যেতে বলেছে। মাত্র আড়াই শ টাকা হাতে গিয়ে ঢাকা চলে যাওয়া যায়, লঞ্চে, কিন্তু সে যাবে না। নিজে নিজেই ধরে নিয়েছে, এই হাঁচি তার সারবে না। বউয়ের সামনে এভাবে হাঁচি দেওয়া ঠিক হবে না। তাই বিয়ের পিঁড়িতে বসেনি, বসতে চায়নি।
হাঁচি নিয়ে এখন আর চিন্তা করে না। তবে আজ চিন্তা হচ্ছে কারণ শিগগিরই ঝুম বৃষ্টি নামবে। তার এই পরপর তিনটি হাঁচি বৃষ্টির বার্তা। এতে তার মন খারাপ হয়ে গেলো। আজকের দুপুরটা বরাদ্দ ছিল শিফার জন্য। কাল শিফার সঙ্গে। নিজামের বিয়ে।
সেদিন সোমবার ছিল। বাসায় পেট পুরে খেয়ে বাজারে এসেছিল নিজাম। বাজারের উত্তর কোণার একটি টংয়ের সামনে দাঁড়িয়ে হাঁসের দুটি ডিম খেয়ে মুখ মুছতে মুছতে মুড়ি মাখাতে বলছিলো, তখন পেছন থেকে শিফা ডেকে বলল, নিজাম ভাই, শোনেন।
হুম। বলো।
আজ যদি আপনার পরপর আটটা হাঁচি হয় এবং নয় নম্বর হাঁচিটা হতে গিয়ে আটকে যায় এবং আর না হয়, তাহলে বুঝবেন আমার-আপনার বিয়ে হবে। বিয়েটা হবে আটদিন শেষে নবম দিনে।
নিজাম ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়, কী বলবে ভেবে পায় না। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। এদিকে মুড়ি মাখিয়ে মুড়িঅলা ছেলেকে প্যাকেট ধরে তাকে খোঁচা দেয়। মুড়ির ঠোঙ্গা হাতে নিয়ে কিছু বলার আগেই শিফা বাজারের মানুষের মধ্যে হারিয়ে যায়। মুড়ি চিবোতে চিবোতে হাঁটতে থাকে। শেষ লোকমা মুড়ি মুখে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই হাঁচি শুরু হলো। একটা। দুইটা। তিনটা। সাতটা। আটটা। ন…। কিন্তু না। নয় বলতে পারলো না, হাঁচি থেমে গেলো। শিফা মেয়েটা কী অদ্ভুত! যেটা তখনো ঘটেছিল না, তা হুবহু বলে গেল কিভাবে?
নিজাম হাঁচির অঙ্ক মিলিয়ে অনেক কিছু মিলিয়ে রেখেছে। একটা হাঁচি হলে কী হয়, দুইটা হলে কী হয়, দশটা হলে কী হয় এমনকী পঞ্চাশটা হলে কী হয়। কিন্তু সাড়ে আটটা হাঁচির হিসাব সে কখনো করেনি।
শিফা নিজামের স্টুডেন্ট। নিজাম যখন টিউশনি করাতো, তখন কেউ যদি জিজ্ঞাসা করতো, এই, কোথায় গিয়েছিলে?
স্টুডেন্ট পড়াতে।
কার ছেলেকে পড়াও?
বললাম না স্টুডেন্ট—রেগে উত্তর দিতো। মেয়েদের পড়ালে সে কখনো ছাত্রী পড়াই বলতো না, বলতো স্টুডেন্ট পড়াই। এমনই এক স্টুডেন্ট শিফা, যাকে সে বছর সাতেক আগে পড়িয়েছে। এতদিনে সে ভুলেই গিয়েছিল যে, শিফাকে পড়াতো একসময়। নিজেও এখন জনতা ব্যাংকে সিনিয়র অফিসার হিসেবে চাকরি করছে। কিন্তু হাঁচির জন্য বিয়ে করতে পারছে না। কিন্তু শিফা কি তার হাঁচি নিয়ে গবেষণা করে রেখেছে? সে উত্তর পায় না। এই হাঁচির পঞ্চম দিন বিয়ে ঠিক হয়ে যায়, এমনকী শিফার সঙ্গেই। পারিবারিকভাবেই কথা হয়েছে অথচ এসবে নিজামের কোনো হাত নেই, মত নেই। সবকিছুই স্বয়ংক্রিয়ভাবে হয়ে যাচ্ছে, না কি শিফার হাত আছে, সে বুঝতে পারে না।
বিয়ের দিন ধার্য হয়েছে আগামী কাল। বিয়ের আগের দিন দুপুরে, অর্থাৎ আজ একসঙ্গে দুপুরের খাবার খাওয়ার পরিকল্পনা করেছে। সকালে শিফাই ফোন দিয়ে বলেছে, আজ দুপুরে আমরা ঘড়িসার খাবো, ভাত-ভর্তা হোটেলে।
কেন?
আমাদের বিয়ে উপলক্ষে ট্রিট। তুমি ট্রিট দিচ্ছ। হবু স্বামীর পক্ষ থেকে হবু স্ত্রীকে ট্রিট। শিফার আপনি ডাক এখন তুমিতে এসে ঠেকেছে। তুমি ডাকটা খুব আপন, কাছের। নিজাম তুমি করেই আগে থেকে ডাকে, তার আর এ ডাক পরিবর্তনের প্রয়োজন নেই। সে বলে,
বিয়ে তো কালই। কালই তো খাইতে পারবা।
কিন্তু তখন আর এখনকার খাওয়ার মধ্যে পার্থক্য আছে। বিয়ের আগেই এই দুপুরের খাবার শেষ করতে হবে।
নিজাম আর কথা বাড়ায় না। সে রাজি হয়। বলে, ওকে, ভাত-ভর্তা হোটেলের সামনে ওয়েট করবো। তুমি ওখানে আসবে।
কিন্তু হাঁচির কারণে যে বৃষ্টি এলো বা বৃষ্টি আসবে বলে যে হাঁচি তিনটি হলো, তা নিজামকে দোলাচলের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। এই বৃষ্টিতে শিফা আসবে কি আসবে না, তা নিশ্চিত হওয়ার জন্য ফোন দেয়। কিন্তু ফোন বন্ধ। তবে শিফাকে যে ভয়ঙ্কর রকম ভালোবাসে, তা প্রমাণের জন্য বৃষ্টির থামার পরপরেই হোটেলে গিয়ে উপস্থিত হলো। অবশ্য ততক্ষণে বিকেল তিনটা বেজে গেছে। গিয়ে দেখে, শিফা দাঁড়িয়ে আছে। অথচ মুখে বিরক্তির ছিটেফোঁটাও নেই, আছে একফালি হাসি। বলে, নিজে দাওয়াত নিয়েছিলাম বলে আমাকে এভাবে দাঁড় করিয়ে রাখলে নাকি?
লজ্জা পেয়ে গেলো নিজাম। তবু একসঙ্গে ভেতরে গিয়ে বসলো, খাওয়া শেষ করলো। খাওয়ার সময় নিজামের খাওয়া দেখতে লাগলো। পাঁচ আঙুলে বিশাল লোকমা ভাত নিয়ে বিশাল বড় হা করে পুরোটা পুরে দিচ্ছে মুখে। একমনে ভাত খাচ্ছে। শেষ লোকমা ভাত মুখে পুরে দিয়ে নিজাম অবাক হয়ে বলল, কী ব্যাপার, খাওয়া বাদ দিয়ে হা করে তাকিয়ে আছো কেন? শিফা নিজের দিকে তাকিয়ে দেখে, সত্যিই তার মুখ হা হয়ে আছে। লজ্জা পেয়ে যায়, বিব্রত বোধ করে। বলে
তোমার খাওয়া দেখছিলাম। একমনে খাচ্ছো। আমি এভাবে কখনো খাইনি।
এখন থেকে খেও।
শিফা মনে মনে ভাবল, এমন পাগল ভুলোমনা মানুষই আমি সারাজীবন চেয়েছিলাম।
খাবারের বিল দিতে গিয়ে নিজাম দেখে, সে মানিব্যাগ আনেনি। মানিব্যাগ না আনাটার চেয়ে বিব্রতকর বিষয় হলো তার পকেটে পাঁচ টাকার একটা নোট আর দুই টাকার এটা ছেঁড়া নোট পাওয়া গেছে। যারা মানিব্যাগ ব্যবহার করে, তাদের পকেটে কি টাকা থাকে? শিফাকে কী বলবে এখন, শিফা কি আদৌ বিশ্বাস করবে। মনে মনে বললো, শিফা যদি বিল দেওয়ার জন্য জোর করে তাহলে সে পাঁচজন ভিখারীকে পঞ্চাশ টাকা করে দেবে। বারবার প্রার্থনা করতে থাকে। কিন্তু খাওয়া শেষ হলে শিফা বলে, নিজাম, চলো। আর হ্যাঁ, বিলটা দাও। আমরা বাইরে কোথাও বসে গল্প করবো।
বিপদ বেড়ে গেলো, সে তার ভিখারীকে খাওয়ানোর মানত বাদ দিলো। অবশ্য এর আগে মনের ইচ্ছা পূরণ হলেও সে কখনো মানত পূর্ণ করেনি। তাই তার ধারণা, আল্লাহ্ তার ওপরে বেজার হয়ে অপমানিত করেছে।
শিফার দিকে অসহায়ের মতো তাকায়। কিছু বলার আগেই হো হো করে শিফা বলে, মানিব্যাগ ভুলে রেখে এসেছো, ভালো কথা, কিন্তু পকেটে এই খুচরো সাত টাকা কেন? নাকি টাকাই নেই?
নিজাম কিছু বলে না। হাসতে হাসতে বলে, সাত টাকা যে পকেটে আছে, কিভাবে টের পেলে?
মেয়েরা ছেলেদের পকেট পড়তে পারে।
দুই.
আজ বিয়ে। আয়োজনে কোনো ঘাটতি নেই। বিয়ে পড়ানোর কাজি চলে এসেছেন। মাওলানা সাহেবও এসেছ্নে। সব কিছু প্রস্তুত। এদিকে নিজাম কবুল বলে ফেলেছে। কিন্তু শিফার কাছে যখন কাজি সাহেব গিয়েছেন, সে বলেছে, আমি এখানে বিয়ে করব না, কবুলও বলব না।
এখানে না, মানে কী? এই ছেলেকে বিয়ে করবে না তো আগে বলোনি কেন? এই আয়োজনের পর এসব করার মানে কী?
এখানে না মানে এই ছেলেকে না, তা বলিনি। বরং এই ঘরে বিয়ে করব না।
তো কোথায়?—অভিভাবকেরা হাঁফ ছেড়ে জিজ্ঞাসা করে।
ভাত-ভর্তা হোটেলে।
সবাই হাসে। ওইটা তো পার্টি সেন্টার না। চায়ের টঙ ছিল আগে, এখন ভাতও বিক্রি করে। তবে কোনো আমিষ তারা বেচে না। কোনো তরকারিও বেচে না। এমনকী ডালও না। শুধু ষোল রকমের ভর্তা বেচে। আর ভাত। আলু ভর্তা, বেগুন ভর্তা, পটল ভর্তা, কলা ভর্তা, মাছ ভর্তা, শুটকি ভর্তা, দূর্বা ঘাস ভর্তা, সজনে পাতা ভর্তা, পুই শাক ভর্তা, লাউয়ের খোসা ভর্তা, মরিচ ভর্তা, আম ভর্তা, লাল শাক ভর্তা, আটা ভর্তা, ভাত ভর্তা, মুড়ি ভর্তা বেচে। আর কিছু না।
এই টঙে বসে বিয়ে করবে। নাহলে সে কবুল বলবে না। সোজাসাপ্টা বলে দিয়েছে। অভিভাবকেরা বোঝাতে চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না। অবশেষে নিজামের কাছে খবর পৌঁছানো হলো, সে যদি শিফাকে বোঝাতে পারে। কিন্তু তাকে বলার সঙ্গে-সঙ্গেই বললো, ওকে, ভাত-ভর্তা হোটেলেই হোক। আমিও মনে মনে সেটাই চাচ্ছিলাম।
কোনো উপায় নেই। লোকলজ্জার মাথা খেয়ে অভিভাবকেরাও যেতে বাধ্য হলেন। বিয়েটা টঙের সেই টেবিলে, যে টেবিলে বসে গতবিকালে ভাত খেয়েছে সেখানেই হলো। বিয়ে পড়ানো হলো। নিজামকে দ্বিতীয় দফায় কবুল বলতে হলো। বিয়ের কাজ শেষ হলে শিফা বললো,‘আমার সামনে বসে ভাত খাও। নিজাম বললো, আচ্ছা।
সবাই শিফার মতোই আগ্রহ নিয়ে নিজামের একাগ্রচিত্তে ভাত খাওয়া দেখতে লাগল। অথচ অন্যরা এই ভাতখাওয়ার মাঝে কিছুই দেখতে পেলো না। বিরক্ত হলো।
তিন.
রাত হয়েছে। সব কাজ গোছগাছ করে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে নিজাম। বিছানায়, সাজানো বিছানায়, বসে আছে শিফা। তার ঘুম পেয়েছে খুব। বিয়ের কয়েকদিন আগে থেকে বিয়ের দিন পর্যন্ত অনেক কাজ থাকে, মানসিক চাপ থাকে। অনেক কিছু সামলাতে হয়। এসবের পর ক্লান্তি লাগে। সে ঘুমাতে পারছে না। কারণ তাকে বলে দেওয়া হয়েছে, বিয়ের রাতে ছেলেরা বাঘ হয়ে যায়। বাঘ না হলেও অন্তত পশু হয়। কোন ধরনের পশু হতে পারে, সেটা ভেবে উত্তর পায়নি। অবশ্য কেউ কেউ মানুষও থাকে, সবাই বাঘ বা পশু হয় না। নিজাম বাঘ, পশু নাকি মানুষ থাকে, সেটা দেখার জন্য হলেও তার জেগে থাকা দরকার। এজন্যই জেগে আছে।
ওপাশে হাসির রোল পড়ে গেলো
নিজাম ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলো। সঙ্গে সঙ্গে সতর্ক অবস্থানে বসলো শিফা। বিছানায় এসে বসতেই শিফা সালাম দিতে যাবে, তার আগেই নিজাম বলে দিলো, কী ব্যাপার, এইসব ফরমাল ড্রেসে কিভাবে বসে আছো? এভাবে ঘুমাতে পারবা? এত সেজেগুজে প্লাস্টিকের মতো বসে থাকার দরকার নেই, যেটাতে আরাম লাগে, সেটা পরে ফেলো।
শিফারও সেটাই মনে হয়েছিল। এভাবে বসে থাকাতে নিজেকে প্লাস্টিক না, জড়পদার্থ মনে হচ্ছিল। কিন্তু কোন জড় পদার্থ বুঝে উঠতে পারছিল না। নিজামের কথা শুনে সে নিশ্চিত হলো, সেই জড়পদার্থ হলো প্লাস্টিক। এমনভাবে সবাই সাজিয়ে দিয়েছে, গালে এক সেন্টিমিটার পুরু কসমেটিক্স লেগে আছে বোধ হয়। আর শাড়িটা কী ভারী, এসব পরে ঘুমানোও যেতো না বটে। কিন্তু বাসা থেকে আনা কাপড়ের ব্যাগ এ ঘরে নেই। কী করা যাবে, এ রুমে যেগুলো আছে, সেগুলো সব নতুন। মাড় লেগে আছে। মাড় লেগে থাকা কাপড় পড়লে কেমন খসখস করে। আরাম লাগে না। কী করবে এখন?
নিজাম বললো, তাও এককথা। কোন রুমে আছে?
আমি তো জানি না। তোমাদের বাসার সব রুমের খবর তো আমি জানি না।
হ্যাঁ। তাইলে এককাজ করো। আমার লুঙ্গি বা ট্রাউজার যেটা তোমার ভাল্লাগে সেটা পরে ফেলো, সকালে ডেকে দেবো, তখন কাপড় বদলে আবার এই শাড়ি পরে ফেলো।
শিফা ‘আচ্ছা’ বলে কাপড় চেঞ্জ করে ফেলল। রাতে ঘুম ভালো হবে, এমনিতে ক্লান্তি তার ওপরে আরামের পোশাক। শিফা যে বাসায় ট্রাউজার বা শর্ট পরে রাতে ঘুমাতো, এটা কি নিজামকে বলবে? বুঝে উঠতে পারে না। আর বাসর রাতেই এত ফ্রি হওয়া কি তার ঠিক হচ্ছে? সে সেটাও বুঝতে পারে না। ঘুমঘুম ভাব থেকেই যায়, অপেক্ষা করতে থাকে নিজামের বাঘ, পশু বা মানুষ হওয়া দেখার জন্য। সে আগে কখনো দেখেনি। এর মধ্যে সে ট্রাউজার পরে আছে, গায়ে নিজামের টি-শার্ট। দরজা খোলা রেখে নিজাম কোথায় গেলো, যদি অন্য কেউ রুমে ঢুকে পড়ে, তাহলে শিফার মানসম্মানের বারোটা বাজবে। সে ভয়ে থাকে।
ঠিক তখনই নিজাম মাটির দুটি মগ নিয়ে ঢোকে। চা বানিয়ে এনেছে। শিফা বলে, এই রাতে ঘুমাবা না, চা খাবা? তাও আবার মাটির মগে? মাটির মগ আমার ভালো লাগে না। টয়লেটের মাটি, নাকি কিসের মাটি, তাও জানি না। ওটা মুখে দিতে পারবো না। নিজাম হাসতে হাসতে বলে, আমারও এটা ধারণা হয়েছিল। আরও চা রেখে এসেছি। দাঁড়াও। কাপে করে নিয়ে আসি তোমার জন্য।
শিফা ভাবতে থাকে, আজ রাতে ঘুমানো হবে না তাহলে?
নিজাম সিরামিক্সের মগ নিয়ে আসে। শিফা বিরক্তির সঙ্গে চুমুক দেয় কিন্তু ঢোক গিলে নেওয়ার পর আর বিরক্তিটা থাকে না। চা এত সুন্দর হয়, শিফা জানতো না। শিফা চা খেলো। নিজামও খেলো।
চা খেতে খেতে নিজাম বলে, শিফা, আজ কী কাজ করেছ সারাদিন?
অনেক কাজ। দুটো ছেলে পেছন পেছন ঘুরতো খুব, জ্বালাতো না কিন্তু সামনে সামনে ঘুরঘুর করলে বিরক্ত লাগে না? ওদের বলে দিয়েছি, আমার সামনে আর আসবেন না। আসলে চাচা বলে ডাকবো। ওরা আসবে না বলে চলে গেছে। ফেসবুকে কয়েকজনকে ব্লক দিয়েছি। যারা খুব ডিস্টার্ব করতো। এই আর কী।
ও। আমার একটা ঝামেলা হয়ে গিয়েছিল আজ।
কী ঝামেলা?
কলেজের এক মেয়েকে খুব ভালো লাগতো। তবে কখনো বলার সাহস পাইনি। কিন্তু যেখানেই পেতাম, তাকিয়ে থাকতাম তার দিকে। সে হয়তো বা বুঝতে পারতো না। মেয়েটা অনার্স ফাইনাল ইয়ারে পড়ছে এখন। আমি চাকরি পেয়েও কিছু বলিনি, বলতে পারতাম না। তাকিয়ে থাকতাম। চোখে চোখ পড়ে গেলে হাসতো। কিছু বলতো না। কিছু বলব কি না, জানতেও চাইতো না। আজ সেই মেয়ের বাড়ি গিয়েছিলাম। গিয়ে ওর মায়ের সামনে বলেছি, আপনাকে আমার খুব ভালো লাগতো। মনে মনে ভালোবেসে ফেলেছিলাম। কিন্তু আজ আমার বিয়ে। শিফার সঙ্গে। আজ থেকে আপনাকে আর লুকিয়ে লুকিয়ে দেখবো না। ভালো থাকবেন। ওর মা-সহ সে হাহা করে হেসে দিয়েছে। ওরা প্রেমের মূল্য বোঝে না। অবশ্য ওর ভাই ‘কোন শালারে’ বলে তেড়ে আসছিল, আমি ওর তেড়ে আসার কোনো কারণ খুঁজে পাইনি। পালিয়ে এসেছি।
চায়ে শেষ চুমুক দিয়েই নিজাম শুয়ে পড়লো। তিন মিনিটের মধ্যেই সে ঘুমিয়ে পড়লো। শিফা তার অঘোর ঘুম দেখতে লাগলো। ঘুমাতে পারলো না। সারারাত পাশে শুয়ে ভাবতে লাগলো, বান্ধবীরা এত ভয় দেখালো, কিন্তু বাসর রাতে ভয়ের তো কিছুই হলো না। রাতে চা খেয়ে ঘুম চলে গিয়েছে। এই ঘুম একবার গেলে আর ঘুম আসে না। শিফা বিছানায় সাবধানে গড়াগড়ি পাড়তে লাগলো যেন নিজামের ঘুম না ভাঙে।
ভোরে শিফাকে ডাকা তো দূরের কথা, শিফাই নিজামকে ডেকে দিলো। শিফা রাতের সাজে বসে আছে। নিজাম উঠে বসতেই শিফা বললো, বাথরুমের খুব চাপ পেয়েছে কিন্তু পিচ্চিরা দরজায় তালা দিয়ে রেখেছে। টাকা না দিলে খুলবে না। তোমার মানিব্যাগ পেলাম না। আর আমার টাকার পার্সটটা আমার কাছে নাই এখন। কী করবো বলো?
জানতাম, ওরা এ কাজ করবে। তাই আমি আগেভাগে বাথরুমের কাজ সেরে এসেছি। দুপুর পর্যন্ত রুম আটকে থাকলেও আমার সমস্যা নাই। ওরা বিরক্ত হয়ে একসময় পালিয়ে যাবে। অবশ্য ওদের জন্য যে ক-টা টাকা রেখেছি, তখন খুঁজে খুঁজে দিয়ে বেড়াতে হবে—বলেই সে হাসতে শুরু করলো।
তুমি রাতে উঠেছিলে? কখন?
আমি উঠেছিলাম। দেখলাম, তুমি কখন আবার শাড়ি পরে ফেলেছো। পরে বিছানায় বসে ঝিমাচ্ছো। তাই আর ডাকিনি। চুপচাপ সেরে এসেছি। ভোরের আজানের একটু আগে।
শিফা অবাক হয়। তারপর দরজা খুলতে যায়। আগের মতোই খোলে না। নিজাম একটা খামে টাকা দেখিয়ে বলে, দরজা খোল। খুললে টাকা দেবো।
ওপাশ থেকে জবাব আসে, আগে টাকা দেন। নাইলে খুলবো না।
এই নে টাকা। খুল এবার। তোদের ভাবি বাথরুম আটকায়া মইরা গেলে মার্ডার কেসের আসামি হয়ে যাবি। তাই আগেভাগেই সটকে পড়। ওপাশে হাসির রোল পড়ে গেলো।
তারা দরজা খুলে দেয়। টাকার খাম খুলে দেখে, পাঁচ টাকার নোট দশটা, বাকিগুলো ওই সাইজের কাটা কাগজ। এই সারারাত দরজার সামনে চকিদারি করে পেলো মাত্র পঞ্চাশ টাকা। তবু সবাই হুড়োহুড়ি শুরু করে দিলো, যারা জেগে দরজা পাহারা দিয়েছে, শুধু তারাই পাবে। সবাই জেগে ছিলো প্রমাণ করার জন্য উঠেপড়ে লেগে গেলো।
বাথরুম সেরে রুমে এসে কোথাও আর মাটির মগটি খুঁজে পেলো না। শিফা অবাক হলো।
চার.
বিয়ের একসপ্তাহ পার হয়েছে। অফিসের সবাই জানে নিজাম বিয়ে করেছে কিন্তু বউকে দেখেনি তারা, দাওয়াত পায়নি। আর বউয়ের ছবি সে ফেসবুকেও দেয়নি।
অফিসে সকালে গিয়ে এক নারী উপস্থিত। নিজামের কাছে ফোন গেছে গেট থেকে। গেটম্যান বললো, স্যার, এক মহিলা এসেছেন, তিনি আপনার সাবেক প্রেমিকা বলে পরিচয় দিয়েছেন। আপনার সঙ্গে দেখা করতে চান। আপনার রুমে পাঠাবো?
কে সে?
নাম বলছেন না, স্যার। শুধু বলছেন, তোমার স্যার আমাকে ভালোভাবে চেনেন। আর তার বিয়ে হয়েছে আমি শুনেছি। কিন্তু বিয়ের দাবি নিয়ে আসিনি। তোমার স্যারকে ভয় পেতে নিষেধ করো।
নিজাম ভাবতে থাকে, কে এলো। সে তো কখনো প্রেম করেনি। প্রেমিকা আসবে কোথা থেকে, তাও আবার বিয়ের দাবি নিয়ে না, তাহলে কেন আসছে সে? কেই বা সেই নারী? তবু যেহেতু একজন দাবি নিয়ে এসেছে, তাকে আসতে দেওয়া যায়। যদি আবার গেটের সামনে প্রেমিকার দাবি নিয়ে অনসনে বসে যায়, আরও বেশি বিপদে পড়ে যাবে।
তার কপালে ঘাম জমে গেছে যদিও এসি চলছে বাইশ পয়েন্টে। রুমে ঢুকলো শিফা। শিফা ঢুকেই দেখে, টেবিলের ওপরে রয়েছে সে রাতে চা খাওয়া মাটির মগ।
শিফা একটা প্যাকেট বের করে দেয় নিজামকে। তারপর কিছু না বলে টেবিলের ওপরে রাখা মাটির মগটা নিয়ে ব্যাগে পুরে নেয়। নিজাম শিফাকে কফি খেতে বলে, সাপোর্ট স্টাফদের ডেকে হইচই অবস্থা সৃষ্টি করে ফেলেছে। অফিসে তার বউ এসেছে নাকি বস, কেউ বুঝতে পারে না। মনের মানুষকে কে না ভালোবাসতে চায় কিংবা ভালোবাসে বলেই সে মনের মানুষ। অথচ শিফা মনে ছিল না কখনো, মনে ছিল একজন নারী। সেই নারীর দুই ঠোঁটের বাম দিকের জোড়ায় একটা তিল ছিল। শিফার কি সেই তিলটা আছে, কখনো খেয়াল করা হয়নি। আজ তাকাতে যাবে, দেখতে যাবে সেই তিল কিন্তু শিফা থামলো না। উঠে চলে গেলো। হন্তদন্ত হয়ে ওঠা কর্মচারীরা হাঁফ ছেড়ে বেঁচে শিফার চলে যাওয়া দেখতে লাগলো।
নিজাম ভারীমুখে প্যাকেট খুলে দেখে, পোড়া মাটির মগ। দারুণ। মগের ভেতরে একটা চিরকুট, সেখানে লেখা তোমার অফিসের মগটা বাসায় নিয়ে যাচ্ছি। এটাতে এখন থেকে আমি চা খাবো, তুমি আমারটাতে চা খাবে। আমিও মাটির মগেই চা খাই। আমি দোয়েল চত্বর থেকে কিনেছি। তোমারটা তো পালপাড়া থেকে কেনা, তাই না?
নিজাম তাকিয়ে থাকে চিরকুটের দিকে। এমন পাগলিই তো সে চেয়েছিল সারাজীবন। শিফা বেরিয়ে গেছে সেই কখন, অথচ নিজাম তখনো দেখে শিফা বসেই আছে। সেই শিফার মুখে এক ফালি সুখ লেপ্টে আছে।