বাবাকে নিয়ে যখন লিখতে বসেছি, তার ১৪ বছর আগেই বাবা চলে গেছেন পৃথিবী ছেড়ে।
২৩ রোজা। ২০০৪ সালের কথা বলছি। আব্বু ঢাকায়। একটা নতুন কাজ নিয়েছেন। আমি সবে উচ্চমাধ্যমিক পরিক্ষা দিয়ে ঢাকায় কোচিং করতে গেছি। ২০ রোজার পর কোচিং বন্ধ হওয়ায় আমি বাড়ি চলে আসি। আমাদের জন্য ঈদের জামাকাপড় কিনে নিয়ে আব্বু আসবেন ২৫ রোজায়।এমনটাই কথা ছিল। কিন্তু একটা ফোন কল সব এলোমেলো করে দিলো। ফোনের অন্য পাশের মানুষটা যমদূত হয়ে কেড়ে নিলেন আমাদের জীবনের সব আনন্দ। আব্বু যখন ফিরলেন, তখন জামাকাপড় কেন নিয়ে এলেন না, তার কারণটা জানা হয়নি কোনোদিন। রাত ৩টার দিকে ফিরলেন আব্বু, না তাকে ফিরিয়ে আনা হলো। আমার বোধগুলো তখন স্থবির, পায়ের নিচে মাটি নেই, বুকের ওপর প্রচণ্ড বড় একটা পাথর চেপে দিয়েছে কেউ। দম বন্ধ হয়ে আসছে, আব্বুকে নিয়ে আসা হচ্ছে, আমরা অপেক্ষায়। প্যান্ট শার্ট পরা, পুরনো জুতাটা পায়ে। ঘুমিয়ে আছেন আমার প্রিয় আব্বু। গা-টা বরফের থেকেও ঠাণ্ডা!
সবার বাবাই সবাইকে ভালোবাসে, সেটা জানি, বুঝেছি বড় হওয়ার পর। কিন্তু আমার বাবা আমার, ভালোবাসাগুলো আমার, অনুভূতিগুলোও আমার একান্ত আপন। আমার বাবা আমাদের সবটুকু দিয়ে, কখনো কখনো সাধ্যের বাইরে গিয়েও ভালোবাসতেন। তাকাননি নিজের দিকে কখনো। বুঝিনি তখন, এখন স্মৃতি হাতড়িয়ে আমাদের জন্য বাবার আত্মত্যাগ ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ে না।
রোজায় আমার বাবার অন্যতম কাজ ছিল ইফতার তৈরি করা, ইফতার তৈরি করার কাজটা তিনি নিজেই করতেন। সন্ধ্যাবেলা বিশাল বড় একটা গামলার মধ্যে মুড়ি, ছোলা, ডালের বড়া, বেগুনি, ডিম সিদ্ধ, বুন্দিয়া, আলুর চপ, পিঁয়াজ, মরিচ কুচি, জিলিপি; সব একসঙ্গে মেখে নিতেন। আমি মুড়ির মধ্যে জিলিপি বু্ন্দিয়া মাখানো একদম পছন্দ করতাম না। ঝাল মিষ্টি একসঙ্গে খেতে পারতাম না। আমার জন্য সব আলাদা করে রাখা হতো।
রোজা এলেই ঈদের আনন্দ শুরু হয়ে যেতো। ঈদ তো একদিনেই শেষ। কিন্তু ঈদের প্রস্তুতি চলতো রোজার শুরু থেকেই। ৫ রোজা পার হলেই চলত নতুন জামা কাপড় কেনার বায়না। সবাই নতুন জামা কিনে ফেললো আমরা কবে কিনব, এই নিয়ে সারাদিন দুঃখ চলতো। বাসার পাশের কেউ নতুন জামা কিনে এনেছে, শুনে দেখতে গেলে দেখাতো না, পুরনো হয়ে যাওয়ার ভয়ে। বাসায় এসে মন খারাপ করে বসে থাকতাম কবে জামাকাপড় কেনা হবে। আম্মু বলতেন, ‘কয়েকদিন পরেই বোনাস পাবো, বোনাসটা পেলেই তোমাদের নিয়ে ফরিদপুর যাবে তোমাদের বাবা।’ এরপর শুরু হতো কবে বোনাস পাবে সেই দিন গোনা। বোনাস পেতে তো অনেক দেরি, ততদিন ভালো ভালো সব জামা বিক্রি হয়ে যাবে, এই চিন্তায় থাকতাম আমরা দুই বোন। ভাই আর সবার ছোট বোনটা তখন একদমই ছোট, তাই ওদের আর কোনো কথা থাকতো না।
এরপর সত্যি সেইদিনটা চলে আসতো, আব্বুর সঙ্গে আমি আর আমার বোন সোনিয়া আমরা দুই বোন ভাঙ্গা থেকে ফরিদপুর যেতাম শুধু ঈদের কেনাকাটা করতে। আব্বুর একটা অভ্যাস ছিল, গাড়িতে উঠলেই ঘুমাতেন । তখন সিক্স বা সেভেনে পড়ি। আশেপাশের সাইনবোর্ডের লেখাগুলো পড়তে পারতাম ভালোই। গাড়ি কোনো স্টেশনে দাঁড়ালেই পড়ার চেষ্টা করতাম ফরিদপুর চলে এসেছে কি না। কিন্তু সব সাইনবোর্ডপড়ে শেষ করার আগেই গাড়ি ছেড়ে দিতো। সারাটাপথ ভয়ে ভয়ে যেতাম। ফরিদপুর বুঝি পার হয়েই গেলাম! আব্বুকে মাঝে মাঝে ডেকে তুলতাম কোথাও ফরিদপুর লেখা দেখলে, আব্বু চেখ বন্ধ করেই বলতেন, এখনো আসিনিরে মা, আসলে আমি বলব। অবাক হয়ে ভাবতাম আব্বু চোখ না খুলেই কী করে বলে দিলেন আসেনি ফরিদপুর। সন্দেহ হতো আব্বু পারবেন তো ঠিক জায়গায় নামতে! কিন্তু ফরিদপুর আসার একটু আগেই উঠে যেতেন আব্বু। আমাদের বলতেন, এই তো এরপরেই আমরা নামব। আব্বু কি ম্যাজিক জানতেন, জানিনা। এ রহস্য আজও আমার কাছে উন্মোচিত হয়নি।
গাড়ি থেকে নেমেই আব্বুর প্রথম কাজ আমাদের নিয়ে ফরিদপুরের সবচেয়ে ভালো রেস্টুরেন্টে যাওয়া, বাসা থেকে যতই খেয়ে আসি না কেন। নিজে রোজা থেকে সামনে বসে থাকতেন আর আমাদের খাওয়া দেখে শান্তি পেতেন। বাসার সবার জন্য কেনা শেষ হয়ে গেলে জানতে চাইতাম , আব্বু তোমারটা কিনবা না? বলতেন, ভালো কাপড় দেখলাম না তো, ঢাকা যেতে হবে একটা কাজে তখন প্যান্ট-শার্টের ভালো কাপড় এনে বানাতে দেব।
ভাবতাম সত্যিই হয়তো তাই। কিন্তু আরও একটু বড়ো হওয়ার পর বুঝেছি আমাদের দামি দামি জামা, ভালো রেস্টুরেন্টে খাওয়ানো আর ঈদের বাজার করতেই আব্বু হিমসিম খেতেন। নিজের পরার উপযোগী প্যান্ট শার্ট থাকতে নতুন করে কেনা তারপক্ষে কঠিন ছিল। কিন্তু তার ছেলেমেয়েদের তিনি রাজকন্যা আর রাজপুত্রের মতো বড় করবেন, এটাই ছিল তার ইচ্ছা।
ভাংগায় প্রথমে আমরা একটা সরকারি কোয়ার্টারে থাকতাম। সরকার যা বাড়ি ভাড়া দেয় তার পুরোটাই চলে যায় কোয়ার্টারে থাকলে, তাই আব্বু পরে একটা বাসা ভাড়া করলেন।
ভাঙ্গা থেকে আমাদের গ্রামের বাড়ির দূরত্ব তিন কিলোমিটার। আমার দাদাবাড়ির পাশেই যে সরকারি স্কুলটা আছে, সেখানেই আমার মা শিক্ষকতা করেন। শুধু আমাদের ভালো স্কুলে পড়াতে আর ভালো পরিবেশে রাখতেই ভাঙ্গা বাসা ভাড়া করে থাকার সিদ্ধান্ত নেন আব্বু।
ঈদের একদিন আগে বা দুই দিন আগে আমরা বাড়ি আসতাম। তখনো আমাদের গ্রামে বিদ্যুৎ যায়নি। তাই বাড়ি গেলে ঈদের টিভি প্রোগ্রামগুলো কিভাবে দেখব? বাড়িতে আমার মেজ চাচা আর ছোট চাচা থাকতেন, আব্বু নিজের বাড়ি ছাড়া ঈদ করতেও কোনোভাবে রাজি নন। তাই আমরা দাদাবাড়ি ঈদ করতে যাওয়ার সময় আমাদের সাদাকালো ১৪ ইঞ্চি টিভিও সঙ্গে করে নিয়ে যেতাম। বাড়ির সবাই খুব খুশি হতো টিভি দেখে। চাচারা ব্যাটারি ভাড়া করে নিয়ে আসতেন, ব্যাটারিতে চলতো টিভি। তখন শুধু একটাই চ্যানেল ছিল, বিটিভি। আব্বু উঠানে টিভি সেট করে দিয়ে খেজুর পাতার পাটি বিছিয়ে দিতেন। বাচ্চারা সব সামনের দিকে বসতো। পাটিতে জায়গা না হলে কেউ কেউ চেয়ার, টুল,পিঁড়িতে বসে টিভি দেখতো। আশেপাশের ও দূরের মানুষ ও আসতো টিভি দেখতে। শাবানা-আলমগীরের ছবি দেখে কাঁদতো না—এমন লোক খুব কম ছিল তখন। আমিও সে দলের একজন ছিলাম । তাই আব্বু আমাকে সিনেমা দেখতে দিতেন না। চাচি ফুফুরা সিনেমাকে বলতেন বই। বলতেন শাবানার বই, রাজ্জাকের বই। আমি বুঝতাম না বই কী। আব্বু আমাকে বুঝিয়ে বলতেন পরে। আমি শুনে খুব হাসতাম ।
রাতে দেখতাম হারিকেন নিয়ে আসতো অনেকেই। হারিকেনের আলো একদম কমিয়ে রেখে টিভি দেখতো। যাদের কাছে কোনো আলো থাকতো না, তারা যাওয়ার সময় আমাদের বাড়ি থেকে একমুঠো পাটকাঠিতে আগুন ধরিয়ে নিয়ে পথ দেখে বাড়ি যেতো। একে গ্রামের ভাষায় বলতো আলা ধরানো।
ঈদের দিন সকালে গোসল করে নতুন জামা, জুতো পরে সাজগোজ করে দল বেঁধে ঘুরতে বের হতাম। কাচের চুড়ি আমার খুব প্রিয় ছিল, এখনো তাই। দুই হাত ভর্তি করে কাচের চুড়ি পরতাম। আব্বু নামাজ পড়ে আসলেই সালাম করা শুরু। আব্বুকে দিয়ে সালাম করা শুরু হতো, এরপর একেক করে সবাইকে সালাম করতাম শুধু সালামি পাওয়ার জন্য। আব্বু ঈদগাহ থেকে কখনো একা ফিরতেন না, সঙ্গে থাকতো অনেক লোক। সিঁড়িতে পা দিয়েই সবাইকে সেমাই দিতে বলত আম্মুকে। আমি একটু বড় হওয়ার পর থেকে ওই দায়িত্বটা চলে আসে আমার ওপর।
যখন কলেজে ভর্তি হলাম, বুঝতে পারলাম রোজা, ঈদ মধ্যবিত্ত পরিবারের মা বাবাদের জন্য আনন্দের পাশাপাশি কতটা ভাবনার। সন্তানের মুখে হাসি ফোটাতে তারা কত ত্যাগই না করে! বুঝতে পারলাম আব্বু আমাদের সবাইকে নতুন জামা কাপড় কিনে দিয়ে নিজে কিনতেন না কিছুই। চোখে পড়তে থাকলো আব্বুর সেলাই করা পুরনো জুতা, পুরনো পাঞ্জাবিকে ধুয়ে নীল দিয়ে ইস্ত্রি করে ঈদগাহে যাওয়া । কিছু লাগবে আমাদের আর আব্বু না বলেছেন, এমন কোনোদিন হয়নি। হাসিমুখে সব দিয়েছেন। কী করে পারতেন এভাবে আজও বুঝতে পারি না আমি। বাবা হলে হয়তো সব পারতে হয়!
সময় সব ভুলিয়ে দেয়। বাস্তবতার আঘাতে, সব সময় আব্বুকে মনে করা হয় না ঠিকই। তোমার বাবা মারা গেছে কত বছর?—এ প্রশ্নের জবাব হয়তো একটু ভেবে, হিসাব করেই দিতে হয়,কিন্তু আব্বু নেই। এ কঠিন সত্যিটার মুখোমুখি প্রতিদিন হতে হয়। হতে হবে যতদিন বেঁচে থাকব। ইফতার করতে বসলেই মনে পড়ে সেই মুড়ি মাখানো। ফরিদপুর ঈদের কেনাকাটা করতে যাই, সেই দোকান সেই রেস্টুরেন্টগুলো, রাস্তার পাশের সাইনবোর্ডগুলো আমাকে বেসামাল করে দেয়। নিজেকে লুকাতে চাই নিজের থেকে, পারি না। বুকে বিঁধে থাকে সেই সেলাই করা পুরনো জুতো জোড়া!