ভূমিকা
আমি চিরকাল এক নেশাসক্ত জীব। বাস করি কালের গর্ভে, কবে যে হবো বিলীন। সেই নেশা আজ কই। কই আজ সেই সব নেশার আয়োজন! কোথায় বাস করে পেয়ারা বাগানের ঘন অন্ধকার! কোথায় ডানা মেলে বাদুর? কোথায় বিষণ্নতা আকাশের লালে গায় পূরবীর গীত! কোথায় ভৈরবী খেলে পাল তুলে সকালের নায়ে! এখানে আছে আরও এক প্রমত্ততা। মত্ত প্রলয়ের গল্প। ক্রুয়েল। কিন্তু সত্য। ক্রমাগত ভাঙছে। ভাঙছে সংসার, মায়া, বন্ধন, ভাঙছে সমাজের জটিল কঠিন আজন্ম আরাদ্ধ শৃঙ্খল। তার কথা বলি আমি।
এক.
কোনো কোনোদিন খুব ভোরে কিছু লোক আসে নিচের ফ্ল্যাটে। শুনি—তারা নেশার দ্রব্য নিতে আসে। এত ভোরে নেশার দ্রব্যের জন্য আনাগোনা! অদ্ভুত। মানুষের এ কেমন বোধ-বুদ্ধি! ক্রম প্রসারমান বস্তুজগৎ মানুষকে কেন্দ্রীভূত না করে কিভাবে যে ছাড়িয়ে নিয়ে চলে যাচ্ছে। ডুবিয়ে দিচ্ছে কোথায় কোন নীল সমুদ্রে, তা সে নিজেই যদি জানতো—আহা জীবন!
আলসে গা-টা মেলে দিয়ে একটা চেয়ারে পা তুলে বসে আছে দারোয়ান নানার পড়ন্ত যৌবনা বউ জরিনা। সবাই তাকে নানি বলে। দারোয়ান অশীতিপর বৃদ্ধ। বয়স প্রায় আশি। দারোয়ানের আগের ঘরের ছোট মেয়েটা সিঁড়ির এক কোণায় পেতে বসা সংসারের চুলায় আগুন জ্বালায়। বয়স নয় দশ হবে, ভাতের উপচেপড়া ফ্যানে ফুঁ দিয়ে পরখ করে ভাত ফুটেছে কি না। ভ্যাপসা গরমে দারোয়ান বউয়ের ব্লাউজহীন খোলা গা এই বোশেখের গরমকে আরও বীভৎস করে তোলে। আমার গা গুলিয়ে ওঠে। মনে হয়, যেন তার বগলের দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে পুরো বাতাসে। তার কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই্ সেদিকে। আনমনে সে টিভি দেখে। গায়ে মাংসের তুফান। বারো হাত শাড়ির আগল ভেঙে মাঝে মধ্যেই উঁকিঝুঁকি মারে ভেতরের নিষিদ্ধ অংশগুলো। আমি প্রায়ই এই সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা করি। স্কুলে যাওয়া-আসা করি। দুপুরে বাচ্চাদের খাওয়াতে পাঁচতলায় উঠি। আবার নামি। টিউশনি শেষ করে সন্ধ্যায় ফিরি। তাই এই বিল্ডিংয়ের অনেক মানুষেরই সঙ্গে দেখা হয় সিঁড়িতে ওঠা-নামার সময়ই। প্রায়ই দেখতে পাই, এখানে বসবাসরত স্যুট-টাই পরিহিত শিক্ষিত সুবেশী সুধী পুরুষগুলোরও চোখ কেমন করে আটকে যায় জরিনার উদোম গায়ের নিষিদ্ধ মাংসের পরতে পরতে। জরিনার তাতে ভ্রূক্ষেপ নেই।
—নানি তাড়াতাড়ি একটু ধরো তো একটা ব্যাগ। পড়ে গেলো, তাড়াতাড়ি ধরো। আমার হাতভর্তি দু’তিনটা বাজার ব্যাগ। আবার চাবি বের করে কলাপসিপল্ গেটের তালা খুলতে হবে। দারোয়ানের বউয়ের কোনো বিকার নেই। একপলক আমার দিকে তাকালো। তার দৃষ্টির প্রক্ষেপণ দেখে মনে হলো ব্যাগটা ধরতে বলে আমি ভীষণ অপরাধ করেছি।
—এইডা তো আমার কাম না।
আমি কুণ্ঠিত হই। গেটের মুখে ব্যাগগুলো রেখে কলাপসিপল্ গেট খুলে ভেতরে আনি সব। তারপর আবার তালা লাগিয়ে ওপরে উঠতে থাকি। সিঁড়ির মাঝ বরাবর উঠেছি, বেশ শব্দ করেই চারতলার দরজাটা বন্ধ হলো। দ্রুত গতিতে নেমে এলেন দাঁড়িওয়ালা লম্বা পাজামা পাঞ্জাবি পরিহিত মাঝ বয়স পার হয়ে যাওয়া একজন মানুষ। পাঞ্জাবির পকেটে ঢুকিয়ে রাখা হাতে কিছু একটা বেশ সতর্কতার সঙ্গে ধরে রেখেছেন তিনি। এটুকু আমার চোখ এড়াতে পারেনি। আমাকে পাশ কাটানোর সময় তার গতির দ্রুততাও আমি টের পাই। বুঝতে পারি কিছু একটা গোপন বিষয় আছে। আমি সিঁড়ির ওপর থেকে ঝুঁকে নিচে তাকাই। দেখি ওই লোকটিকে দেখেই দ্রুত উঠে আসে দারোয়ানের বউ। কলাপসিপল্ গেট খোলে। লোকটি আগেরই মতো দ্রুত বেগে বের হয়ে যায়।
মেইন গেটের দরজা দিয়ে ঢুকছেন রিফাতের বাবা।
—এই খালা ধরো তো বাজারের ব্যাগটা।
নানি দ্রুত উঠে পড়ে। ভীষণ বিনীত ভঙ্গিতে ব্যাগটা তুলে নিয়ে আসতে থাকে তার পিছু পিছু চারতলার দরজায়। আমি হাতভর্তি সদাইয়ের ব্যাগগুলো নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। আমার ঘর পাঁচতলায়। আমাকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার বেলায় দারোয়ানের বউয়ের কোনো ভ্রূপক্ষেপ নেই। যেন আমি কেটে ফেলে দেওয়া আঙুলের নখ, তার পায়ে মাড়িয়ে যাওয়া একটি ধূলোকণা। রিফাতের বাবা বেশ সুবেশী। বয়স ৩০/৩৫ হবে। গায়ে দামি পারফিউমের ঘ্রাণ। দামি জুতা। বাজার করে ফিরে আসতেও চোখে দামি সানগ্লাস পরেন। আর আমি বাজার করতে গেলে ঘেমে নেয়ে একাকার। বাজারে অজস্র মানুষ, দরদাম, থিকথিকে কাদা, মাছ-মাংসের গন্ধে জীবনটাই দুর্বিষহ মনে হয়। ফিরে আসার সময় মনে আনন্দ তো দূরে থাক জীবনটাই একটা বিড়ম্বনার মনে হয়। এসব ভাবতে ভাবতে আমি ওপরে উঠতে থাকি। পাঁচতলায় যাব। দেখি, ঘরে বাজার দিয়ে রিফাতের বাবা আবার নিচে নেমে যাচ্ছেন। মনে হয়, আরও একবার তিনি পারফিউম ছড়িয়েছেন গায়ে। চোখে সানগ্লাসটা আগেরই মতো। আর শিস্ দিতে দিতে তিনি আমার পাশ দিয়ে চলে গেলেন ঠিক হিন্দি সিনেমার নায়কের মতো। সেদিকে আমায় টানে না। আমি তার ঘরের খোলা দরজাটা দিয়ে একচোট তাকাই ভেতরে। কী সুন্দর দামি দামি আসবাব! দামি কার্পেটপাতা ফ্লোরে। বেশিক্ষণ তাকানো যায় না। চোখ ফিরে আসে আবার বাইরে। চোখের কী দোষ! আবার চোখ আটকে যায় দরজার বাইরে পাপসের ওপর রাখা কয়েক জোড়া মেয়েদের জুতো দেখে। আহা, কত দামি আর আরাম সেগুলোয়! সংসারের কত যে দায়িত্ব আমাকে পালন করতে হয়। স্বামীর চাকরি নেই। তবু আরামে ঘুমান তিনি। কয়েক প্রস্থ ব্যাংক লোনে ফেঁসে গেছেন। তার টেনশন আর ব্যাংকের রিকোভারি ডিপার্টমেন্টের লোকজনের যাবতীয় খিস্তি আমাকেই শুনতে হয়। তাই আমি দিনরাত হাঁটি। হাঁটার দামে পরিশ্রমের দাম মেলে না। রাস্তায় অনেক পথ আমাকে হাঁটতে হয়। আমার ঠিক এমন একজোড়া আরামদায়ক জুতোর দরকার। কিন্তু কী করে সম্ভব? টানাটানির সংসার। খাবার আর সন্তানের স্কুলের বেতন জোগাতেই সব শেষ। আছে বাড়িভাড়ার তাগাদা। অত দামি জুতা কি আমার কেনা সাজে? না কুলোয়?
দুই.
এই জায়গাটা খুব ঘিঞ্জি। ঘনবসতি। বাড়ি ঘরগুলো খুব গা-ঘেঁষা। এর বাড়ির ঝগড়া, ওর বাড়ির প্রেম, পাশের বাড়ির সিঁডিতে ফুল ভলিউমে বাজানো গানের বিকট শব্দ কিংবা পাশের বাড়ির ব্যাচেলার ছেলেগুলোর ঘরে অবাধ লিভিংয়ের ফিসফাস—সবই যেন ঠিকঠাক মতো শোনা যায় এই ঘর থেকে। তখন মধ্যদুপুর। একমনে রান্না করছি। ঘরকন্না ছাড়া আমার আর কোনো কাজ নেই সেদিন। খুব যত্ন করে তেলে ফোঁড়ন দিয়ে পেঁয়াজ রসুন ছাড়ছি। পুঁইশাকগুলো ধুয়ে পানি ঝরতে দিয়েছি। হঠাৎ একটানা মৃদু কান্নার শব্দ এলো কানে। একটু উৎকর্ণ হলাম। আবার কাজে মন দিতে চেষ্টা করি। পুঁইশাকটা প্রায় হয়ে আসে। কিন্তু কান্নার শব্দ কমে না। বাড়ে না। থামেও না। একই লয়ে-তালে চলছে প্রায় মিনিট পঁয়তাল্লিাশ তো হবেই। কে কাঁদে এই মধ্যদুপুরে পাখির মতো! চৈত্রের কাঠফাটা দুপুরে আমি ঘুঘুর এমন বুকফাটা কান্না শুনেছি অনেক। আজ মনে হচ্ছে ঘুঘুটা বাড়ির ভেতর ঢুকে পড়েছে। বুকে খুব যন্ত্রণা। আমি গ্যাসটা অফ করে বাইরের দরজা খুলি। পাশের বাসার দরজায় কান পাতি। হ্যাঁ, এখানেই তো। এখানেই ঘুঘুটা কাঁদছে।
এরপর থেকে প্রায়ই মানিককে নিয়ে
নানা অঘটন ঘটতে থাকে
জোরে দরজা ধাক্কা দেই। ওই বাসার বড় মেয়ে রুনু দরজা খুলে দেয়, দিতে চায় না, তবু দেয়। করার কিছু নেই। আমি ওকে ঠেলে ঢুকে পড়ি ভেতর ঘরে। দেখি লম্বা হয়ে মরা মানুষের মতো শুয়ে আছে এই বাসার একমাত্র ছেলে মানিক। আর ঘুঘু মা কাঁদছে। ছেলের পাশে দাঁড়িয়ে একটানা বিলাপ করছে।
—ছোট-ছোট তিনটা বোন তোর। ওগোরে ক্যামনে বিয়া দিমু। তুই কি কুনোদিন এইসব চিন্তা করবি না? তুই বড় ভাই। বাপটা সারাদিন খাইট্টা মরে। আর তুই ই ই ই ই হি হি হি ইই….।
আঁচলে মুখ মোছেন। মানিকের রা নেই কোনো। একটা লাশ যেন পড়ে রয়েছে মায়ের সামনে। মায়ের একটানা বিলাপ কানে একেবারেই ঢোকেনা না তার। আমার রাগ হয়ে যায় খুব। আমি ধাক্কা দেই আপাদমস্তক কাঁথা দিয়ে ঢেকে শুয়ে থাকা ছেলেটিকে। বলি, মানিক। এই মানিক। তোমার মধ্যে কি মানুষ বলতে কিছু নেই না কি? এভাবে কাঁদছে মা টা তোমার। আর তুমি তাকে একটু সান্ত্বনারো দিচ্ছি না। তুমি কেমন ছেলে?
মানিকের তবু কোনো উত্তর নেই। এরপর থেকে প্রায়ই মানিককে নিয়ে নানা অঘটন ঘটতে থাকে। সেদিনের পর থেকে মানিকের মা-বোনেরা আর আমার কাছে কোনো কিছু গোপন করে না।
এই ভাবি মানে মানিকের মা খুব পরহেজগার। আমার নেক্সট্ ডোর নেইবার। বয়স আটত্রিশ চল্লিশের বেশি নয়। নিয়মিত নামাজ পড়েন। রোজা রাখেন। বড় মেয়ে রুনুকে বিয়ে দিয়েছে ন। জামাই কুয়েতে থাকে। গাড়ি চালায়। মাস কাবারে মোটা মাইনে পায়। বড় মেয়েকে কুয়েতে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে বার দুই গলাকাটা পাসপোর্টে। তাও সম্ভব হয়নি। আগের বছর কুয়েত সরকার সব ভিসা দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। তাই রুনু শ্বাশুরবাড়িতে থাকে। প্রায়ই মায়ের বাসায় চলে আসে। ছোট আরও দুই মেয়ে বিয়ের উপযুক্ত। তিন মেয়ের বড় একমাত্র ছেলে মানিক। বয়স আটাশ। ছেলে আলসে। ঘরে থাকলে বেশিরভাগ সময়ই বিছানায় পড়ে থাকে। বাইরে গেলে বন্ধুদের সঙ্গে পাড়ার দোকানে আড্ডা মারে। অনেক চেষ্টা করেও মা তাকে পড়ালেখা করাতে পারেনি। মাঝে মাঝে কোথায় যেন খুব জরুরি কাজে চলে যায়। আবার কোনো কোনো রাতে বাড়ি ফেরে না। সারারাত মা জেগে কাটায়। আল্লাহর কাছে দোয়া করে—ছেলের যেন মতিগতি ফেরে। বাবার কাজে একটু সাহায্য করে। বোনদের বিয়ের জন্য একটু আয় ইনকাম করে। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয় না। ছেলে পাড়ায় আড্ডা দিয়ে ফেরে। কী যেন কী করে, মা বোঝে কিন্তু ফেরাতে পারে না। কিছুদিন আগেও পাড়ার কয়েকটা ছেলে ওকে গুলি করেছিল শুনেছি। গুলিটি কানের পাশ দিয়ে চলে গেছে। শুনে মনে হয়েছিল লোরকার মৃত্যু মঞ্চ ফায়ারিয়ং স্কোয়াডের গল্প শুনছি। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা—প্রথম গুলিটি কবির ডান পাশ দিয়ে গেল। যেমন যায়।
ছেলেগুলো টার্গেট মিস করায় ওদের পেছনে থাকা একটি বাইক থেকে অন্য ছেলেগুলো বাঁশ দিয়ে মাথায় আঘাত করে রাস্তায় ফেলে রেখে যায়। এখনো মাথায় ব্যন্ডেজ বাঁধা। হঠাৎ সেদিনই মানিকের মা আমাকে বলতে শুরু করে, ভাবি, দেখছেন চারতলার রিফাতের বাবা সারাদিন ঘরেই পড়ে থাকে?
—হুম । দেখলাম।
—আমার মেজো মেয়ে পাপিয়া বললো, ওদের কলেজের সামনে নাকি মাঝে মধ্যে সানগ্লাস পরে দাঁড়িয়ে থাকে।
—ভাবি, কী বলেন? রিফাত তো স্কুলে পড়ে। কলেজের সামনে ওর বাবার কী কাজ?
—হায় হায় ভাবি! আপনি এত শিক্ষিত এত লেখাপড়া আপনের। এইডা বুঝলেন না?
আমি লজ্জিত হই। আমার বোঝা উচিত ছিল। ভাবি আবার বলে, —আচ্ছা ভাবি ওর বাবা সারাদিন পরিশ্রম করে যত টাকা কামায়, তাতে তো নতুন নতুন ফার্নিচার দূরে থাক, অসুখ-বিসুখ হলে ঠিকমতো কারও চিকিৎসা করাই দায় হয়ে পড়ে।
—হুম, তা তো পড়েই।
—এই যে আপনের ছোট সংসার। দুইটা ছোট ছোট বাচ্চা। তাও তো দিনরাত ঘর বাইর করতে হয়।
—হুম। তা তো করতে হবেই। খাবার দেবে কে তা না হলে?
—আচ্ছা ভাবি, রিফাতের বাবার খাবার তাহলে কোথা থেকে আসে? রিফাতের মায়ের গায়ে কত দামি, দামি কাপড় দেখছেন কুনোদিন? কত দামি জুতা পরে?
—হুম। দেখেছি।
তারপর মুখ নামিয়ে গলার স্বর নিচু করে আমার কানের কাছে মুখ লুকিয়ে বলে—ভাবি জানেন নাকি?
—কী?
—রিফাতের বাবা ইয়াবা ব্যবসা করে? আরও অনেক নেশাদ্রব্য নিয়ে আসে। ছেলেদের কাছে বিক্রি করে। গোপনে।
—কী বলেন এসব? আপনি জানেন?
—হ, আমার মায়ের বাড়ির আশেপাশের সব পোলাপান তার কাছ থেকে ইয়াবা নিতে আসে। আরও নানা নেশাদ্রব্য। আমি জানি।
—ধুর। সত্যি নাকি এসব?
—হ ভাবি। আমি জানি।
—একজন পাঞ্জাবি পরা বয়স্ক লোকও আসে। দেখছেন কখনো? সে বেশ ভোর বেলার দিকে আসে। কড়কড়ে টাকা গুনে গুনে দিতে দেখেছি আমি একদিন সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে। তারপর পকেটে হাত দিয়ে চলে যায়।
সেদিন লোকটির চলে যাওয়ার দৃশ্যটা আমার মনে পড়ে যায়। বুঝতে পারি খুব একটা ভুল নয় ভাবির পর্যবেক্ষণ। তারপর ভাবি সুর করে কাঁদতে শুরু করে—ভাবি এই সঙ্গে পড়েই তো আমার ছেলেটা নেশাখোর হয়ে উঠলো। পাড়ার সব ছেলে নেশা করে। আমার ছেলে তো ওদেরই সাথে ঘুরেফিরে। আমি বিস্ময়ে হতবাক। বলেন কী ভাবি? মানিক নেশা করে?
—হ ভাবি। দেখেন না প্রায়ই রাতে বাড়ি ফেরে না?
—তাই নাকি?
—আমি তো ভাবলাম বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে রাত পার হয়ে যায়।
—ভাবি সারারাত কী এমন আড্ডা চলতে পারে, আপনি বুঝেন না?
আমার নিজেরই লজ্জা লাগে ভাবীর কথা শুনে। আমার বোঝা উচিত ছিল। আমি আসলেই এমন কিছুতো জীবনে দেখিনি। বুঝবো কি করে। মনে পড়ে বাড়িতে রুটিন ছিল সন্ধ্যার পর ছেলে কি মেয়ে কেউ বাড়ির বাইরে থাকতে পারবেনা। সবাইকে এসে ঘরে পড়ার টেবিলে বসে পড়তে হবে। আমার বড় তিন ভাই। দুই বোন আমরা। কোনোদিন কোনো ভাইকে দেখিনি সন্ধ্যার পর বাড়ির বাইরে থাকতে। বিশেষ কোনো কাজ থাকলে অনুমতি নিয়ে কোথায় যাচ্ছে কার সাথে কোথায় পাওয়া যাবে দরকারে এইসব রাজ্যের ফিরিস্তি দিয়ে যেতে হতো বাবার কাছে। আমার ভাবনার ছেদ পড়ে ভাবির ডাকে।
—ভাবি দেখেন না? যখন ভোর বেলা ফিইরা আসে, তখন কেমুন মরার মতো পইড়া ঘুমায়। ওই দিন সারাদিনই ঘুমায়। আমি যতই কান্নাকাটি করি, তার কানে ঢোকে না। একবার মায়ের মুখের দিকেও ফিরা তাকায় না। একফোঁটা চোখের পানিও পড়ে না রে ভাবি। কী পাষাণ দিল আমার পোলার!
আমার সেদিনের মানিকের মায়ের কান্নার কথা মনে পড়ে যায়। মানিকের মা বলতেই থাকে—ওই নেশার ব্যাপারিই সব খাইলো ভাবি। পোলাপানগুলারে নষ্ট কইরা ফালাইতাছে ভাবি। জানেন না তো ভিতরে ভিতরে কী অবস্থা। আমার ভাইয়ের ছেলেটাও সেদিন ধরা পড়ছে। নেশা কইরা।
—কী বলছেন এসব?
—হ ভাবি। আপনি রাস্তায় যাইতে আসতে যে সব পোলাপানগুলারে দাঁড়াইয়া আড্ডা দিতে দেখেন, তার সবগুলি রাত হইলেই আমাগো নিচতলায় আসে। ইয়াবা লইয়া যায়। মধ্যরাতে নেশায় বসে।
শুনুন মানুষ যদি সভ্য হয়ে না থাকে, তবে তাকে
সভ্য মানুষের সাথে চলার শিক্ষা দিতে হবে তো
আমি যাতায়াতের পথে ১৫ ১৬ ১৭ থেকে ২০/২২ বছরের যে ছেলে ছোকরাগুলোকে প্রতিদিন দেখি, তাদের মুখগুলো মনে করার চেষ্টা করতে থাকি। কী সুন্দর কচিকাচা মুখগুলো ভেসে ওঠে। স্বভাবও যে ওদের খুব খারাপ, তা বলতে পারি না। স্কুলশিক্ষক আমি। আমায় দেখে কেউ কেউ সালাম দেয়। কেউ কেউ হয়তো দেয় না। কিন্তু বেশ সমীহ করে সরে দাঁড়ায়। তাতে মনে হয় না, ওদের মধ্যে কোনো কুশিক্ষা রয়েছে। এইসব ছেলে নেশাসক্ত! বারবার আমি ছেলেগুলোর মুখ মনে করার চেষ্টা করি। মেলাতে পারি না কিছুই। রাত বাড়ে। প্রায় বারোটা বাজতে লাগলো।
—ভাবি বাসায় যাই ।
—মা..আ আ আ. ওমা।
একটা মেয়েলি কণ্ঠের আর্ত চিৎকারে বুক কেঁপে ওঠে। আমরা দু’জনেই এ-ওর দিকে থমকে তাকাই। ভাবির বাসা থেকে ছোট মেয়েটা দৌড়ে আসে—আম্মু আম্মু গো, রিফাতের বাবা রিফাতের মায়েরে পিটাইতাছে।
ভাবির মুখ শক্ত হয়ে ওঠে। খুব গম্ভীর গলায় বলে,—তুমি এইখানে আসছ ক্যান পিউ? বাসায় যাও।
পিউ মুখটা নামিয়ে মাথা নিচু করে চলে যায়।
—ও মাগো। মেরে ফেলল গো।
রিফাতের মায়ের গলা এবার স্পষ্ট চেনা যায়। সঙ্গে ভীষণ জোরে চিৎকার ওর বাবার। বাড়িতে নানা জিনিষপত্রের উথাল-পাথাল শোনা যায়। ঝড়ঝঞ্ঝা যেন প্রলয়ঙ্করী। ওপরের তলায়ও বসে থাকা দায়। আবার চিৎকার, —উহহ। মা আ আা । মাগো মেরে ফেলল । বাঁচাও। বাঁওওওও…।
আমি উঠে একটা দৌড় দেই।—কই যান ভাবি, কই যান, বলতে বলতে আমার পেছনে ছোটে পাশের বাসার ভাবি।
—ভাবি মানা করতেছি। যাইয়েন না। যাইয়েন না। আপনি শিক্ষিত। মানী লোক। ওরা আপনার মান বুঝবে না।
আমি ততক্ষণে চলে এসেছি দরজা খুলে নিচে চার তলায়। জোরে আঘাত করতে থাকি দরজায়—ভাবি দরজা খুলুন । দরজাটা খুলুন ভাবি। কী করছেন আপনারা?
আমাকে থামাতে না পেরে পাশের বাসার ভাবিও ছুটতে ছুটতে নিচে চলে আসে। আমার পাশে দাঁড়িয়ে থাকে। আমি দরজা ধাক্কাতে থাকি। কিছুক্ষণ বেশ সুনসান সব। আমি ভয় পেয়ে যাই। ভাবির চোখেও চাপা ভয়। আমার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলে, কী হলো ভাবি? মেরে ফেললো না কি?
ঠিক তখনই বেশ জোর শব্দে খুলে যায় দরজাটা। বিধ্বস্ত রিফাতের মা মুখ বের করে চেষ্টা করেছেন চোখে মুখে স্বাভাবিকতা আনার।
—ভাবি। কী হয়েছে ভাবি?
রিফাতের মা বলে—আপনারা নিজের বাসায় যান। কিছু হয়নি। কোনো সমস্যা না।
আমি আর পাশের বাসার ভাবি কিছুটা স্বস্তি অনুভব করি যে, রিফাতের মাকে মেরে ফেলেনি।
—ঠিক আছে, বলে ঘুরে দাঁড়াই পাঁচতলার সিঁড়ির দিকে রওনা দিতে।
—শুনুন। ডাক শুনে পেছন দিকে ফিরি। দেখি রিফাতের বাবা রিফাতের মায়ের ঘাড়ের ওপর দিয়ে তাকিয়ে কথা বলছে—স্কুলে পড়াচ্ছেন পড়ান । নিজেকে অন্য বাড়ির শিক্ষক ভাবতে যাবেন না।
ঠোঁট চেপে পাশের বাসার ভাবি আমাকে ধাক্কাতে ধাক্কাতে গাল দেয় বোধ করি রিফাতের বাবাকে। বলে, হারামি। শয়তানের বাচ্চা। চলেন ভাবি।
আমি তার হাত সরিয়ে ঘুরে দাঁড়াই, শুনুন মানুষ যদি সভ্য হয়ে না থাকে, তবে তাকে সভ্য মানুষের সাথে চলার শিক্ষা দিতে হবে তো?
কথাটা বলতে বলতে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমি সোজা তাকাই রিফাতের বাবার চোখে। আমার সে অগ্নিদৃষ্টিকে উপেক্ষা করতে পারে না সে। খানিকটা প্রগলভ্ দেখায় বটে তাকে। কিন্তু সামলে নিয়ে আবার বলে, সাবধান। সামলে চলুন। কথাটাই বলেই চোখে দারুণ রোষ এনে পাশের বাসার ভাবির দিকে একবার তাকায়। দরজা বন্ধ হয়ে যায় বিকট শব্দে।
চলবে…